আজ থেকে প্রায় এক যুগ আগেই বিশ্বের সেরা ও প্রথম স্থানীয় ঋনগ্রস্ত দেশ হিসেবে নিজের নাম লিখিয়েছে আমেরিকা। আর এখন ২০২৩ সালে এসে নিজেকে অর্থনৈতিক দেউলিয়া বা শাটডাউনের হাত থেকে রক্ষা করতে ঋণগ্রস্ত দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণসীমার বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়ার বিল পাস করেছে দেশটির কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেট। আর এর মাধ্যমে আমেরিকা রাষ্ট্রীয়ভাবে দেউলিয়া হওয়ার হাত থেকে নিশ্চিতভাবেই এখন নিজেকে রক্ষা করল। তবে এটা ঠিক যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আজ অব্ধি ডলার বিশ্বের সকল দেশের আন্তঃবানিজ্য লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রধান মুদ্রা হিসেবে ডলার ব্যবহৃত হওয়ায় আমেরিকা কিন্তু বার বার নিজেকে দেউলিয়া হওয়া থেকে রক্ষা করে নিল।
মূলত গত ৩রা জুন বৃহস্পতিবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ঋন গ্রহণ সীমার বাধ্যবাধকতা সংক্রান্ত বিলের ওপর কংগ্রেসে প্রস্তাব আনা হয়। সেখানে কার্যত ডেমোক্র্যাট-নিয়ন্ত্রিত উচ্চ আইন পরিষদ সিনেটে ভোটাভুটি হলে তা প্রত্যাশিতভাবে আইনটি পাশ করা হয়। ১০০ আসনের সিনেটে বিলটি পাস করতে হলে ৬০ ভোটের দরকার ছিল। তবে সিনেটে ডেমোক্রেট ও রিপাবলিক উভয় দলের আইন প্রণেতাদের প্রত্যক্ষ ভোটে আইনটি পাশ করা হয়। এই ঋনসীমা উঠিয়ে নেওয়ার প্রস্তাবটির পক্ষে সিনেটে ৬৩ ভোট পড়ে এবং বিপক্ষে পড়ে ৩৬ ভোট। তবে প্রকাশ থাকে যে, চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মহামন্দা ও ভয়াবহ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের মুখে আমেরিকার জাতীয় অর্থনীতি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে ডলারের ক্রমহ্রাসমান অবনতি ও প্রভাব হ্রাসের মতো বিষয়টি দেশটির অর্থনীতিকে এক গভীর অন্ধকারের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
প্রায় ৩৩.৪৭ কোটির জনসংখ্যার দেশ আমেরিকার নমিনাল জিডিপি’র আকার ২৬.৮৫৪ ট্রিলিয়ন ডলার। জিডিপি’র আকারের দিক থেকে আমেরিকার অর্থনীতি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও প্রথম স্থানীয় দেশ। অথচ দেশটির অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋনের মোট পরিমান অবিশ্বাস্যভাবে প্রায় ৩১.০০ ট্রিলিয়ন ডলারের অধিক। আর দেশটির জিডিপি’র তুলনায় মোট ঋনের পরিমাণ কিন্তু শতকরার হিসেবে প্রায় ১১৬% হয়ে যায়। আমেরিকার অর্থনৈতিক সক্ষমতা সুবিশাল হলেও তার ব্যয়ের খাতগুলো কিন্তু মোটেও ছোট নয়। বিশেষ করে বৈশ্বিক কৌশলগত প্রভাব বিস্তার করতে আমেরিকা নির্বিচারে অর্থ্য ব্যয় করে থাকে। নিজ দেশে ও সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৫,৮০০টি সামরিক ঘাঁটি পরিচালনা, চীন ও রাশিয়াকে মোকাবেলা ও বৈশ্বিক যুদ্ধনীতি কিংবা বন্ধুভাবাপন্ন দেশকে সামরিক সহায়তা কার্যক্রম বাস্তবায়নে দেশটি চলতি ২০২৩ সালে নজিরবিহীনভাবে ৮৪২ বিলিয়ন ডলারের সামগ্রিক সামরিক ও প্রতিরক্ষা বাজেট অনুমোদন করে দেশটির বাইডেন সরকার ও কংগ্রেস।
তবে এটা ঠিক যে, সারা বিশ্ব অর্থনীতির (জিডিপি) আকারের প্রায় এক-চতুর্থাংশ নীয়ন্ত্রণ করে বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি আমেরিকা। তার চেয়ে আরো বেশি গুরুত্বপুর্ন হলো যে, সারা বিশ্বের অধিকাংশ সরকারসহ বিনিয়োগকারীরা আমেরিকান সরকারের অর্থবাজারে (treasuries) বিনিয়োগ করে। সেটা করে সরকার কর্তৃক ইস্যুকৃত ট্রেজারী বন্ড ও সরকারি ঋনপত্র ইত্যাদি ক্রয়ের মাধ্যমে। আর আমেরিকার এই ট্রেজারী বন্ড ও ঋনপত্র সবচেয়ে বেশি ক্রয় করে বাইডেন প্রশাসনকে ঋন দিয়ে রেখেছে রেড জায়ান্ট চীন। শত্রুভাবাপন্ন হওয়া সত্ত্বেও চীন খুব সম্ভবত এক ট্রিলিয়ন ডলারের অধিক বৈদেশিক ঋন বা বিনিয়োগ করেছে। আমেরিকাকে ঋন প্রদানের তালিকায় শীর্ষ স্থানে রয়েছে এশিয়ার দুই দেশ চীন ও জাপান।
