চলতি ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসটি ছিল ইউক্রেনের জন্য এক ভয়াবহ রকমের বিপর্যয়ের সময়। গত এপ্রিল মাস থেকে আজ অব্ধি ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী নজিরবিহীনভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা দপ্তরের দেয়া তথ্যমতে, গত এপ্রিল মাসে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর প্রায় ১৫ হাজারের অধিক সেনা হতাহত হয়েছে। তার পাশাপাশি একই সময়ে ইউক্রেনের ৮টি যুদ্ধবিমান, প্রায় তিন শতাধিক কমব্যাট ড্রোন ও তার পাশাপাশি ৪৩০টি ট্যাংক ও সামরিক যান ধ্বংস করেছে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী।
যদিও রাশিয়া কিন্তু যুদ্ধের শুরুর পর থেকে আজ অব্ধি নিজেদের ঠিক কতজন সেনা হতাহত হয়েছে এবং তাদের সামরিক ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে কোন ধরনের সঠিক তথ্য উপাত্ত বিশ্ব মিডিয়ার সামনে উপস্থাপন করেনি। পশ্চিমা মিডিয়ার দেয়া তথ্যমতে, যুদ্ধের শুরু থেকে এখনো পর্যন্ত রাশিয়ার প্রায় লক্ষাধিক সেনা হতাহত হয়েছে। এদিকে রাশিয়ার দেয়া তথ্যমতে, গত ২০২২ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি থেকে আর এখন কিনা এই সামরিক আগ্রাসনে প্রথম বারের মতো টিইউ-১৬০ স্ট্যাটিজিক হেভি বোম্বার মোতায়েন করেছে রাশিয়া। মূলত গত ১লা মে খুব সকালে রাশিয়ার বিমান বাহিনীর ৯টি টিইউ-৯৫ বিয়ার এবং ২টি টিইউ-১৬০ হেভি স্ট্যাটিজিক বোম্বার ইউক্রেনে বড় ধরনের মিসাইল হামলায় অংশ নেয়।
সাম্প্রতিকতম সময়ে ইউক্রেনে রাশিয়ার বিমান বাহিনীর হেভি বোম্বার বিমান থেকে মোট ১৮টি নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড ক্যাপবল সভিয়েত আমলের কেএইচ-১০১/ কেএইচ-৫৫৫ ক্রুজ মিসাইল ফায়ার করে। তবে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর দেয়া ভাষ্যমতে, তাদের নিজস্ব এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম মোট ১৫টি মিসাইল আকাশেই ধ্বংস করেছে এবং মাত্র ৩টি টার্গেটে আঘাত করেছে। এটিই ছিল আসলে রাশিয়ার টিইউ-১৬০ হেভি স্ট্যাটিজিক বোম্বারের সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ।
তবে সবচেয়ে আশাঙ্খাজনক খবর হচ্ছে যে, যুদ্ধের ভয়াবহতা ধীরে ধীরে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিণতি বা নিউক্লিয়ার ওয়ারের দিকে যাচ্ছে, তাও বেশ স্পষ্ট করেই মিডিয়ায় জানিয়ে দিয়েছেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ‘সার্গেই ল্যাভরভ’। রাশিয়ার সীমানায় সার্বভৌমত্বে আঘাত আসলেই যে কোন দেশের উপর আগাম ঘোষণা না দিয়েই নিউক হামলা করতে মোটেও দ্বিতীয় বার ভাববে না দেশটির সামরিক বাহিনী। এদিকে রাশিয়ার হুমকিকে আমলে নিয়ে আমেরিকা ও তার নেতৃত্বে ন্যাটো জোট নিউক্লিয়ার এন্ড থার্মোনিউক্লিয়ার যুদ্ধের ঝুঁকি মোকাবেলায় এক রকম নিরবেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিয়েছে।
আর এই চীরশত্রু দুই শিবিরের পাল্টাপাল্টি ভয়ঙ্কর রণ হুংকার ও যুদ্ধ প্রস্তুতি কিন্তু সারা বিশ্বের অস্তিত্বের জন্য এক চরম হুমকি ও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ আলামত হিসেবে মনে করেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সামরিক বিশ্লেষকেরা। আর রাশিয়া কিন্তু এখন এক রকম প্রকাশ্যেই ইউক্রেনকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে হলেও নিজ দখলে নেওয়ার হুমকি দিয়ে রেখেছে। যা আসলে স্পর্ষ্টভাবেই অদূর ভবিষ্যতে মানচিত্র থেকে দেশটির চিহ্ন একেবারেই মুছে যাওয়ার মতো ভয়াবহ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আর তার সাথে অত্র অঞ্চলে মারা যেতে পারে প্রায় কোটির কাছাকাছি হতভাগ্য সাধারন মানুষ। যাদের সাথে কিনা যুদ্ধের কোনই সম্পর্ক নেই এবং তারা এখনো পর্যন্ত হয়ত জানেই না যে, এই দীর্ঘ মেয়াদী ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ কেন চলছে।
