তুরস্কের রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশে আসবেন ব্যাপারটি প্রথমে আলোচনায় আসে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে। শুরু হয় তার সফর নিয়ে নানা জল্পনা কল্পনা। বিশেষ করে দেশের সাধারণ জনগণের আগ্রহের কোন সীমা ছিল না। বিষয়টি নিয়ে নানাবিধ পর্যালোচনা শুরু হয় সবার মাঝে।
ইউটিউব কিংবা ফেসবুক সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রব উঠে তাহলে কবে আসছেন এরদোয়ান। তার এই বিপুল জনপ্রিয়তার বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ঘোর তুরস্ক-বিরুধী মিডিয়াগুলোও এরদোয়ান ও তুরস্কেকে নিয়ে ইতিবাচক সংবাদ প্রচার করতে শুরু করে।
বাংলাদেশ সহ বিশ্বের সকল মুসলমানদের কাছে এরদোয়ান একটি প্রিয় নাম। সবার ভালবাসার পাত্র। ভালবাসার সেই উদ্দীপনা থেকে কেউ তাকে বলছে সুলতান, কেউ বলছে খলিফা, কেউবা আবার বলছে তিনিই হলেন মুসলিম বিশ্বের একমাত্র অবিসংবাদিত নেতা।
এমনই একজন নেতাকে কাছ থেকে এক পলক দেখার সপ্ন বুকে লালন করেন অনেকেই। তাই এরদোয়ানের সফর বাংলাদেশের মানুষের কাছে আলাদা গুরুত্ব বহন করে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাষ্ট্রপতি এরদোগান
এই সফরের বিষয়টি প্রথম মিডিয়ায় আসে গতবছর(২০২১)সেপ্টেম্বর মাসে যখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন তার আঙ্কারা সফরকালে এরদোগানের সাথে সাক্ষাত করেন এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণ পত্র তুরস্কের প্রেসিডেন্টের কাছে হস্তান্তর করেন।
তখন প্রচার করা হয় যে এরদোগান “আগামী বছর মুজিব বর্ষ সমাপনী অনুষ্ঠান এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশে আসছেন”।
তখন এ খবর বাংলাদেশের পাঠক শ্রেণির মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়
পাঠক সংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতায় গণমাধ্যমও তখন খবরটিকে আরও ফলাও করে প্রচার করতে থাকে । বাংলাদেশ থেকে অনেকে আমার কাছে এ বিষয়ে জানতে চান। আমি তাদেরকে বলি, তুরস্ক সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এখনো আসেনি। সুতরাং তার সফরের বিষয় নিয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আঙ্কারায় অবস্থানকালে বিষয়টি নিয়ে তার সাথে আলোচনা করলে তিনি বলেন, ” এরদোগান যেন বাংলাদেশ সফর করেন সে ব্যাপারে আমি তার কাছে আমাদের আগ্রহের কথা জানিয়েছি।
এক রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষ থেকে আরেক রাষ্ট্রপ্রধানকে যখন আমন্ত্রণ পত্র দেওয়া হয় তখন স্বাভাবিক ভাবেই প্রাপক প্রেরকে ধন্যবাদ দেন এবং ওই দেশ ভ্রমণের আগ্রহ প্রকাশ করেন। এটা কূটনৈতিক শিষ্টাচারেরও একটি অংশ। কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধানদের সফরের জন্য শুধু একটু মৌখিক সম্মতি বা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের কারণে ভ্রমণের আগ্রহ প্রকাশই যথেষ্ট নয়।
বিষয়টি আমি আমার বাংলাদেশি সাংবাদিক বন্ধুদের বুঝানোর চেষ্টা করলাম। এ নিয়ে আমার ফেইসবুক পেইজেও স্ট্যাটাস দিলাম। কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিজ্ঞপ্তি আকারে বিষয়টি জানানো হয়েছে তাই আমার যুক্তি তাদের কাছে ধোপে টিকল না।
এক মাস পরে এরদোগানের সফরের বিষয়টি আবার বাংলাদেশের মিডিয়ায় আসে ফলাও হয়ে। যখন বাংলাদেশে নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মুস্তাফা ওসমান তুরান করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে তুরস্কের প্রসিডেন্টের পক্ষ থেকে চিকিৎসা সামগ্রী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নিকট হস্তান্তর করতে তার কার্যালয়ে আসেন। তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে ঘোষণা আসে যে, “এরদোগান বাংলাদেশে আসছেন”। এবার বলা হয় কোভিড-১৯ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ২০২১ সালের গোরার দিকে বাংলাদেশে আয়োজিত ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে বাংলাদেশে যেতে পারেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান।
আবার ঢাকার সাংবাদিক পাড়ায় এ নিয়ে হইচই পড়ে যায়।
এরদোগানের সফরে কি কি বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে? কোন সামরিক চুক্তি হবে কি না? রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো নিয়ে কোন সুরহায় আসবেন কিনা? ইত্যাদি নিয়ে বাংলাদেশী মিডিয়া আবার খবর প্রচার করতে সচেষ্ট হয়। অনেকে আবার আমাকেও জিজ্ঞেস করেন।
আমার আবারও সেই একই জবাব, তুরস্কের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোন ঘোষণা আসেনি।
তাঁরা বললেন ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত সরাসরি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছেন। আর কি আনুষ্ঠানিক ঘোষণার দরকার আছে? আমি নিশ্চুপ হয়ে যাই।
বিষয়টি নিয়ে আমারও যে আগ্রহ ছিল না তা কিন্তু নয়। যে কোন রাষ্ট্রপ্রধানের বাংলাদেশ সফরই আমাদের জন্য সুসংবাদ। বিশেষ করে সে অতিথি যদি হন এরদোগান, সে রাষ্ট্রপ্রধান যদি হন এমন একটি দেশের যেখানে আমি বসবাস করছি গত ১৭ বছর যাবৎ।
তখন বিষয়টি নিয়ে তুরস্কের ঢাকাস্থ দূতাবাসে কথা বললাম। তাঁরা জানালেন যে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোন কিছুই বলা হয়নি।
আঙ্কারায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসেও যোগাযোগ করলাম। তাঁরাও এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোন সবুজ সংকেত পাননি।
দুদেশের দূতাবাস এবং বাংলাদেশে কর্মরত তুরস্কের বিভিন্ন সরকারি সংস্থার সাথে কথা বলে এবং তাদের কাজের গতিবিধি লক্ষ্য করে আমি নিশ্চিত হলাম যে এরদোগান মার্চ-এপ্রিল তো দূরের কথা খুব শিগগিরই বাংলাদেশে যাচ্ছেন না।
২৬ শে মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আসবেন। তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় এসে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন এবং সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছেন। সে অনুষ্ঠানে এরদগানের যাওয়ার সম্ভবনা থাকলে তুরস্ক থেকেও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ঢাকায় গিয়ে সে ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করে তার সফরের বিষয়টি নিশ্চিত করতেন। কিন্তু তা হয়নি। সুতরাং এরদোগান ২৬শে মার্চের অনুষ্ঠানে যে যাচ্ছেন না সেটা এখন মোটামুটি নিশ্চিত।
বাকি থাকলো ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার বিষয়টি। বাংলাদেশে এ সম্মেলনটি গত বছর হওয়ার কথা থাকলেও করোনার কারণে তা কয়েকবার পিছিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত এ বছরের শুরুতে হওয়ার কথা ছিল তাও পিছিয়ে যায়। এবং সর্বশেষ বাংলাদেশ সরকার এই সম্মেলনটি এপ্রিলের ৪ তারিখে ভার্চুয়াল ভাবে করার সিদ্ধান্ত নেয়।
যেহেতু সম্মেলনটি অনলাইনে হবে সেহেতু ডি-৮ ভুক্ত অন্য দেশের সরকার প্রধানদের মত এরদোগানেরও বাংলাদেশে যাওয়ার কোন সম্ভবনা নেই।
করোনা ভাইরাসের মধ্যে এরদোগান বিদেশ ভ্রমণ অনেক কমিয়ে দিয়েছেন। শুধুমাত্র আজারবাইজান, কাতার ও তুর্কি সাইপ্রাস ছাড়া অন্য কোথাও যাননি। দেশের ভিতরের অনুষ্ঠানগুলোতেও বেশিরভাগ সময়ে অনলাইনে যোগদান করেন। তাই করোনার বিষয়টিকে মাথায় রেখে বাংলাদেশ সফরের বিষয়ে তাড়াতাড়ি কোন সিদ্ধান্তে আসতে চাচ্ছে না এরদোগান সরকার।
তবে আঙ্কারা বাংলাদেশের সাথে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, সামরিক, এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে আগ্রহী। বাংলাদেশও তুরস্ককে বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে কাছে পেতে চায় সবসময়। সে দিক থেকে এরদোগান
বাংলাদেশ সফর করলে তা উভয় দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সারা বিশ্বে লক্ষকোটি মুসলিমের প্রাণের নেতা, শত কোটি যুবকের মনে আশার সঞ্চারকারী, মুসলিম বিশ্বের অবিসংবাদিত নেতা এরদোগানের বাংলাদেশ সফর শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্যই না, এই অঞ্চলের শোষিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত, মানুষের জন্য বিশেষ করে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সহ আরও অনেক দেশের জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
তাই এখন না হলেও অদূরভবিষ্যতে তার ঢাকা সফর হওয়া উচিত। আর সে সফর অনেক নতুন সম্ভবনার দ্বার উম্মুক্ত করবে।
আমেরিকার নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে জো বাইডেনের বিজয়, নাগরনো কারাবাখ যুদ্ধে আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে আজারবাইজানের জয়, ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সারা মুসলিম বিশ্বে জনরোষ, করোনা ভাইরাসের নতুন করে ছড়িয়ে পড়া! এ সবকিছুই সারা বিশ্বের রাজনীতিতে বিশেষ করে মদ্ধপ্রাচ্যে এবং ইউরেশিয়াতে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। গুরুত্বপূর্ণ সব দেশই নতুন করে ছক আকঁতে মরিয়া। ট্রাম্পের সময়ে যে নীতিতে ভূরাজনৈতিক চাল চালা হত বাইডেনের সময় সেই নিয়মে খেলা চলবে না। এর আগের লেখাও আমি বলেছিলাম বাইডেনের বিজয় এই অঞ্চলের রাজনীতি এবং আঞ্চলিক সম্পর্কে নতুন মোড় নিয়ে আসবে।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেজেপ তাইয়িপ এরদোগানের গত দুই সপ্তাহের বক্তব্য এবং দেশের মধ্যে ব্যাপক রিফর্মের ডাক, ইউরোপ এবং আমেরিকাকে উদ্দেশ্য করে নতুন কিছু মেসেজ উপরোক্ত বক্তব্যেরই সত্যতা প্রমাণ করে।
তুরস্কের অর্থনীতি গত কয়েক বছর ধরেই খুব খারাপ যাচ্ছিল। যেই এরদোগানের নেতৃত্বে তুরস্ক তার অর্থনীতিতে চমক দেখিয়ে বিশ্বের ১৫ তম স্থানে চলে এসেছিল। তুর্কিরা অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের আঁনন্দে আত্মহারা হয়েছিল। সেহি এরদোগানের নেতৃত্বেই আবার অর্থনীতির ধ্বস! প্রায় বিষ বছর ধরে গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচনের মাধ্যমে একটানা ক্ষমতায় থাকার পিছেন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধিই কাজ করছিল বেশি।
অর্থনৈতিক সমস্যার জন্য অনেকগুলো কারণ থাকলেও মূল কারণ ছিল পশ্চিমাদের সাথে তার সাপে নেউলে সম্পর্ক। সুদের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক সুদ চক্র তার অর্থিনীতির গলা এমনভাবে চেপে ধরল যে শেষ পর্যন্ত তাকেই হার মানতে হল।
আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজার আর বিনিয়োগকারীদের সবগুলো দাবি তিনি মেনে নিলেন। যেমন, তার জামাতাকে অর্থ মন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপর থেকে তার নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে ব্যাংকটিকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিয়ে দেওয়া যাতে ব্যাংকটি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অঙ্গনের চাহিদামত সুদের হার বাড়াতে পারে। ২০১৬ সালের ব্যর্থ সামরিক অভ্যূথানের পরে দেশের ভিতরে আইনের শাসন নিয়ে অনেক মহলে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল। সুতরাং আইন ও বিচার বিভাগে সংস্কারের দাবি ছিল অনেক দিনের। সেটাও তিনি মেনে নিলেন।
অনেক দিন ধরে ইউরোপের সাথে চলছিল অবিশ্বাস। তুরস্ক যেমন ইউরোপের কোনো প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করতে পারেনি ইউরোপও তেমনি বিভিন্ন দিক দিয়ে তুরস্ককে ঘায়েল করার চেষ্টা করেছে। ফলশ্রুতিতে তুরস্ক ইউরোপিয় ইউনিয়ন থেকে আস্তে আস্তে সরে এসেছে।
মুসলিম বিশ্বকে নিয়ে নতুন এক বলয় তৈরির চেষ্টা করছিল। কিন্তু সেখানে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় সৌদি রাজপুত্র মোহাম্মদ বিন সালমান, আবু ধাবির ক্রাউন প্রিন্স শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান এবং মিশরের স্বৈরশাসক জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আস-সিসি।
একারণে তুরস্ক আবার ফিরে যেতে চাচ্ছে পশ্চিমা বলয়ে। গত সপ্তাহে এরদোগান তো সরাসরি ঘোষণাই দিলেন যে তুর্কীরা নিজেদেরকে ইউরোপের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে মনে করে। তুরস্কের ভবিষ্যত, তুরস্কের ভাগ্য ইউরোপের সাথে বাঁধা। তিনি ন্যাটোর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এই সামরিক জোটে তার দেশের অবদানের কথা তুলে ধরেন। যুক্তরাজ্যের সাথে আরো ঘনিষ্ট সম্পর্ক স্থাপনের ডাক দেন। শুধু কিছু বক্তব্য দিয়েই শান্ত হননি এরদোগান। তিনি তার মেসেজ আরো স্পষ্টকরে তুলে ধরার জন্য তার প্রধান উপদেষ্টা ইব্রাহিম কালিনকে ইউর হেড কোয়ার্টারে পাঠান। কালিন সেখানে ইউর প্রধানদের সাথে বৈঠকে তুরস্কের আগ্রহের কথাগুলো তুলে ধরেন। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এরদোগানের ভাষণ আর কালিনের বৈঠকে কতটা কনভিন্সড হয়েছে তা বুঝতে আরও দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। কারণ, ডিসেম্বরের ১০-১১ তারিখ ইউ নেতাদের শীর্ষ সম্মেলনে তুরস্কের বিরুদ্ধে কিছু অবরোধ-নিষেধাজ্ঞা জারির কথা রয়েছে।
আমেরিকা থেকে এখনই তুরস্ক বিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত আসার সম্ভাবনা কম। কিন্তু ইউ-তুরস্ক সম্পর্ক আগামী কয়েক দিনে নতুন মোর নিতে পারে।
ইউ-তুরস্ক সম্পর্কে তিনটি প্রধান সমস্যা
ইউরোপীয় ইউনিয়ন-তুরস্ক সম্পর্কের মধ্যে তিনটি প্রধান সমস্যা হল:
এক. তুরস্কের ফ্রান্স এবং অস্ট্রিয়ার মত কিছু ইউ সদস্য দেশের সাথে দ্বিপক্ষীয় সমস্যা।
দুই. গ্রীস এবং সাইপ্রাসের সাথে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে স্বার্থ সংশ্লিষ্ঠ দ্বন্দ্ব।
তিন. সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কে গণতন্ত্র রেকর্ডের চরম অবনতি।
এর মধ্যে যে বিষয়টি আঙ্কার জন্য সবচেয়ে বেশি মাথাব্যথার কারণ হতে পারে তা হলো পূর্ব ভূমধ্যসাগরে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা।
ইইউ নেতৃবৃন্দ ১০-১১ ডিসেম্বরের শীর্ষ সম্মেলনে তুরস্কের বিরুদ্ধে অবরোধ আনার কথা ভাবছে। এক্ষেত্রে ভূমধ্যসাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে নিয়োজিত তুরস্কের ওরুচ রেইস নামক জাহাজ এবং এর পাহারায় নিয়োজিত যুদ্ধ জাহাজগুলোকে ফেরত আনার দাবি জানিয়েছে ইউরোপ। তুরস্ক ওই সম্মেলনের আগে জাহাজগুলোকে ভূমধ্যসাগর থেকে ফেরত আনার ইঙ্গিত দিয়েছে। কিন্তু এই ইঙ্গিতে বিশ্বাস করতে পারছে না ইউরোপ। কারণ অক্টোবর মাসেও এরকম একটি অবরোধের হুমকির মুখে ওরুচ রেইস জাহাজটিকে কয়েকদিন বন্দরের নোঙ্গর করে রেখেছিল আঙ্কারা। কিন্তু পরে আবার সাগরে পাঠায়। উত্তেজনা নতুন করে দানা বাঁধে।
এবার জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মের্কেলও বলেচেন যে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় ইস্যুতে বিষয়গুলি সঠিক দিকে অগ্রসর হচ্ছে না, সুতরাং তুরস্কের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার সম্ভাবনা নিয়ে ১০ই ডিসেম্বর আলোচনা হবে।
ফ্রান্স আর অস্ট্রিয়া তো অনেকদিন ধরেই তুরস্কের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা প্রস্তাবনা নিয়ে আসার চাপ দিচ্ছে ইউকে।
তুরস্ক কী চাচ্ছে ?
