বৈশ্বিক বাজারে প্রতিরক্ষা সাজ সরঞ্জাম রপ্তানির ক্ষেত্রে চলতি ২০২৪ সালে অন্যতম অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে তুরস্ক। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্কের প্রতিরক্ষা সাজসরঞ্জাম এবং এ্যারোস্পেস সিস্টেম রপ্তানি রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্সি অফ ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিজ (এসএসবি) এর দেয়া তথ্যমতে, সদ্য সমাপ্ত ২০২৪ সালে প্রায় ১৮০টি দেশে ৭.১৫৪ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ও সামরিক সাজ সরঞ্জাম রপ্তানি করেছে তুরস্কের ডিফেন্স রিলেটেড ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাবগুলো।
তুরস্কের এরদোয়ান প্রশাসন গত ২০২৪ সালের শুরুতে সারা বছরের জন্য ৬.৫ বিলিয়ন ডলারের ডিফেন্স সিস্টেম রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। তবে দেশটি একই সময়ে সেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ১১% অধিক পরিমাণ ও মূল্যের ডিফেন্স সিস্টেম রপ্তানির রেকর্ড গড়ে। গত ২০২৪ সালে তার পূর্বের ২০২৩ অপেক্ষা প্রায় ২৯% বেশি ডিফেন্স এবং এ্যারোস্পেস সিস্টেম রপ্তানি করে দেশটি। আর গত ২০২৩ সালের ১২ মাসে মোট ৫.৫ বিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা সাজ সরঞ্জাম রপ্তানি করে।
গত ২০২০ সালের দিকে করোনা মহামারির কারণে পর্যটন নির্ভর তুরস্কের অর্থনীতি মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও গত ২০২৩ সাল থেকেই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে দেশটির সার্বিক অর্থনীতি এবং রপ্তানি আয়। বিশেষ করে গত ২০২৪ সালে ডিফেন্স সিস্টেমসহ সারা বিশ্বে রেকর্ড পরিমাণ মোট ২৬২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য ও সেবা রপ্তানি করে। যেখানে গত ২০২৩ সালে দেশটির মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২৫৫.৮ বিলিয়ন ডলার এবং গত ২০২২ সালে তা ছিল প্রায় ২৬১ বিলিয়ন ডলার।
তুরস্ক বর্তমানে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং নিজস্ব প্রযুক্তির সমন্বয়ে বিশ্ব মানের কমব্যাট ড্রোন, অ্যাটাক হেলিকপ্টার, স্বল্প রেঞ্জের মিসাইল, রকেট, লাইট ট্যাংক, আর্মাড ভেইকল (সামরিক সাঁজোয়া যান), ব্যাটল শিপ, রাডার এন্ড এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম,আর্টিলারি সিস্টেমসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরির লাইট আর্মস এবং ডিফেন্স সিস্টেম ম্যানুফ্যাকচারিং এবং নিজে ব্যবহারের পাশাপাশি সারা বিশ্ব রপ্তানির করে। তাছাড়া চলতি ২০২৫ সাল শেষে হয়ত ১০ বিলিয়ন ডলারের ডিফেন্স এন্ড এ্যারোস্পেস সিস্টেম রপ্তানির মাইলফলক অর্জন করতে পারবে বলে আশাবাদী দেশটি।
আজ থেকে প্রায় এক দশক আগেও তুরস্ককে একটি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম আমদানিকারক দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হত। অথচ বর্তমানে দেশটি পর্যায়ক্রমে তার অস্ত্র আমদানি ৮০% পর্যন্ত হ্রাস করে নিজস্ব এক সমৃদ্ধশালী প্রতিরক্ষা শিল্প ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। তার পাশাপাশি নিজ দেশের মেধাবী তরুণ প্রজন্মকে কাজে লাগিয়ে তুরস্ক কিন্তু অত্যন্ত পরিকল্পনা মাফিক বেশকিছু বিশ্ব মানের ডিফেন্স সিস্টেম ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি গড়ে তুলেছে।
বর্তমানে তুরস্কের গুরুত্বপূর্ণ ডিফেন্স এন্ড এ্যারোস্পেস সিস্টেম ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির মধ্যে বায়রাক্তার, অ্যাসেলসান, হ্যাভেলসান, এসটিএম, টার্কিস এ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ (টিএআই), রকেটসান কোম্পানি হচ্ছে অন্যতম। তার পাশাপাশি পশ্চিমা বিশ্বের প্রযুক্তি সমৃদ্ধ ইতালি, জার্মানি এবং স্পেনের মতো দেশের সাথে কলাব্রেট করে নিজ দেশেই বেশকিছু উচ্চাভিলাষী ডিফেন্স প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করছে তুরস্ক।
বিশেষ করে তুর্কি নৌবাহিনীর জন্য টিসিজি আনাদুলুর মতো ডেডিকেটেড ফ্ল্যাগশিপ লাইট হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার তৈরি করে এক নতুন প্রযুক্তিগত সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে তুরস্ক। তাছাড়া নিজস্ব প্রযুক্তির তৈরি নতুন প্রজন্মের (কেএএএন) অ্যাডভান্স কমব্যাট এয়ারক্রাফট এবং চালকবিহীন ‘কিঝিলএলমা’ এয়ারক্রাফট পরীক্ষামূলকভাবে আকাশে উন্নয়ন করে নিজের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও দক্ষতা বিশ্বের সামনে উন্মোচন করেছে। আর তুরস্করে এরদোয়ান সরকারের টেকসই এবং অত্যন্ত পরিকল্পিত প্রতিরক্ষা শিল্পের বিকাশ সারা বিশ্বে ইতোমধ্যেই ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে।
তথ্যসূত্র:- দ্য ডেইলি সাবাহ, আনাদুলু, তুর্কি টুডে।
সিরাজুর রহমান, (Sherazur Rahman), শিক্ষক ও লেখক, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com
বর্তমানে এভিয়েশন সেক্টরে সবচেয়ে জটিল এবং স্পর্শকাতর প্রযুক্তি হচ্ছে জেট ইঞ্জিন ডিজাইন এন্ড ম্যানুফ্যাকচারিং। বর্তমানে সারা বিশ্বের প্রায় ১২টি থেকে ১৫টি দেশ সামরিক ও বেসামরিক এয়ারক্রাফট, হেলিকপ্টার, মিসাইল, কমব্যাট এন্ড ননকমব্যাট ড্রোন ডিজাইন ও তৈরি করলেও বাস্তবে মাত্র ৬টি দেশ একেবারে নিজস্ব প্রযুক্তির জেট ইঞ্জিন তৈরি করতে সক্ষম। যার মধ্যে রয়েছে আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন এবং ইউক্রেনের মতো দেশের নাম।
প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে সমৃদ্ধ হলেও জাপান এবং জার্মানির মতো দেশ কিন্তু একেবারে হাইলি অ্যাডভান্স জেট ইঞ্জিন ডিজাইন ও তৈরিতে এখনো পর্যন্ত সেভাবে এগিয়ে আসেনি। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জেট ইঞ্জিন চালিত প্রথম যুদ্ধবিমান আবিষ্কার বা তৈরি করে জার্মানি। তবে এবার কিন্তু সারা বিশ্বকে চমকে দিয়ে জেট ইঞ্জিন তৈরিতে নিজের নাম লিখিয়েছে তুরস্ক। আর এই গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিতে সাম্প্রতিক সময়ে নজরকাড়া সাফল্য দেখিয়েছে দেশটি।
মূলত প্রায় এক দশক আগে থেকেই তুরস্ক জেট ইঞ্জিনের জন্য পশ্চিমা বিশ্বের উপর নির্ভরতা হ্রাস করে নিজস্ব প্রযুক্তির ডেডিকেটেড ইঞ্জিন তৈরির চেষ্টা করে আসছে। যার ধারাবাহিকতায় এবার তারা নিজস্ব প্রযুক্তির বেশ কিছু সিরিজের যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টারে ব্যবহারের উপযোগী ইঞ্জিন উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে। মনে করা হয় আধুনিক প্রযুক্তির যুগে এসে রকেট এবং পরমাণু বোমার চেয়েও ভালো মানের জেট ইঞ্জিন তৈরি করা অনেক কঠিন একটি কাজ।
আসলে বছর খানেক আগে রাশিয়া কঠিন শর্তের মুখে তুরস্ককে জেট ইঞ্জিন তৈরির প্রযুক্তি হস্তান্তর করতে চাইলে তুরস্ক তাতে রাজি হয়নি। তারা অনেকটাই নীরবেই যুক্তরাজ্য ও ইউক্রেনের সহায়তায় নিজস্ব প্রযুক্তির টার্বোফ্যান এবং টার্বোশেফট জেট ইঞ্জিনের প্রযুক্তি অর্জনে ব্যাপকভাবে গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকে। তবে ড্রোন, মিসাইল এবং হেলিকপ্টারের উপযোগী ইঞ্জিন তৈরিতে সফলতা পেলেও যুদ্ধবিমানে ব্যবহারের উপযোগী জেট ইঞ্জিন ডিজাইনে দেশটি এখনো পর্যন্ত উন্নয়নের একেবারে প্রাথমিক স্তরে রয়েছে।
অন্যদিকে গত দুই দশক থেকে রাশিয়া ও ইউক্রেনের জেট ইঞ্জিনের ক্লোন কপি করে কিংবা প্রযুক্তি হাতিয়ে নিয়ে হলেও চীন তার নিজস্ব প্রযুক্তির কিছুটা নিম্ন মানের বা সিরিজের ডাব্লিউএস-১০/১৩/১৫ সিরিজের ইঞ্জিন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। আর চীন এখন পর্যন্ত উচ্চ প্রযুক্তির জেট ইঞ্জিন ডিজাইন ও আধুনিকায়নে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে। এদিকে কয়েক দশক থেকে ভারত নিজস্ব প্রযুক্তির জেট ইঞ্জিন তৈরির ব্যাপক চেষ্টা করে গেলেও বাস্তবে তারা এখনো পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।
