বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে একেবারে শেষের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে একটি অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যা ছিল আসলে ‘মাধ্যমিক পর্যায়ের পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি’ বা ইন্টারমিডিয়েট-রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস (আইএনএফ) চুক্তি। ১৯৮৭ সালের ৮ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান এবং সোভিয়েত জেনারেল সেক্রেটারি মিখাইল গর্বাচেভ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। তবে যাই হোক না কেন, সাবেক মার্কিন ট্রাম্প প্রশাসন গত ১লা ফেব্রুয়ারী ২০১৯ সালে প্রথম এই চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয় এবং একই পথ অনুসরণ করে রাশিয়া ২রা আগস্ট ২০১৯ সালে এই চুক্তি পুরোপুরি বাতিল করে দেয়।

এ চুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সভিয়েত ইউনিয়নের হাতে থাকা সব পারমাণবিক ও প্রচলিত ভূমি থেকে নিক্ষেপ যোগ্য মিডিয়াম রেঞ্জ ব্যালেস্টিক এন্ড ক্রুজ মিসাইল চিরস্থায়ীভাবে পর্যায়ক্রমে সরিয়ে ফেলা এবং সমাঝোতার মাধ্যমে তা পরিত্যাগ করা। এখানে ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ মিসাইল বলতে সাধারণত ৫০০ থেকে ৫,০০০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত আঘাত হানতে সক্ষম নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড নির্ভর ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাকে বোঝানো হয়েছে।

ইন্টারমিডিয়েট-রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস (আইএনএফ) চুক্তিটির মাধ্যমে মূলত প্রথম বারের মতো বিশ্বের দুই প্রধান সামরিক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সভিয়েত ইউনিয়ন উভয়ই সম্মত হয়েছিল যে, তাঁদের হাতে মজুত থাকা বিপুল পরিমাণ নিউক্লিয়ার ওয়েপন্স এন্ড ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ স্ট্রটিজিক মিসাইল কমিয়ে আনা এবং নিউক্লিয়ার এন্ড থার্মোনিউক্লিয়ার অস্ত্র ভান্ডারের একটি বড় অংশ একেবারেই নিষ্ক্রিয় করে দেয়া। সরিয়ে দিতে। পারস্পারিক আলোচনা এবং চুক্তির ভিত্তিতে এই দুই পরাশক্তি একে অপরের নিউক্লিয়ার ডেভলপমেন্ট সাইট পর্যবেক্ষেণ এবং যাচাইয়ের জন্য নিয়মিত পরিদর্শনের সুযোগ সৃষ্টি করতে সম্মত হয়েছিল।

১৯৮৭ সালে করা ইন্টারমিডিয়েট-রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস (আইএনএফ) চুক্তির আওতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৯১ সালের ১ জুন পর্যন্ত ২,৬৯২টি স্বল্প এবং মধ্যম পাল্লার নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড এবং মিসাইল সিস্টেম ধ্বংস করে দেয়। ২০০১ সাল পর্যন্ত চুক্তি অনুযায়ী দেশ দুটির মধ্যে চলমান আলোচনা এবং সমাঝোতার ভিত্তিতে নিউক্লিয়ার ওয়েপন্স ডেভলপমেন্ট সাইট পরিদর্শন করা হতো। তবে ২০০২ সাল থেকে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত স্যাটেলাইটের সিস্টেমের মাধ্যমে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা হতো উভয় দেশের পক্ষ থেকে। তবে এখন তা সম্পূর্ণভাবে বাতিল হয়ে গেছে।

তবে দীর্ঘ দিন থেকেই মার্কিন প্রশাসন এবং প্রতিরক্ষা বিভাগ প্রকাশ্যেই অভিযোগ করে আসছিল যে, তাদের কাছে যথেষ্ঠ তথ্য প্রমাণ রয়েছে যে, রাশিয়া অত্যন্ত গোপনেই (আইএনএফ) চুক্তি লঙ্ঘন করে চুক্তিতে যে পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে, সেই নিউক ওয়ারহেড ক্যাপবল ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জের মিসাইল সিস্টেম ব্যাপকভাবে তৈরি করে যাচ্ছে। যদিও রাশিয়া মার্কিন প্রশাসনের এমন অভিযোগ বার বার প্রত্যাখান করে উল্টো এই চুক্তি বাতিলের জন্য আমেরিকাকে দায়ী করে।