তুরস্ক ইইউ এবং আমেরিকার কাছ থেকে বৈষম্য মূলক আচরণ পরিহার করা, গুরুত্বপূর্ণ এক ন্যাটো সদস্য হিসেবে সঠিক মূল্যায়ন এবং ইইউর সাথে যে অমীমাংসিত বিষয়গুলো আছে সেগুলোর দ্রুত সমাধান।
ইইউর সাথে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর শুরুতেই আসে আঙ্কারা-ব্রাসেলসের মধ্যে শুল্কমুক্ত পণ্য চুক্তির নবায়ন। ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত এই চুক্তি নিয়ে তুরস্ক অনেক দিন ধরেই নবায়নের তাগিদ দিয়ে আসছে। কারণ চুক্তির পরে ইইউতে অনেক দেশ যুক্ত হয়েছে এবং আমদানি রপ্তানিতেও অনেক পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয়েছে।
দুই. তুরস্কের জনগণের জন্য ভিসা মুক্ত ইউরোপ ভ্রমণ। যদিও তুরস্কের ইইউর অন্তর্ভুক্তি প্রায় অসম্ভব হলেও আঙ্কারা-ব্রাসেলসের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছিল ২০১৫ সালে এবং সেই চুক্তি অনুযায়ী কিছু শর্তসাপেক্ষ তুরস্কের জনগণকে বিনা ভিসায় ইইউ ভ্রমণের সুযোগ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়নি।
তিন. শরণার্থী ফেরত চুক্তির নবায়নঃ ২০১৫ সালের ওই চুক্তি অনুযায়ী তুরস্ক গ্রীস থেকে সিরিয়ার শরণার্থী ফেরত নিবে এবং ইইউ শরণার্থীদের ভরণপোষণ বাবদ তুরস্ককে ৬ বিলিয়ন ইউরো দিবে। তুরস্ক তার প্রতিশ্রুতি পালন করলেও ইইউ চুক্তি অনুযায়ী অর্থ পরিশোধ করেনি।
তবে আপত দৃষ্টিতে তুরস্কের সাথে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউর সম্পর্ক উন্নয়নের ইঙ্গিত দিলেও বর্তমান পরিস্থিতির খুব বেশি পরিবর্তন হবে বলে আমার মনে হয় না। তুরস্কও ইউরোপ বা আমেরিকার চাহিদা মত কাজ করবে না আর আমেরিকা ইউরোপও তুরস্কের চাওয়াগুলো পূরণ করবে না।
বর্তমান সময়ে তুরস্ক বাংলাদেশের অন্যতম সামরিক অংশিদার।২০১৭-১৮ সালের আগের দিনগুলোতে বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের সাথে তুরস্কের বুঝাপড়া তেমন একটা ভাল যায়নি। অবস্থার উন্নতি শুরু হয় ২০১৬ সালে তুরস্কে ঘটে যাওয়া ব্যার্থ সামরিক অভ্যুন্থানের পর থেকে। ঐ সময়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তড়িঘড়ি করে এরদোগানের প্রতি তার অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যাক্ত করেন। এবং ঐ অভ্যুন্থানচেষ্টার নিন্দা জানান।
একদিকে দু’দেশের সম্পর্ক উন্নতি হতে থাকে অপরদিকে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নের লক্ষ্যে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করে বহুল আলোচিত forces goal 2030. এর অধীনে সরকার সামরিক বাহিনীকে যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে দীর্ঘ মেয়াদি বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রনয়ণ করে। পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সমরাস্ত্র ঘাটতি পুরা করতে বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম যুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের সামরিক ঘাটতি পূরণে বিভিন্ন ধরনের সমরাস্ত্র সরবরাহের প্রস্তাব দেয় দেয় তুরস্ক। বাংলাদেশের জন্যও আদর্শ ছিল তুরস্কের সমরাস্ত্রের বাজার, কারণ তারা পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় অনেক সহজ শর্তে অস্ত্র বিক্রি করে। পাশাপাশি তাদের সমরাস্ত্রের দামও কম এবং যথেষ্ট আধুনিক। অপর দিকে তুরস্ক মুসলিম দেশ হওয়ায় যুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশের পাশে থাকবে।
শুরু হয় দুই দেশের মাঝে সামরিক সম্পর্ক। ২০১৮ সালের আগে তুরস্ক বাংলাদেশের সমরাস্ত্রের বাজারে তেমন উল্লেখযোগ্য কোন নাম ছিল না। ১৮ সালের পর থেকে শুরু হয় পটপরিবর্তন। দুদেশের সম্পর্কের পালে বসন্তের হাওয়া লাগতে শুরু করে।
অন্যদিকে তুরস্কের সামরিক সক্ষমতাও বাড়তে থাকে জ্যামিতিক হাড়ে। নিজেদের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি প্রচুর পরিমানে অস্ত্র রপ্তানি শুরু করে দেশটি। তারা এখন বিশ্বের ১২ তম বৃহৎ অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশে পরিনত হয়েছে। তাদের সমরাস্ত্র বিক্রির পরিমাণ বিশ্বের মোট সমর বানিজ্যের ১.১ শতাংশ। তুরস্কের রপ্তানি বাজার দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে।
গত পাঁচ বছরে তাদের রপ্তানি ৫৭৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২২ সালে তারা অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙে বিশ্বে মোট ৪ বিলিয়ন ডলারের সমরাস্ত্র সরবরাহে করেছে। এবছর তারা ৬ বিলিয়ন ডলারের সমরাস্ত্র রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
তুরস্কের রপ্তানি বাজারের অন্যতম গন্তব্য এখন বাংলাদেশ, ২০২১ সালে বাংলাদেশ তুরস্কের ৫ম বৃহৎ রপ্তানি গন্তব্যে পরিনত হয়েছে।
গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার রেংকিং অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪০ তম শক্তিশালী রাষ্ট্র। এবং ২৪ তম বৃহৎ অস্ত্র আমদানিকারক। এতদিন ধরে বাংলাদেশের সমরাস্ত্রের বাজারে একাধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিল চীন। কারণ এত অধিক দামে পশ্চিমা অস্ত্র কেনার সামর্থ্য বাংলাদেশের ছিল না।
সেই দিন এখন বদলাতে শুরু করেছে বাংলাদেশ তার সমরাস্ত্রে বৈচিত্রতা আনতে চাইছে, তুরস্কের সাথে সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করছে।বিভিন্ন সামরিক আমদানির ক্ষেত্রে তুরস্ককে প্রাধান্য দিচ্ছে বাংলাদেশ। ২০১৯ সাল থেকে ২০২২ সাল এ চার বছরে বাংলাদেশের অস্ত্রের যোগানদাতা দেশগুলোর মাঝে তুরস্ক কখনো দ্বিতীয় কখনো তৃতীয় অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল তুরস্ক থেকে কেনা অনেক সমরাস্ত্রের লেনদেনের বিষয়টি পাবলিশ করা হয় না। যারা বাংলাদেশর সমরাস্ত্র সম্পর্কে গভীর নজরদারি করে থাকেন,তারা বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে কোন কোন নতুন অস্ত্র যুক্ত হয়েছে এবং এর দাম কত এর উপর ভিত্তি করে বলছেন তুরস্ক এখন বাংলাদেশের প্রধান সামরিক সরঞ্জাম যোগানদাতা দেশ। যদিও এসকল কথার নির্ভরযোগ্য প্রমাণ তাদের কাছে নেই।
নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশে সামরিক রপ্তানির ক্ষেত্রে তুরস্কের এ স্থান ধরে রাখতে অনেক কঠিন হবে, কারণ এখন বাংলাদেশ ভারী সমরাস্ত্র ক্রয়ের দিকে ঝুকছে।সেক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলোকে প্রাধান্য দেয়া হবে। আর তুরস্ক থেকে কেনা অধিকাংশই ছিল হালকা সমরাস্ত্র। পশ্চিমা সমরাস্ত্র ক্রয় করতে এখন বাংলাদেশ অনেকটা বাধ্যই বলা যায়। কারণ পশ্চিমা ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে বাংলাদেশ সরকারের দিশেহারা অবস্থা। তাদের সাথে অস্ত্র কেনার চুক্তি করলে তারা এ চাপ বহুলাংশে কমিয়ে দিবে।
তুরস্ক কিভাবে এই বিশাল বিপ্লব ঘটিয়ে আজকের এ স্থানে আসল,চলুন বিষয়টা আমার জীবনে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা দিয়ে শুরু করা যাক।
সময়টি সম্ভবত ২০০৯-২০১০. বাংলাদেশের বিমানবাহিনীর একজন উইং কমান্ডার এসেছেন তুরস্কে প্রশিক্ষণ নিতে। তিনি ইস্তানবুলের মিলিটারি একাডেমীতে ট্রেনিং নিয়েছেন এক বছর। তার সাথে আমাদের ভালো সম্পর্ক ছিল। ঐ সময়ে ইস্তানবুলে অধ্যয়নরত ১২-১৫ জন ছাত্র ছিলাম আমরা। উইকেন্ডে আমরা একত্র হতাম। তিনিও আসতেন। প্রায়ই কথা হত বিভন্ন বিষয় নিয়ে। খুব ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার সাথে। তার ট্রেনিং শেষে যখন দেশে যাবেন তার আগে আমাদের সাথে শেষ দেখা করলেন। সেদিন তিনি খুবই এক্সাইডেড ছিলেন। তিনি অনেক উৎসাহ নিয়ে আমাদেরকে বললেন যে গত ৩-৪ দিনে তিনি এবং সাথে অন্য দেশেরও সেনা সদস্যরা যারা ট্রেনিং শেষ করেছে তারা তুরস্কের অস্ত্র তৈরির কারখানাগুলো পরিদর্শন করেছেন। তিনি তখন তুরস্কের অনেক গুলো কোম্পানিরও নাম বলেন। নামগুলোর সবগুলোর শেষেই – সান থাকায় এখন মিলাতে পারছি সেগুলোর নাম। যেমন আসেলসান, রকেটসান, হাভেলসান, মেতেকসান, এগুলো। তিনি এদের অস্ত্রের বর্ণনা দিলেন আমাদেরকে। আর বললেন সরওার তোমরা ধারনাও করতে পারবে না যে এরা কত ধরণের অস্ত্র তৈরি করছে আর কত দ্রুত এগুচ্ছে। আমরা তখন এগুলোর নাম তো দূরের কথা তুরস্ক রাইফেল আর বন্দুকের বাইরে কিছু তৈরি করতে পারে সেই ধারণাই ছিলনা। আমি অবশ্য একটু আগ বাড়িয়েই তাকে বললাম ভাই আপনি মনে হয় প্রথম কোন অস্ত্র কারখানায় গেছেন তাই আপনার উৎসাহ এত বেশি। আর আপনি এতো উদ্দীপনা অনুভব করছেন। তিনি বলেন সরওয়ার দেখো আর দশ বছরের মধ্যে তুরস্ক সামরিক শিল্প যে কোন পর্যায়ে পৌছাবে তোমরা ধারণাও করতে পারবে না।
আমরা তখন তার কথার মর্ম বুঝিনি। আসলেই বুঝিনি। সেই ভাই এখন বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। তখন যে তুরস্কের নিজস্ব তৈরি সমরাস্ত্র সম্পর্কে নিজ দেশেই কেউ কিছু জানতো না বা সে রকম আহামরি টাইপের কিছু তৈরি করতে পারে বলে ধারণা করতো না। মাত্র দশ বছরের মাথায় এখন তুরস্কের নিজস্ব তৈরি ড্রোনের দিকে সারা দুনিয়া বিস্ময় ভরে তাকিয়ে থাকে। তুরস্কের সামরিক শিল্প এখন বিশ্বের প্রধান কয়েকটি দেশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। সত্যিই অবিশ্বাস্য। ভাবলে স্বপ্নের মত মনে হয়।
১৫ বছর আগেও তুরস্কের ব্যবহৃত অস্ত্রের ৮০ ভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হত। আর এখন তুরস্কের সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত অস্ত্রের ৭৫ ভাগই দেশের তৈরী। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করছে নিজস্ব প্রযুক্তির অস্ত্র । আমরা যদি গত পাঁচ বছরের অস্ত্র রপ্তানির পরিমাণ দেখি তাহলে বিষয়টি আরেকটু স্পষ্ট হবে।
তুরস্কের মোট সামরিক রপ্তানি
২০১৬ – ১,৬৮ বিলিয়ন ডলার (১,৬৭৭,১১৬,১৫০)
২০১৭ – ১.৭৪ বিলিয়ন ডলার (১,৭৩৮,৫১২,০০০)
২০১৮- ২ বিলিয়ন (২,০৩৫,৯৫৬,০০০)
২০১৯- ২,৭ বিলিয়ন (২,৭৪০,৬৯৪,০০০ ডলার)
২০২০- ২,৩ বিলিয়ন (২,২৭৯,০২৭,০০০ ডলার)
২০২১ -এ বছরের প্রথম ৯ মাসে ২,১ বিলিয়ন (২,১০৯,৪৭৮,০০০ ডলার (জানুয়ারী – সেপ্টেম্বর)
২০২২- এ মোট ৪ বিলিয়ন ডলার
ডলারের অস্ত্র রপ্তানি হয়েছে। ডিফেন্স নিউজ ম্যাগাজিন প্রকাশিত ২০২০ সালের বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১০০ অস্ত্র প্রস্তুতকারক কোম্পানির মধ্যে তুরস্কের ৭ টি কোম্পানি স্থান পেয়েছে। মুসলিম বিশ্বের মধ্যে একমাত্র তুরস্কই আছে এই তালিকায় । যেখানে বিশ্বের শীর্ষ ১০০ কোম্পানির তালিকায় ভারতের মাত্র ২ টি কোম্পানি স্থান পেয়েছে ।
যাহোক, এবার আসি বাংলাদেশের তুরস্কের সম্পর্কে। গত দশ বছর ধরে বাংলাদেশের সাথে তুরস্কের রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্কে অনেক উত্থান পতন হলেও, সামরিক সম্পর্কে সেগুলোর প্রভাব পড়েনি বললে একটুও ভুল হবে না। তুরস্ক বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে থাকায় এবং গত কয়েক বছর আগে পর্যন্তও বাংলাদেশের গণমাধ্যমে তুরস্কের গুরুত্ব না থাকায় এই দুই দেশের মধ্যের সামরিক বেসামরিক অনেক গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক তেমন একটা প্রচার হয়নি। যেমন, সেই ২০০০ সালে তুরস্কের Netaş (নেতাশ) টেলিকমুনিকেশন বাংলাদেশের BTCL এর সাথে একটা চুক্তি হয়। তখন BTCL এর নাম ছিল বাংলাদেশ টেলিগ্রাম এন্ড টেলিফোন বোর্ড বা বিটিটিবি। সেই চুক্তি অনুযায়ী ১০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ঢাকা থেকে বগুড়ার মধ্যে অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল বসানোর কাজ পায় তুরস্কের এই কোম্পানিটি।
