
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় সুপার পাওয়ার দেশগুলোর পাশাপাশি তুরস্কের নাম সবার উপরে উঠে এসেছে। বিশেষ করে দেশটির সম্মানিত প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণভাবে মার্কিন ও রাশিয়া উভয় শিবিরের সাথে সখ্যতা ও বন্ধুবাবাপন্ন সম্পর্ক বজায় রাখার কৌশল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। তবে যাই হোক না কেন, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও পররাষ্ট্র নীতিতে তুরস্ক ব্যাপক অগ্রগতি বা সফলতা লাভ করলেও সার্বিক অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেশটির সরকার গুরুত্ব সহকারে নজর দিচ্ছেন বলে মনে হয় না। এদিকে বর্তমানে বিশ্বের সর্বোচ্চ ২০টি অর্থনৈতিক ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় উঠে এসেছে তুরস্কের নাম।

২০২০ সাল থেকে চলা করোনা মহামারী এবং ইউক্রেন যুদ্ধের বিরুপ প্রভাবে লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি এবং ডলারের বিপরীতে ক্রমাগত তুর্কী মুদ্রা লিরার মান হ্রাস পাওয়ায় তুরস্কের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ২০২২ সালে এসে অনেকটাই সংকুচিত হয়ে গেছে। এদিকে বিশ্বের অধিকাংশ দেশই যখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টানতে ধারাবাহিকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হার বৃদ্ধি করে যাচ্ছে, সেখানে তুরস্কের এরদোয়ান সরকার ঠিক তার উল্টো পথেই হাঁটতে শুরু করেছেন। তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আজ ১৮ই আগস্ট সুদের হার ১৪% থেকে কমিয়ে ১৩% এ নির্ধারণ করলে তার্কিস মুদ্রা লিরার মান ১ ডলারের বিপরীতে কিছুটা কমে ১৮.০৯ লিরায় নেমে আসে।

তাছাড়া গত ২০২১ সালের ২৬শে অক্টোবরে ১ ডলারের বিপরীতে তুর্কী মুদ্রা ৯.৬১ লিরাতে লেনদেন করা হয়েছিল। যেখানে কিনা তার মাত্র কয়েক দিন আগেই ২০২১ সালের ১০ই অক্টোবর ১ ডলারের বিপরীতে ৮.৯৬ লিরা এবং গত বছরের ১২ই আগস্ট ৮.৪৪ লিরাতে লেনদেন করা হয়। অথচ ২০১৬ সালের ১৩ই জানুয়ারি ডলারের বিপরীতে তুরস্কের মুদ্রার মূল্য ছিল ০.৩৩ লিরা এবং ২০১৫ সালের ১লা জানুয়ারিতে ছিল ২.৩৩ লিরা।

আল জাজিরা নিউজের দেয়া তথ্যমতে, গত জুলাই মাসে তুরস্কের সার্বিক মুদ্রাস্ফীতির হার ইতিহাসে সর্বোচ্চ পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়ে বিপদজনকভাবে ৭৯.৬% এ পৌঁছে যায়। যেখানে কিনা চলতি ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে দেশটির মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৬৯.৯৭%। আর ২০০২ সালের পর এটা সবচেয়ে বেশি মাত্রায় মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির ঘটনা। তাছাড়া গত মার্চ মাসে এই মুদ্রাস্ফীতি ছিল কিন্তু ৬১%।

দীর্ঘ মেয়াদী করোনা মহামারির পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন ভয়াবহ যুদ্ধ, বৈশ্বিক মহামন্দা এবং জ্বালানি তেলের ব্যাপক মূল্য বৃদ্ধির কারণে সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কে আশাঙ্খাজনক হারে মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছে। তাছাড়া দীর্ঘ দিন থেকেই দেশটিতে অবস্থানরত প্রায় ৪ মিলিয়ন সিরীয় বা অন্যান্য দেশের শরণার্থীর বোঝা চেপে থাকায় তা কিন্তু সরাসরি তুরস্কের জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ধরণের বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে করোনা মহামারির কারণে দেশটিতে বিদেশী নির্ভর পর্যটন শিল্পখাতে ধস নামার কারণে সার্বিকভাবে জাতীয় অর্থনীতি মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