তুরস্কের এরদোয়ান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিগত দুই দশকে নিজস্ব প্রতিরক্ষা শিল্প উন্নয়নে পরিকল্পিতভাবে কাজ শুরু করে। যার ধারাবাহিকতায় দেশটি সামরিক যান, ট্যাংক এবং হেলিকপ্টারে ব্যবহারের উপযোগী বেশকিছু সিরিজের ডেডিকেটেড ইঞ্জিন তৈরির কাজ শুরু করে এবং এ কাজে তারা কিন্তু ইতোমধ্যেই বড় ধরনের সফলতা পেয়েছে। এর পাশাপাশি দেশটি বর্তমানে আরও বেশকিছু মডেলের উচ্চ প্রযুক্তির ইঞ্জিন নিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে উন্নয়ন ও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। যা সার্ভিসে আসতে আরো হয়ত কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে।
বর্তমানে তুরস্কের ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাবে উৎপাদিত ইঞ্জিনের মধ্যে একটি হচ্ছে ‘বিএমসি’ পাওয়ারের তৈরি ৪০০ হর্সপাওয়ারের ‘টুনা’ ইঞ্জিন। এই জাতীয় ইঞ্জিন সাধারণত সামরিক সাঁজোয়া গাড়িতে ব্যবহার করা হয়। এর পাশাপাশি বর্তমানে তার্কিস এ্যারোস্পেস কোম্পানির তৈরি পিডি-১৭০ লাইট ইঞ্জিন আনকা, আকসুঙ্গুর এবং বায়রাক্তার টিবি-৩ হাইলি অ্যাডভান্স কমব্যাট ড্রোনে ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার একই প্রতিষ্ঠানের তৈরি পিজি-৫০ সিরিজের ছোট আকারের ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয় ‘কারগু’ অটোনোমাস সুইসাইডাল ড্রোনে।
তার্কিস অ্যারোস্পেস কোম্পানির নিজস্ব ডিজাইনে তৈরি টিএস-১৪০০ সিরিজের হাইলি অ্যাডভান্স টার্বোশেফট ইঞ্জিন অতি সাম্প্রতিক সময়ে সম্প্রতি তুরস্কের ‘গোকবে’ হেলিকপ্টারে সফলভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। তাছাড়া তাদের তৈরি একই টার্বোশেফট ইঞ্জিন এছাড়াও অ্যাটাক হেলিকপ্টারে ব্যবহার করে বড় ধরনের সফলতা পায় দেশটি। আর দেশটি এখন একেবারে নিজস্ব প্রযুক্তির তৈরি যুদ্ধবিমানে ব্যবহারের উপযোগী ২টি সিরিজের টিএফ-৬০০০ এবং টিএফ-১০০০০ আফটার টার্বোফ্যান (প্রোটোটাইপ) ইঞ্জিন নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। যা বর্তমানে পরীক্ষামূলক পর্যায়ে থাকলেও আগামী ২০২৬ সালের দিকে হয়ত সার্ভিসে চলে আসতে পারে।
তুরস্কের আরেক ইঞ্জিন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি ‘কালে আরগে’ কোম্পানি একেবারে নিজস্ব প্রযুক্তির ক্রুজ মিসাইলে ব্যবহারের উপযোগী কেটিজি-৩২০০/৩৭০০ সিরিজের ইঞ্জিন ডিজাইন ও তৈরি করে। যা ‘এ্যাটমাকা’ এবং স্টান্ড অফ ক্রুজ মিসাইলে (এসওএম) ব্যবহার করা হয়। আবার একই কোম্পানির তৈরি কেটিজি-১৭৫০ সিরিজের জেট ইঞ্জিন ব্যবহৃত হচ্ছে শর্ট রেঞ্জের ‘চাকির’ মিসাইলে। রকেটসান কোম্পানির তৈরি ২৭৫ কেজি ওজনের ‘চাকির’ ক্রুজ মিসাইলের সর্বোচ্চ রেঞ্জ ১৫০ কিলোমিটার।
তথ্যসূত্রঃ দ্য ডেইলি সাবাহ, দ্য ইউরোএশিয়ান টাইমস, ইউকীপিডিয়া।
সিরাজুর রহমান, (Sherazur Rahman), শিক্ষক ও লেখক, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সার্ভিসে এসেছে তুরস্কের তৈরি ডেডিকেটেড বায়রাখতার টিবি-২ কমব্যাট এন্ড সার্ভেল্যান্স (ইউসিএভি) ড্রোন। বাংলাদেশের আকাশে ইতোমধ্যেই এর পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন শুরু হয়ে গেছে। ব্যাটল প্রুভেন টিবি-২ কমব্যাট ড্রোন ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তার পাশাপাশি কিছুদিন আগেই নার্গানো কারাবাখে এই ড্রোন দিয়ে আর্মেনিয়ান সামরিক বাহিনীর উপর সফল এয়ার স্টাইক চালিয়েছে আজারবাইজান।
তাছাড়া চলতি ২০২৩ সালের জুন মাসের দিকে কুয়েত সরকার সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কের ড্রোন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি ‘বায়কার’ এর সাথে মোট ৩৬৭ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি সম্পন্ন করেছে। এই চুক্তিটি গত ১৩ই জুন কুয়েতের সেনাবাহিনীর টুইটার অ্যাকাউন্টে নিশ্চিত করা হয়। তার পাশাপাশি ২৮ তম দেশ হিসেবে তার্কিস বায়রাক্তার টিবি-২ কমব্যাট ড্রোন আত্মপ্রকাশ করে মধ্যপ্রাচ্যের ছোট্ট দেশ কুয়েত।
তুরস্কের বায়কার কোম্পানির তৈরি বায়রাখতার টিবি-২ কমব্যাট ড্রোন হচ্ছে একটি অ্যাডভান্স মিডিয়াম এল্টিটিউট লং এন্ডিউরেন্স (এমএএলই) কমব্যাট ড্রোন (ইউসিএভি)। যা কিনা একাধারে ইন্টেলিজেন্স, সার্ভেলেন্স, রিকর্নিসেন্স এবং তার পাশাপাশি শত্রু সীমানায় সরাসরি কমব্যাট বা অ্যাটাক মিশনে পরিচালনা করার বিশেষ উপযোগী করে ডিজাইন করা হয়েছে। এটি সর্বোচ্চ ১৮ হাজার ফিট উচ্চতায় একাধারে ২৭ ঘণ্টা পর্যন্ত কমব্যাট মিশন পরিচালনা করতে সক্ষম এবং এর গতি প্রতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২২০ কিলোমিটার।
টিবি-২ কমব্যাট ড্রোনের পে-লোড ক্ষমতা অনেকটা সীমিত হলেও এটি ১৫০ কেজি ওজন পর্যন্ত অস্ত্র ও ৪টি সিরিট মিসাইল বহন করতে পারে। এই ড্রোনের ৪টি হার্ড পয়েন্টে এন্টি-ট্যাংক এণ্ড এন্টি এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম মিসাইল, এল-ইউএমটিএএস, এমএএম-সি/এল প্রেসিসন গাইডেড মিউনিশন, রকেটসান সিরিট ৭০ এমএম মিসাইল সিস্টেমসহ গাইডেড এণ্ড আন-গাইডেড রকেট ও নিউনেশন ইনস্টল করা যায়।
তুরস্ক মূলত বিগত এক যুগ থেকেই তাদের উচ্চ প্রযুক্তির ড্রোন (ইউসিএভি) উন্নয়ন এবং ডিজাইনে ব্যাপকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তুরস্কের ‘বায়কার’ ড্রোন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে বায়রাক্তার টিবি-২ কমব্যাট ড্রোনের (ইউসিএভি) প্রথম সফল ফ্লাইট টেস্ট সম্পন্ন করে। তাছাড়া দেশটির সামরিক বাহিনী ২০১৫ সাল থেকেই এই জাতীয় ড্রোন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এবং কার্যকরভাবে ব্যবহার করে আসছে।
২০১৪ সালে প্রথম ব্যাচে ৬টি এবং ২০১৫ সালে দ্বিতীয় ব্যাচে ৬টি এই জাতীয় কমব্যাট ড্রোন সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে বায়রাক্তার টিবি-২ কমব্যাট ড্রোনের যাত্রা শুরু করে তুরস্ক। বর্তমানে তুরস্কের সামরিক বাহিনীর হাতে প্রায় দুই শতাধিকের অধিক সংখ্যক এই জাতীয় অ্যাডভান্স কমব্যাট ড্রোন অপারেশনাল রয়েছে। এদিকে তুর্কি ড্রোন ম্যানুফ্যাকচারিং জায়ান্ট বায়কার কোম্পানি সাম্প্রতিক সময়ে ক্যারিয়ার বেসড নতুন প্রজন্মের টিবি-৩ (মেরিটাইম) কমব্যাট ড্রোনের বেশকিছু সফল পরীক্ষা চালিয়েছে।
চলতি ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত তুরস্ক মোট ৩১ দেশের কাছে বায়রাখতার টিবি-২ কমব্যাট ড্রোন রপ্তানি করেছে কিংবা রপ্তানির চুক্তি সম্পন্ন করেছে। তুরস্কের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি এই জাতীয় অ্যাডভান্স কমব্যাট ড্রোন সংগ্রহ করে ইউক্রেন। ইউক্রেন গত ২০২১ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে প্রায় ৬০টির কাছাকাছি টিবি-২ কমব্যাট ড্রোন ক্রয় করে। যার একটি বড় অংশ ইতোমধ্যেই যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়া ধ্বংস করেছে।
তাছাড়া এ মুহূর্তে কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কসোভো, পোল্যান্ড, লিবিয়া, কুয়েত, বাংলাদেশ, মরক্কো, আজারবাইজানসহ আরো বেশকিছু দেশের সামরিক বাহিনী এটি অপারেট করে। তবে একক দেশ হিসেবে তুরস্কের বাহিরে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদেশ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশে সংযুক্ত আরব আমিরাত ওয়েপন্স এন্ড ট্রেনিং প্যাকেজসহ ২ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে মোট ১২০টি হাইলি অ্যাডভান্স বায়রাখতার টিবি-২ কমব্যাট এন্ড সার্ভেল্যান্স ড্রোন (ইউসিএভি) ক্রয়ের চূড়ান্ত চুক্তি সম্পন্ন করেছে কিংবা করতে যাচ্ছে।
Turkish Airlines has shown interest in procuring 355 different series of civil aircraft made by the Airbus Company at the “Dubai Air Show 2023,” running from November 13 to 17 in the United Arab Emirates. Turkey’s Turkish Airlines has almost finalized a contract for the purchase of this large number of luxury and modern passenger aircraft on the sidelines with Europe’s aviation giant Airbus Corporation. Turkey wants to increase the number of aircraft in the fleet to 800 by 2033, with the aim of building the world’s first jetliner fleet, according to the plan.
