পাকিস্তানের চলমান ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সৌদি আরব সরকার আগের দেয়া ৩.০০ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋনের সুদ মাফ এবং আসল পরিশোধের সময় বাড়ানোর বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করছেন। তাছাড়া অর্থ সহায়তা প্যাকেজের আওতায় পাকিস্তানকে দেয়া ৩.০০ বিলিয়ন ডলারের ঋন নবায়নের বাহিরে আবারো নতুন করে ১.০০ বিলিয়ন ডলারের জ্বালানী তেল সরবহারের বিষয়টি বিবেচনা করছে সৌদি আরব। যা কিনা পাকিস্তানের জ্বালানী তেল খাতে ১০ মাসের জন্য প্রতি মাসে ১০০ মিলিয়ন ডলার করে প্রদান করবে বা তেল সরবরাহের মাধ্যমে সমন্বয় সাধন করা হবে।
মনে করা হয়, পাকিস্তানকে দেয়া আইএমএফ এর প্রস্তাবিত বেল-আউট প্যাকেজের ৪.০০ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋন পেতে সহায়তা করবে সৌদি আরবের নতুন অর্থিক ঋন সহায়তা প্যাকেজ। যদিও পাকিস্তানে নতুন সরকার আশা করে যে, আগামী ২৯শে আগস্ট আইএমএফ এর নির্বাহী পরিষদ বৈঠক বসলে ৪.০০ বিলিয়ন ডলারের প্রথম কিস্তি হিসেবে ১.১৮ বিলিয়ন ডলারের তহবিল চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করবে আইএমএফ। এক্ষেত্রে অবশ্য আমেরিকার বাইডেন প্রশাসনের গোপন গ্রীন সিংনাল বা সম্মতি পেয়েছে ইমরান সরকারের পতনের পর।
স্বল্প আয়ের একটি দেশের জন্য দীর্ঘ মেয়াদী বৈদেশিক ঋন ও দেনা কতটা বিপদজনক হতে পারে তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার দেশ পাকিস্তান। দেশটি মুলত নিজেদের বেল-আউট ঠেকাতে বিগত চার দশক থেকেই সৌদি আরব ও চীনসহ বিশ্বের একাধিক দেশ, বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি এবং জাইকার মতো ঋন প্রদানকারী বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এখনো পর্যন্ত নির্বিচারে বৈদেশিক ঋন নিয়েই যাচ্ছে।
স্টেট ব্যাংক অফ পাকিস্তানের দেয়া তথ্যমতে, ২০২২ সালের জুনের শেষে পাকিস্তানের মোট বৈদেশিক ঋন এবং দেনার স্থিতির পরিমাণ ১৩০.২০ ছিল বিলিয়ন ডলার। যেখানে ২০২১ সালের একই সময়ে দেশটির মোট বৈদেশিক ঋনের স্থিতির পরিমাণ ছিল ১১৬.৩১ বিলিয়ন ডলার। ২০০৮ সাল থেকে পাকিস্তান এ পর্যন্ত তাদের বৈদেশিক ঋন এবং দেনার বোঝা অবিশ্বাস্যভাবে ২০০% পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছে। যেখানে দেশটির ২০০৮ সালে বৈদেশিক ঋনের পরিমাণ ছিল ৪৫.৪ বিলিয়ন ডলার। তাছাড়া ২০২২ অর্থবছরে পাকিস্তানের সরকার নতুন করে আরও ৮.০০ বিলিয়ন ডলার থেকে ১০.০০ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋন পাবে বলে আশা করছে।
স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের তথ্য অনুযায়ী চলতি ২০২২ সালের ২৯শে জুলাই এর হিসেব অনুযায়ী পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১৪.২০৮ বিলিয়ন ডলার। তবে এই রিজার্ভের আবার ৬০% কিনা আবার বৈদেশিক ঋন ও আর্থিক সহায়তার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। আর দেশটির বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋন ও দেনার বিবেচনায় ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ কিন্তু মোটেও যথেষ্ঠ নয় বলেই প্রতিয়মান হয়।
পাকিস্তান বর্তমানে বিভিন্ন দেশ ও বৈশ্বিক ঋন প্রদানকারী সংস্থা থেকে যে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋন নিচ্ছে বা নিবে, তার ৬০% পর্যন্ত নিশ্চিতভাবেই সরাসরি ব্যয় করতে হবে আগে থেকে অন্য দেশ এবং সংস্থা থেকে নেয়া বৈদেশিক ঋনের আসল ও সুদ বাবদ পরিশোধ করতে। তার মানে পাকিস্তান বর্তমানে অন্য দেশে থেকে নেয়া পূর্বের ঋনের কিস্তি এবং এর সুদ বাবদ পরিশোধ করতে নতুন করতে আরেক দেশ বা আন্তর্জাতিক কোন সংস্থা থেকে নির্বিচারে এবং কঠিন শর্তের মুখে ঋন নিতে বাধ্য হচ্ছে। যা বর্তমানে অন্যান্য স্বল্প আয়ের এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বৈদেশিক ঋন ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি চরম সতর্ক বার্তা বহন করে।
এদিকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পর্যাপ্ত ভালো উৎস বা খাত না থাকলেও পাকিস্তান তার চীরবৈরী ভারতের সাথে সামরিক শক্তিতে পাল্লা দিতে গিয়ে আধুনিক ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ক্রয় এবং আধুনিকায়নে নির্বিচারে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে যাচ্ছে। তাছাড়া দেশটিতে চলমান একাধিক উন্নয়ন প্রকল্পসহ ৬২.০০ বিলিয়ন ডলারের চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি) প্রকল্পে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের কারণে বর্তমানে অবিশ্বাস্যভাবে পাহাড় সমান বৈদেশিক ঋন ও দেনায় জড়িয়ে গেছে পাকিস্তান।
চীন কিন্তু ইতোমধ্যেই সুবিশাল ৬২ বিলিয়ন ডলারের চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর প্রকল্পে আনুমানিক প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি অর্থ বিনিয়োগ করে বসে আছে। এটাকে ঠিক বিনিয়োগ নয় বরং এটিকে চড়া সুদে বৈদেশিক ঋন বলাই শ্রেয়। যা হোক পাকিস্তানের বর্তমান অর্থনৈতিক সক্ষমতার বিচারে এই বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋন পরিশোধ করার আদৌ কোন সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। তবে এর দায় কিন্তু ঠিকই আগামী ১০০ বছর পর্যন্ত হয়ত পাকিস্তানের সাধারণ দরিদ্র জনগণকে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে।
এখানে প্রকাশ থাকে যে, ঋন শোধ করতে না পাড়লে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, সামুদ্রিক ও স্থল বন্দর পর্যায়ক্রমে দীর্ঘ মেয়াদে চীনের মতো দেশের হাতে তুলে দেয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প রাস্তা খোলা থাকবে বলে মনে হয় না। আর বকেয়া ঋন আদায়ের নামে এভাবে হয়ত দেশটির গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বন্দর ও স্থাপনা নিজ নিয়ন্ত্রনে নিয়ে এগুলোর প্রধান ব্যবহারকারী বা অদূর ভবিষ্যতে সুবিধাভোগী হতে যাচ্ছে পাকিস্তানের চীর অকৃত্রিম ও পরীক্ষিত বন্ধুদেশ চীন।
সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক ও লেখক, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com