আমেরিকা তার অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও ডলারকে সুকৌশলে পুঁজি করে সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এখনো পর্যন্ত আমেরিকার মুদ্রা ডলার সারা বিশ্ব রাজত্ব করে বেড়াচ্ছে। তাছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও বানিজ্যে লেনদেনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে নিরাপদ ও গ্রহণযোগ্য বিনিময় মুদ্রা হিসেবে ডলার প্রায় ৬৮% দখল করে রেখেছে। যদিও ২০০১ সালের দিকে সারা বিশ্বের দেশগুলো প্রায় ৭৩% মুদ্রা ডলারে রিজার্ভ করে রাখত। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষ করে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মহামন্দা ও ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের বিরুপ প্রভাবে আমেরিকার অর্থনীতি দেউলিয়া হতে পারে এমন গুজবে নজিরবিহীনভাবে আমেরিকার অন্যতম বৃহৎ ব্যাংক সিলিকন ভ্যালি এবং সিগনেচার ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যায়। যা ছিল আমেরিকার জাতীয় অর্থনীতির জন্য একটি আশাঙ্খাজনক বার্তা।
মনে করা হয় চলতি ২০২৩ সালের মার্চ মাস শেষে আমেরিকার বৈদেশিক ঋন ও দেনার স্থিতির পরিমাণ অবিশ্বাস্য ভাবে প্রায় ৮.৫ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে। তাছাড়া দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস হতে নেয়া ঋনের স্থিতির পরিমাণ খুব সম্ভবত প্রায় ২৩ ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি হতে পারে। তবে এই হিসেবটি যুক্তি সঙ্গত কারণেই কিছুটা কম বা বা বেশি হতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় কথা আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যয় ও দেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকার একটি বড় অংশ কিন্তু ঘুরেফিরে সেই আমেরিকারই বড় বড় অস্ত্র উৎপাদনকারী কর্পোরেশনের পকেটে চলে যায়। আমেরিকার সরকার চরম মাত্রায় ঋনগ্রস্থ হলেও সেই দেশটিতেই আবার ইলন মাস্কের মতো কিন্তু বিশ্বের আনুমানিক প্রায় ৪০% শীর্ষ ধনী বা ধনকুবের বসবাস করেন। যাদের সম্মিলিত মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি হতে পারে।
তবে আমেরিকার সবচেয়ে বাজে ও নিকৃষ্ট মানের কাজটি হচ্ছে কারণে বা অকারণে অন্য দেশের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধ আরোপ করা। এমনকি একটি দেশের পাশাপাশি সুনিদিষ্ট ব্যক্তি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের উপরও অবরোধ আরোপ করে বসে দেশটি। তাছাড়া হাইপারসনিক গতির রকেট পরীক্ষার জন্য গত ২০২২ সালে চীনের একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষকের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে মার্কিন প্রশাসন। তাই বর্তমানে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ আমেরিকার বিভিন্ন কর্মকান্ডে অনেকটাই বিরুপ ও হতাশ হয়ে ডলারের বিকল্প মুদ্রা চালু করার বিষয়ে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বিশেষ করে ব্রিকস এর আওতায় চীন, ভারত, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের নেতৃত্বে বাস্তবে মোট ৩০টি দেশ একত্রে ডলারের বিকল্প মুদ্রা ও অর্থ ব্যবস্থা চালুর বিষয়ে অনেকটাই একমত হয়েছেন। আর তাই ৩০ সদস্যের জোটটি আন্তর্জাতিকভাবে বিকল্প মুদ্রায় লেনদেন শুরু করলে ডলার কিন্তু অনেকটাই দুর্বল হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ, সৌদি, ইরান, মিশর, তুরস্ক, আর্জেন্টিনা নতুন সদস্য হিসেবে যোগ দিতে যাচ্ছে ব্রিকস জোটে। সবচেয়ে বড় কথা তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো কিন্তু সরাসরি মার্কিন চোখ রাঙ্গানি উপেক্ষা করেই ব্রিকস জোটে যোগ দিতে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। এতে করে আর যাই হোক না কেন জোটভুক্ত দেশগুলো ডলারের বিকল্প মুদ্রায় অন্তর্জাতিক বানিজ্যের পাশাপাশি তেল আমদানি-রপ্তানির বড় ধরনের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে আশা করা যায়।
লেখকঃ সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com