The estimated contract price may be $100 billion for 250 Airbus A-321NEO, 75 A-350-900, 15 A-350-1000, and 5 A-350F series aircraft. If this agreement is completed, Airbus Corporation will supply this aircraft with advanced technology in phases between 2026 and 2036. Turkish Airlines is also continuing discussions with Boeing Corporation of America about the purchase of more than a hundred aircraft, with the aim of bringing a total of 800 modern and luxury aircraft into service in the aircraft fleet by 2033.
According to the report “Skytrax,” published around June 2023, even though Singapore Airlines has been listed as the best airline in the world, Turkey’s Turkish Airlines is in the top 6th place. And this position is not bad at all. Especially as the best airline in Europe, Turkey’s flag carrier ‘Turkey Airlines’ won the 2022 Europe’s Best Aviation Award. Turkish Airlines won Europe’s highly respected “Oscars of the Aviation Industry” for the eighth time.90 years ago, on May 20, 1933, Turkish Airlines was founded in modern-day Turkey. Although this flag carrier of Turkey started its journey with only five very ordinary aircraft, it currently has a total of about 400 different series of ordinary and luxury passenger transport aircraft in its air fleet. As of 2022, Turkish Airlines currently operates regular flights to a total of 340 destinations in 126 countries around the world, including Turkey. Moreover, the cargo division of their fleet consists of 24 state-of-the-art product transport or cargo aircraft. With which Turkish Airlines transports goods to a total of 82 destinations.
In 2020 and 2021, Turkish Airlines suffered huge losses due to the Corona epidemic, but they overcame all limitations and achieved a huge revenue of $18.426 billion in 2022. During the same period, the airline reported operating income of $3.193 billion and net income of $2.725 billion. The total number of employees working for these airlines can be estimated to be around 40 thousand. However, due to the Corona pandemic in 2020, the income of the airlines decreased at a large rate, and the net loss was $836 million.
Sherazur Rahman, Assistant Teacher and Writer, Singra, Natore, Bangladesh. sherazbd@gmail.com
আজ থেকে প্রায় এক যুগ আগেই বিশ্বের সেরা ও প্রথম স্থানীয় ঋনগ্রস্ত দেশ হিসেবে নিজের নাম লিখিয়েছে আমেরিকা। আর এখন ২০২৩ সালে এসে নিজেকে অর্থনৈতিক দেউলিয়া বা শাটডাউনের হাত থেকে রক্ষা করতে ঋণগ্রস্ত দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণসীমার বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়ার বিল পাস করেছে দেশটির কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেট। আর এর মাধ্যমে আমেরিকা রাষ্ট্রীয়ভাবে দেউলিয়া হওয়ার হাত থেকে নিশ্চিতভাবেই এখন নিজেকে রক্ষা করল। তবে এটা ঠিক যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আজ অব্ধি ডলার বিশ্বের সকল দেশের আন্তঃবানিজ্য লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রধান মুদ্রা হিসেবে ডলার ব্যবহৃত হওয়ায় আমেরিকা কিন্তু বার বার নিজেকে দেউলিয়া হওয়া থেকে রক্ষা করে নিল।
মূলত গত ৩রা জুন বৃহস্পতিবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ঋন গ্রহণ সীমার বাধ্যবাধকতা সংক্রান্ত বিলের ওপর কংগ্রেসে প্রস্তাব আনা হয়। সেখানে কার্যত ডেমোক্র্যাট-নিয়ন্ত্রিত উচ্চ আইন পরিষদ সিনেটে ভোটাভুটি হলে তা প্রত্যাশিতভাবে আইনটি পাশ করা হয়। ১০০ আসনের সিনেটে বিলটি পাস করতে হলে ৬০ ভোটের দরকার ছিল। তবে সিনেটে ডেমোক্রেট ও রিপাবলিক উভয় দলের আইন প্রণেতাদের প্রত্যক্ষ ভোটে আইনটি পাশ করা হয়। এই ঋনসীমা উঠিয়ে নেওয়ার প্রস্তাবটির পক্ষে সিনেটে ৬৩ ভোট পড়ে এবং বিপক্ষে পড়ে ৩৬ ভোট। তবে প্রকাশ থাকে যে, চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মহামন্দা ও ভয়াবহ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের মুখে আমেরিকার জাতীয় অর্থনীতি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে ডলারের ক্রমহ্রাসমান অবনতি ও প্রভাব হ্রাসের মতো বিষয়টি দেশটির অর্থনীতিকে এক গভীর অন্ধকারের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
প্রায় ৩৩.৪৭ কোটির জনসংখ্যার দেশ আমেরিকার নমিনাল জিডিপি’র আকার ২৬.৮৫৪ ট্রিলিয়ন ডলার। জিডিপি’র আকারের দিক থেকে আমেরিকার অর্থনীতি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও প্রথম স্থানীয় দেশ। অথচ দেশটির অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋনের মোট পরিমান অবিশ্বাস্যভাবে প্রায় ৩১.০০ ট্রিলিয়ন ডলারের অধিক। আর দেশটির জিডিপি’র তুলনায় মোট ঋনের পরিমাণ কিন্তু শতকরার হিসেবে প্রায় ১১৬% হয়ে যায়। আমেরিকার অর্থনৈতিক সক্ষমতা সুবিশাল হলেও তার ব্যয়ের খাতগুলো কিন্তু মোটেও ছোট নয়। বিশেষ করে বৈশ্বিক কৌশলগত প্রভাব বিস্তার করতে আমেরিকা নির্বিচারে অর্থ্য ব্যয় করে থাকে। নিজ দেশে ও সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৫,৮০০টি সামরিক ঘাঁটি পরিচালনা, চীন ও রাশিয়াকে মোকাবেলা ও বৈশ্বিক যুদ্ধনীতি কিংবা বন্ধুভাবাপন্ন দেশকে সামরিক সহায়তা কার্যক্রম বাস্তবায়নে দেশটি চলতি ২০২৩ সালে নজিরবিহীনভাবে ৮৪২ বিলিয়ন ডলারের সামগ্রিক সামরিক ও প্রতিরক্ষা বাজেট অনুমোদন করে দেশটির বাইডেন সরকার ও কংগ্রেস।
তবে এটা ঠিক যে, সারা বিশ্ব অর্থনীতির (জিডিপি) আকারের প্রায় এক-চতুর্থাংশ নীয়ন্ত্রণ করে বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি আমেরিকা। তার চেয়ে আরো বেশি গুরুত্বপুর্ন হলো যে, সারা বিশ্বের অধিকাংশ সরকারসহ বিনিয়োগকারীরা আমেরিকান সরকারের অর্থবাজারে (treasuries) বিনিয়োগ করে। সেটা করে সরকার কর্তৃক ইস্যুকৃত ট্রেজারী বন্ড ও সরকারি ঋনপত্র ইত্যাদি ক্রয়ের মাধ্যমে। আর আমেরিকার এই ট্রেজারী বন্ড ও ঋনপত্র সবচেয়ে বেশি ক্রয় করে বাইডেন প্রশাসনকে ঋন দিয়ে রেখেছে রেড জায়ান্ট চীন। শত্রুভাবাপন্ন হওয়া সত্ত্বেও চীন খুব সম্ভবত এক ট্রিলিয়ন ডলারের অধিক বৈদেশিক ঋন বা বিনিয়োগ করেছে। আমেরিকাকে ঋন প্রদানের তালিকায় শীর্ষ স্থানে রয়েছে এশিয়ার দুই দেশ চীন ও জাপান।