কিছুদিন থেকে রাশিয়া যে ধরনের কনভেনশনাল ওয়ারহেড দ্বারা মিসাইল ফায়ার করে যাচ্ছে তা আসলে কিন্তু সভিয়েত আমলের তৈরি নিউক্লিয়ার এন্ড থার্মোনিউক্লিয়ার ওয়ারহেড ক্যাপবল মিসাইল ওয়েপন্স সিস্টেম। যা দিয়ে যে কোন মুহুর্তেই নিউক্লিয়ার ওয়ার শুরু করে দিতে পারে রাশিয়া। মনে করা হয় রাশিয়ার অস্ত্র ভান্ডারে এখনো পর্যন্ত প্রায় তিন থেকে পাঁচ হাজারের কাছাকাছি বা অধিক সংখ্যক এই জাতীয় ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জের ব্যালেস্টিক এন্ড ক্রুজ মিসাইলের বিশাল ভান্ডার রয়েছে। যদিও ১৯৯১ সালের দিকে ইউক্রেনের অস্ত্র ভান্ডারে প্রায় দুই হাজারের কাছাকাছি একই জাতীয় মিসাইলের বিশাল মজুত ছিল।
নব্বই এর দশকে ভীতিজনক কোল্ড ওয়ার যুগের অবসান ঘটিয়ে ১৯৯১ সালে সভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে মোট ১৫টি নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। তার মধ্যে সভিয়েত ইউনিয়নের হাতে থাকা প্রায় ১২ হাজারের কাছাকাছি নিউক্লিয়ার অস্ত্রের বেশির ভাগ রাশিয়া ও ইউক্রেনের হাতে থেকে যায়। আর স্বাধীনতা লাভের পর ইউক্রেনের হাতে প্রায় ২ হাজারের কাছাকাছি নিউক্লিয়ার অস্ত্র, ১৭৬টি ইন্টারকন্টিন্যান্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল, ৪৪টি স্ট্যাটিজিক হেভি বোম্বার, আনুমানিক প্রায় দুই থেকে তিন হাজারের কাছাকাছি শর্ট এন্ড ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জের ব্যালেস্টিক এন্ড ক্রুজ মিসাইলের বিশাল মজুত ছিল। তার সাথে শতাধিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, হাজার হাজার ট্যাংক ও আর্টিলারী সিস্টেম থেকে যায় কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ইউক্রেনের হাতে।
তবে নিজেকে শান্তিপ্রিয় ও ঝামেলামুক্ত দেশ হিসেবে বিশ্বের সামনে প্রমান করতে গিয়ে ইউক্রেন পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যেই রাশিয়া, আমেরিকা ও জাতিসংঘের সাথে চুক্তি করে সকল ধরনের নিউক্লিয়ার ওয়েপন্স, আইসিবিএম ও হেভি বোম্বার ধ্বংস কিংবা রাশিয়ার কাছে হস্তান্তর করে দেয়। তাছাড়া হাজার হাজার অমূল্য ডিফেন্স সিস্টেম খোলা আকাশের নিচে অবহেলায় পড়ে থেকে জং ধরে নষ্ট ও অকেজো হয়ে যায়। এদিকে ইউক্রেনের কাছে থেকে যায় সভিয়েত আমলের (অসমাপ্ত নির্মাণাধীন) ৬০ হাজার টন ওজনের একটি হেভি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার। যা পরবর্তীতে ইউক্রেন ব্লুপ্রিন্ট ও অন্যান্য ডুকুমেন্টসহ একেবারেই পানির দামে (খুব সম্ভবত ৮০ থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার) চীনের কাছে বিক্রি করে দেয় ইউক্রেন সরকার।
অথচ এদিকে সুচতুর রাশিয়া কিন্তু শত বাধা ও সমস্যার মধ্যেও তার হাতে থাকা সকল নিউক্লিয়ার ওয়েপন্সসহ ডিফেন্স সিস্টেম অত্যন্ত যত্ন করেই সংরক্ষণ করে রেখেছে এবং বর্তমান যুদ্ধে রাশিয়া যত অস্ত্র ও মিসাইল ব্যবহার করছে তার ৮০% পর্যন্ত কিন্তু সেই আবার কিনা সভিয়েত আমলের তৈরি অস্ত্র ও সামরিক সাজ সরঞ্জাম। যা হোক এটা সত্য যে, অতি উন্নত ও শান্তিপ্রিয় দেশ হিসেবে নিজেকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে গিয়ে নিজস্ব প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বজায় রাখাকে এক রকম অবজ্ঞা করে ইউক্রেন তার নিজস্ব স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে পরোক্ষভাবে হলেও নিজেই কিন্তু আজ ধ্বংসের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে।
