বর্তমানে বিশ্বের সামরিক শক্তিধর দেশগুলো নিউক্লিয়ার এন্ড থার্মোনিউক্লিয়ার অস্ত্রের আধুনিকায়নের পাশাপাশি একেবারেই নতুন কনসেপ্টের আরো মারাত্বক কিছু অস্ত্র তৈরির গোপন নেশায় মেতে উঠেছে। আর এই নতুন ভয়ানক অস্ত্রের নাম হচ্ছে ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক পালস বা (ইএমপি)। রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দীর্ঘ মেয়াদী অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে চীনও কিন্তু একেবারে নিজস্ব প্রযুক্তির ইলেকট্রোম্যাগনেটিক পালস (ইএমপি) প্রযুক্তি সমৃদ্ধ হাইপারসনিক গতির ক্ষেপণাস্ত্র বিশ্বের সামনে উম্মোচন করেছে। তবে এই নতুন প্রজন্মের অস্ত্র প্রতিযোগিতায় আমেরিকা, রাশিয়া এবং চিনের পাশাপাশি ভারতের নামও কিন্তু উঠে এসেছে। তাছাড়া অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা উত্তর কোরিয়াও কিন্তু এই জাতীয় মারাত্বক অস্ত্র তৈরিতে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে বলে মনে করা হয়।

নন-নিউক্লিয়ার ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক পালস (ইএমপি) রশ্মি ছুড়তে আসলে অত্যাধুনিক মিসাইল ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে ইলেক্ট্রন শক্তির প্রবল চাপ তৈরি করতে ব্যবহার করা হয় অতি শক্তিশালী মাইক্রোওয়েভ ওভেন। এই শক্তি বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রে, চুম্বকীয় ক্ষেত্রে, বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বিকিরণ ও বৈদ্যুতিক পরিচলন রূপে অতিক্রম করতে পারে। আর ইলেক্ট্রন ও চুম্বকীয় শক্তির উচ্চ মাত্রায় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ব্যাপক আলোক রশ্মির আঘাত করাই হলো ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক পালস (ইএমপি) অস্ত্রের মূল যাদুমন্ত্র।

একটি নিদিষ্ট এলাকায় ইএমপি অস্ত্র আঘাত হানার পর সেখানে রাসায়নিক বিস্ফোরণ ঘটায় এবং ফ্লাক্স কমপ্রেশন জেনারেটর নামে পরিচিত বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত চুম্বককে সংকুচিত করে ফেলে। যার ফলস্রুতিতে তৈরি হওয়া শক এনার্জি অত্যন্ত শক্তিশালী ইলেকট্রন এবং চুম্বকীয় শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। এটা অনেকটা লেজার রশ্মি বা বজ্রপাতের আঘাত জনিত একটি বিষয়ের মতো। একই সময়ে আকাশে লক্ষ লক্ষ বজ্রপাত হলে যে ভয়ানক আলোকরশ্মি সৃষ্টি হবে, ঠিক ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক পালস (ইএমপি) এর আঘাতে তার থেকে কয়েক গুন বেশি আলোক রশ্মি সৃষ্টি হতে পারে।

আকাশে মাত্রাতিরিক্ত বজ্রপাত যেমন ভূ-পৃষ্ঠে থাকা অবকাঠামো, পাওয়ার গ্রীড, রেডার এন্ড কমিউনিকেশন সিস্টেম নষ্ট করে দিতে পারে। ঠিক তেমনি ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক পালস (ইএমপি) রশ্মিও পাওয়ার গ্রীড, বৈদুতিক সাজ সরঞ্জাম এবং বিমান পরিবহণ ব্যবস্থা এক নিমেষেই ধ্বংস করে দিতে সক্ষম। এ রশ্মি সরাসরি সরল পথে এবং আঁকাবাঁকা পথে দু-ভাবেই চলতে পারে।