ইউকীপিডিয়ার দেয়া তথ্যমতে, ২০২২ সালে তুরস্কের নমিনাল জিডিপির আকার ৬৯২ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখানে ২০১৩ সালে দেশটির নমিনাল জিডিপির আকার ছিল ৯৫৭.৮ বিলিয়ন ডলার। তার মানে ২০১৩ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রায় ৯ বছরে তুরস্কের জিডিপির আকার ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা প্রায় ২৬৫.৮ বিলিয়ন ডলার হ্রাস পেয়েছে। তার পাশাপাশি একই সময়ে ডলারের বিপরীতে তুরস্কের নিজস্ব মুদ্রা লিরার মানের পতন হয়েছে প্রায় ৩০০% পর্যন্ত।

চলতি ২০২২ সালের এপ্রিল মাসের হিসেব অনুযায়ী তুরস্কের সার্বিক বেকারত্বের হার ছিল প্রায় ১১.৩% এবং চলতি আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১০৮.৬৪ বিলিয়ন ডলার। অথচ ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে তুরস্কের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১১৫.১৪ বিলিয়ন ডলার। গত কয়েক বছরে তুরস্কের রিজার্ভের প্রায় ১২৮ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যা তুর্কি সরকারের মতে দেশটির মুদ্রার মানের পতন ঠেকিয়ে রাখতে ব্যবহার করা হয়েছে৷

তুরস্কের সার্বিক অর্থনীতিতে দীর্ঘ মেয়াদী নেতিবাচক প্রবণতা দেখা গেলেও বৈদেশিক বানিজ্যে সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। ২০২১ সালে তুরস্কের মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২২৫ বিলিয়ন ডলার। যা কিনা ২০২০ সাল অপেক্ষা ৩২.৯% বেশি। তাছাড়া একক বছর হিসেবে ২০২১ সালে ইতিহাসে সর্বোচ্চ পরিমানে ২০০ বিলিয়ন ডলারের অধিক পন্য সারা বিশ্বে রপ্তানি করতে সক্ষম হয় দেশটি। যদিও তুরস্কের সরকারের তরফে বৈশ্বিক রপ্তানির টার্গেট ছিল ২০২১ সালে ১৮৪ বিলিয়ন ডলার, ২০২২ সালের টার্গেট ছিল ১৯৮ বিলিয়ন এবং ২০২৩ সালের রপ্তানির টার্গেট নির্ধারণ করা হয় ২১০ বিলিয়ন ডলার। সে হিসেবে তুরস্ক রপ্তানি বানিজ্যে গত বছরই ২০২৩ সালের টার্গেটে পৌঁছে গেছে। বর্তমানে তুর্কী এরদোয়ান সরকার ২০২৩ সালের জন্য সারা বিশ্বে ৩০০ বিলিয়ন ডলারের পন্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে নতুন পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছেন।

তবে ২০২১ সালে তুরস্কের রপ্তানি আয় ইতিবাচকভাবে বৃদ্ধি পেলেও থেমে নেয় দেশটির সার্বিক আমদানি ব্যয়। গত ২৪শে ফেব্রুয়ারি থেকে চলমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের মধ্যেও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে দেশটির আমদানি ব্যয়। ২০২১ সালে তুরস্ক মোট ২৭১ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে সারা বিশ্ব থেকে পন্য, কাঁচামাল, ক্যামিক্যাল, ও জ্বালানী তেল ও গ্যাস আমদানি করতে। তবে ২০২১ সালে আমাদানি-রপ্তানি বানিজ্যে ব্যাপক ঘাটতি থাকলেও বৈদেশিক আমদানি ও রপ্তানি বানিজ্য ভারসাম্যে কিন্তু ইতিবাচক উন্নতি লাভ করেছে দেশটি। আবার বৈদেশিক বাণিজ্যে ডলারের ঘাটতি ৭.৮% হ্রাস পেয়ে ৪৫.৯ বিলিয়ন ডলারে এসে পৌঁছেছে। যা কিনা ২০০৯ সালের পরে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন রেকর্ড ছিল।
Sherazur Rahman
About the author