আমেরিকা তার অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও ডলারকে সুকৌশলে পুঁজি করে সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এখনো পর্যন্ত আমেরিকার মুদ্রা ডলার সারা বিশ্ব রাজত্ব করে বেড়াচ্ছে। তাছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও বানিজ্যে লেনদেনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে নিরাপদ ও গ্রহণযোগ্য বিনিময় মুদ্রা হিসেবে ডলার প্রায় ৬৮% দখল করে রেখেছে। যদিও ২০০১ সালের দিকে সারা বিশ্বের দেশগুলো প্রায় ৭৩% মুদ্রা ডলারে রিজার্ভ করে রাখত। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষ করে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মহামন্দা ও ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের বিরুপ প্রভাবে আমেরিকার অর্থনীতি দেউলিয়া হতে পারে এমন গুজবে নজিরবিহীনভাবে আমেরিকার অন্যতম বৃহৎ ব্যাংক সিলিকন ভ্যালি এবং সিগনেচার ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যায়। যা ছিল আমেরিকার জাতীয় অর্থনীতির জন্য একটি আশাঙ্খাজনক বার্তা।
মনে করা হয় চলতি ২০২৩ সালের মার্চ মাস শেষে আমেরিকার বৈদেশিক ঋন ও দেনার স্থিতির পরিমাণ অবিশ্বাস্য ভাবে প্রায় ৮.৫ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে। তাছাড়া দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস হতে নেয়া ঋনের স্থিতির পরিমাণ খুব সম্ভবত প্রায় ২৩ ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি হতে পারে। তবে এই হিসেবটি যুক্তি সঙ্গত কারণেই কিছুটা কম বা বা বেশি হতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় কথা আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যয় ও দেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকার একটি বড় অংশ কিন্তু ঘুরেফিরে সেই আমেরিকারই বড় বড় অস্ত্র উৎপাদনকারী কর্পোরেশনের পকেটে চলে যায়। আমেরিকার সরকার চরম মাত্রায় ঋনগ্রস্থ হলেও সেই দেশটিতেই আবার ইলন মাস্কের মতো কিন্তু বিশ্বের আনুমানিক প্রায় ৪০% শীর্ষ ধনী বা ধনকুবের বসবাস করেন। যাদের সম্মিলিত মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি হতে পারে।
তবে আমেরিকার সবচেয়ে বাজে ও নিকৃষ্ট মানের কাজটি হচ্ছে কারণে বা অকারণে অন্য দেশের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধ আরোপ করা। এমনকি একটি দেশের পাশাপাশি সুনিদিষ্ট ব্যক্তি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের উপরও অবরোধ আরোপ করে বসে দেশটি। তাছাড়া হাইপারসনিক গতির রকেট পরীক্ষার জন্য গত ২০২২ সালে চীনের একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষকের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে মার্কিন প্রশাসন। তাই বর্তমানে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ আমেরিকার বিভিন্ন কর্মকান্ডে অনেকটাই বিরুপ ও হতাশ হয়ে ডলারের বিকল্প মুদ্রা চালু করার বিষয়ে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বিশেষ করে ব্রিকস এর আওতায় চীন, ভারত, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের নেতৃত্বে বাস্তবে মোট ৩০টি দেশ একত্রে ডলারের বিকল্প মুদ্রা ও অর্থ ব্যবস্থা চালুর বিষয়ে অনেকটাই একমত হয়েছেন। আর তাই ৩০ সদস্যের জোটটি আন্তর্জাতিকভাবে বিকল্প মুদ্রায় লেনদেন শুরু করলে ডলার কিন্তু অনেকটাই দুর্বল হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ, সৌদি, ইরান, মিশর, তুরস্ক, আর্জেন্টিনা নতুন সদস্য হিসেবে যোগ দিতে যাচ্ছে ব্রিকস জোটে। সবচেয়ে বড় কথা তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো কিন্তু সরাসরি মার্কিন চোখ রাঙ্গানি উপেক্ষা করেই ব্রিকস জোটে যোগ দিতে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। এতে করে আর যাই হোক না কেন জোটভুক্ত দেশগুলো ডলারের বিকল্প মুদ্রায় অন্তর্জাতিক বানিজ্যের পাশাপাশি তেল আমদানি-রপ্তানির বড় ধরনের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে আশা করা যায়।
লেখকঃ সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com
বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাকডোনাল ডগলাস ও বোয়িং কর্পোরেশনের তৈরি জয়েন স্টাইক এফ-১৫ ঈগল সিরিজের এডভান্স এয়ার সুপিউরিটি জেট ফাইটাকে সারা বিশ্বে মধ্যে সার্ভিসে থাকা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, হাইলি পারফর্মেন্স এবং আনস্টপেবল যুদ্ধবিমান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাছাড়া এই সিরিজের সবচেয়ে আধুনিক এফ-১৫ইএক্স সিরিজের এডভান্স মাল্টিরোল যুদ্ধবিমানের ম্যাক্সিমাম পেলোড ক্যাপাসিটি ১২ টন। যদিও পুরনো জয়েন্ট স্টাইক এফ-১৫ এর পরীক্ষিত পে-লোড ক্যাপাসিটি বা অস্ত্র বহণ করার ক্ষমতা ১০,৪০০ কেজি বা ১০.৪ টন।
The first F-15EX parks next to a F-15E Strike Eagle on the ramp at Eglin Air Force Base, Fla., after delivery 11 March, 2021. The 40th Flight Test Squadron takes possession of the EX1 in order to complete combined developmental testing of the U.S. Air Forces’ newest fighter. (U.S. Air Force photo by Staff Sgt. Joshua Hoskins)
এফ-১৫ সিরিজের যুদ্ধবিমান প্রথম সার্ভিসে আসে ১৯৭৬ সালে এবং ৪৭ বছরের সার্ভিস লাইফে মোট ১০২টি শত্রু দেশের যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার শুট ডাউন করে এক বিরল রেকর্ডের সৃষ্টি করে রেখেছে। অথচ বিশ্বের কোন দেশের যুদ্ধবিমান আজ অব্ধি একটিও এফ-১৫ যুদ্ধবিমান শুট ডাউন করতে পারেনি। যদিও অবশ্য এটি তার সমকক্ষ কোন যুদ্ধবিমানের মোকাবেলা আজ অব্ধি করেছে বলে মনে হয় না। তবে এই সিরিজের যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে সবচেয়ে বেশি কিলিং রেকর্ড গড়ে তুলেছে ইসরাইলের বিমান বাহিনী।
তবে এই যুদ্ধবিমানের নিজস্ব কিলিং রেকর্ড সকলের কাছে অনেক বেশি বলে মনে করা হলেও বাস্তবে এর অতি স্পর্শকাতর কিছু দূর্বলতা ও সমস্যা কিন্তু রয়েই গেছে। যা আমেরিকা কখনোই বিশ্বের সামনে প্রকাশ করে না। আর তা হলো এফ-১৫ যুদ্ধবিমানের নিজস্ব ক্রাস রিপোর্ট। তাছাড়া আমেরিকা নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ায় এ নিয়ে খুব বেশি তথ্য পাওয়ার সম্ভবনা এক রকম নেই বললেই চলে। যদিও এর জাতীয় যুদ্ধবিমানের সিরিজ ভেরিয়েন্টে গড়ে পার আওয়ার ফ্লাইং এন্ড মেইটেনেন্স কস্ট প্রায় ২৯ হাজার ডলারের অধিক হয়ে যেতে পারে।
ইউকীপিডিয়া ও বিভিন্ন সামরিক থিংক ট্যাংকের দেয়া তথ্যমতে, ১৯৭৬ সাল থেকে ২০১৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত মার্কিন বিমান বাহিনীর মোট ১২৩টি বিভিন্ন সিরিজের এডভান্স এফ-১৫সি/ডি ঈগল যুদ্ধবিমান নন-কমব্যাট মিশনে উড্ডয়নরত অবস্থায় নিজে নিজেই ধ্বংস বা ক্রাস হয়েছে। তাছাড়া অন্যান্য দেশের বিমান বাহিনী যেমন ইসরাইল, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সৌদি আরবের বিমান বাহিনীর আরো মোট ৫২টি এই সিরিজের যুদ্ধবিমান নন-কমব্যাট মিশনে ধ্বংস হয়। সে হিসেবে ১৯৭৬ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মোট ১৭৫টি বিভিন্ন সিরিজের হেভি এফ-১৫ যুদ্ধবিমান ক্রাস বা ধ্বংস হয়ে যায়।
আর চলতি ২০২৩ সাল পর্যন্ত সারা বিশ্বে সার্ভিসে থাকা এফ-১৫ যুদ্ধবিমানের ধ্বংসের হিসেবটি বিবেচনায় আনলে ১৯৭৬ সাল থেকে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত মোট প্রায় ১৮৮টি বিভিন্ন সিরিজের এফ-১৫ যুদ্ধবিমান নন-কমব্যাট মিশনে যুদ্ধ না করে নিজে নিজেই ক্রাস ল্যান্ডিং কিংবা আকাশেই ধ্বংস হয়ে গেছে। যদিও এর মোট সংখ্যা কিন্তু যুক্তিসঙ্গত কারণেই কিছুটা কম বা বেশি হতে পারে। তাই কফিন ফ্লাইং খ্যাত মিগ-২১ এর পরেই কফিন ফ্লাইং ভার্সন ২.০ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে আমেরিকার চতুর্থ প্রজন্মের (৪++ প্রজন্ম) এফ-১৫ সিরিজের হাইলি এডভান্স যুদ্ধবিমান।
