ইউরেশিয়া টাইমস নিউজের দেয়া তথ্যমতে, রাশিয়া ভারতকে তাদের লং রেঞ্জের কৌশলগত টিইউ-১৬০ হেভী সুপার বোম্বার এয়ারক্রাফট অফার করেছে। রাশিয়া আপাতত ভারতকে ৬টি এই জাতীয় হেভী বোম্বার এয়ারক্রাফট লিজ দিতে চায়। এর ন্যাটো রিপোটেড কোড নেম হচ্ছে ‘ব্লাকজ্যাক’। বর্তমানে রাশিয়ার বিমান বাহিনীতে মোট ১৫টি টিইউ-১৬০ হেভী সুপার বোম্বার অপারেশনাল রয়েছে এবং এটিই হচ্ছে কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগামী ও বিশাল আকারের বোম্বার বা সামরিক বিমান।
রাশিয়া ইতোমধ্যেই তার বিমান বহরে থাকা ১৫টি পুরনো সুপারসনিক গতির টিইউ-১৬০ বোম্বারকে নতুন প্রযুক্তির সমন্বয়ে আপগ্রেড করে টিইউ-১৬০এম২ সিরিজে উন্নীত করেছে। তাছাড়া নতুন করে আরো ১০টি এই সিরিজের হেভী বোম্বার অর্ডার দিয়ে রেখেছে রাশিয়ার বিমান বাহিনী। এই হেভী বোম্বার এয়ার ক্রাফটের একমাত্র যোগ্য প্রতিদ্বন্দী হচ্ছে আমেরিকার বি-১বি ল্যান্সার সুপার বোম্বার।
সভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর চলতি ২০২২ সালের ১২ই জানুয়ারি রাশিয়ার কাজান এভিয়েশন এন্টারপ্রাইজের প্রডাকশন প্লান্টে তৈরি হওয়া প্রথম হাইলী আপগ্রেডেড এণ্ড লং রেঞ্জের স্ট্যাট্রিজিক টিইউ-১৬০ এম সিরিজের হেভি সুপার বোম্বার রাশিয়ার বিমান বাহিনীর হাতে হস্তান্তর করা হয়। আর রাশিয়ার পুতিন সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট ও তার ন্যাটো জোটকে আকাশ পথে কার্যকরভাবে প্রতিহত করার জন্য আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে এরুপ ৫০টি নতুন প্রজন্মের হেভী সুপার বোম্বার সার্ভিসে আনার মহা পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
রাশিয়ার নতুন প্রজন্মের টিইউ-১৬০ এম বোম্বারকে স্বয়ংক্রিয় চালিত অত্যাধুনিকত প্রতিরক্ষামূলক এইড স্যুট, আপগ্রডেড জ্যামিং প্রতিরোধ সিস্টেমসহ এবং অনন্য অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দ্বারা সজ্জিত করা হয়েছে। পাশাপাশি এটিতে একটি উন্নত এবং নির্ভরযোগ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা ইনস্টল করেছে রাশিয়া। যা স্ট্র্যাটিজিক বোম্বারটিকে যে কোন ধরণের প্রচলিত এবং নিউক্লিয়ার যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ১২,৩০০ কিলোমিটার রেঞ্জে সুপারসনিক গতিতে কমব্যাট মিশন পরিচালনা করার সক্ষমতা প্রদান করে। তাছাড়া রাশিয়ার এতে সর্বাধুনিক এভিয়েশন, রেডার, কমিউনিকেশন এন্ড নেভিগিয়েশন প্রযুক্তি সংযুক্ত করেছে।
রাশিয়া বর্তমানে তাদের উচ্চ প্রযুক্তির টিইউ-১৬০ এম সিরিজের যে হেভী বোম্বারটির ম্যাসিভ প্রডাকশন লাইন চালু করেছে তা আসলে সভিয়েত আমলের কৌশলগত তুপলেভ টিইউ-১৬০ (ব্লাকজ্যাক) লং রেঞ্জ বোম্বারের উন্নত এবং আধুনিক ভার্সন। মুলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত বি-১বি ল্যান্সার এবং নেক্সড জেনারেশন বি-২১ এর যোগ্য কাউন্টার হিসেবে এই হেভী সুপার বোম্বার সার্ভিসে আনতে অত্যাধুনিক টিইউ-১৬০ এম সুপারসনিক গতির পারমাণবিক বোম্বারের প্রডাকসন লাইন চালু করেছে রাশিয়া। তবে কাজান এভিয়েশন প্লান্টে প্রতি বছর মাত্র ১টি থেকে ২টি এই জাতীয় হেভী সুপার বোম্বার উৎপাদন করা সম্ভব।