এরপর এই দুই কোম্পানির মধ্যে আরকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ২০০৪ সালের দিকে। তখন তুরস্কের এই কোম্পানিটি সারা দেশে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য অবকাঠামো উন্নয়নের দায়িত্ব পায়।
২০০৮ সালে আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সে চুক্তি অনুযায়ী ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন লিংকের ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি এবং ওই লাইনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে অতিরিক্ত আরেকটা লাইন বসানোর জন্য ১,৯ (প্রায় ২ মিলিয়ন) ডলারের কাজ পায় তুরস্কের এই কোম্পানিটি।
২০১৪ সালে, ইন্টারনেট লাইনের ক্যাপাসিটি বৃদ্ধির জন্য ৩ মিলিয়ন ডলারের আরেকটি কাজ পায়।
এভাবে এই নেতাশ বাংলাদেশের ইন্টারনেট লাইন স্থাপনে গত ১৬ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে। এরকম অনেক কোম্পানি আছে যারা বাংলাদেশে কাজ করে যাচ্ছে বহু বছর ধরে।
অন্যদিকে ১৯৮১ সালের ঢাকায় উভয় দেশ সামরিক প্রশিক্ষণ, শিক্ষা ও সেনাবাহিনীর যৌথ সহায়তার বিষয়ে একটি চুক্তি সাক্ষর করে। সে চুক্তির উপর ভিত্তি করে তুরস্কের সাথে বাংলাদেশের নৌ বাহিনীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠে। তুরস্ক নৌবাহিনী বহু বছর বাংলাদেশের নৌবাহিনীর স্পেশাল অপারেশন ফোর্স SWADS কে ট্রেনিং দিয়ে আসছে।
সেই আশির দশক থেকেই বাংলাদেশ তুরস্কের তৈরি অস্ত্র ব্যবহার করছে। তখন বিশেষ করে ভারী অস্ত্র বা আর্টিলারি গান কিনেছে বাংলাদেশ।
তবে দু দেশের মধ্যে সামরিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় হতে শুরু করে ২০০৪ সালের পর থেকে। কারণ ওই বছর তুরস্ক এবং বাংলাদেশের মধ্যে সামরিক প্রশিক্ষণ সম্পর্কিত একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সে চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের সেনা বিমান এবং নৌবাহিনীর ৩০০০ অফিসারকে ট্রেনিং দেয় তুরস্ক।এদের মধ্যে অনেকেই তুরস্ক এসে স্বল্প মেয়াদে এবং দীর্ঘ মেয়াদে প্রশিক্ষণ নেন। এই ভিডিওর শুরুতে বিমানবাহিনীর যে অফিসারের কথা বললাম তিনিও ওই ট্রেনিং কর্মসূচির আওতায়ই তুরস্কে আসে। তারা তুরস্ক ভাষা শিখতে বাধ্য। এ কারণে বাংলাদেশ এখন ট্রেনিংএর জন্য তুরস্কে সেনা পাঠানো কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে।
এর পর শুরু হয় তুরস্ক থেকে অস্ত্র কেনার পালা। তুরস্কের Otokar কোম্পানি থেকে ২০০৭-৮ সালে পরীক্ষার জন্য ২৪ টি কোবরা হাল্কা সাঁজোয়া যান নেয় বাংলাদেশ। ২০১০ সালে বাংলাদেশ পুলিশ ৭ টি কোবরা কিনে। ২০১৩ সালে আরও ২২ টি কোবরা কিনে বাংলাদেশ। ২০১৭-১৮ সালে আরও ৬৭ টি কোবরা পায় বাংলাদেশ। ২০১৩ সালে তুরস্কের Otokar কোম্পানি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে xxx টি কোবরা হাল্কা সাঁজোয়া যান সরবরাহ করে।
২০১৫ সালে তুরস্ক বাংলাদেশকে জি২জি চুক্তির মাধ্যমে গাইডেড মিসাইল ফ্রিগেট অফার করে। যদিও বাংলাদেশ সেদিকে ধীর গতিতে অগ্রসর হয়। এবং সে প্রস্তাবে এখনো হ্যাঁ, না কিছুই বলেনি।
২০১৭ সালে তুরস্কের Delta ডিফেন্স নামক কোম্পানি বাংলাদেশে ৬৮০ টি TUR-K সাঁজোয়া যান সরবরাহের একটা কাজ পায় ১ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে। এবং ২০১৯ সালের মধ্যে সেগুলোকে সরবরাহ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে। বর্তমানে বাংলাদেশ তুরস্কের, রাশিয়ার এবং সার্বিয়ার তৈরি সাঁজোয়া যান ব্যবহার করছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আছে তুরস্কের তৈর যান।
২০১৮ সালে তুরস্কের Dronmarket নামক একটা কোম্পানি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ১,৫ (দেড়) বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ৫০০ টি ড্রোন সরবরাহ করে।
তুরস্কের সামরিক সিমুলেটর তৈরিকারী কোম্পানি Simsoft এর সাথে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ২০১৬ সালে। সে চুক্তি অনুযায়ী তুরস্কের এই কোম্পানিটি বাংলাদেশের জন্য সাঁজোয়া যান সিমুলেটর তৈরী, সরবরাহ এবং ট্রেনিংয়ের চুক্তি হয়। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে আরও দুটি নতুন চুক্তি হয়। সে অনুযায়ী Simsoft বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে আর্মার্ড পার্সোনাল ক্যারিয়ার ভেহিকেল শুটিং অ্যান্ড ড্রাইভিং ট্রেনিং সিমুলেটর এবং এয়ার ডিফেন্স ওয়েপন ট্রেনিং সিমুলেটর সরবরাহ করে। একই সাথে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের ট্রেনিং দেয়।
২০১৮ সালে তুরস্কের METEKSAN কোম্পানির তৈরি ৬ টি Retinar PTR রেটিনার পিটিআর নামক স্থল নজরদারি রাডার কিনে বাংলাদেশ।
২০১৯ সালে তুরস্কের কোম্পানি ইলেকট্রোল্যান্ড ডিফেন্স থেকে ৫ টি খান নামক রিমোট কন্ট্রোলড বোম্ব ডিসপোসাল রোবট কিনে বাংলাদেশ। সেবছর একই কোম্পানি থেকে ৬টি বোমা নিষ্ক্রিয়কারী ব্যারেলও কিনে। পরের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে আরও ২ টি বোম্ব ডিসপোসাল রোবট এবং ১০ টি বোমা নিষ্ক্রিয়কারী ব্যারেলের অর্ডার দেয়।
তুরস্ক থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র কেনার চুক্তি হয় ২০১৯ সালে।
সে বছর ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারেক আহমেদ সিদ্দিকী এবং তখনকার সেনা প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ তুরস্ক সফর করেন। সেসময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩১-জনের একটা দল তুরস্কের KIS-2019 নামক বহুজাতিক শীতকালীন সামরিক মহড়ায় অংশগ্রহণ করে। তখন এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও সে মহড়া পরিদর্শন করেন।
এর এক মাস পরে ২০১৯ সালের মার্চ মাসে তুরস্কের মিসাইল প্রস্তুত কারক কোম্পানি রকেটসানের সাথে বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে মাঝারি পাল্লার গাইডেড মাল্টিপল রকেট লাঞ্চার দেয়ার কথা। এই চুক্তির পরিমাণ প্রায় ৬০ মিলিয়ন ডলার। এটাই তুরস্ক এবং বাংলাদেশের মধ্যে এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় সামরিক চুক্তি। এরই অংশ হিসেবে বাংলদেশ সেনাবাহিনীর ৪১ জন সদস্য TRG-300 Kasirga MLRS এর উপর তুরস্কে ট্রেনিং নেয়। ২০২১ সালের জুন মাসে রকেটসান তার TRG-300 Kaplan/টাইগার MLRS রকেট লাঞ্চার সিস্টেম বাংলাদেশকে সরবরাহ করে। ১২০ কিলোমিটার পাল্লার এই TRG-300 kaplan মিসাইলের ১৮টি ইউনিট পায় বাংলাদেশ। এটাই এখন বাংলাদেশের হাতে সবচেয়ে লম্বা পাল্লার । বাংলাদেশ তুরস্ক থেকে ১ রেজিমেন্ট (১৮ ইউনিট) T-300 kasirga মাল্টিপল রকেট লাঞ্চার সিস্টেম কিনেছে।
এই সিস্টেমের আছে চারটি ৩০০ মিমি. রকেটের লাঞ্চার টিউব। আর এই সিস্টেমের রকেট সর্বোচ্চ ১২০ কিলোমিটার দূরে আঘাত হানতে সক্ষম।
করোনার কারণে ২০২০ সালে এই সেক্টরে নতুন চোখে পড়ার মত তেমন কোন কর্মকাণ্ড দেখা যায়নি। তবে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করেছে দুই দেশ। যার উপর ভিত্তি করে ২০২২ সালটি তুরস্ক-বাংলাদেশের সামরিক সম্পর্কের এযাবৎ কালের সবচেয়ে সবচেয়ে ফলপ্রসূ বছর হিসেবে সামনে চলে আসে।
এ বছর এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল মাসিহুজ্জামান সেরনিয়াবাত ৬ দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে তুরস্কে আসেন। এবং তুরস্ক সেনা নৌ ও বিমান বাহিনী কমান্ডারদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন এবং বাংলাদেশ ও তুরস্ক বিমান বাহিনীর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচনা করেন।
এর পরে মে-জুন মাসে বাংলাদেশের নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল এম শাহীন ইকবাল ৮ দিনের সফরে তুরস্ক আসেন। সে সফরে তিনি তুরস্কের সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে জাহাজ নির্মাণ, সাইবার নিরাপত্তায় পারস্পারিক সহযোগিতা বাড়ানোসহ বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেন।
এর পরে আগস্ট মাসে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ ৮ দিনের সরকারী সফরে তুরস্কে আসেন। সেখানে তিনি তুরস্কের সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে দুই দেশের সামরিক এবং তুরস্কের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে সামরিক সরঞ্জামাদিসহ সব প্রকার সহযোগিতা এবং সহায়তার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।
সে সফরের পর তুরস্ক এবং বাংলাদেশের মধ্যে আরেকটা g2g চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যার আওতায় তুরস্কের রকেটসান বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করবে। চুক্তির পরিমাণ এবং ধরণ সম্পর্কে স্পষ্ট কোন কিছু জানানো হয়নি। তবে ধারণা করা হয় এই চুক্তি এর আগের চুক্তির চেয়েও বড় একটা চুক্তি। এবং এই চুক্তির অধীনে রকেটসান বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সাথে একত্রে বাংলাদেশে গোলাবারুদ এবং রকেট ও মিসাইল উৎপাদন করবে।
এই চুক্তির কয়েকমাস পরে বাংলাদেশ সফর করেন রকেটসানের বড় একটা প্রতিনিধি দল। প্রায় ৩২ জনের সেই দলে আছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং ইঞ্জিনিয়ার। তাদের সফর বা তারা বাংলাদেশে কি করবেন এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কিছু জানানো হয়নি। তাই আমিও বিস্তারিত কিছু বলা থেকে বিরত থাকাকেই যৌক্তিক মনে করছি। তবে রকেটসানের সাথে বাংলাদেশের বিগত চুক্তি গুলো পর্যালোচনা করলে এই ফলাফলে উপনীত হওয়া যায় যে তুরস্কের এই প্রতিনিধিদল দুইটি কাজে বাংলাদেশে যেতে পারেন, একটা হচ্ছে রকেটসান থেকে বাংলাদেশ যে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কিনছে সেটার পরিক্ষামূলক উৎক্ষেপণ করা। আরেকটা হচ্ছে, বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর অস্ত্র উৎপাদন কারখানায় রকেটসানের অস্ত্র উদপাদন লাইন স্থাপন করা।
এ বছরের মাঝামাঝি সময় দু দেশের মধ্যে আরেকটি জি২জি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সে চুক্তি অনুযায়ী তুরস্কের REPKON কোম্পানি বাংলাদেশের সামরিক শিল্প তৈরি প্রতিষ্ঠানের জন্য ১০৫ এবং ১৫৫ মিলিমিটারের ক্যানন-বল বডি এবং শেল প্রডাকশন লাইন স্থাপন করে দিবে।
এছাড়াও meteksan থেকে সিমুলেটর, অন্য কোম্পানি থেকে গোলাবারুদ, বন্ধুকের বিভিন্ন অংশ, আরও কিছু আনআর্মড ড্রোন সহ আরও অনেক সামরিক অস্ত্র কিনছে তুরস্ক থেকে।
কিছু অসমর্থিত সূত্রমতে বাংলাদেশ তুরস্ক থেকে রকেটসানের HISAR-O নামক মাঝারি পাল্লার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। এই সিস্টেম থেকে নিক্ষিপ্ত মিসাইল সর্বোচ্চ ২৫ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁতভাবে আঘাত হানতে সক্ষম।
ভবিষ্যতে, বাইরাক্তার টিবি-২, ( বাংলাদেশ এখন এ ড্রোন কিনেছে) ভেস্টেল কারায়েল সহ আরও কিছু ড্রোন কোম্পানি থেকে ড্রোন কিনতে পারে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ যে ছয়টা ফ্রিগেট জাহাজ কেনার টেন্ডার দিয়েছে সেখানেও তুরস্ক আবেদন জমা দিয়েছে। অনেক খবরে অবশ্য বলা হয়েছে যে এই টেন্ডারটি তুরস্ক পাবে। কিন্তু এখনো এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোন ঘোষণা আসেনি।
তুরস্ক থেকে বাংলাদেশের সামরিক সরঞ্জাম আমদানির পরিমাণ
২০১৩- ৩,০০০,০০০ (৩০ লাখ ডলার)
2016- 323,790 ( ৩ লাখ ডলার)
২০১৭ – ১৬,৩৭৫,০০০ (১ কোটি ৬৪ লাখ ডলার)