এখানে প্রকাশ থাকে যে, বোয়িং কর্পোরেশনের তৈরি এফ-১৫ যুদ্ধবিমানের কমব্যাট কিলিং রেকর্ড এ পর্যন্ত মোট প্রায় ১০২টি হলেও তা কিন্তু অধিকাংশি একেবারেই নিম্ন মানের দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের বিরুদ্ধে এই রেকর্ড গড়ে তুলেছে। আসলে এফ-১৫ যুদ্ধবিমানের সমকক্ষ যুদ্ধবিমান যেমন এসইউ-৩৫, এসইউ-৩০, রাফায়েল ও ইউরোফাইটার তাইফুনের মতো এডভান্স যুদ্ধবিমানের বিরুদ্ধে কখনই কিন্তু আকাশ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়নি কিংবা ব্যবহারের সুযোগ পায়নি এই জয়েন স্টাইক খ্যাত এফ-১৫ ঈগল ফাইটার জেট। তবে লো ক্রাস রিপোর্ট এন্ড লো মেইনটেনেন্স কস্টের বিচারে বিশ্বের মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে নির্ভর যোগ্য এবং আধুনিক মান সম্পন্ন যুদ্ধবিমান হচ্ছে ফ্রান্সের তৈরি রাফায়েল টুইন ইঞ্জিন ফাইটার জেট।
চলতি ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসটি ছিল ইউক্রেনের জন্য এক ভয়াবহ রকমের বিপর্যয়ের সময়। গত এপ্রিল মাস থেকে আজ অব্ধি ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী নজিরবিহীনভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা দপ্তরের দেয়া তথ্যমতে, গত এপ্রিল মাসে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর প্রায় ১৫ হাজারের অধিক সেনা হতাহত হয়েছে। তার পাশাপাশি একই সময়ে ইউক্রেনের ৮টি যুদ্ধবিমান, প্রায় তিন শতাধিক কমব্যাট ড্রোন ও তার পাশাপাশি ৪৩০টি ট্যাংক ও সামরিক যান ধ্বংস করেছে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী।
যদিও রাশিয়া কিন্তু যুদ্ধের শুরুর পর থেকে আজ অব্ধি নিজেদের ঠিক কতজন সেনা হতাহত হয়েছে এবং তাদের সামরিক ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে কোন ধরনের সঠিক তথ্য উপাত্ত বিশ্ব মিডিয়ার সামনে উপস্থাপন করেনি। পশ্চিমা মিডিয়ার দেয়া তথ্যমতে, যুদ্ধের শুরু থেকে এখনো পর্যন্ত রাশিয়ার প্রায় লক্ষাধিক সেনা হতাহত হয়েছে। এদিকে রাশিয়ার দেয়া তথ্যমতে, গত ২০২২ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি থেকে আর এখন কিনা এই সামরিক আগ্রাসনে প্রথম বারের মতো টিইউ-১৬০ স্ট্যাটিজিক হেভি বোম্বার মোতায়েন করেছে রাশিয়া। মূলত গত ১লা মে খুব সকালে রাশিয়ার বিমান বাহিনীর ৯টি টিইউ-৯৫ বিয়ার এবং ২টি টিইউ-১৬০ হেভি স্ট্যাটিজিক বোম্বার ইউক্রেনে বড় ধরনের মিসাইল হামলায় অংশ নেয়।
সাম্প্রতিকতম সময়ে ইউক্রেনে রাশিয়ার বিমান বাহিনীর হেভি বোম্বার বিমান থেকে মোট ১৮টি নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড ক্যাপবল সভিয়েত আমলের কেএইচ-১০১/ কেএইচ-৫৫৫ ক্রুজ মিসাইল ফায়ার করে। তবে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর দেয়া ভাষ্যমতে, তাদের নিজস্ব এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম মোট ১৫টি মিসাইল আকাশেই ধ্বংস করেছে এবং মাত্র ৩টি টার্গেটে আঘাত করেছে। এটিই ছিল আসলে রাশিয়ার টিইউ-১৬০ হেভি স্ট্যাটিজিক বোম্বারের সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ।
তবে সবচেয়ে আশাঙ্খাজনক খবর হচ্ছে যে, যুদ্ধের ভয়াবহতা ধীরে ধীরে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিণতি বা নিউক্লিয়ার ওয়ারের দিকে যাচ্ছে, তাও বেশ স্পষ্ট করেই মিডিয়ায় জানিয়ে দিয়েছেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ‘সার্গেই ল্যাভরভ’। রাশিয়ার সীমানায় সার্বভৌমত্বে আঘাত আসলেই যে কোন দেশের উপর আগাম ঘোষণা না দিয়েই নিউক হামলা করতে মোটেও দ্বিতীয় বার ভাববে না দেশটির সামরিক বাহিনী। এদিকে রাশিয়ার হুমকিকে আমলে নিয়ে আমেরিকা ও তার নেতৃত্বে ন্যাটো জোট নিউক্লিয়ার এন্ড থার্মোনিউক্লিয়ার যুদ্ধের ঝুঁকি মোকাবেলায় এক রকম নিরবেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিয়েছে।
আর এই চীরশত্রু দুই শিবিরের পাল্টাপাল্টি ভয়ঙ্কর রণ হুংকার ও যুদ্ধ প্রস্তুতি কিন্তু সারা বিশ্বের অস্তিত্বের জন্য এক চরম হুমকি ও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ আলামত হিসেবে মনে করেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সামরিক বিশ্লেষকেরা। আর রাশিয়া কিন্তু এখন এক রকম প্রকাশ্যেই ইউক্রেনকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে হলেও নিজ দখলে নেওয়ার হুমকি দিয়ে রেখেছে। যা আসলে স্পর্ষ্টভাবেই অদূর ভবিষ্যতে মানচিত্র থেকে দেশটির চিহ্ন একেবারেই মুছে যাওয়ার মতো ভয়াবহ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আর তার সাথে অত্র অঞ্চলে মারা যেতে পারে প্রায় কোটির কাছাকাছি হতভাগ্য সাধারন মানুষ। যাদের সাথে কিনা যুদ্ধের কোনই সম্পর্ক নেই এবং তারা এখনো পর্যন্ত হয়ত জানেই না যে, এই দীর্ঘ মেয়াদী ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ কেন চলছে।
কিছুদিন থেকে রাশিয়া যে ধরনের কনভেনশনাল ওয়ারহেড দ্বারা মিসাইল ফায়ার করে যাচ্ছে তা আসলে কিন্তু সভিয়েত আমলের তৈরি নিউক্লিয়ার এন্ড থার্মোনিউক্লিয়ার ওয়ারহেড ক্যাপবল মিসাইল ওয়েপন্স সিস্টেম। যা দিয়ে যে কোন মুহুর্তেই নিউক্লিয়ার ওয়ার শুরু করে দিতে পারে রাশিয়া। মনে করা হয় রাশিয়ার অস্ত্র ভান্ডারে এখনো পর্যন্ত প্রায় তিন থেকে পাঁচ হাজারের কাছাকাছি বা অধিক সংখ্যক এই জাতীয় ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জের ব্যালেস্টিক এন্ড ক্রুজ মিসাইলের বিশাল ভান্ডার রয়েছে। যদিও ১৯৯১ সালের দিকে ইউক্রেনের অস্ত্র ভান্ডারে প্রায় দুই হাজারের কাছাকাছি একই জাতীয় মিসাইলের বিশাল মজুত ছিল।
নব্বই এর দশকে ভীতিজনক কোল্ড ওয়ার যুগের অবসান ঘটিয়ে ১৯৯১ সালে সভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে মোট ১৫টি নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। তার মধ্যে সভিয়েত ইউনিয়নের হাতে থাকা প্রায় ১২ হাজারের কাছাকাছি নিউক্লিয়ার অস্ত্রের বেশির ভাগ রাশিয়া ও ইউক্রেনের হাতে থেকে যায়। আর স্বাধীনতা লাভের পর ইউক্রেনের হাতে প্রায় ২ হাজারের কাছাকাছি নিউক্লিয়ার অস্ত্র, ১৭৬টি ইন্টারকন্টিন্যান্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল, ৪৪টি স্ট্যাটিজিক হেভি বোম্বার, আনুমানিক প্রায় দুই থেকে তিন হাজারের কাছাকাছি শর্ট এন্ড ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জের ব্যালেস্টিক এন্ড ক্রুজ মিসাইলের বিশাল মজুত ছিল। তার সাথে শতাধিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, হাজার হাজার ট্যাংক ও আর্টিলারী সিস্টেম থেকে যায় কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ইউক্রেনের হাতে।