মার্কিন ও তার ন্যাটো জোটের ভাষ্যমতে, সাম্প্রতিক সময়ে পুতিনের সামরিক বাহিনী যে উচ্চ প্রযুক্তির ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জের মোবাইল ইস্কেন্দার-এম (৯এম৭২৯) নিউক ওয়ারহেড ক্যাপবল ট্যাক্টিক্যাল মিসাইল সিস্টেম পূর্ব ইউরোপের বিশাল সীমান্ত জুড়ে মোতায়েন সম্পন্ন করেছে। যার ন্যাটো রিপোটেড কোড নেম এসএসসি-৮। এটিকে কার্যত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ন্যাটো জোট ১৯৮৭ সালে করা ইন্টারমিডিয়েট-রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস (আইএনএফ) চুক্তির চূড়ান্ত লংঘন হিসেবে বিবেচনা করেছে। তাছাড়া, এ ধরনের অস্ত্র প্রতিযোগিতার ব্যাপারে ইউরোপীয় দেশগুলো সবসময়ই রাশিয়াকে দায়ী করে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছিল।

এখানে প্রকাশ থাকে যে, রাশিয়ার মোবাইল লাউঞ্চ ইস্কেন্দার-এম (৯এম৭২৯) নিউক ওয়ারহেড ক্যাপবল ট্যাক্টিক্যাল মিসাইল সিস্টেম খুব সহজেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বহন করা যায়। এটি আকারে ছোট হওয়ায় শনাক্ত করাও কিন্তু যথেষ্ঠ কঠিন। এখানে সবচেয়ে বড় বিপদ এ জাতীয় ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জের নিউক মিসাইল সিস্টেম ইউরোপের যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় এবং শহরে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে ভয়ঙ্কর নিউক আঘাত হানতে সক্ষম।

মার্কিন ট্রাম্প প্রশাসনের অভিযোগের বিপরীতে আইএনএফ চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে রাশিয়ার পুতিন প্রশাসন অভিযোগ করে বলেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে পূর্ব ইউরোপে রাশিয়াকে একেবারে ঘিরে ফেলার জন্য অত্যাধুনিক দীর্ঘ পাল্লার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম (টিএইচএএডি) ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রতিরোধী ব্যবস্থা স্থাপন করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে।

ইউরোপের তুরস্ক, জার্মানী, বেলজিঊয়াম এবং নেদারল্যান্ডে থাকা মার্কিন চারটি সামরিক ঘাঁটিতে প্রায় ২ থেকে ৩ শতাধিক বি-৬২ জাতীয় নিউক্লিয়ার অস্ত্র এবং এফ-২২ স্টেলথ জেট ফাইটার মোতায়েন স্পষ্টই আইএনএফ চুক্তির লঙ্ঘন বলে মনে করে ক্রেমিলিন সরকার। আর এই পাল্টা পাল্টি আইএনএফ চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে প্রথমে কূটকৌশলী মার্কিন ট্রাম্প প্রশাসনের আমলেই ২০১৯ সালে এ চুক্তি থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। এর তীব্র প্রতিবাদ স্বরূপ রাশিয়াও একই বছরের শেষের দিকে পাল্টা বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে আইএনএফ চুক্তি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। তবে এ চুক্তি থেকে মার্কিন ট্রাম্প প্রশাসন প্রথমে নিজেকে সরিয়ে নিলেও এই আইএনএফ চুক্তি অকার্যকর বা বাতিল হওয়ার পেছনে এই দুই সুপার পাওয়ার দেশকেই সমান ভাবে দায়ী করা চলে।

এখানে প্রকাশ থাকে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ইউরোপীয় ন্যাটো জোটকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা এবং নিজস্ব সামরিক সক্ষমতা বজায় রাখার স্বার্থে রাশিয়ার এই আইএনএফ চুক্তি লঙ্ঘন করে হলেও দুই দশক আগে থেকেই অত্যন্ত গোপনে ইন্টার মিডিয়েট রেঞ্জের মিসাইল ডেভলপ করা ব্যাতিত বিকল্প কোন রাস্তা খোলা ছিল না। বিশেষ করে ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জের নিউক ওয়ারহেড ক্যাপবল মিসাইল সিস্টেমকে ভয়াবহ যুদ্ধে গেম চেঞ্জার ওয়েপন্স হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এমনিতে অর্থনৈতিক সংকটের কবলে পড়ে রাশিয়ার ডিফেন্স ডেভলপমেন্ট প্রজেক্টগুলো খুব বেশি দূর আর এগোতে পারছিল না।

এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেখানে ২০০৭ সাল থেকে তাঁদের সুপার স্টিলথ টেকনোলজির এফ-২২, এফ-৩৫ এর মতো ডেডিকেটেড সার্ভিসে এনে ফেলেছে এবং তারা এখন ৬ষ্ঠ প্রজন্মের জেট ফাইটার ডেভলপমেন্টের প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। ঠিক সেই সময় রাশিয়া তার স্টেলথ প্রযুক্তির এসইউ-৫৭ জেট ফাইটার একেবারে সীমিত পরিসরে সার্ভিসে এনেছে। মনে করা হয়, আগামী ২০২৮-৩০ সালের মধ্যেই মার্কিন ৬ষ্ঠ প্রজন্মের জেট ফাইটার কিম্বা বোম্বার সার্ভিসে আনতে পারে। তাছাড়া মার্কিন নিউক্লিয়ার পাওয়ারড ১২টি সুপার এয়ার ক্র্যাফট ক্যারিয়ার এখনো পর্যন্ত কিন্তু সারা বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সেখানে কিনা রাশিয়ার অতি পুরনো একমাত্র কনভারশনাল ক্যারিয়ার আজ বাতিল বা স্ক্র্যাপিং হওয়ার পথে।

তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া পাল্টা পাল্টি অভিযোগের মুখে আইএনএফ চুক্তি বাতিল হয়ে যাওয়ার কারণে ৫০০ থেকে ৫,০০০ কিলোমিটার পাল্লা পর্যন্ত ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জের নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড ক্যাপবল মিসাইল সিস্টেম এক রকম প্রকাশ্যেই রাশিয়া তার নিজ ভূমিতে কিম্বা পূর্ব ইউরোপরে সীমান্ত বরাবর মোতায়েন করেছে এবং ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী কনভেনশনাল ওয়ারহেড ক্যাপবল বিভিন্ন সিরিজের ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জের প্রায় ৩ হাজারের কাছাকাছি ক্রুজ এন্ড ব্যালেস্টিক মিসাইল ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে।

তাছাড়া একই সময়ে পোল্যান্ড থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্টের অত্যাধুনি দীর্ঘ পাল্লার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম (টিএইচএএডি) ব্যালিস্টিক নিউক মিসাইল প্রতিরোধী ব্যবস্থা এবং তার আশপাশের এলাকার অদূর ভবিষ্যতে যে কোন যুদ্ধকালীন মুহুর্তে একেবারেই প্রথমে রাশিয়ান নিউক হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত যে হবে না তা কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। তাই আইএনএফ চুক্তি অকার্যকর হয়ে পড়ায় ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন ভুক্ত দেশগুলো এবং বিশেষ করে তাঁদের ন্যাটো ও রাশিয়ার মধ্যে নতুন করে আবার অতি ভয়ানক নিউক্লিয়ার অস্ত্র প্রতিযোগিতা বা স্নায়ুযুদ্ধের আলামত বেশ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে।

এদিকে অনেক আগেই ইন্টারমিডিয়েট-রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস (আইএনএফ) চুক্তিটি অকার্যকর হয়ে পড়ায় রাশিয়া এবং চীনকে কৌশলগতভাবে মোকাবেলা করার জন্য বর্তমানে মার্কিন প্রশাসন ইউরোপের পাশাপাশি এশিয়া প্যাসিফি অঞ্চলে বিশেষ করে জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় ব্যাপক মাত্রায় নিউক্লিয়ার ওয়েপন্স এন্ড মিসাইল সিস্টেম ডিপ্লয় করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। এতে করে আমেরিকা ও রাশিয়ার জন্য এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলসহ গোটা বিশ্ব আবারো নতুন করে এক ভয়ানক স্নায়ুযুদ্ধের কবলে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়।

সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক ও লেখক, ছোট চৌগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com