চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং সর্বোপরি বৈশ্বিক মহামন্দার মুখে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আশাঙ্খাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে। বিশেষ করে রাশিয়াকে ঘিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো ভয়াবহ যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে এমন আশাঙ্খা, ডলার সংকট কিংবা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট আরো দীর্ঘায়িত হতে পারে এমন অনিশ্চিত পরিস্থিতির কারণে হয়ত বিশ্বের অধিকাংশ প্রভাবশালী দেশগুলো ভবিষ্যতের বিকল্প কারেন্সি হিসেবে এখন সোনার মজুত গড়ে তুলছে। অবশ্য বর্তমানে বিশ্বের সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকারী দেশ হিসেবে বিগত প্রায় দুই দশক থেকেই শীর্ষস্থানে রয়েছে এড় জায়ান্ট চীন। মুলত চীনের স্টেট অ্যাডমিনিস্টেশন অফ ফরেন এক্সচেঞ্জের (এসএএফই) এর দেয়া তথ্যমতে, চলতি ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চীনের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুটা হ্রাস পেয়ে ৩.১৩৩২ ট্রিলিয়ন ডলার হয়। যদিও তা গত জানুয়ারি মাসে চীনের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩.১৮৫ ট্রিলিয়ন ডলার। যা কিনা শতকরার হিসেবে ১.৬১% কম। যা গত ২০২১ সালের অক্টোবর মাস শেষে চীনের কাছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩.২১৮ ট্রিলিয়ন ডলার বা ৩২১৮ বিলিয়ন ডলার।

দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান অর্থনৈতিক পরাশক্তি ভারত বৈশ্বিক মহামন্দার মুখেও তার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের স্থিতিশীল অবস্থা ধরে রাখেতে সক্ষম হয়েছে। টাইমস অব ইন্ডিয়া নিউজের দেয়া তথ্যমতে, চলতি ২০২৩ সালের ১৭ই মার্চের হিসেব অনুযায়ী ভারতের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৫৭২.৮ বিলিয়ন ডলার এবং গত ২০২২ সালের ৭ই ডিসেম্বরের হিসেব অনুযায়ী তা ছিল ৫৬৪.১ বিলিয়ন ডলার। যেখানে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার দেয়া তথ্যমতে, গত ২০২১ সালের ২৯শে অক্টোবরে ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৬৪২.০১৯ বিলিয়ন ডলার।

এদিকে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৩ সালের ১৭ই মার্চের হিসেব অনুযায়ী পাকিস্তানের স্টেট ব্যাংকের হাতে মজুত থাকা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়ে ৪.৫৯৯ বিলিয়ন ডলার এবং একই সময়ে বানিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে থাকা রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৫.৫৪১ বিলিয়ন ডলার। সে হিসেবে পাকিস্তানের কাছে বর্তমানে ব্যবহার যোগ্য মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে ১০.১৩৯ বিলিয়ন ডলার। তবে অশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের দেয়া তথ্যমতে, গত ২০২১ সালের ৫ই নভেম্বরে পাকিস্তানের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা স্থিতির পরিমাণ ছিল ২৪.০২৫ বিলিয়ন ডলার। অথচ পরিকল্পনা বিহীন উন্নয়ন ও লাগামহীন আমদানি ব্যায়ের পাশাপাশি ও ব্যাপক মাত্রায় বিদেশে অর্থ পাচারের জন্য আজ ২০২৩ সালে এসে ভয়াবহ মাত্রায় অর্থনৈতিক সংকটের পতিত হয়েছে পাকিস্তানের জাতীয় অর্থনীতি।

তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩২.২৬৭ বিলিয়ন ডলার। বিশেষ করে ইতিবাচক রেমিট্যান্স ও রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবারো ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। যদিও গত ২০২১ সালের ২৪শে আগস্ট মঙ্গলবারের কার্যদিবস শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৪৮.০৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যায়। আবার গত ২০২০ সালের ২৯শে ডিসেম্বর বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৩.১৭ বিলিয়ন ডলার। ২০১৭ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভ ৩৩.৬৮ বিলিয়ন ডলারের সীমাকে স্পর্শ করে।

বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অর্জনকারী দেশ হিসেবে এশিয়ার আরেক ইকনোমিক জায়ান্ট জাপানের নাম সবার উপরে উঠে এসেছে। চলতি ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস শেষে ১.২২৬ ট্রিলিয়ন ডলারের ফরেন এক্সচ্যেঞ্জ রিজার্ভের মজুত ছিল। আবার বিশ্বের সর্বোচ্চ তৃতীয় বৈদেশিক মুদ্রা মজুতকারী দেশ হিসেবে ইউরোপের দেশ সুইজারল্যান্ডের কাছে চলতি ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাস শেষে বৈদেশিক ৮৫০.৯৮ বিলিয়ন ডলার রয়েছে। এখানে প্রকাশ থাকে যে, জাপান ও সুইজারল্যাণ্ডের রিজার্ভের পরিমাণ ২০২১ সাল অপেক্ষা অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। যেখানে ২০২১ সালে জাপানের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১.৪০৫ বিলিয়ন ডলার এবং একই সময়ে সুইজারল্যান্ডের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১.০৩৬ ট্রিলিয়ন ডলার।

ইউকীপিডয়ার দেয়া তথ্যমতে, বর্তমানে বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকারী দেশ হিসেবে রাশিয়ার কাছে ৫৮৫.৮ বিলিয়ন ডলার (১৭ই মার্চ ২০২৩) এবং পঞ্চম শীর্ষ দেশ হিসেবে ভারতের কাছে ৫৭২.৮ বিলিয়ন ডলারের মজুত রয়েছে। আবার ৫৫৮.৩৭ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ নিয়ে ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে তাইওয়ান, ৪৩৭.৮ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ নিয়ে সপ্তম স্থানে সৌদি আরব, ৪৩৬.৩ বিলিয়ন ডলার নিয়ে হংকং অষ্ঠম স্থানে, ৪১৪ বিলিয়ন ডলার নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া নবম স্থানে এবং ৩১৩.১২২ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ নিয়ে দশম স্থানে রয়েছে ল্যাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিল। তবে বিশ্বের এক নম্বর সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্টের কাছে বর্তমানে ২৪২.৭৩ বিলিয়ন ডলারের ফরেন এক্সচ্যেঞ্জ রিজার্ভ রয়েছে।

চলতি ২০২৩ সালের মার্চ মাসে তুরস্কের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ৭০.২৮ বিলিয়ন ডলার। যদিও গত ফেব্রুয়ারি মাসে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ভূমিকম্প ও প্রকৃতিক দূর্যোগের কারণে তুরস্ক বড় ধরণের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে যায়। তাই চরম আর্থিক ঝুঁকির মুখে থাকা তুরস্ককে আর্থিক সহায়তার অংশ হিসেবে সৌদি আরবের মোহাম্মদ বিন সালমান সরকার অতি সাম্প্রতিক সময়ে ৫.০০ বিলিয়ন ডলার দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডিপোজিট করেছে। এতে করে তুরস্কের বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা অনেকটাই লাঘব হবে বলে প্রত্যাশা করে তুর্কী এরদোয়ান সরকার। এদিকে গত ২০২১ সালের ১লা অক্টোবরে তুরস্কের সেন্ট্রাল ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১২১.৮৪ বিলিয়ন ডলার (বৈদেশিক মুদ্রা ও সোনার রিজার্ভ)।

বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের বিচারে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলংকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতা মোটেও সন্তোষজনক নয়। চলতি ২০২৩ সালের মার্চ মাসের হিসেব অনুযায়ী শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে ২.১২ বিলিয়ন ডলার। যা গত ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাস শেষে শ্রীলংকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে মাত্র ২.৭ বিলিয়ন ডলার। তাছাড়া অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে একই সময়ে ভুটানের ৯৭০ মিলিয়ন ডলার, নেপালের ৯.৩৫ বিলিয়ন ডলার এবং মালদ্বীপের কাছে প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলারের ফরেন এক্সচ্যেঞ্জ রিজার্ভ রয়েছে।

সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক এবং লেখক, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com