তবে নিজেকে শান্তিপ্রিয় ও ঝামেলামুক্ত দেশ হিসেবে বিশ্বের সামনে প্রমান করতে গিয়ে ইউক্রেন পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যেই রাশিয়া, আমেরিকা ও জাতিসংঘের সাথে চুক্তি করে সকল ধরনের নিউক্লিয়ার ওয়েপন্স, আইসিবিএম ও হেভি বোম্বার ধ্বংস কিংবা রাশিয়ার কাছে হস্তান্তর করে দেয়। তাছাড়া হাজার হাজার অমূল্য ডিফেন্স সিস্টেম খোলা আকাশের নিচে অবহেলায় পড়ে থেকে জং ধরে নষ্ট ও অকেজো হয়ে যায়। এদিকে ইউক্রেনের কাছে থেকে যায় সভিয়েত আমলের (অসমাপ্ত নির্মাণাধীন) ৬০ হাজার টন ওজনের একটি হেভি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার। যা পরবর্তীতে ইউক্রেন ব্লুপ্রিন্ট ও অন্যান্য ডুকুমেন্টসহ একেবারেই পানির দামে (খুব সম্ভবত ৮০ থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার) চীনের কাছে বিক্রি করে দেয় ইউক্রেন সরকার।
অথচ এদিকে সুচতুর রাশিয়া কিন্তু শত বাধা ও সমস্যার মধ্যেও তার হাতে থাকা সকল নিউক্লিয়ার ওয়েপন্সসহ ডিফেন্স সিস্টেম অত্যন্ত যত্ন করেই সংরক্ষণ করে রেখেছে এবং বর্তমান যুদ্ধে রাশিয়া যত অস্ত্র ও মিসাইল ব্যবহার করছে তার ৮০% পর্যন্ত কিন্তু সেই আবার কিনা সভিয়েত আমলের তৈরি অস্ত্র ও সামরিক সাজ সরঞ্জাম। যা হোক এটা সত্য যে, অতি উন্নত ও শান্তিপ্রিয় দেশ হিসেবে নিজেকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে গিয়ে নিজস্ব প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বজায় রাখাকে এক রকম অবজ্ঞা করে ইউক্রেন তার নিজস্ব স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে পরোক্ষভাবে হলেও নিজেই কিন্তু আজ ধ্বংসের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে।
তবে এটা ঠিক যে, প্রযুক্তিগত অক্ষমতা ও কিছু যুক্তিসঙ্গত কারণেই ইউক্রেনের হাতে থাকা নিউক্লিয়ার ওয়েপন্সগুলো ডিকোডিং করে এক্টিভ করার কোন সুযোগ ছিল না। তাছাড়া যুগের পর যুগ এসব অপ্রচলিত ভয়ঙ্কর অস্ত্র সংরক্ষণ করার প্রযুক্তিগত কোন সক্ষমতাও নেই ইউক্রেনের। তাই দেশটির হাতে থাকা প্রায় দুই হাজারের কাছাকাছি নিউক্লিয়ার ওয়েপন্স ও ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল ধ্বংস করে দেয়াটা অনেকটাই সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল বলে মনে করা হয়। তবে তাদের হাতে থাকা হাজার হাজার শর্ট এন্ড ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জের ব্যালেস্টিক ও ক্রুজ মিসাইল একেবারে ধ্বংস কিংবা রাশিয়ার হাতে তুলে দেয়াটা ছিল চরম মাত্রায় একটি ভূল সিদ্ধান্ত। ইউক্রেন সব সময় মনে করে এসেছে যে, রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে তার বন্ধু আমেরিকাও তার ন্যাটো জোট রক্ষা করবে। তবে আমেরিকা কিন্তু ঠিকই এই যুদ্ধকে ঘিরে শত বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বানিজ্য হাতিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনের হাতে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র তুলে দিলেও সরাসরি নিজেদের কখনোই যুদ্ধে জড়াবে বলে মনে হয় না।
এদিকে ইউক্রেনের দ্বায়িত্বহীনতার জন্য হাজার হাজার ট্যাংক ও আর্টিলারি সিস্টেম খোলা আকাশের নিচে কয়েক যুগ ধরে পড়ে থেকে ও জং ধরে অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া ইউক্রেনের কাছে থাকা সভিয়েত ইউনিয়নের একটি প্রায় ৬০ হাজার টন ওজনের অসমাপ্ত নির্মাণাধীন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার একেবারে পানির দামে চীনের কাছে বিক্রি করে দেয় এবং তাদের ট্যাংক বহরে থাকা ৩২০টি টি-৮০ মেইন ব্যাটল ট্যাংক পাকিস্তানের কাছে বিক্রি করেছিল। এভাবে নিজস্ব নিরাপত্তা বিষয়টিকে গুরুত্বহীন মনে করে হাতে থাকা অমূল্য সামরিক সাজ সরঞ্জাম বিক্রি করে নগত অর্থ আয় করতে থাকে ইউক্রেন সরকার। এখানে মনে রাখতে হবে রাশিয়া বা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি চরম মাত্রায় আগ্রাসী ও সাম্রাজ্যবাদী দেশ হিসেবে বিগত এক শতাব্দী থেকে টিকে রয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশের সাথে সম্পর্ক খারপ হলেই দেশটির উপর সামরিক আগ্রাসন চালাতে দ্বিতীয় বার ভাবে না দেশটি। তাছাড়া রাশিয়ার পাশে অবস্থানরত অধিকাংশ ছোট দেশ রাশিয়ার সাথে সমঝোতা করে টিকে রয়েছে ও দেশটিকে জমের মতো ভয় করে। অন্তত অতীত ইতিহাস রাশিয়া সম্পর্কে তাই বলে।
প্রথম দিকে রাশিয়ার সাথে ভালো সম্পর্ক থাকলেও স্বাধীনতার এক দশক পর থেকে পশ্চিমা বিশ্বের দিকে অতি মাত্রায় ঝুঁকে যাওয়ার জন্য রাশিয়ার সাথে সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটতে থাকে ইউক্রেনের। যার ফলস্রুতিতে রাশিয়া ২০১৩-১৪ সালের দিকে সরাসরি সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া অঞ্চল দখল করে নিলেও তাতেও ইউক্রেনের হুশ ফেরে না। রাশিয়ার অদূর ভবিষ্যতে আবারো ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন চালাতে পারে এমন আশাঙ্খা প্রবল হলেও ইউক্রেন কিন্তু তার সামরিক ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সেভাবে আধুনিকায়ন করেনি বয়া তা করার খুব একটা চেষ্টা করেছে বলে মনে হয় না। আর কিছু না হোক ২০১৫ সালের দিক থেকে পর্যায়ক্রমে আমেরিকা থেকে ৫০-৬০টি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ক্রয় বা সংগ্রহ করার যথেষ্ঠ সুযোগ থাকলেও তা মোটেও কাজে লাগায় নি ইউক্রেন সরকার। অন্তত পক্ষে সভিয়েত আমলের পুরনো হাজারের অধিক শর্ট এন্ড ব্যালেস্টিক মিসাইল সংরক্ষণ ও তার পাশাপাশি প্রায় ৬০টি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান হাতে থাকলে আজ রাশিয়া কিন্তু কোন ভাবেই এই সামরিক আগ্রাসন চালাতে পারত না। আর এখন কিন্তু এই ইউক্রেন যুদ্ধ সারাবিশ্বকে আস্তে আস্তে ভয়াবহ পরমাণু ও বিশ্বযুদ্ধের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক এবং লেখক, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com
বিগত প্রায় ছয় দশক থেকে সারাবিশ্বে বৈদেশিক বাণিজ্যের অন্যতম লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয় আমেরিকার মুদ্রা ডলার। ডলার মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ধীরে ধীরে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। তবে বৈদেশিক লেনদেনে প্রধান মুদ্রা ডলার হলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নতুন এক বৈশ্বিক অর্থ ব্যবস্থাপনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এখন ডলারের প্রভাব অনেকটাই হ্রাস পেয়ে তার বিপরীতে চীনের মুদ্রা ইউয়ান ও রাশিয়ার মুদ্রা রুবল শক্তিশালী হতে শুরু করেছে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশই নিজেদের মুদ্রায় অন্তর্জাতিক লেনদেন করার বিষয়ে সচেতন হচ্ছে। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে চীনের মুদ্রা ইউয়ান অত্যন্ত দ্রুত গতিতে তার শক্তিশালী অবস্থান জানান দিচ্ছে।
আসলে পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক পরিস্থিতির বিবেচনায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে শুধুমাত্র একটি মাত্র মুদ্রাকে বেছে নেয়ার আর কোন সুযোগ থাকে না। প্রয়োজনে আমেরিকার মুদ্রা ডলারের পাশাপাশি চীনের নিজস্ব মুদ্রা ইউয়ান, রাশিয়ার মুদ্রা রুবল, জাপানিজ মুদ্রা ইয়েন, ভারতের মুদ্রা রুপি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মুদ্রা ইউরোকে সমান গুরুত্ব দিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে প্রচলন করাটা এখন কিনা সময়ের দাবি হয়ে দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক থিংক ট্যাংকের দেয়া তথ্যমতে, ডলার এখন মোট বৈশ্বিক মুদ্রার রিজার্ভের ৫৮% প্রতিনিধিত্ব করে এবং যা ২০০১ সালে যা ছিল ৭৩%।