উচ্চ প্রযুক্তির হাইপারসনিক মিসাইল সিস্টেমের মাধম্যে শত্রু দেশের উপর হামলা করা হলে ইএমপি রশ্মি বায়ু মণ্ডলকে বিরাট ঝাকুনি দিতে দিতে ভূ-পৃষ্ঠে ভূপাতিত হবে এবং চারপাশ চরম মাত্রায় উত্তপ্ত করে ভূমি থেকে ৬০ মাইল উচু থেকে ১.৫ মিলিয়ন বর্গ মাইল এলাকায় থাকা ইলেক্ট্রিক ব্যবস্থা এবং ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতি এবং সাজ সরঞ্জাম ধ্বংস করে দিতে পারে এক নিমেষেই। আবার বৈদ্যুতিক তারের মাধম্যেও ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক পালস (ইএমপি) অস্ত্র প্রয়োগ করা সম্ভব জানিয়েছেন সামরিক প্রযুক্তিবিদেরা।

অন্যদিকে ইএমপি অস্ত্র ব্যবহারে নিশ্চিতভাবেই যে কোন দেশের জাতীয় নিরাপত্তা তথ্য ব্যবস্থা খুব দ্রুত হ্যাক বা ধ্বংস করা সম্ভব। এক গবেষণামুলক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ভবিষ্যতে রাশিয়া বা চিনের গোপন ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক পালস (ইএমপি) অস্ত্র হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় তথ্য এবং পাওয়ার গ্রীড ও সরবরাহ ব্যবস্থা ধ্বংস করা হলে তা পুনরুদ্ধারে প্রায় এক যুগ লেগে যাবে এবং খরচ হবে আনুমানিক প্রায় চার ট্রিলিয়ন ডলার।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০১২ সালে প্রথমবারের মতো এই নতুন প্রযুক্তির ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক পালস (ইএমপি) অস্ত্রের বেশকিছু গোপন পরীক্ষা চালায়। মার্কিন গণমাধ্যমের তথ্যমতে, মার্কিন বিমানবাহিনী ও বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠাতা বোয়িং কর্পোরেশন যৌথভাবে নন-নিউক্লিয়ার ইএমপি তৈরি্তে কাজ করেছে। ‘চ্যাম্প’ বা কাউন্টার-ইলেকট্রনিক্স হাই পাওয়ার্ড মাইক্রোওয়েভ অ্যাডভান্সড মিসাইল প্রজেক্টের অধীনে তৈরি করা হচ্ছে। আর ইতোমধ্যেই রাশিয়াও এ অস্ত্রের গোপন পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে।

চীন খুব সম্ভবত গত ২০২১ সালের শেষের দিকে ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক পালস (ইএমপি) প্রযুক্তি সমৃদ্ধ হাইপারসনিক মিসাইলের পরীক্ষা সম্পন্ন করেছিল। চীনের নিজস্ব প্রযুক্তির তৈরি ম্যাক ৭ গতি সম্পন্ন হাইপারসনিক মিসাইলের কার্যকরী রেঞ্জ হচ্ছে ৩,২০০ কিলোমিটার। এটি প্রচলিত ক্ষেপণাস্ত্রের মতো তার লক্ষবস্তুতে ওয়ারহেড হীট না করে বরং তার শত্রু পক্ষের নিদিষ্ট অবস্থানে রসায়নিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সেখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা, কম্পিউটার, রাডার সিস্টেম এণ্ড এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের সকল ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস ধ্বংস করার পাশাপাশি বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা একেবারে অচল করে দিতে পারে বলে চীনের মিডিয়ায় প্রচার করা হয়।

এদিকে ভারত কার্যত ২০০৪ সাল থেকেই তাদের নিজস্ব প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনী সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে কালি-৫০০০ নামে নতুন এই ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক পালস (ইএমপি) অস্ত্র তৈরি ও গবেষণায় অনেক দূর এগিয়ে গেছে বলে মনে করা হয়। যদিও ভারতের তরফে এ নিয়ে খুব একটা তথ্য মিডিয়ায় প্রচার করা হয় না।

Sherazur Rahman