২০১৮ – ২৪,১১৩,০০০ ( ২ কোটি ৪১ লাখ ডলার)
২০১৯ – ২,৩২২,৯৪০ (২৩ লাখ ডলার)
২০২০ – ১,৩০৪,০৪০ ( ১৩ লাখ ডলার)
২০২১ – ৫৯,৩২৫,০৪০ ( ৬ কোটি ডলার) (জানুয়ারী সেপ্টেম্বর)
সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদ মুবারাক। সারা বিশ্বের মুসলমাদের জাতি এবং ভাষা ভিন্ন হলেও কিন্তু সবাই ঈদ মোবারাক কথাটি ব্যবহার করেই ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে। এটা সার্বজনীন। কিন্তু তুর্কিরা এই কথাটির পরিবর্তে নিজস্ব ভাষায় ঈদের শুভেচ্ছা জানায়। Bayraminiz Mubarek Olsun. আজ আমরা তুর্কিদের ঈদের কেনাকাটা নিয়ে আলোচনা করব। তুর্কিরাও ঈদের আগে আমাদের মতই কেনাকাটা করতে ছুটে যায় বাজারে দোকানে শপিং মলে? শপিং মল গুলোতে এবং চেইনশপগুলোতে ঈদে ব্যপক ছাড় ও বিভিন্ন ধরণের অফার দেয়া হয় । তাই মানুষ এই সময় শপিং মলে গিয়ে কেনাকাটা করে। বিশেষ করে পোশাক কিনতে শপিং মলে যায় মানুষ। আর গত দুই বছর পর এই প্রথম মাস্ক ছাড়া চলাফেরা এবং কেনাকাটার সুযোগ পেয়ে মানুষ মন খুলে ঘোরাফেরা করছে। চকলেট,, মিষ্টি, চাল, ডাল, মসলা গোস্ত বিক্রি হয় এমন জায়গায় মানুষের সমাগম চোখে পড়ার মত। আঙ্কারার সবচেয়ে বিখ্যাত এবং সবচেয়ে পুরাতান মসলার বাজার Ulus Halı। আমরা সেখানে গিয়ে যে ভিড় দেখতে পাই তা বলার মত না। তুর্কিরা সবচেয়ে বেশি কিনছে চকলেট। বিভিন্ন রঙের বিভিন্ন স্বাদের চকলেট। ঈদের সময় শিশুদের চকলেট দেয়ার রীতি আছে এখানে। পরিচিত অপরিচিত সব শিশুকেই আপনি চকলেট দিতে পারেন। আবার ঈদের দিন আপনার এলাকার সব শিশুরাই আপনার বাসার কড়া নেড়ে ঈদ মোবারাক জানাবে। তখনও তাদেরকে চকলেট দিতে হয়। তাই ঈদের সময় চকলেট বাসায় থাকতেই হবে। আরেকটা মিষ্টান্ন হচ্ছে বাকলাভা। এই বাকলাভা ছাড়া ঈদ যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাই ঈদের আগে বাকলাভা কেনার ভিড় পরে। আমরা এই যে বাকলাভা বিক্রির দোকানটিতে এসেছি এখানে চারিদিকে এতো ভিড় যে আপনার সিরিয়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। বাকলাভা ৫ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত অনায়াসেই রাখা যায়। নষ্ট হয় না। তাই ঈদের আগে থেকেই অনেকে বাকলাভা কিনে রাখেন। অনেকে আবার অর্ডার দিয়ে রাখেন ঈদের দিন সকালে নিয়ে যান। অনেকে আবার বাসায়ই তৈরি করেন ঈদের বাকলাভা। বাকলাভার পরে আমরা এসেছি একটি মসলার দোকানে। আঙ্কারার এই উলুস এলাকার সবচেয়ে বিখ্যাত মসলার দোকানে আছি আমরা। দোকানটির নাম hacibaba baharat। এখানে সবধরনের মসলা পাওয়া যায়। তুর্কিদের পাশাপাশি প্রচুর বিদেশীরাও এখান থেকেই মসলা কিনতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এখানের কর্মচারীদের অমায়িক আচরণ আর মসলাগুলোর বাংলায় নাম জানার কারণে এই দোকানটি বাংলাদেশীদের কাছেও অনেক পরিচিত। বাসমতী চাল, কাসুন্দি, জয়ফল, জয়থ্রি সহ সব ধরণের মসলাই এখানে পাওয়া যায়। ঈদের আগে মসলার দোকানগুলোতে ভিড় ছিল চোখে পড়ার মত। কারণ ঈদের দিন তুর্কিরা গোস্তের কাভুরমা বা ভুনা গোশত খেতে পছন্দ করে। একারণে গোস্তের দোকানেও ভিড় ছিল চোখে পড়ার মত। এখানে পশুর সব অংশই বিক্রি করা হয়। পা থেকে শুরু করে কলিজা ভুরি সবকিছুই পাওয়া যায় এখানে। তবে ঈদের আগে মাছের দোকানে তেমন ভিড় থাকে না। আর রুটি কেনার জন্যও আছে প্রচুর ভিড়। ঈদের সকালের নাস্তায় তুর্কিদের আরেকটি জনপ্রিয় খাবার হলো পাস্তিরমা বা বেকন। সাথে সুজুক সালাম, সসিস, পনির, জয়তুন আর মধু তো থাকবেই। তাই এগুলো বিক্রির দোকানেও ব্যপক ভিড় থাকে।
আমরা আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী কেনাকাটা করে। উলুস থেকে বাসায় ফিরলাম।
গণ যোগাযোগ এবং সাংবাদিকতায় এজেন্ডা সেটিং বলে একটা থিওরি আছে। যেখানে, জনগণ কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে সেটা মিডিয়ার মাধ্যমে সেট করা হয়। এটি বিভিন্ন মিডিয়া নিজস্ব স্বার্থে ভিন্ন ভিন্ন ভাবেও করে। আবার সব মিডিয়া একত্রেও করে।
একটা নির্দিষ্ট সময়ে দেশের হট টপিক কী হবে সেটা নির্ধারণ করা হয় মিডিয়ার মাধ্যমে। এই থিওরি অনুযায়ী পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে নির্দিষ্ট কোন বিষয়কে সুকৌশলে নির্দিষ্ট সময়ে সামনে আনা হয়। মিডিয়া ওই বিষয়টিকে ফলাও করে প্রচার করে। দিনের পর দিন বিষয়টিকে অনেক বেশি কভারেজ দেয়। ঘন্টার পর ঘন্টা টকশোর আয়োজন করা হয়। যে দিকেই তাকাবেন দেখবেন সব গনমাধ্যমই সেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছে। কেউ পক্ষে কেউবা বিপক্ষে।কিন্তু আলোচনা হচ্ছেই। সাধারণ মানুষও তখন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করে। এবং শেষ পর্যন্ত অন্য সব বিষয়কে ছাড়িয়ে এই বিষয়টিই হয়ে ওঠে দেশের হট টপিক। প্রধানত তিন কারণে এজেন্ডা সেটিং করা হয় ১। সমাজে কোন বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে (যেমন মাদক বিরোধী, যৌতুক বিরোধী, দুর্নীতি বিরোধী, বা কোন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক দিবসকে নিয়ে বিশেষ কভারেজ) ২। কোন বিষয়ে অতিরিক্ত গুরুত্তারোপ করতে (যেমন কোন বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানদের সফর) ৩। নির্বাক বা কণ্ঠরোধ করতে (যেমন কোন ইস্যুকে আড়াল করতে বা ওই ইস্যু নিয়ে যেন কেউ কথা না বলে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে অন্য কোন ইস্যুকে সামনে নিয়ে আসা হয়) এই এজেন্ডা সেটিং যেমন গণমাধ্যমগুলো নিজস্ব স্বার্থে করে তেমন তাদের পিছনের যে বড় বড় হোল্ডিং বা গ্রুপ থাকে তাদের স্বার্থেও করতে পারে। আবার নির্দিষ্ট কোন রাজনৈতিক দলের জন্যও করে থাকে। তবে এই যে শেষের কারণটি বললাম অর্থাৎ নির্বাক বা কণ্ঠ রোধ করতে এজেন্ডা সেটিং। এটা ব্যবহার হয় সুকৌশলে। বিশেষ করে রাজনৈতিক দল, ক্ষমতাসীন দল অথবা ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা যখন কোন বিষয়ে চাপে থাকে তখন সেই চাপ থেকে বাঁচতে অন্য কোন ইস্যুকে সামনে নিয়ে আসে। যেমন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমরা দেখেছি সরকার যখন বড় কোন বিষয় নিয়ে বেকায়দায় পড়ে তখন ফেইক কিছু ইস্যু তৈরি করে যাতে জনমতকে অন্য দিকে ধাবিত করতে পারে। যেমন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন যখন করোনার বিধিনিষেধ অমান্য করে নৈশ পার্টি করার কারণে ব্যপক চাপে ছিলেন তখন তিনি অন্য কতোগুলো বিষয়কে সামনে নিয়ে আসেন। আবার যখন কোন দেশের সরকার অর্থনীতি নিয়ে বড় ধরণের ঝামেলায় থাকে তখন অন্য কোন ইস্যুকে সামনে নিয়ে আসে। আর সে ইস্যুটি হতে হয় এমন কোন স্পর্শকাতর বিষয় যা জনগণের একটি বড় অংশকে জড়িয়ে ফেলে। হতে পারে কোন ধর্মীয় বিষয় অথবা কোন জাতীয় বিষয় অথবা কোন সামাজিক বিষয়। দেশের মানুষের সেন্টিমেন্টের উপর নির্ভর করে এগুলো সেট করা হয়। কখনো দেশের খুব জনপ্রিয় কোন ঐতিহাসিক নেতাকে বিতর্কিত করা হয়, কখনো ব্যপক জনপ্রিয় কোন জীবিত নেতাকে বিতর্কিত করা, কখন কোন সেলিব্রিটিকে ভাইরাল করা, কখনো সেলিব্রিটিকে বিতর্কিত করা। এধরনের কোন ইস্যুকে সামনে আনার পর জনগণের বড় একটা অংশ হয়তো সেটার পক্ষে অথবা বিপক্ষে অবস্থান নেয়।তবে বিপক্ষে অবস্থান নেয়াদের আওয়াজ বেশি বুলন্দ হয়। এই পক্ষে বিপক্ষে যুক্তিতর্ক চলতে থাকে। তবে পর্দার অন্তরালে থেকে এই দুই পক্ষের পিছন থেকে আসল কলকাঠি যারা নাড়েন তাদের উদ্দেশ্য থাকে একই। মাঠ উত্তপ্ত করা। এটা করার জন্য এই ইস্যুটি নিয়ে যত বেশি মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এটা তো এক পক্ষের হাঁক ডাকে সম্ভব না। এক হাতে কি তালি বাজানো সম্ভব? এ জন্য এক পক্ষ আরেক পক্ষকে আরো বেশি আক্রমন করে ব্যপক উত্তেজনা ছড়ায়, ইস্যুটি নিয়ে যত বেশি সম্ভব মাঠ গরম করে এবং শেষ পর্যন্ত মানুষের মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়। এভাবে আসল ইস্যুকে পুরোপুরি আড়াল করা হয়। শেষ পর্যন্ত জনগণ আসল সমস্যা ভুলে এই কৃত্রিম এজেন্ডা নিয়েই ব্যাস্ত থাকে। যে বিষয়টিকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয় সে বিষয়টি যত বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ এই ফেইক ইস্যুটিকেও তত বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা হয়। আর ওই আসল বিষয়টি নিয়ে যারা চাপে ছিল তারা যখন মনে করে যে চাপ মুক্ত হয়েছে তখন এই নকল ইস্যুটিকে সমাজ থেক আস্তে আস্তে বিলুপ্ত করা হয়। এভাবেই এজেন্ডা সেটিং করে আসছে বিভিন্ন মহল, বিভিন্ন গোষ্ঠী, বিভিন্ন দল, সরকার এমনকি বিভিন্ন রাষ্ট্র।
এজিয়ান সাগরে তুরস্ক গ্রীসের সমস্যা কী? ওই সাগরের দ্বীপগুলো গ্রীস কখন কিভাবে দখল করেছে? এখন কেন সেগুলো নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে? এই সমস্যা কি তুরস্ক-গ্রিস যুদ্ধে মোড় নিতে পারে? এগুলো নিয়ে আলোচনা করব আজ।
তুরস্কের সাথে গ্রীসের সমস্যা অনেক। সাইপ্রাস নিয়ে সমস্যা, ভূমধ্য সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে সমস্যা, গ্রীসে বসবাসরত সংখ্যালঘু মুসলিম তথা তুর্কিদের উপড়ে গ্রীসের আক্রমণ নিয়ে সমস্যা, তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানে গ্রীসের ভেটো নিয়ে সমস্যা, আয়া সফিয়াকে আবার মসজিদে রূপান্তর নিয়ে সমস্যা এবং এজিয়ান সাগরের দ্বীপগুলো নিয়ে সমস্যা। আজ আমরা এই দ্বীপগুলো নিয়ে আলোচনা করব।
তুরস্ক এবং গ্রীসের মধ্যে অবস্থিত ছোট্ট একটা সাগর হল এজিয়ান সাগর। কৃষ্ণ সাগর থেকে তুরস্কের মধ্যের দুটি প্রণালী দিয়ে ভূমধ্য সাগরে আসতে এই সাগর পাড়ি দিতে হয়। এই সাগরে ছোট বড় প্রায় তিন হাজার ২০০ দ্বীপ আছে। এ কারণে এই সাগরটিকে দ্বীপের সাগর বলা হয়।
এই দ্বীপ গুলোর ৩০৫০ টি গ্রীসের দখলে আর ১০০ এর মত আছে তুরস্কের অধীনে ।
এই তিনহাজারেরও অধিক দ্বীপের মধ্যে মাত্র অল্প কিছু দ্বীপে মানুষ বসবাস করে। বেশিরভাগ দ্বীপই জনমানবহীন। অনেকগুলো আবার এতই ছোট যে দূর থেকে খালি চোখে দেখা যায় না।
আসুন আমরা মানচিত্রে একটু চোখ বুলিয়ে নেই।
এখন প্রশ্ন হলো, উভয় দেশেরই প্রায় সমপরিমাণ সমুদ্রসীমা থাকলেও কেন প্রায় সবগুলো দ্বীপই গ্রীসের অধীনে। এমনকি তুরস্কের তীরবর্তী দ্বীপগুলোও কিভাবে এই হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে থাকা গ্রীসের হয়ে গেলো। এই বিষয়টি বুঝতে হলে আমাদের ২০০ বছর আগে ফিরে যেতে হবে।
শুরুতেই বলে রাখি উসমানীয় সম্রাজ্যের সাথে ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি যুদ্ধ হয়েছে রাশিয়ার। ১৫৬৮ সাল থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত রাশিয়া উসমানীয় সম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ১২ বার যুদ্ধ করে যার ৭ বার রাশিয়া বিজয়ী হয় আর ৫ বার উসমানীয়রা বিজয়ী হয়।
১২৯৯ সালে ওসমান গাজির হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় উসমানী সালতানাত ১৬৯৯ সাল পর্যন্ত অটোম্যান সম্রাজ্য বিস্তৃতি লাভ করে বহুবার তা শেষ পর্যন্ত ভিয়েনার দরজায় গিয়ে ঠেকে।উসমানীয় বাহিনী কৃষ্ণ সাগর, এজিয়ান সাগর, ভূমধ্য সাগর, লোহিত সাগর এবং পারস্য উপসাগরে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।যে কারণে কৃষ্ণ সাগরে রাশিয়ার ঢোকার পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। কারণ রাশিয়ার যতগুলো সমুদ্র বন্দর ছিল সেগুলো শীতে জমে বরফ হয়ে যায়। সারা বছর সেগুলোতে জাহাজ নোঙর করতে পারে না। এ কারণে রাশিয়া উষ্ণ জলে নামার পথ খোঁজে। এবং বার বার ক্রাইমিয়া দখলে উসমানীয়দের সাথে যুদ্ধ লিপ্ত হয়। উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ক্রাইমিয়া এবং আজব সাগরের তীরবর্তী অঞ্চলগুলো দখল করে নেয়। এভাবে কৃষ্ণ সাগরের গুরুত্বপূর্ণ একটি বন্দর তার দখলে আসে। কিন্তু কৃষ্ণ সাগর দিয়ে ভূমধ্য সাগরে আসতে যে সব সাগর এবং প্রণালী ছিল সেগুলো সবই ছিল উসমানীয়দের দখলে। কিন্তু ইস্তানবুল যেহেতু উসমানীয়দের রাজধানী তাই সেটা তো দখল করা সম্ভব না। তাই এজিয়ান সাগরকে মুক্ত করতে গ্রীসের স্বাধীনতায় উঠে পরে লাগে রাশিয়া। এক দিকে উসমানীয়দের অধীনে থাকা বলকান অঞ্চলে বিদ্রোহ উস্কে দেয় আরেক দিকে গ্রীকদের বিদ্রোহে ইন্দন দেয়। তিনদিক থেকে উসমানীয়রা বিদ্রোহ দমনে দিশেহারা।
