
বিগত প্রায় ছয় দশক থেকে সারাবিশ্বে বৈদেশিক বাণিজ্যের অন্যতম লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয় আমেরিকার মুদ্রা ডলার। ডলার মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ধীরে ধীরে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। তবে বৈদেশিক লেনদেনে প্রধান মুদ্রা ডলার হলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নতুন এক বৈশ্বিক অর্থ ব্যবস্থাপনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এখন ডলারের প্রভাব অনেকটাই হ্রাস পেয়ে তার বিপরীতে চীনের মুদ্রা ইউয়ান ও রাশিয়ার মুদ্রা রুবল শক্তিশালী হতে শুরু করেছে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশই নিজেদের মুদ্রায় অন্তর্জাতিক লেনদেন করার বিষয়ে সচেতন হচ্ছে। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে চীনের মুদ্রা ইউয়ান অত্যন্ত দ্রুত গতিতে তার শক্তিশালী অবস্থান জানান দিচ্ছে।
আসলে পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক পরিস্থিতির বিবেচনায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে শুধুমাত্র একটি মাত্র মুদ্রাকে বেছে নেয়ার আর কোন সুযোগ থাকে না। প্রয়োজনে আমেরিকার মুদ্রা ডলারের পাশাপাশি চীনের নিজস্ব মুদ্রা ইউয়ান, রাশিয়ার মুদ্রা রুবল, জাপানিজ মুদ্রা ইয়েন, ভারতের মুদ্রা রুপি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মুদ্রা ইউরোকে সমান গুরুত্ব দিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে প্রচলন করাটা এখন কিনা সময়ের দাবি হয়ে দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক থিংক ট্যাংকের দেয়া তথ্যমতে, ডলার এখন মোট বৈশ্বিক মুদ্রার রিজার্ভের ৫৮% প্রতিনিধিত্ব করে এবং যা ২০০১ সালে যা ছিল ৭৩%।
এদিকে বৈদেশিক লেনদেনে ডলারের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য দেশের মুদ্রা আন্তর্জাতিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণ ও আন্তঃবানিজ্য লেনদেনে নিজস্ব দেশীয় মুদ্রার ব্যবহারে যথেষ্ট সচেতন হচ্ছে বিশ্বের প্রথম সারির অধিকাংশ দেশ। বিশেষ করে সৌদি আরব এবং ব্রাজিলের মতো দেশআ কিন্তু ইতোমধ্যেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ডলারের পাশাপাশি ইউয়ান ও ইউরোতে সংরক্ষণ শুরু করে দিয়েছে এবং আন্তঃবানিজ্য লেনদেনের ক্ষেত্রে দেশগুলোর সেন্ট্রাল ব্যাংক নিজস্ব দেশীয় মুদ্রার বিনিময় ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে যাচ্ছে।
বর্তমানে চলমান আমদানি রপ্তানি বানিজ্য ও আন্তর্জাতিক লেনদেনে ডলারের প্রাধান্যকে খারিজ করতে নতুন পদক্ষেপ নিয়েছে চীন ও ব্রাজিল। ডলারের লেনদেন পরিহার করে চীন ও ব্রাজিলের সেন্ট্রাল ব্যাংক নিজস্ব মুদ্রায় আন্তঃবানিজ্য করার জন্য একটি চুক্তি সম্পন্ন করেছে। যার আওতায় বর্তমানে ব্রাজিলের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ মুদ্রা হিসেবে চীনের মুদ্রা ইউয়ানকে প্রতিস্থাপন করেছে। চলতি ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস শেষে ব্রাজিলের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২৯৭.৩ বিলিয়ন ডলার। আর গত ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাস শেষে ব্রাজিলের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের মধ্যে মার্কিন ডলার ছিল ৮০.৪%, চীনের ইউয়ান ছিল ৫.৩৭% এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মুদ্রা ইউরো ছিল ৪.৭৪%।
আসলে কিছুটা ধীরে হলেও রেড জায়ান্ট চীনের নিজস্ব মুদ্রা ইউয়ান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে দিয়েছে। কারো কাছে ভালো লাগুক আর নাই বা লাগুক চীন কিন্তু এক বিংশ শতাব্দীর এক শীর্ষ স্থানীয় ইকোনমিক সুপার পাওয়ার দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ২০২২ সালে চীনের বৈদেশিক বানিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ৬.৩ ট্রিলিয়ন ডলার এবং দেশটি আসলে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক বানিজ্যের দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। অবশ্য একই সময়ে ভারতের বৈদেশিক বানিজ্যের পরিমাণ ছিল ১.১৭ ট্রিলিয়ন ডলার এবং আমেরিকার বৈদেশিক বানিজ্যের পরিমাণ ছিল ৫.৩৬ ট্রিলিয়ন ডলার।
বর্তমানে ব্রাজিলের পাশাপাশি রাশিয়া ও সৌদি আরবের মতো দেশ চীনের সাথে আমদানি রপ্তানি বানিজ্যে নিজস্ব দেশীয় মুদ্রায় লেনদেন করতে সম্মত হয়েছে। তাছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ হিসেবে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাংলাদেশ এবং ইসরায়েল পর্যন্ত চীনের মুদ্রা ইউয়ান সংরক্ষণের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে।
এদিকে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের নিজস্ব মুদ্রা রুপি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার শক্তিশালী অবস্থান জানান দিচ্ছে। বিশেষ করে বতসোয়ানা, ফিজি, জার্মানি, গায়ানা, ইসরায়েল, কেনিয়া, মালয়েশিয়া, মরিশাস, মায়ানমার, নিউজিল্যান্ড, ওমান, রাশিয়া, সেশেলস, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, তানজানিয়া, উগান্ডা,ইংল্যান্ডসহ আরও কিছু দেশ আন্তঃবানিজ্য লেনদেনের ক্ষেত্রে রুপিতে বানিজ্য করতে প্রবল আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
বর্তমানে সারা বিশ্বের আন্তর্জাতিক বানিজ্য ও লেনদেনের ক্ষেত্রে যে একটি দেশের কারেন্সির একচ্ছত্র অধিপত্য রয়েছে তা বিশ্বশান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য বড় ধরণের বাধা হয়ে থেকেই যাচ্ছে। বিশেষ করে উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বৃটিশ মুদ্রা পাউন্ড সারাবিশ্বে রাজত্ব কায়েম করেছিল। যা বর্তমানে আমেরিকার কারেন্সি ডলার করছে এবং আগামীতে হয়ত অন্য কোন দেশের মুদ্রা একচ্ছত্র রাজত্ব করবে। তাই বিশ্বের দেশগুলোকে একত্রিত হয়ে আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে একটি দেশের কারেন্সিকে আন্তর্জাতিক লেনদেনের একক আদর্শ হিসেবে না নিয়ে কমপক্ষে ৫ থেকে ৬টি দেশের শক্তিশালী মুদ্রাকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে অবাধ প্রচলনের বিষয়টিকে নিশ্চিত করা ও আন্তঃবানিজ্য লেনদেনে নিজস্ব দেশীয় মুদ্রার ব্যবহারে সচেতন হওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু হয়ে দেখা দিয়েছে।
See insights and ads
All reactions:
10Afgan Ahmed Khan, Tuhin Uddin and 8 others
About the author