এদিকে বৈদেশিক লেনদেনে ডলারের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য দেশের মুদ্রা আন্তর্জাতিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণ ও আন্তঃবানিজ্য লেনদেনে নিজস্ব দেশীয় মুদ্রার ব্যবহারে যথেষ্ট সচেতন হচ্ছে বিশ্বের প্রথম সারির অধিকাংশ দেশ। বিশেষ করে সৌদি আরব এবং ব্রাজিলের মতো দেশআ কিন্তু ইতোমধ্যেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ডলারের পাশাপাশি ইউয়ান ও ইউরোতে সংরক্ষণ শুরু করে দিয়েছে এবং আন্তঃবানিজ্য লেনদেনের ক্ষেত্রে দেশগুলোর সেন্ট্রাল ব্যাংক নিজস্ব দেশীয় মুদ্রার বিনিময় ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে যাচ্ছে।
বর্তমানে চলমান আমদানি রপ্তানি বানিজ্য ও আন্তর্জাতিক লেনদেনে ডলারের প্রাধান্যকে খারিজ করতে নতুন পদক্ষেপ নিয়েছে চীন ও ব্রাজিল। ডলারের লেনদেন পরিহার করে চীন ও ব্রাজিলের সেন্ট্রাল ব্যাংক নিজস্ব মুদ্রায় আন্তঃবানিজ্য করার জন্য একটি চুক্তি সম্পন্ন করেছে। যার আওতায় বর্তমানে ব্রাজিলের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ মুদ্রা হিসেবে চীনের মুদ্রা ইউয়ানকে প্রতিস্থাপন করেছে। চলতি ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস শেষে ব্রাজিলের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২৯৭.৩ বিলিয়ন ডলার। আর গত ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাস শেষে ব্রাজিলের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের মধ্যে মার্কিন ডলার ছিল ৮০.৪%, চীনের ইউয়ান ছিল ৫.৩৭% এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মুদ্রা ইউরো ছিল ৪.৭৪%।
আসলে কিছুটা ধীরে হলেও রেড জায়ান্ট চীনের নিজস্ব মুদ্রা ইউয়ান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে দিয়েছে। কারো কাছে ভালো লাগুক আর নাই বা লাগুক চীন কিন্তু এক বিংশ শতাব্দীর এক শীর্ষ স্থানীয় ইকোনমিক সুপার পাওয়ার দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ২০২২ সালে চীনের বৈদেশিক বানিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ৬.৩ ট্রিলিয়ন ডলার এবং দেশটি আসলে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক বানিজ্যের দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। অবশ্য একই সময়ে ভারতের বৈদেশিক বানিজ্যের পরিমাণ ছিল ১.১৭ ট্রিলিয়ন ডলার এবং আমেরিকার বৈদেশিক বানিজ্যের পরিমাণ ছিল ৫.৩৬ ট্রিলিয়ন ডলার।
বর্তমানে ব্রাজিলের পাশাপাশি রাশিয়া ও সৌদি আরবের মতো দেশ চীনের সাথে আমদানি রপ্তানি বানিজ্যে নিজস্ব দেশীয় মুদ্রায় লেনদেন করতে সম্মত হয়েছে। তাছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ হিসেবে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাংলাদেশ এবং ইসরায়েল পর্যন্ত চীনের মুদ্রা ইউয়ান সংরক্ষণের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে।
এদিকে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের নিজস্ব মুদ্রা রুপি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার শক্তিশালী অবস্থান জানান দিচ্ছে। বিশেষ করে বতসোয়ানা, ফিজি, জার্মানি, গায়ানা, ইসরায়েল, কেনিয়া, মালয়েশিয়া, মরিশাস, মায়ানমার, নিউজিল্যান্ড, ওমান, রাশিয়া, সেশেলস, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, তানজানিয়া, উগান্ডা,ইংল্যান্ডসহ আরও কিছু দেশ আন্তঃবানিজ্য লেনদেনের ক্ষেত্রে রুপিতে বানিজ্য করতে প্রবল আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
বর্তমানে সারা বিশ্বের আন্তর্জাতিক বানিজ্য ও লেনদেনের ক্ষেত্রে যে একটি দেশের কারেন্সির একচ্ছত্র অধিপত্য রয়েছে তা বিশ্বশান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য বড় ধরণের বাধা হয়ে থেকেই যাচ্ছে। বিশেষ করে উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বৃটিশ মুদ্রা পাউন্ড সারাবিশ্বে রাজত্ব কায়েম করেছিল। যা বর্তমানে আমেরিকার কারেন্সি ডলার করছে এবং আগামীতে হয়ত অন্য কোন দেশের মুদ্রা একচ্ছত্র রাজত্ব করবে। তাই বিশ্বের দেশগুলোকে একত্রিত হয়ে আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে একটি দেশের কারেন্সিকে আন্তর্জাতিক লেনদেনের একক আদর্শ হিসেবে না নিয়ে কমপক্ষে ৫ থেকে ৬টি দেশের শক্তিশালী মুদ্রাকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে অবাধ প্রচলনের বিষয়টিকে নিশ্চিত করা ও আন্তঃবানিজ্য লেনদেনে নিজস্ব দেশীয় মুদ্রার ব্যবহারে সচেতন হওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু হয়ে দেখা দিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে রকেট ডিজাইন ও ইঞ্জিনিয়ারিং এ একের পর এক চমক সৃষ্টি করে যাচ্ছে রেড জায়ান্ট চীন। বর্তমানে মহাকাশ ভিত্তিক নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন, তৈরি ও গবেষণায় সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রবল প্রতিযোগিতা শুরু করে করেছে দেশটি। যারই ধারাবাহিকতায় এবার চীনের একটি বেসরকারি অ্যারোস্পেস কোম্পানি কয়লা ভিত্তিক তরল জ্বালানী ব্যবহার করে এই প্রথমবারের মতো মহাকাশে নতুন প্রজন্মের রকেট উৎক্ষেপণ করেছে।
যা বিশ্বের প্রথম ব্যবহারকারী দেশ হিসেবে সারাবিশ্বকে পথ দেখাচ্ছে চীন। কয়লা ভিত্তিক তরল জ্বালানি নির্ভর রকেটটি অতি সাম্প্রতিক সময়ে চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় চিউকুয়ান স্যাটেলাইট লঞ্চড প্যাড থেকে সফলভাবে মহাকাশে পাঠানো হয়।
শুধু কি তাই চাঁদের উল্টো যে পাশে সূর্যের আলো পড়েনা সেখানে ল্যান্ডার নামিয়েছে চীন ও মঙ্গলগ্রহে আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা’র পাশাপাশি একেবারে নিজের মতো করে মিশন পরিচালনা করে রাশিয়া, জাপান ও গোটা ইউরোপকে অনেক আগেই ছাপিয়ে গেছে। তাছাড়া বর্তমানে বিশ্বের কোন একক দেশ হিসেবে মহাকাশে নিজস্ব প্রযুক্তির স্পেস স্টেশন স্থাপন করে মহাকাশ ভিত্তিক প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও উন্নয়নের নতুন এক নজির সৃষ্টি করেছে চীন।
এদিকে আমেরিকা ও সভিয়েত ইউনিয়নের পাশাপাশি ১৯৬০ সালের দিকে মহাকাশ জয়ের রকেট প্রজেক্ট নিয়ে চীন সীমিত পরিসরে গবেষণা শুরু করলেও একেবারে নিজস্ব প্রযুক্তির স্পেস অবজেক্ট বা স্যাটালাইট সার্ভিসে আনতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় । চীন কার্যত ১৯৭৫ সালে তাদের নিজস্ব প্রযুক্তির লিকুইড ফুয়েল চালিত ডিএফ-৫ লং রেঞ্জের হেভী রকেট (আইসিবিএম) সিস্টেম ব্যবহার করে আকাশে স্যাটালাইট প্রেরণ করে মহাকাশ জয়ের শুভ সূচনা করে।