এই অবস্থায় ১৮২০ সালের দিকে রাশিয়ার সাথে যোগ দেয় ব্রিটেন এবং ফ্রান্স। এবার তারা অটোম্যান সম্রাজ্যকে ভাঙ্গার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামে। সে পরিকল্পনার একটি ছিল গ্রীকদের দিয়ে বিদ্রোহ করানো এবং গ্রীসকে স্বাধীন করানো। এরই অংশ হিসেবে ওই সময়ে উসমানীয় সম্রাজের অধীনে থাকা গ্রীসের বিভিন্ন অংশে বিদ্রোহ শুরু হয়। ১৮২২ সালে গ্রীকরা হেলেনিক রিপাবলিক নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়। সংখ্যালঘু মুসলিম তুর্কিদের উপর অত্যাচার শুরু করে । তুর্কিদের অধীনে থাকা গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস করে দেয় এবং লাখ লাখ তুর্কি হত্যা করা হয়। কোন কোন সোর্সে নিহত তুর্কিদের সংখ্যা ৫ লাখ বলেও দাবি করা হয়। এরই মধ্যে ১৮২৭ সালে রাশিয়া ব্রিটেন এবং ফ্রান্স অটোম্যানদের কাছে গ্রীসকে স্বাধীন করে দেওয়ার দাবি করে। কিন্তু অটোম্যান সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ তাদের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তখন ভূমধ্যসাগরে অটোমানদের নৌ বাহিনীর দাপটে অ্যাজিয়ান সাগর, পূর্ব ভূমধ্য সাগর এবং দক্ষিণ কৃষ্ণ সাগরে কেউ প্রভাব খাঁটাতে পারতো না। সে সময়ে বাল্টিক সাগর থেকে রাশিয়া তার নৌ বহরের একটি অংশ পাঠায় ভূমধ্য সাগরে। রাশিয়ার সাথে ব্রিটেনের নৌবহর যোগ দেয় ভূমধ্য সাগরে এসে। তাদের সাথে যোগ দেয় ফ্রান্সের নৌবহর। এই দিন দেশের নৌবহর একত্রে সুযোগ খুঁজতে থাকে অটোম্যানদের নৌবহরে আঘাত হানার। সেসময় অটোম্যান এবং মিশরের নৌবহর তখনকার নাভারিনো বন্দর যা বর্তমান গ্রীসের পাইলোস বন্দরে নামে পরিচিত সেখানে অবস্থান করছিলো। তারা নাভারিনো বন্দরে থাকা অটোম্যান নৌবহরকে ঘেরাও করে ফেলে। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন ব্রিটিশ অ্যাডমিরাল এডওয়ার্ড কড্রিংটন। সেখানে অটোম্যানদের ৭৮টি ছোট বড় যুদ্ধ জাহাজ ছিল। এগুলোকে ঘেরাও করার পর মুক্তিপণ হিসেবে গ্রীসকে স্বাধীন করার দাবি জানায় তারা। ওসমানী সুলতান এই দাবিও প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তীতে একটা নামকাওয়াস্তে সমঝোতা হয় এবং তারা ওই বন্দরের অবরোধ উঠিয়ে নেয়। এবং যুদ্ধ না করার ঘোষণা দেয়। ওসমানী শক্তির কাছে বন্দরে নোঙরের অনুমতি চায়। নোঙরের অনুমতি দিলে তাদের জাহাজ গুলো বন্দরে এসে তারপর অতর্কিত হামলা করে উসমানীয় নৌ বহরে। সে যুদ্ধে উসমানীয়দের সব জাহাজ ধ্বংস হয় এবং প্রায় ৪১০৯ জন নাবিক হতাহত হয়।
সেই নৌ বহর হারিয়ে উসমানীয় নৌবাহিনী অনেক দুর্বল হয়ে পড়ে যা কাটিয়ে উঠতে পারেনি গত দুইশ বছরেও। অর্থাৎ ২০০০ সালের শুরুর দিক পর্যন্ত তুর্কিদের নৌবাহিনী অনেক দুর্বল ছিল। যাই হোক সেই নাভারিনোর যুদ্ধের পর দুর্বল নৌবাহিনী এজিয়ান সাগরে গ্রীকদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তখন গ্রীকরা মাত্র একটা যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে এজিয়ান সাগরের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ দখল করে নেয়। সে সময় অটোম্যান সুলতান রুশদের জন্য চানাক্কালে প্রণালী বন্ধ করে দিলে শুরু হয় রাশিয়ানদের সাথে অটোম্যানদের নবম যুদ্ধ। ১৮২৮ থেকে ১৮২৯ সাল পর্যন্ত সে যুদ্ধ চলে। আসল উদ্দেশ্য অটোম্যানদের দুর্বল করা যাতে গ্রীকরা আরও জায়গা দখল করতে পারে। উসামানিয়রা সেই যুদ্ধে রাশিয়ার কাছে পরাজিত হয়ে ১৮২৯ সালে এদিরনে চুক্তির মাধ্যমে গ্রীসের স্বাধীনতাকে মেনে নেয়।
নাভারিনোর যুদ্ধ
তখন এই সাগরের দখলকৃত দ্বীপগুলোর বাইরেও নতুন নতুন দ্বীপ দখল করতে শুরু করে গ্রীস। পরে উসমানীয় খেলাফত যতই দুর্বল হতে থাকে ততই এই দ্বীপগুলো হাতছাড়া করতে বাধ্য হয়। কখনো গ্রীসের কাছে, কখনো ইতালির কাছে কখনো বা ব্রিটেনের কাছে।
যেমন ১৮২৯ সালে এদিরনে চুক্তির মাধ্যমে এজিয়ান সাগরের পশ্চিম দিকের দ্বীপগুলো গ্রীসের কাছে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ১৮৩২ সালে লন্ডন চুক্তির মাধ্যমে উত্তর স্পোরাত দ্বীপগুলো গ্রীসের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়। ১৮৯৮ সালে গ্রিত দ্বীপ গ্রীস দখল করে নেয়। ১৯১১-১২ সালে তুর্ক-ইতালি যুদ্ধে ওনইকি দ্বীপ নামক একগুচ্ছ দ্বীপ ইতালি দখল করে নেয়। আর ১৯১২-১৩ সালে উস্মানিয়রা যখন বলকান অঞ্চল রক্ষায় ব্যস্ত অর্থাৎ বলকান যুদ্ধে ব্যাস্ত তখন পূর্ব অ্যাজিয়ানের সবগুলো দ্বীপ দখল করে নেয় গ্রীস। পরে আর উসমানীয়রা ওই দ্বীপগুলো পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয় নি। ১৯১৩-১৯১৪ সালে ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, জার্মানি, ইতালি, এবং অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি এই ছয় দেশ লন্ডন চুক্তি এবং লন্ডন কনফারেন্সের মাধ্যমে এই দ্বীপগুলোতে গ্রীক কর্তৃত্বকে মেনে নেয় এবং ওসমানীয়দের সেই চুক্তি মানতে বাধ্য করে। অর্থাৎ প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের আগেই বিশেষ করে সুলতান আব্দুল হামিদকে খমতাচ্যুতির পরপরই এজিয়ান সাগরের প্রায় সবগুলো দ্বীপ গ্রীস এবং ইতালির দখলে চলে যায়।
এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। অটোম্যান সম্রাজ্য ভেঙ্গে খান খান। ব্রিটিশ, ফ্রান্স এবং রাশিয়া সহ পরাশক্তিরা উসমানীয়দের প্রায় সবটুকু ভূমি ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছে নিজেদের মধ্যে। ইস্তাম্বুলে সুলতান তখন ব্রিটিশদের হাতের পুতুল। একদল তুর্কিরা তখন কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে স্বাধীনতার লড়াই শুরু করে। শেষ পর্যন্ত ১৯২৩ সালে লুজান চুক্তি হয়। সেই লুজান চুক্তির ৬, ১২, ১৩, ১৪, ১৫, এবং ১৬ নম্বর ধারা অনুযায়ী তুর্কিরা আরও একবার মেনে নিতে বাধ্য হয় যে এই দ্বীপগুলোর কর্তৃত্ব গ্রীস এবং ইতালিরই। তবে সেই চুক্তির ৬ নম্বর ধারা অনুযায়ী তাদের অধীনে থাকা দ্বীপগুলো ছাড়াও দুই দেশের অর্থাৎ গ্রীস এবং তুরস্কের মূল ভূখণ্ডের তিন নটিক্যাল মাইলের মধ্যে যে দ্বীপগুলো আছে সেগুলোর কর্তৃত্ব ওই দেশের কাছে ছেড়ে দিতে হবে। সে অনুযায়ী তুরস্ক অল্প কয়েকটি দ্বীপের অধিকার পায়। আর ১৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী তুরস্কের নিকটবর্তী যে সব দ্বীপ গ্রীসের অধীনে আছে যেমন মিদিল্লি, সাকিজ, সিসমান, এবং আহিকেরিয়া এগুলো থেকে গ্রীস সব ধরণের অস্ত্র এবং সামরিক বাহিনী সরিয়ে নিবে। দেশটি এইসব দ্বীপে ভবিষ্যতে কখনোই সামরিক উপস্থিতি ঘটাবে না। সেগুলোতে কোন সামরিক ঘাঁটিও করতে পারবে না। এছাড়া ছোট ছোট যে সব জনমানবহীন দ্বীপ আছে সেগুলোতেও সামরিক ঘাঁটি বা বসতি স্থাপন করতে পারবে না।
এর পর ১৯৪৭ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে ইতালি এবং গ্রীসের মধ্যে একটা চুক্তি হয় সেই চুক্তি অনুযায়ী ইতালি এজিয়ান সাগরে তার অধীনে থাকা সবগুলো দ্বীপ গ্রীসের হাতে ছেড়ে দেয়। এভাবেই গ্রীস হয়ে উঠে এজিয়ান সাগরের প্রায় সবগুলো দ্বীপের একক অধিপতি। অন্যদিকে তুরস্ক শুধু তার সমুদ্র তীর থেকে তিন নটিক্যাল মাইল বা প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে যে দ্বীপগুলো আছে সেগুলোর অধিকার পায়। এই হল দ্বীপের অধিকার বা দ্বীপ দখলের ইতিহাস।
ঝামেলা কোথায়?
ঝামেলা হচ্ছে দুটো জায়গায় এবং সেগুলো লুজান চুক্তিতে নিহিত।
এক নম্বরঃ লুজান চুক্তির সময় বলা হয়েছে গ্রীস এই দ্বীপগুলোতে কোন সামরিক ঘাঁটি বা সেনা এবং অস্ত্র উপস্থিতি ঘটাতে পারবে না। কিন্তু গ্রীস গত কয়েক দশক ধরে সেই দ্বীপগুলোতে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তুলছে এবং অস্ত্র বৃদ্ধি করছে। তুরস্ক এটায় বাঁধা দিতে চায়।
দুই নম্বর সমস্যা হচ্ছে- সমুদ্র সীমা নির্ধারণ। অর্থাৎ এই দ্বীপের চারিদিকের কতটুকু অঞ্চল গ্রীসের অধীনে যাবে। গ্রীসের সমুদ্রসীমা কি মূল ভূখণ্ড থেকে হিসেব করা হবে নাকি এই দ্বীপ থেকে। অলুজান চুক্তি অনুযায়ী দ্বীপগুলোর চারিদিকে ৩ নটিক্যাল মাইল জায়গা দ্বীপের মালিকের অধীনে যাবে বাকি জায়গা আন্তর্জাতিক জলসীমায় পড়বে এবং অন্য সব দেশ সেখানে বিনা বাঁধায় তার জাহাজ বা বিমান চালাতে পারবে।
কিন্তু ১৯৩৬ সালে গ্রীস এক তরফা ভাবে লুজান চুক্তির ধারা ভঙ্গ করে তার জলসীমা ৩ নটিক্যাল মাইল থেকে ৬ নটিক্যাল মাইলে বৃদ্ধি করে। তুরস্ক তখন সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ভয়ে গ্রীসের এই অবৈধ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে টু শব্দ ও করে নি। ১৯৬৪ সালে সাইপ্রাসে সমস্যা শুরু হলে তুরস্ক তখন তার নিজের জলসীমাকেও ৬ নটিক্যাল মাইলে নির্ধারণ করে।
এরপর ১৯৭৪ সালে সাইপ্রাসের এক অংশ তুরস্ক তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলে গ্রীস তার জলসীমাকে বাড়িয়ে ১২ নটিক্যাল মাইল করার জন্য পদক্ষেপ নেয়। তখন তুরস্ক হুমকি দেয় যে গ্রীস একতরফা ভাবে এই সিদ্ধান্ত নিলে তুরস্ক ডাইরেক্ট যুদ্ধ শুরু করবে। তাই গ্রীস তখন সে সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসে।
কিন্তু ১৯৮২ সালে আন্তর্জাতিক সমুদ্রসিমা আইন অনুযায়ী সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ভূখণ্ড থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল।
গ্রীস সেই চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এবং দেশটির দাবি হচ্ছে সমুদ্রের এই প্রতিটি দ্বীপের চারিদিকে ১২ নটিক্যাল মাইল বা ২২ কিলোমিটার জায়গা ধরে গ্রীসের অধীনে যাবে। যদি তাই হয় তাহলে সমুদ্রে তুরস্কের পা ফেলার মত কোন জায়গা থাকেনা। আর তেমন কোন আন্তর্জাতিক জলসীমাও থাকে না বললেই চলে। এ কারণে তুরস্ক ১৯৮২ সালের সেই আন্তর্জাতিক সমুদ্রসিমা আইন স্বাক্ষর করেনি। যদিও ভেনিজুয়েলা, আমেরিকা, এবং ইসরাইলও তাদের নিজ নিজ এলাকায় নিজেদের স্বার্থের জন্য সেই চুক্তি স্বাক্ষর করেনি।
কিন্তু গ্রীস যেহেতু এই চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। তাই গ্রীস বলছে সে তার সমুদ্রসিমা ১২ নটিক্যাল মাইলে নিয়ে যাবে এবং সেগুলোর মধ্যে তাদের অনুমতি ছাড়া তুরস্কের কোন জাহাজ বা বিমান ঢুকতে পারবে না। যদি ঢুকে তাহলে সীমা লঙ্ঘনকারী বলে গণ্য হবে। এবং সেক্ষেত্রে গ্রীস তুরস্কের জাহাজ বা বিমানে আক্রমণ করবে।
আর তুরস্কের কথা হচ্ছে যেহেতু তুরস্ক ১৯৮২ সালের সেই চুক্তি স্বাক্ষর করেনি তাই ৬ নটিক্যাল মাইলকেই সীমানা ধরতে হবে। তাতেও কিন্তু বর্তমানে এই সাগরের ৪০% জল গ্রীসের অধীনে আছে। আর যদি গ্রীস তার জলসীমাকে ১২ নটিক্যাল মাইল বা ২২ কিলোমিটার করে নেয় তাহলে এজিয়ান সাগরের ৭০% পুরোপুরি গ্রীসের অধীনে চলে যাবে। তাতে আন্তর্জাতিক জলসীমা ৫১% থেকে কমে ১৯% এ নেমে আসবে। আর তুরস্কের অধীনে ওই সাগরের মাত্র ১০% জায়গা থাকবে। যেটা তুরস্ক কোন ভাবেই মানতে চাইছে না।
এখন তাহলে সমাধান কী?