টিইউ-১৬০ এম রাশিয়ান বোম্বারে পূর্বের চারটি পুরোনো ইঞ্জিনের পরিবর্তে নতুন প্রজন্মের অত্যন্ত শক্তিশালি এনকে-৩২ (Kuznetsov NK-৩২ afterburning turbofan) সিরিজ-২ আফটার বার্নিং টার্বোফ্যান জেট ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে। আর টিইউ-১৬০ বোম্বারের ইন্জিন হচ্ছে বর্তমান বিশ্বে সার্ভিসে থাকা এয়ারক্রাফট গুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ইন্জিন। এনকে -৩২ এর প্রতিটি জেট ইঞ্জিন ৩ হাজার ৪শত কেজি ওজনে ৩০০ কেএন পর্যন্ত থ্রাষ্ট উৎপন্ন করতে সক্ষম। যা এফ-২২ র্যাপটারের এর দুই ইন্জিনের মিলিত থ্রাষ্টের চেয়েও প্রায় দ্বিগুণ। আবার এ রকম ৪টি ইন্জিন টিইউ-১৬০ এম স্ট্যাটিজিক বোম্বারে ইন্সটল করা হয়েছে। চারটি এনকে-৩২ সুপার থ্রাস্ট ইঞ্জিনের বদৌলতে এটিই হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগামী বোম্বার এয়ারক্রাফট। টিইউ-১৬০ এম সিরিজের সুপার বোম্বার ম্যাক ২.০২ গাতিতে ৪০ টন ওজনের নিউক্লিয়ার এণ্ড নকভেনশোনাল যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে বিরতী না দিয়েই একটানা ১২,৩০০ কিলোমিটারের দীর্ঘ আকাশ পথ পাড়ি দিতে সক্ষম।
রাশিয়ার কাজান এভিয়েশন এন্টারপ্রাইজ এর প্রডাকশন প্লান্টে টিইউ-১৬০ এম সিরিজের প্রতিটি সুপার বোম্বারের ইউনিট কস্ট ধরা হয়ছে ১৬ বিলিয়ন রুবল বা ২৮০-৩০০ মিলিয়ন ডলার। তাছাড়া এর প্রজেক্ট কস্ট নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮০ বিলিয়ন রুবল বা তিন বিলিয়ন ডলার প্রায়। প্রাথমিকভাবে সংক্ষিপ্ত সময়ে রাশিয়ার স্টাটিজিক নিউক বিমান বাহিনীর জন্য আগামী ২০২৭-২৮ সালের মধ্যেই নুন্যতম ১০টি এই সিরিজের স্ট্যাটিজিক সুপার বোম্বার সরবরাহ করবে কাজান এভিয়েশন এন্টারপ্রাইজ।
এখানে আসলে নতুন প্রজন্মের টিইউ-১৬০ এম সুপার বোম্বার উৎপাদনের ক্ষেত্রে রাশিয়া বিমানের স্টেলথ টেকনোলজির মতো বিষয়কে গুরুত্ব না দিয়ে এর সর্বোচ্চ গতি, ম্যাসিভ ওয়েপন্সস ক্যাপাবিলিটি এবং লং রেঞ্জের মতো প্রযুক্তিগত বিষয়গুলোকে গুরুত্ব প্রদান করে বিশেষভাবে ডিজাইন ও তৈরির কাজে মনোযোগ দিয়েছে। তাই শত্রুর রাডারে ধরা পড়লেও একে ইন্টারসেপ্ট করাটা খুবই কঠিন একটি কাজ হয়ে যাবে। সভিয়েত আমলের তোপলেভ টিইউ-১৬০ এর সর্বোচ্চ গতিবেগ ২.০০ ম্যাক হলেও নতুন প্রজন্মের টিইউ-১৬০এম সুপার বোম্বারের সর্বোচ্চ গতিবেগ ম্যাক ২.৫ পর্যন্ত বা এর এর কাছাকাছি হতে পারে।
১৩,২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাল্লার টিইউ-১৬০ এম২ এর ম্যাক্সিমাম পেলোড ক্যাপাসিটি প্রায় ৪০ হাজার কেজি বা ৪০ টন। এর কম্ব্যাট রেডিয়াস ৭৩০০ কিলোমিটার এবং সার্ভিস সিলিং ১৬ হাজার মিটার। এটি একই সাথে ২০০ কিলোটন ক্ষমতা সম্পন্ন ১২টি ৩০০ কিলোমিটার পাল্লার কেএইচ-৫৫ (প্রচলিত ও পারমাণবিক ওভারহেড) অথবা ১২টি পারমাণবিক ওভারহেড সমৃদ্ধ ৩০০ কিলোমিটার পাল্লার কেএইচ-১৫ ক্রুজ মিসাইল বহন করতে পারবে। তাছাড়া এটি কমপক্ষে ১২টি ক্ষেপনাস্ত্রসহ প্রচলিত গাইডেড এন্ড আইগাইডেড হেভী বোম্বস এন্ড ওয়েপন্সস সিস্টেম বহন করতে পারে।
আসলে তৎকালীন সোভিয়েত আমলে ১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত প্রোটোটাইপ কপিওশ মোট ৩৬টি টিইউ-১৬০ তৈরি করা হয়। পরবর্তী সময়ে চরম আর্থিক সংকটের মুখে এই স্টাটিজিক সুপার বোম্বারের উৎপাদন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয় রাশিয়া। বর্তমানে রাশিয়ার বিমান বাহিনীতে মোট ১৫টি কৌশলগত টিইউ-১৬০ (ব্লাকজ্যাক) বোম্বার, ৩২টি টার্বোপ্রোপ টিইউ-৯৫ বিয়ার এবং ৬৯টি টিইউ-২২এম বোম্বার এয়ারক্রাফট অপারেশনাল রয়েছে।
তবে ১৯৯১ সালের পর ইউক্রেনের কাছে ১৯টি এই জাতীয় টিইউ-১৬০ সুপার বোম্বার ছিল। রাশিয়া থেকে গ্যাস রিলিফ পেতে ১৯৯৯ সালে ৮টি এই জাতীয় বোম্বার রাশিয়ার কাছে হস্তান্তর করে দেয়। অবশিষ্ট ১১টি বোম্বার আমেরিকার আর্থিক সহায়তা প্রাপ্তির চুক্তির আলোকে স্ক্যার্প হিসেবে নিজেই দেশেই ধ্বংস করে ফেলে ইউক্রেন।
সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক ও লেখক, গ্রামঃ ছোট চৌগ্রাম, সিংড়া, নাটোর। sherazbd@gmail.com