তবে চীন কিন্তু তার অনেক আগেই ২৪শে এপ্রিল ১৯৭০ সালেই লং মার্চ-১ রকেটের সাহায্যে ১৭৩ কেজি ওজনের ডং ফেং হং-১ কমিউনিকেশন স্যাটালাইট প্রথম বার পৃথিবীর লো আর্থ অর্বিটে স্থাপন করে চীনা জাতির এক নতুন ইতিহাস রচনা করেছিল। এখন কিনা সেই চীন বিশ্বের সব দেশকে ছাপিয়ে মহাকাশে একেবারে নিজস্ব প্রযুক্তির ‘তিয়ানগং’ স্পেস স্টেশন স্থাপন করে সারাবিশ্বকে চমকে দিয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন থেকে অনেকটা ছোট আকারের হলেও ৯৬ হাজার কেজি ওজনের চীনের ‘তিয়ানগং’ স্পেস স্টেশন মহাকাশ গবেষণার জন্য চালু করা হলেও আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে একটি পরিপূর্ণ স্পেস স্টেশন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। আর এবার কিনা রকেট জ্বালানির নতুন এক ‘কয়লা ভিত্তিক তরল জ্বালানি’ কনসেপ্ট বিশ্বের সামনে উন্মোচন করল রেড জায়ান্ট চীন।
তাছাড়া গত বছর চীনের নর্থওয়েস্টার্ন পলিটেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির সম্মানিত গবেষক এবং শিক্ষার্থীরা যৌথভাবে একটি একেবারে নতুন প্রযুক্তির হাইপারসনিক রকেট মিসাইল ডিজাইন ও তৈরি করে মহাকাশে পাঠিয়েছিল। ফাইটান-১ নামক এই রকেট সিস্টেমটি গতি ম্যাক ৫+ এর অধিক গতিতে তার প্রথম টেস্ট ফ্লাইট সফলভাবে সম্পন্ন করেছে। এটি ছিল আসলে রকেট এবং স্ক্যামজেট বা এয়ার ব্রিদিং ইঞ্জিন এর সমন্বয়ে ডিজাইন করা নতুন প্রযুক্তির এক হাইপারসনিক রকেট বা মিসাইল সিস্টেম। যাতে জ্বালানি হিসেবে সাধারণ কেরোসিন ব্যবহার করা হয়। তবে সবচেয়ে মজার বিষয় হলো যে, এই রকেট পরীক্ষা করার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন চীনের নর্থওয়েস্টার্ন পলিটেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির উপর নিষেধাজ্ঞা বা অবরোধ আরোপ করে দেয়। যদিও আমেরিকার এই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবে কোন কাজের ছিল না।
তুরস্কের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত এভিয়নিক্স ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি তার্কিস অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ (টিএআই) এর সিইও ড. তেমিল জানিয়েছেন যে, পাকিস্তানের সাথে নতুন করে ৩০টি’র অধিক টি-১২৯ (এটিএকে) এডভান্স এ্যাটাক হেলিকপ্টার রপ্তানি চুক্তির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শেষ করা হয়েছে। যা আগের আমেরিকার হানিওয়েল টার্বোশ্যাফট ইঞ্জিনের পরিবর্তে নিজস্ব প্রযুক্তির ইঞ্জিন কিংবা অন্য কোন দেশের (ইউক্রেন) তৈরি হেলিকপ্টার ইঞ্জিন ব্যবহার করে পাকিস্তানে রপ্তানি করা হবে কিংবা এর বিকল্প হিসেবে পাকিস্তানের কাছে নতুন প্রজন্মের এটিএকে-২ হেভি গানশীপ রপ্তানি করা হতে পারে।
যদিও গত ২০২১ সালের শেষের দিকে মার্কিন প্রশাসনের বাধা ও নিষেধাজ্ঞার ফলে পাকিস্তানে ১.৫ বিলিয়ন ডলারের ৩০টি তুর্কী টি-১২৯ কমব্যাট হেলিকপ্টার রপ্তানির প্রক্রিয়াটি বাতিল হয়ে যায়। আমেরিকা সাফ জানিয়ে দেয় যে, চুক্তি অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি অত্যাধুনিক হানিওয়েল টি-৮০০-৪এ টার্বোশেফট ইঞ্জিন সজ্জিত টি-১২৯ কমব্যাট হেলিকপ্টার তাদের অনুমোদন বা লাইসেন্স ছাড়া পাকিস্তানের কাছে সরবরাহ করা যাবে না। আমেরিকার আশাঙ্কা করে যে, পাকিস্তানের কাছে তাদের ইঞ্জিন সজ্জিত টি-১২৯ কমব্যাট হেলিকপ্টার দেয়া হলে তা অদূর ভবিষ্যতে এর প্রযুক্তি চীনের হাতে চলে যেতে পারে। আবার হয়ত ভারতের গোপন কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে আমেরিকা এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারে।
তাই তুরস্ক এবার খুব সম্ভবত তার নিজস্ব প্রযুক্তির তৈরি ১,৪০০ হর্স পাওয়ারের টিইআই টিএস-১৪০০ টার্বোশেফট হেলিকপ্টার ইঞ্জিন ইনস্টল করে টি-১২৯ (এটিএকে) কমব্যাট হেলিকপ্টার রপ্তানি চুক্তিটি নতুন করে সম্পন্ন করেছে। বর্তমানে এই হেলিকপ্টারটি তুরস্কের পাশাপাশি ফিলিপাইন্স অপারেট করে। ইউরোপীয় স্টান্ডার্ড এ তৈরিকৃত এই টি-১২৯ (এটিএকে) লাইট কমব্যাট চপারটিকে বর্তমানে সার্ভিসে থাকা বিশ্বের সেরা একটি লাইট এ্যাটাক হেলিকপ্টার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
তুরস্কের টার্কিস এ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিক (টিএআই) এর নিজস্ব প্রযুক্তির তৈরি টি-১২৯ ট্যাক্টিক্যাল রিকর্নিসেন্স এণ্ড এ্যাটাক হেলিকপ্টারটি ইতালিয়ান আগস্টা-১২৯ এট্যাক হেলিকপ্টার এর উপর ভিত্তি করে ডিজাইন ও তৈরি করা হলেও এটিকে আরো অত্যাধুনিক অস্ত্র, প্রযুক্তি ও নতুন প্রজন্মের এভিয়নিক্স সিস্টেম দ্বারা সজ্জিত করা হয়েছে। এটি সর্ব প্রথম আকাশে ওড়ে ২৪শে সেপ্টেম্বর ২০০৯ সালে এবং তার পাশাপাশি তুরস্কের সামরিক বাহিনীতে প্রথম সার্ভিসে আসে ২০১৪ সালে। টার্কিস অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ (টিএআই) ২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত মোট ৭৬টি টি-১২৯ চপার তৈরি করেছে এবং তুরস্কের সামরিক বাহিনীর হাতে বর্তমানে মোট ৬৫টি এই জাতীয় হাইলী এভভান্স এ্যাটাক চপার তুলে দিয়েছে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক ক্রেতা দেশ হিসেবে ফিলিপিন্স ৬টি এই জাতীয় এডভান্স এ্যাটাক হেলিকপ্টার অপারেট করে।
দুইজন ক্রু দ্বারা চালিত এই এ্যাটাক হেলিকপ্টারের দৈর্ঘ্য ১৪.৫৪ মিটার এবং উচ্চতা ৩.৪ মিটার। এর ম্যাক্সিমাম টেকঅফ ওয়েট ৫,০৫৬ কেজি এবং ম্যাক্সিমাম স্পীড প্রতি ঘন্টায় ২৮১ কিলোমিটার। এর রেঞ্জ ৫৩৭ কিলোমিটার এবং ফেরিরেঞ্জ ১,০০০ কিলোমিটার। এটি যে কোন প্রতিকূল আবহাওয়ায় ও পরিবেশে আকাশে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ফিট উচ্চতায় উঠতে পারে এবং এটি একটানা ৩ ঘন্টা পর্যন্ত আকাশে কমব্যাট মিশন পরিচালনা করতে সক্ষম। তাছাড়া আকাশে সাবলীলভাবে উড্ডয়ন করার জন্য এই হেলিকপ্টারে ২টি অত্যন্ত শক্তিশালী হানিওয়েল টি-৮০০-৪এ টার্বোশেফট মাউন্টেন্ড ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে।
এর প্রধান অস্ত্র হিসেবে একটি ২০ এমএম রোটারি ক্যানন ইনস্টলেশন করা হয়েছে। যা কিনা তিনটি ব্যারেলে মোট ৫০০ রাউন্ড গুলি ফায়ার করতে পারে। তাছাড়া এর ৪টি হার্ড পয়েন্টে সর্বোচ্চ ১,২০০ কেজি পর্যন্ত বিভিন্ন ধরণের আনগাইডেড রকেট ও মিসাইল বহণ করতে পারে। এটি ৪টি পডে মোট ৭৬টি আনগাইডেড রকেট বহণ করার পাশাপাশি ৮টি গাইডেড এন্টি ট্যাংক মিসাইল, ১৬টি রকেটসানের তৈরি সিরিট গাইডেড মিসাইল এবং ৮টি সর্ট রেঞ্জের এয়ার টু এয়ার স্টিংগার মিসাইল বহণ করতে পারে। তাছাড়া এটি প্রতি ২৯৪ কেজি ওজনের ২টি ড্রপ ট্যাংক বহণ করে।
এই এ্যাটাক হেলিকপ্টারের এডভান্স এভিয়নিক্স সিস্টেম হিসেবে তার্কিস এ্যাসেলসান কোম্পানির তৈরি এএসইএলএফএলআইআর-৩০০টি ইলেক্ট্রো অপটিক্যাল এফএলআইআর সিস্টেম ইন্সটল করা হয়েছে। তাছাড়া কাউন্টারমেজারস হিসেবে এটিতে কাউন্টারমেজার ডিসপেন্সিং সিস্টেম, একটি মিসাইল ওয়ার্নিং সিস্টেম, একটি লেজার ওয়ার্নিং সিস্টেম, একটি রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি জ্যামার, একটি রাডার ওয়ার্নিং রিসিভার (আরডাব্লিউআর), ইনফ্রা-রেড কাউন্টারমেজারসবং একটি সুইট কন্ট্রোল প্রোসেসিং সিস্টেম (এসসিপিএস) ইনস্টল করা হয়েছে। তাছাড়া সর্বোশেষ সংযোজন হিসাবে এতে ১২ কিলোমিটার রেঞ্জের মিলডার মিলিমিটার ওয়েব রাডার ব্যবহার করা হচ্ছে।
সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman) সহকারী শিক্ষক ও লেখক, গ্রামঃ ছোট চৌগ্রাম, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com