তুরস্ক এই সমস্যার সমাধানে সমুদ্র বিষয়ক আন্তর্জাতিক আদালতে সুরহা চেয়ে আবেদন করেছে। অর্থাৎ কেস করেছে। কিন্তু গ্রীস এই আদালতে যেতে রাজি না।
এটা হচ্ছে সেই আদালত যেটি বাংলাদেশ এবং ভারতের সমুদ্রসিমা নির্ধারণে রায় দিয়েছিল। ওদিকে আবার লুজান চুক্তি অনুযায়ী গ্রীস তুরস্কের একেবারে ঘরের কাছে এসে ওই সব দ্বীপে সেনা ঘাঁটি করতে পারবে না, বলে তুরস্ক যে দাবি করছে সেটাও মানতে রাজি না গ্রীস।
এমনকি তুরস্কের অধীনে থাকা নতুন নতুন অনেক দ্বীপও দখল করে নিয়েছে বলে দাবি তুরস্কের। জনবসতি হীন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপেও গ্রীস বসতি গড়ে তুলছে, সামরিক ঘাঁটি গড়ছে এবং সেগুলোতে সেনা উপস্থিতি বাড়াচ্ছে।
এ কারণে এই দ্বীপগুলো ঘিরে অর্থাৎ এজিয়ান সাগর ঘিরে এখন দু দেশের মধ্যে উত্তেজনা চরমে। তুরস্ক বলছে গ্রীস যদি দখলকৃত দ্বীপগুলো ছেড়ে না দেয় ওই দ্বীপগুলো থেকে সামরিক উপস্থিতি সরিয়ে না নেয় এবং সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি অব্যাহত রাখে তাহলে তুরস্ক তার সামরিক শক্তি প্রয়োগ করবে। আবার গ্রীস বলছে তুরস্ক যদি ওই ১২ নটিক্যাল মাইলে ঢুকে তাহলে গ্রীস আক্রমণ করবে। ওদিকে আবার গ্রীস আমেরিকার কাছে নালিশ করেছে যে তুরস্ক সামরিক হুমকি দিচ্ছে, আমাদের সহযোগিতা করো। আমেরিকা গত দুই বছরে গ্রীসকে ব্যাপক আধুনিক অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করছে। বিশেষ করে f-35 যুদ্ধ বিমান এবং ট্যাঙ্ক।তুরস্কের সীমান্ত সংলঘ্ন অনেকগুলো সেনা ঘাঁটিতে প্রচুর অস্ত্র পাঠিয়েছে আমেরিকা। আবার তুরস্ককে এফ-৩৫ প্রকল্প থেকে বেড় করে দিয়েছে, এফ-১৬ যুদ্ধ বিমান কেনা প্রকল্প ঠেকিয়ে রেখেছে।
অন্যদিকে তুরস্ক তার নিজস্ব সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে মনোযোগ দিচ্ছে। বিশেষ করে নৌবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করছে। আর মানবহিনীর অস্ত্রেও যথেষ্ট মননিবেশ করছে।
ইতিমধ্যে এরদোয়ান গ্রীসের সাথে উচ্চ পর্যায়ের স্ট্রাটেজিক চুক্তি বাতিল করার ঘোষণা দিয়েছে। গ্রীস তাদের সেনাদেরকে তুর্কী বিরোধী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবার নির্দেশ দিয়েছে। অর্থাৎ এজিয়ান সাগরের পানি আস্তে আস্তে উত্তপ্ত হচ্ছে।
২০০ বছর আগে যেমন রাশিয়া প্রথম ক্রাইমিয়া দখল করে গ্রীকদেরকে উসমানীয়দের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়েছিল এবং পরবর্তীতে তাতে যোগ দিয়েছিল ব্রিটেন এবং ফ্রান্স। এখনো কি রাশিয়া ক্রাইমিয়া এবং ইউক্রেনের একটা অংশ দখল করে আমেরিকা ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের সাথে একজোট হয়ে গ্রীসকে উস্কানি দিয়ে তুরস্কের বিরুদ্ধে নতুন যুদ্ধের কোন পাঁয়তারা করছে কিনা? ওদিকে আবার সিরিয়ার বর্ডারে পিকেকে সন্ত্রাসীদেরকেও কিন্তু রাশিয়া এবং আমেরিকা সাপোর্ট দিচ্ছে। তাহলে কি ২০০ বছর আগের সেই ইতিহাসেরই পুনরাব্রিতি হতে যাচ্ছে? বেঁচে থাকলে দেখা যাবে।আজ তাহলে এই পর্যন্তই ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন আল্লাহ হাফেজ।
অদূর ভবিষ্যতে প্রকট খাদ্য সংকটে পড়তে পারে বিশ্ব। এখনই যদি খাদ্য নিরাপত্তায় পদক্ষেপ নেয়া না হয় তাহলে এই খাদ্য সংকট দুর্ভিক্ষে রূপ নিতে পারে। এরকম হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছে বিশ্বের বড় বড় সংস্থা। এ নিয়ে এখন চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি।
এই খাদ্য সংকট নিয়ে যদি শুধু গত এক সপ্তাহের বিশ্ব পরিক্রমার দিকে তাকাই তাহলে বোঝা যাবে এই বিষয়টি এখন ইউক্রেন যুদ্ধকে ছাড়িয়ে বিশ্বের নাম্বার ওয়ান টপিক হয়েছে। কয়েকদিন আগে G7 সম্মেলন শেষে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ৭ দেশের নেতারা এক যৌথ বিবৃতিতে এ বিষয়ে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। বিশ্ব ব্যাংক, আই এম এফ, বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা সহ সবাই এই খাদ্য সংকট নিয়ে সোচ্চার হয়েছে। বিশ্বের নামকরা দ্যা ইকনমিস্ট সাময়িকী পচ্ছদ করেছে এই খাদ্য সংকট নিয়ে। সেখানে গমের শীষের ছবিতে গমের দানার পরিবর্তে মৃত মানুষের মাথার খুলির ছবি লাগানো হয়েছে। পত্রিকাটি লিখেছে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ বিশ্বে গমের সংকটকে এতো ভয়াবহ করবে যে শুধু ইউক্রেনই নয়, বরং ইউক্রেন থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের বিভিন্ন দেশের মানুষ মারা যাবে না খেয়ে, অনাহারে, অর্ধাহারে। আসলে সবাই এই সংকটের জন্য রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং তার ইউক্রেন আক্রমণকেই দায়ী করছেন।
জাতিসঙ্ঘের প্রধান এন্থনিও গুতেরেস বলেছেন ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ আর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এখনই থামাতে না পারলে আন্তর্জাতিক খাদ্যসংকট আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে । তার মতে ইউক্রেন থেকে খাদ্য রপ্তানি যুদ্ধের আগের পর্যায়ে না গেলে বিশ্বে বছরের পর বছর এই খাদ্য সংকট চলতে পারে। কারণ ইউক্রেনের বন্দরগুলো রাশিয়া আটকে রাখার জন্য দুনিয়ার প্রয়োজনীয় সূর্যমুখী তেল এবং খাদ্যশস্যের একটা বড় অংশ সেখানে আটকে আছে।
ওদিকে গ্রো ইন্টেলিজেন্স নামক আন্তর্জাতিক খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংস্থার ইথিওপিয়া বংশোদ্ভুত প্রধান সারা মেনকের বলেছেন বিশ্বে আর মাত্র ১০ সপ্তাহের গম মজুদ আছে। যেটা ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটের সময়ের চেয়েও খারাপ অবস্থা। অনেক সংবাদে বলা হচ্ছে এবারের এই সংকট দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পরে সবচেয়ে ভয়াবহ। অর্থাৎ বিশাল এক খাদ্য সংকটে পড়তে যাচ্ছে বিশ্ব।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে আসলে কি তাই? সত্যি সত্যি কি বিশ্ব এতো বড় ধরণের খাদ্য সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে। আসলেই কি খাদ্যের বিশাল ঘাটতি আছে বিশ্বে। এই সংকটের জন্য আসলেই কি ইউক্রেন যুদ্ধ দায়ী। যদি না হয় তাহলে কেন এতো ঢাক ঢোল পিটিয়ে খাদ্য সংকটের কথা বলা হচ্ছে। এর পিছনে কি বিশ্ববাদীদের অর্থাৎ বিশ্বের সব মানুষকে যারা একক নিয়ন্ত্রনে নিতে চায় তাদের নতুন কোন পরিকল্পনা লুকিয়ে আছে? নাকি কৃত্রিমভাবে এই সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে? আমাদের এখন কি করা উচিত? এগুলো নিয়ে আলোচনা করবো আজ।
শুরুতেই দেখে নেই খাদ্য সংকট কী? যদি মানুষ তার প্রয়োজনীয় খাদ্য না পায় তখন আমরা বলতে পারি মানুষটি খাদ্য সংকটে ভুগছে। যেমন যদি কেউ অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে আমরা বলে লোকটি অর্থ সংকটে ভুগছে। একজন ব্যক্তি যেমন এই সংকটে পড়তে পারে তেমনি একটা জাতি এবং একটা দেশও পড়তে পারে এই খাদ্য সংকটে। যেমনটি এখন পড়েছে শ্রীলঙ্কা। কয়েক বছর ধরে ব্যাপক খাদ্য সংকটে আছে যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইয়েমেন, আফগানিস্তান, লেবানন এবং আফ্রিকার অনেকগুলো দেশ। এই সংকট কেন হচ্ছে? বিশ্বে কি খাদ্য উৎপাদন কম হচ্ছে? অনেকেই হয়তো এটাই ভাববেন।
আসুন তাহলে দেখি আমরা কি পরিমাণ খাবার খাই আর কি পরিমাণ খাবার উৎপাদন করি। যেহেতু আমরা সারা বিশ্বের খাদ্য সংকট নিয়ে কথা বলছি সেহেতু আমাদের সারা বিশ্বের খাদ্য উৎপাদন এবং ভক্ষণ নিয়ে একটু তথ্য উপাত্ত যাচাই করে দেখা দরকার।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ফাও FAO এর তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের সব মানুষের এক বছরে যত খাবারের প্রয়োজন, সারা বিশ্বে এক বছরে তার দেড় গুন বেশি খাবার উৎপাদন করা হয়। এটা শুধু এ বছর বা গত বছর না। বহু বছর ধরেই এই বেশি উৎপাদন চলছে এবং এটা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু FAO এর হিসেব অনুযায়ী এই উৎপাদিত খাবারের তিনভাগের এক ভাগ নষ্ট করা হয়।
আবার আরেকটি রিপোর্টে বলা হয়েছে গত ৬০ বছরে জনসংখ্যা যে হারে বেড়েছে খাদ্য উৎপাদন তার চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে।
যেমন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা OECD এর এক রিপোর্টে দেখা গেছে যে ১৯৬০ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা ছিল ৩ বিলিয়ন যেটা ২০২২ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৭.৮ বিলিয়ন। অর্থাৎ গত ৬০ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে ২.৬ গুন। অথচ ১৯৬০ সালে যে পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন হতো ২০২১ সালে এসে তার ৩.৩২ গুন বেশি খাদ্য উৎপাদন হয়েছে।
এবার এভাবে হিসেব করি, একজন মানুষ দৈনিক দেড় থেকে আড়াই কেজির মত খাবার খায়। পানি সহ। আর পানি ছাড়া গড়ে দৈনিক দেড় কেজিরও কম, ১ কেজি ৪০০ গ্রাম খাবার খায়। অর্থাৎ একজন মানুষ গড়ে বছরে ৫১১ কেজি খাবার খায়। দুনিয়ার জনসংখ্যা ৭.৮ বিলিয়ন। সুতরাং আমরা সবাই মিলে এক বছরে মোট খাবার খাই ৪ বিলিয়ন মেট্রিক টন।এখানে শিশুদেরকেও কিন্তু প্রাপ্ত বয়স্কের মতই হিসেব করা হয়েছে।
এখন FAO এর ২০২০ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বে বছরে ৪ থেকে ৫ বিলিয়ন মেট্রিক টন খাদ্য উৎপাদন হয়। যার ১.৩ বিলিয়ন মেট্রিক টন নষ্ট করা হয়। এই হিসেব অনুযায়ী নষ্ট হওয়ার পরেও যে খাবার থাকে তাতে বিশ্বের সব মানুষের পর্যাপ্ত খাবার থাকার কথা।অর্থাৎ বিশ্বে যে খাবার উৎপাদন হয় তা সব মানুষের জন্য যথেষ্ট। FAO এর আরেক রিপোর্টে দেখা গেছে ২০০০ সালে বিশ্বে যে খাবার উৎপাদন হতো ২০১৯ সালে তা প্রায় ২০-৩০ গুন বেড়েছে। এমনকি কিছু কিছু খাদ্য শস্যের উৎপাদন আরও বহু গুন বেড়েছে।
যাহোক আর বেশি হিসাব নিকাশ করে আপনাদের মাথা ভারী করবো না। কিন্তু এটুকু আলোচনায় আমরা যেটা দেখলাম যে বিশ্বে যত খাবার উৎপাদন হয় তা সারা বিশ্বের সব মানুষের প্রয়োজনের চেয়েও অনেক বেশি। কিন্তু তারপরও সারা বিশ্বে প্রায় ১৬০ থেকে ২০০ মিলিয়ন অর্থাৎ ২০ কোটি মানুষ খাদ্য সংকটে ভুগছে। এবং এই সংখ্যাটি দিন দিন বাড়ছে। এক দিকে দিন দিন খাদ্য উৎপাদন বাড়ছে আবার অন্য দিকে দিন দিন অনাহারে থাকা মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। কিন্তু কেন? উত্তরটি সিম্পল – অসম বণ্টন।
একজন ১০০ জনের খাবার মজুদ করে রাখবে, আরেকজন ২ দিনে এক বেলা খাবার পাবে। এক দেশ ইচ্ছে মত মজুদ করবে, আরেক দেশে মানুষ, না খেয়ে রাস্তায় নামবে। দেখুন না শ্রীলঙ্কার অবস্থা! মাত্র ২২ মিলিয়ন মানুষের এই দেশটি খাদ্য সংকটে কি অবস্থায় আছে। অথচ সারা বিশ্বের কাছে এই সংখ্যাটি খুবই নগণ্য। কিন্তু কেউ হেল্প করতে আসছে না। আই এম এফ, বিশ্ব ব্যাংক এরা আসলেও আরও কড়া কড়া শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। মরার উপর খাঁড়ার ঘা। যাহোক বিশ্ব খাদ্য সংকটে ফিরে আসি।
এই খাদ্য সংকটের কারণ কী? এই কারণ যদি খুঁজে পান তাহলে শ্রীলংকার এই সমস্যারও কারণ খুঁজে পাবেন।
জাতিসংঘ, IMF, বিশ্ব ব্যাংক এবং WEF সহ বিশ্বের বড় বড় অর্থনৈতিক সংস্থা গুলো এই খাদ্য সংকটের পিছনে মূলত খড়া, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঝড় বন্যা সহ জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং বিশ্বের বিভিন্ন এলাকার সংঘাতকেই মূলত দায়ী করতো এতদিন। যেমন আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলের সংঘাত এবং সেখানের খাদ্য সংকটের জন্য ওই অঞ্চলকে নিংড়ে খাওয়া এবং বছরের পড় বছর ধরে যুদ্ধ চালানো ফ্রান্সের নাম কাউকে নিতে দেখেছেন কখনো? অথবা ইয়েমেনের লাখ লাখ মানুষ না খেয়ে দিন যাপন করছে, খাবার না পেয়ে বিড়াল ধরে খাচ্ছে মানুষ। সে জন্য কখনো সবাই একসুরে সৌদি আরবকে দোষী করেছে? অন্যদিকে, খাদ্যে অব্যবস্থাপনা, গরিবদের মুখের খাবার ধনীদের কেড়ে নেয়া কিংবা বিশ্বের ধনী দেশগুলোর অবিশ্বাস্য মাত্রায় খাদ্য মজুদ এবং খাবারের অপচয়কে খুব কম সময়ই কিন্তু হাইলাইট করতে দেখবেন।।
অন্যদিকে এবার সবাই এক যোগে ইউক্রেন যুদ্ধকেই দায়ী করছে এই খাদ্য সংকটের জন্য। এটা ঠিক যে পুতিন অন্য দেশে হামলা করে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা এবং লাখ লাখ মানুষকে বাস্তুহারা করার জন্য দায়ী। এই ভোগান্তির দায় তিনি এড়াতে পারবেন না। আবার সেখানেও তো পশ্চিমাদেরও হাত আছে। কিন্তু এই খাদ্য সংকটের জন্য পুতিন একা কতোটা দায়ী?