তবে এটা ঠিক যে, প্রযুক্তিগত অক্ষমতা ও কিছু যুক্তিসঙ্গত কারণেই ইউক্রেনের হাতে থাকা নিউক্লিয়ার ওয়েপন্সগুলো ডিকোডিং করে এক্টিভ করার কোন সুযোগ ছিল না। তাছাড়া যুগের পর যুগ এসব অপ্রচলিত ভয়ঙ্কর অস্ত্র সংরক্ষণ করার প্রযুক্তিগত কোন সক্ষমতাও নেই ইউক্রেনের। তাই দেশটির হাতে থাকা প্রায় দুই হাজারের কাছাকাছি নিউক্লিয়ার ওয়েপন্স ও ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল ধ্বংস করে দেয়াটা অনেকটাই সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল বলে মনে করা হয়। তবে তাদের হাতে থাকা হাজার হাজার শর্ট এন্ড ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জের ব্যালেস্টিক ও ক্রুজ মিসাইল একেবারে ধ্বংস কিংবা রাশিয়ার হাতে তুলে দেয়াটা ছিল চরম মাত্রায় একটি ভূল সিদ্ধান্ত। ইউক্রেন সব সময় মনে করে এসেছে যে, রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে তার বন্ধু আমেরিকাও তার ন্যাটো জোট রক্ষা করবে। তবে আমেরিকা কিন্তু ঠিকই এই যুদ্ধকে ঘিরে শত বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বানিজ্য হাতিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনের হাতে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র তুলে দিলেও সরাসরি নিজেদের কখনোই যুদ্ধে জড়াবে বলে মনে হয় না।
এদিকে ইউক্রেনের দ্বায়িত্বহীনতার জন্য হাজার হাজার ট্যাংক ও আর্টিলারি সিস্টেম খোলা আকাশের নিচে কয়েক যুগ ধরে পড়ে থেকে ও জং ধরে অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া ইউক্রেনের কাছে থাকা সভিয়েত ইউনিয়নের একটি প্রায় ৬০ হাজার টন ওজনের অসমাপ্ত নির্মাণাধীন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার একেবারে পানির দামে চীনের কাছে বিক্রি করে দেয় এবং তাদের ট্যাংক বহরে থাকা ৩২০টি টি-৮০ মেইন ব্যাটল ট্যাংক পাকিস্তানের কাছে বিক্রি করেছিল। এভাবে নিজস্ব নিরাপত্তা বিষয়টিকে গুরুত্বহীন মনে করে হাতে থাকা অমূল্য সামরিক সাজ সরঞ্জাম বিক্রি করে নগত অর্থ আয় করতে থাকে ইউক্রেন সরকার। এখানে মনে রাখতে হবে রাশিয়া বা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি চরম মাত্রায় আগ্রাসী ও সাম্রাজ্যবাদী দেশ হিসেবে বিগত এক শতাব্দী থেকে টিকে রয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশের সাথে সম্পর্ক খারপ হলেই দেশটির উপর সামরিক আগ্রাসন চালাতে দ্বিতীয় বার ভাবে না দেশটি। তাছাড়া রাশিয়ার পাশে অবস্থানরত অধিকাংশ ছোট দেশ রাশিয়ার সাথে সমঝোতা করে টিকে রয়েছে ও দেশটিকে জমের মতো ভয় করে। অন্তত অতীত ইতিহাস রাশিয়া সম্পর্কে তাই বলে।
প্রথম দিকে রাশিয়ার সাথে ভালো সম্পর্ক থাকলেও স্বাধীনতার এক দশক পর থেকে পশ্চিমা বিশ্বের দিকে অতি মাত্রায় ঝুঁকে যাওয়ার জন্য রাশিয়ার সাথে সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটতে থাকে ইউক্রেনের। যার ফলস্রুতিতে রাশিয়া ২০১৩-১৪ সালের দিকে সরাসরি সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া অঞ্চল দখল করে নিলেও তাতেও ইউক্রেনের হুশ ফেরে না। রাশিয়ার অদূর ভবিষ্যতে আবারো ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন চালাতে পারে এমন আশাঙ্খা প্রবল হলেও ইউক্রেন কিন্তু তার সামরিক ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সেভাবে আধুনিকায়ন করেনি বয়া তা করার খুব একটা চেষ্টা করেছে বলে মনে হয় না। আর কিছু না হোক ২০১৫ সালের দিক থেকে পর্যায়ক্রমে আমেরিকা থেকে ৫০-৬০টি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ক্রয় বা সংগ্রহ করার যথেষ্ঠ সুযোগ থাকলেও তা মোটেও কাজে লাগায় নি ইউক্রেন সরকার। অন্তত পক্ষে সভিয়েত আমলের পুরনো হাজারের অধিক শর্ট এন্ড ব্যালেস্টিক মিসাইল সংরক্ষণ ও তার পাশাপাশি প্রায় ৬০টি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান হাতে থাকলে আজ রাশিয়া কিন্তু কোন ভাবেই এই সামরিক আগ্রাসন চালাতে পারত না। আর এখন কিন্তু এই ইউক্রেন যুদ্ধ সারাবিশ্বকে আস্তে আস্তে ভয়াবহ পরমাণু ও বিশ্বযুদ্ধের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক এবং লেখক, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com