আমরা একটু আগে খাদ্য উৎপাদন এবং খাবার গ্রহণের যে চিত্র দেখলাম সেখান থেকে বুঝতে পারি যে বিশ্বে খাদ্য সংকট নতুন কিছু না। এবং এই যুদ্ধের মাধ্যমেই সেটা শুরু হয় নি। যদিও এই যুদ্ধে সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে। যেমনটি করেছিল করোনা, করোনার আগের চীন-আমেরিকা বাণিজ্য যুদ্ধ, তার আগের ২০১৫ সালে শুরু হওয়া ইয়েমেন যুদ্ধ। তার আগে ২০১১ সালে শুরু হওয়া আরব বসন্ত তথা লিবিয়া, মিশর এবং সিরিয়ার যুদ্ধ। তার আগে ২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা। এই বিষয়গুলোতে আসবো। তবে আসুন রাশিয়া এবং ইউক্রেনের খাদ্য উৎপাদন কে দেখি।
বলা হয় যে ইউক্রেন হচ্ছে ইউরোপের শস্য ভাণ্ডার। এবং একটু আগে যে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কথা বললাম তারা সবাই এই যুদ্ধকে দোষ দেয়ার সময় রাশিয়া এবং ইউক্রেনের যৌথ উৎপাদকে সামনে নিয়ে আসে।
এখানে গম এবং সূর্যমুখী তেলের কথাটাই সামনে আনা হয়।
যেমন গমের ক্ষেত্রে বলা হয়, এই যুদ্ধে বিশ্বে গমের উপর ব্যপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কারণ বিশ্বের ৩০% ভাগ গম উৎপাদন হয় রাশিয়া এবং ইউক্রেনে। আবার ইউক্রেনে ২০ মিলিয়ন টন গম কৃষি ক্ষেতে পড়ে আছে কৃষকরা তুলতে পারছে না যুদ্ধের জন্য। আবার ইউক্রেনের সমুদ্র বন্দর গুলোতে সাড়ে চার মিলিয়ন টন কৃষি পণ্য আটকা আছে যেগুলো রাশিয়া পরিবহন করতে দিচ্ছে না। যদি সেগুলোকে ছাড়া হয় তাহলে বিশ্বে খাদ্য সমস্যা কিছুটা হাফ ছেড়ে বাঁচবে।
ভাষার মার প্যাচ দেখেছেন। মনে হয় যেন বিশ্বের এখন এই যে খাদ্য সমস্যা হচ্ছে এর একমাত্র কারণ এই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। যুদ্ধ না হলে এই রকম পরিস্থিতি হতো না।
আচ্ছা রাশিয়া কি পরিমাণ গম উৎপাদন করে? ৭৫ থেকে ৮০ মিলিয়ন টন।
আর ইউক্রেন? ২০ থেকে ২৫ বা ৩০ মিলিয়ন টন।
গত বছর যদি আমরা বিশ্বের গম উৎপাদনের পরিমাণ দেখি তাহলে দেখা যাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১৩৬.৫ মিলিয়ন টন, চীন ১৩৫ মিলিয়ন টন, ভারত ১০৮ মিলিয়ন টন গম উৎপাদন করেছে। এর পর চার নম্বরে আছে রাশিয়া। পাঁচ নম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ৬ কানাডা, ৭ অস্ট্রেলিয়া, ৮ পাকিস্তান, ৯ ইউক্রেন, ১০ আর্জেন্টিনা এবং ১১ নম্বরে আছে তুরস্ক। ইউক্রেনে গত বছর মাত্র ২১.৫ মিলিয়ন টন গম উৎপাদন করেছে। আচ্ছা যুদ্ধের আগে এই গমের একটা অংশ কি সে দেশ থেকে রপ্তানি হয়নি? তবুও যেহেতু সেখানে যুদ্ধ চলছে তাই আমরা যদি ধরেও নেই যে সেখানের ২১.৫ মিলিয়ন টনের পুরোটাই দেশে আছে। বেড় হতে পারেনি। তাতেও কিন্তু সেটা বিশ্বের মোট গম উৎপাদনের মাত্র ২.৭ ভাগ।
কারণ FAO এর তথ্য অনুযায়ী গত বছর বিশ্বে মোট ময়দা উৎপাদন হয়েছে ৭৭৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন।
এবার যদি আমরা রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মোট গম উৎপাদনকে বিশ্বের মোট গম উৎপাদনের সাথে তুলনা করি তাহলে দেখবো যে এই দুই দেশের মোট উৎপাদন হচ্ছে বিশ্বের মাত্র ১১.৭ ভাগ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ৩০ ভাগ কোত্থেকে এলো? বিশ্বাস করুন আমি জানি না। মনে হয় বিষয়টিকে অতিরঞ্জিত করে প্রচার করা হচ্ছে। যেমন শুধু ইউক্রেনের গম উৎপাদনকে একক ভাবে বলা হচ্ছে না কারণ পারসেন্টিজটা খুবই নগণ্য। তাই রাশিয়ারটাকে মিলিয়ে বললে অনেক বড় একটা সংখ্যা মনে হবে। যদিও এই ৩০% কথাটিও সঠিক না। তাহলে কেন বলা হচ্ছে? আসছি একটু পরে।
এখন ইউক্রেনের গত বছর মোট গম উৎপাদন ছিল বিশ্বের ২.৭ ভাগ। যুদ্ধ শুরু হয়েছে ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখ। তাহলে এ বছরের প্রথম দুই মাসে কি একটুও গম সাপ্লাই হয়নি? আবার এই যে ইউক্রেনের মোট ২১.৫ বিলিয়ন গম এটা তো পুরোটাই গত চার মাসে অর্থাৎ এই যুদ্ধের সময়টাতেই শুধু বিশ্ব বাজারে আসার কথা না। সামনে তো আরও কয়ক মাস বাকি তাহলে বিষয়টি কেন এমন ভাবে দেখানো হচ্ছে যে ইউক্রেন থেকে গম বেড় হতে পারছে না তাই সারা বিশ্বে গমের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে?
আবার ইউক্রেনে না হয় রাশিয়া যুদ্ধ করে। পুতিন সেখানের গম সাপ্লাই আটকে দিয়েছে সারা বিশ্বে মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে পুতিনের জন্য। কিন্তু রাশিয়া তো ইউক্রেনের চেয়েও চার গুন বেশি গম উৎপাদন করে। এই রাশিয়ার গম সাপ্লাইও কি পুতিন বন্ধ করে দিয়েছে? নাকি রাশিয়ার সবকিছুতে, এমনকি কুকুরটার উপড়েও যে বা যারা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তারা এর জন্য দায়ী?
আবার দেখুন ভারত গম উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়, এই দেশটি কেন গম রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে? যদিও সেখানে আগাম জলবায়ু পরিবর্তনকে ব্যবহার করে অর্থাৎ সেটাকে একটা উসিলা বানিয়ে গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।কিন্তু এই জলবায়ু পরিবর্তন আসল বিষয় না। আসল বিষয় অন্যকিছু। সেদিকে নাই বা গেলাম আজ। আবার বিশ্বে গম উৎপাদনে প্রথম রাষ্ট্র চীন। এই চীনের সাথে গত কয়েক বছর ধরে বাণিজ্য যুদ্ধ, বাণিজ্য যুদ্ধ খেলে চীন থেকে পণ্য বেড় হতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে কে?
এতো গেলো উৎপাদনের কথা। রাশিয়া এবং ইউক্রেন তাদের উৎপাদিত গমের সবই তো রপ্তানি করে না তাই না। তারা একত্রে ২০২০ সালে সারা বিশ্বের মোট ৭.৩% গম রপ্তানি করেছে। রাশিয়া কিন্তু তার রপ্তানি বন্ধ করেনি।পশ্চিমারা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ঠিকই কিন্তু যারা নিষেধাজ্ঞা দেয়নি তাদের কাছে রাশিয়ার রপ্তানি চলছে। আবার বছরের প্রথম দুই মাসে ইউক্রেন থেকেও গম রপ্তানি হয়েছে। বছর শেষ হতে এখনো ৬-৭ মাস বাকি। তারপরও ধরলাম ইউক্রেন থেকে পুরো এক বছরে কোন রপ্তানি হয়নি বা হবে না। তবুও যদি ধরেও নেই যে এই দুই দেশের এই ৭.৩% গমের পুরোটাই রপ্তানি হবে না। তাতেও কি বিশ্ব ইতিহাসের সর্ব বৃহৎ খাদ্য সংকট হতে পারে? এর এগে কি কখনো এমন হয়নি? হয়েছে অবশ্যই হয়েছে। ১৯৯১ সালে, ১৯৯৪ সালে ২০০৩ সালে এরকম বড় মাপের গম উৎপাদনে ভাটা পড়েছে। ২০১০ সালে খড়ার কারণে রাশিয়ার গম উৎপাদন মাত্র ২০ মিলিয়ন মেট্রিক টনে নেমে এসেছিল। যে কারণে সে বছর সারা বিশ্বের গম উৎপাদনে ৬.৩% ঘাটতি হয়েছিল। কিন্তু তাতেও কি বিশ্বে এই ধরণের লাল সংকেত বাজাতে দেখা গেছে? যায় নি। তবে একটা ঘটনা ঘটেছিল। ২০১১ সালে আরব বসন্ত শুরু হয়েছিল?
এখন কি আসলে নতুন কোন বসন্ত শুরুর পাঁয়তারা করছে কেউ? কেউ কি অনেক বছর ধরে এরই মহা পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগিয়েছে। যেমন ২০০৮ সালের বিশ্ব মন্দা থেকে শুরু করেই কিন্তু খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। এবং এ নিয়ে বড় বড় সংস্থা এবং কোম্পানি অনেক প্রকল্প শুরু করেছে।
বিশ্বে সন্ত্রাস ছড়িয়ে, দেশে দেশে যুদ্ধ বাঁধিয়ে, নিরাপত্তার অজুহাত দিয়ে, মানুষকে একরকম ডিজিটাল বন্দী করা হয়েছে যেভাবে। নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে সারা বিশ্বের মানুষকে কন্ট্রোল করার জন্য যেমন কাজ করছে বিশ্ববাদিরা। ঠিক তেমনি কি খাদ্য নিরাপত্তার অজুহাত দিয়ে বিশ্বের কৃষি পণ্যকে, কৃষি ক্ষেত, আবাসযোগ্য ভূমি এবং খাদ্যকে পুরোপুরি তাদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে যাওয়ার নতুন পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগুচ্ছে?
আর সে জন্য হয়তো সবাই এক সুরে কথা বলা শুরু করেছে। এই খাদ্য নিরাপত্তার নামে বিশ্বের খাদ্য নিয়ন্ত্রণ বা খাদ্য কন্ট্রোলের কাজ শুরু হয়েছে আরও কমপক্ষে ২০ বছর আগে। আস্তে আস্তে মাঠ প্রস্তুত করা হয়েছে। এবং এখন মাঠ প্রায় পুরোপুরি প্রস্তুত।
এজন্য গ্রো ইন্টেলিজেন্স, Zetane systems,unsupervised,pachama নামক কোম্পানিগুলো বিশেষ উল্লেখযোগ্য। আর বিশ্বের বড় বড় ধনী যেমন বিলগেটস, জেফ বেজস এরা তো হাজার হাজার হেক্টর জমি ক্রয় শুরু করেছে এবং সেগুলোকে আরও বিস্তৃত করছে। কৃষকে, কৃষি ভূমিকে ভাড়া করা শুরু করেছে। হয়ত এক সময় দেখা যাবে ভূমি আপনার, কিন্তু মালিক আপনি না। অর্থাৎ ওখানে কি ফসল চাষ করবেন সে সিদ্ধান্ত আপনি নিতে পারবেন না। আপনার ভূমিতে আপনি ভাড়ায় খাটবেন।
যেমন ধরুন গ্রো ইন্টেলিজেন্স নামক এই সংস্থাটি আফ্রিকার সব কৃষি পণ্য এবং আবাদি ভূমির সব ধরণের ডাটা সংগ্রহ করে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে সেই তথ্য এনালাইসিস করে গ্রাহকদের সরবরাহ করে। এর মাধ্যমে তারা কৃষকদের এবং কৃষি পণ্যকে একটা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নিয়ে এসে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে। কে কি উৎপাদন করছে কার কি উৎপাদন কড়া উচিত এগুলো সম্পর্কে তথ্য দিচ্ছে। যদিও দেখতে বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে কৃষি বান্ধব উদ্যোগ মনে হবে। কিন্তু বর্তমান বিশ্ব তথ্যের বিশ্ব। ডাটা যে নিয়ন্ত্রণ করে সে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। যার উদাহরণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। কিভাবে সারা বিশ্বের যুব সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আবার এ গ্রো ইন্টেলিজেন্সের এই কাজে রকফেলার ফাউন্ডেশন আর্থিক সহয়তা দিচ্ছে। এই ফাউন্ডেশন পরিচালিত হয় আমেরিকার রকফেলার পরিবারের বা তাদের কোম্পানির অর্থায়নে। মূলত বিশ্বের ধনী যে কয়কটি ফ্যামিলি আছে, যারা বিশ্বের সব কিছুতেই কোন না কোন ভাবে জড়িত বলে মনে করা হয়, তাদের একটা হচ্ছে এই রফেলার পরিবার। এ নিয়েও বিস্তারিত আলাপ করছি না। এছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য বড় বড় অর্থনৈতিক সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাও এই খাদ্য নিরাপত্তার কাজে ব্যাপকভাবে মননিবেশ করছে।
হেনরি কিসিঞ্জারের একটা কথা আছে, পেট্রোল কন্ট্রোল করলে দেশগুলোকে কন্ট্রোল করতে পারবে আর খাদ্যকে কন্ট্রোল কর দেখবে মানুষকে কন্ট্রোল করতে পারবে।
এখন পেট্রোলকে কন্ট্রোলের দিন শেষ। রাষ্ট্রকে কন্ট্রোল এখন অনেক সহজ। রাষ্ট্র নেতারা এখন এমনিতেই অন্যদের কন্ট্রোলে আছে। এখন দরকার মানুষকে কন্ট্রোল করা। তাই ব্যক্তিকে কন্ট্রোল করার জন্য, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিল এক নম্বর হাতিয়ার যেটা ব্যপক জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দা এবং ২০১১ সালের আরব বসন্তের পর। এখন নতুন খাদ্য সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে, যেটা চালু হয়েছে আরও তিন চার বছর আগে সেটার মাধ্যমে বিশ্বের খাদ্য তথা কৃষককে এবং কৃষি ভূমিকে নিয়ন্ত্রনে নেয়ার মাধ্যমে মানুষকে অর্থাৎ প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণের নতুন কোন পরিকল্পনা চলছে কি না ভেবে দেখা দরকার।
আবার করোনার কারণে সব দেশেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্ব গতি রেকর্ড পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতেই নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধির হার গত ৪০-৫০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। গরিব দেশগুলোর কথা তো চিন্তাই করা যায় না।
কিন্তু করোনার সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য ভর্তুকি দিয়েছে। যার পরিমাণ প্রায় ১০ থেকে ১৫ ট্রিলিয়ন ডলার।
করোনার কারণে সারা বিশ্বে ২০০ মিলিয়ন মানুষ চাকরি হারিয়েছে। তাদের একটা বড় অংশ এখনো চাকরি পায়নি।
এর মধ্যেই শুরু হয়েছে এই যুদ্ধ।
আবার ভোজ্য তেলের বিষয়টি দেখুন। খবরে দেখবেন বিশ্বের সূর্যমুখী তেলের সবচেয়ে বড় উৎপাদক হচ্ছে ইউক্রেন। দ্বিতীয় রাশিয়া এই দুটি দেশ বিশ্বের ৭০% সূর্যমুখী তেল উৎপাদন করে। পুতিনের এই যুদ্ধের কারণে এই তেল রপ্তানি বন্ধ তাই তেল সংকটে বিশ্ব।
আচ্ছা সারা বিশ্ব কি সূর্যমুখী তেল খেয়ে থাকে?
আমেরিকার কৃষি মন্ত্রণালয় বা USDA এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ২০২১/২০২২ কৃষি বছরে বা অর্থবছরে বিশ্বে মোট ২১৪.৮ মিলিয়ন টন ভোজ্য তেল উৎপাদন হবে। যা গত বছরের তুলনায় ৮.২১ মিলিয়ন টন বেশি। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয় পাম অয়েল, ৭৬.৫ মিলিয়ন টন, বা ৩৬%। এর পর সয়াবিন তেল। উৎপাদন হয় ৬১.৭ মিলিয়ন টন। এর পর রাইসরিষার তেল ২৭.৪ মিলিয়ন টন। এর পরে সূর্য মুখী তেল উৎপাদন হবে ২১.৮ মিলি টন। কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্ত দেশগুলোতে এ বছর বাম্পার ফলন হয়েছে। আমি বলছি না আমেরিকার কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে। এছাড়াও আছে অন্য অনেক ধরণের তেল। সব তেলের মধ্যে অর্থাৎ এই ২১৪ মিলিয়ন টন তেলের মধ্যে ২২ মিলিয়ন টন সূর্যমুখী তেল। কত পারসেন্ট? মাত্র ১০ পারসেন্ট। এই ২২ মিলিয়নের মধ্যে রাশিয়া এবং ইউক্রেনে উৎপাদন হয় ৮ বা ৯ মিলিয়ন টন সূর্যমুখী তেল। অর্থাৎ সারা বিশ্বের মোট সূর্যমুখী তেলের অর্ধেক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ৭০ বা ৭৫% যে বলা হয় সেটা আসলো কোত্থেকে। সেটাও না হয় বাদ দিলাম। ২১৪ মিলিয়ন টন তেল দরকার ইউক্রেন এবং রাশিয়ার আছে ৮ থেকে ১০ মিলিয়ন টন। খুব ঘাটতি হবে এটা না হলে। আবার আমেরিকার কৃষি মন্ত্রণালয়ই তো বচলে মোট ভোজ্য তেল উৎপাদন গত বছরের তুলনা ৮.২১ মিলিয়ন টন বেশি উৎপাদন হবে।
তাহলে এই সংকট কেন? কেন এই বাজারের অস্থিরতা? মনে হয় অদৃশ্য কোন হাতের কারসাজি। বড় কোন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। নইলে করোনার লকডাউনে এমনিতেই বিশ্বে খাদ্য উৎপাদন এবং সাপ্লাই চেইনে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। তার উপর জোড় করে এই যুদ্ধটা বাঁধিয়ে দেয়া হলো। তাই না? যুদ্ধ শুরুতে মনে আছে আমেরিকা এবং ব্রিটেনের বিবৃতি গুলো এই বাধল, এই শুরু হলো, কালই আক্রমণ করবে। ভাবখানা এমন যেন পুতিন যত তাড়াতাড়ি ইউক্রেনে আক্রমণ করবে ততই তারা খুশি।
তো এই যুদ্ধটিও জোড় করে বাঁধিয়ে দিয়ে এখন আবার দীর্ঘায়িত করার জন্য যা যা দরকার সবই করছে। ইউক্রেনে উত্তেজনা কিছুটা কমতে শুরু করেছে কিন্তু উত্তেজনা তো কমানো ঠিক হবে না তাই অন্য ফ্রন্টে এখন উত্তেজনা ছড়ানো হচ্ছে। যতদিন না এই খাদ্য নিয়ন্ত্রণের সব বন্দবস্ত হয় ততদিন হয়তো চলবে এই উত্তেজনা।
এখন আমাদের কি করা উচিত। সরকারের উচিত হবে আরও বেশি কৃষি খাতে মননিবেশ করা। কৃষি জমি রক্ষায় যে আইন করেছে বর্তমান সরকার তার পূর্ণ বাস্তবায়িনে সচেষ্ট হওয়া। পুরো দেশের প্রয়োজন অনুযায়ী কৃষিকে এবং কৃষকে পরিচালিত করা। দেশের চাহিদা অনুযায়ী কৃষি পণ্যের ভ্যারাইটি তৈরি করা এবং নিয়ন্ত্রণ করা। আমদানি এবং রপ্তানিকারকদের সুবিধার্থে কৃষি পণ্য উৎপাদনে পরোক্ষ বাঁধা দেয়া বন্ধ করা উচিত। সব ধরণের কৃষিকে উৎসাহিত করা। যার যেখানে যেটুকু জায়গা আছে সেগুলোকে চাষ করা। মাছ চাষ, মুরগি পালন, পশু পালনে আরও মনযোগী হওয়া দরকার। এক সময় আমরা নিজেরা নিজেদের প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন করতে পারতাম এখন সবাই শহরমুখী হচ্ছি টাকা কামাইয়ের আশায়। কেনার মত খাবারই যদি না থাকে টাকা দিয়ে কি হবে? টেকনোলজি তো আর আপনার পেট ভরাবে না তাই কৃষিতে তথা খাদ্য উৎপাদনে মনোযোগ দেয়া দরকার, যেমন সরকারী ভাবে তেমন ব্যক্তি মালিকানাধীন ভাবে। সব রাজনৈতিক দল গুলোর, ওয়াজ মাহফিল যারা করেন তাদের এমনকি, বড় বড় বা ছোট ছোট সামাজিক সংগঠনগুলোকেও এই মানুষকে সচেতন করা তাদেরকে উৎসাহ দেয়া এবং সহযোগিতা করা দরকার।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি এবং ফ্রান্সসহ দশটি দেশের রাষ্ট্রদূতদের তুরস্কে অবাঞ্চিত ঘোষণা করার যে হুমকি দিয়েছেন দেশটির রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগান, তা নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে এখন নতুন পরিকল্পনা চলছে।
জার্মানি জানিয়েছে যে, তুরস্কের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে তারা অন্য সব দেশের আলোচনা করবে।
গত সোমবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স, কানাডা, নেদারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক এবং নিউজিল্যান্ডের তুরস্কে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতরা এক যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেন। সেখানে তারা তুরস্কে আটক ওসমান কাভালা নামক এক তুর্কি ব্যবসায়ীর অনতিবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তির দাবি করেন।
বিবৃতিতে তারা জানান যে, চার বছর ধরে জেলে থাকা কাভালার এই পরিস্থিতি প্রমাণ করে যে তুরস্কে আইনের শাসন এবং গণতন্ত্র হুমকির মুখে।
আদালতে বিচারাধীন এক তুর্কি নাগরিককে ‘অনতিবিলম্বে মুক্তির’ এই দাবিকে আঙ্কারা দেখছে তার দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের হস্তক্ষেপ হিসেবে।
যদিও কাভালাকে পশ্চিমা মিডিয়া এবং রাষ্ট্রদূত, সুশীল সমাজ, সাংবাদিকরা অনেক বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ একজন ‘সমাজকর্মী’ এবং ‘জন হিতৈষী ব্যক্তি’ হিসেবে। কিন্তু তার আসল পরিচয় তিনি একজন ব্যবসায়ী।
যে কারণে পশ্চিমাদের প্রিয়পাত্র কাভালা
যুক্তরাষ্ট্রে পড়ালেখা শেষ করার পর বাবার ব্যবসার হাল ধরেন। কট্টর বামপন্থি হিসেবে পরিচিত কাভালা পরবর্তীতে তার এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি গড়ে তোলেন বিভিন্ন ধরণের এনজিও। যেগুলো মূলত সংখ্যালঘুদের নিয়ে কাজ করে। যেমন কুর্দি বামপন্থি সংগঠন, আর্মেনীয় খ্রিস্টান গ্রুপ, সমকামী অধিকার প্রতিষ্ঠা গ্রুপসহ আরও অনেকে গোষ্ঠী তার এই সব এনজিও থেকে বিভিন্ন ধরণের ট্রেনিং এবং আর্থিক সহযোগিতা পেত। কাভালার এই সব এনজিওগুলোকে অর্থ সাপ্লাই দিতো পশ্চিমা অনেক বড় বড় সংস্থা। যাদের মধ্যে জর্জ সরোস এর ওপেন সোসাইটি অন্যতম।
তুরস্ক যে কারণে কাভালাকে সাজা দিয়েছে
তুরস্ক সরকারের দাবি, কাভালা এবং তার এই এনজিওগুলো ২০১৩ সালে গেযি পার্ক বিক্ষোভে এবং ২০১৬ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পিছনে কলকাঠি নেড়েছে। এই এনজিওগুলো পশ্চিমাদের সহযোগিতায় এবং পশ্চিমাদের মদদে এই কাজগুলো করেছে তুরস্কের সরকারকে উৎখাত করতে। এমনকি কাভালা তুরস্কের সেই ২০১৬ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের সময় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর একজন গুপ্তচরের সঙ্গে বৈঠক করেন বলেও দাবি করছে সরকার।
এসব বিষয় নিয়ে তার বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা দায়ের করা হয়। তিনি ইতিমধ্যে দুইটি মামলায় খালাস পান। কিন্তু এখনো কিছু মামলা প্রক্রিয়াধীন আছে। অনেকে ধারণা করছেন যে, কাভালার বাকি মামলাগুলো থেকেও আগামী ২৪শে নভেম্বর খালাস পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
কিন্তু এরই মধ্যে পশ্চিমা ১০টি দেশের এই ধরণের বিবৃতি আসলে তার এই বিচার প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলল। তাদের এই বিবৃতিকে তুরস্কের সরকার তার স্বাধীন বিচার বিভাগের ওপর বহির্বিশ্বের হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছে।
কড়া অবস্থানে তুরস্ক
ওই বিবৃতির প্রতিক্রিয়ায় তুরস্কের রাষ্ট্রপতি এরদোগান ওই রাষ্ট্রদূতদেরকে তুরস্ক থেকে বহিষ্কারের ইঙ্গিত দিয়েছেন।
তিনি জানান, দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে তিনি আদেশ দিয়েছেন এই সব ডিপ্লোম্যাটদের যেন ‘অবাঞ্ছিত ঘোষণা’ করা হয়। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় যদি সত্যিই তাদেরকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করে এবং তুরস্ক থেকে বহিষ্কার করে তাহলে সেটা হবে তুরস্কের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত। দেশটি এর আগে কখনও এতোগুলো বিদেশী কূটনীতিকের বিরুদ্ধে একত্রে এ ধরণের সিদ্ধান্ত নেয়নি। তাই এখন এ ধরণের সিদ্ধান্ত নিলে তুরস্কের সাথে পশ্চিমাদের বড় ধরণের দ্বন্দ্ব লাগার আশংকা প্রকটা
যদিও এখানে আসল প্রশ্নটি হচ্ছে, কেন ওই ১০ রাষ্ট্রদূত এই মুহূর্তে এ ধরনের একটা বিবৃতি দিয়ে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর প্রয়োজন অনুভব করলেন? তারা কি আসলেই কাভালাকে অনেক বেশি ভালোবাসেন? তাহলে তার প্রতি তাদের এতো দরদ কেন? আর যদি তারা সত্যি সত্যিই আইনের শাসন আর গণতন্ত্রের প্রতি তাদের অগাধ শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা থেকে এই কাজটি করেন তাহলে আরও কিছু প্রশ্ন সামনে আসে।
পশ্চিমাদের দ্বিমুখী নীতি
সেগুলো হলো, গণতন্ত্র আর আইনের শাসন কি শুধু তুরস্কের বিষয় আসলেই তাদের ঘাড়ে চেপে বসে? তা না হলে মিশরে, সৌদি আরবে, অন্যান্য দেশে যত লোককে জেলে পুরে রাখা হয়েছে, ফাঁসি দেয়া হয়েছে, তখন তাদের এই গণতন্ত্র আর আইনের শাসনের বুলি কোথায় ছিল? কাভালা তো একজন ব্যবসায়ী, এমনকি কোন রাজনৈতিক নেতাও না। যদিও পশ্চিমা মিডিয়া এবং এই সুশীলরা তাকে এক জন
জনহিতৈষী এবং এরদোগান বিরোধী হিসেবে পরিচিত করার চেষ্টা করছে। কারণ এভাবে পরিচিত করতে পারলে সরকারকে দোষ দেয়া সহজ।
কিন্তু মিশরে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে জেলে রাখলো সামরিক জান্তা, সেখানে কয়েকশ মানুষকে মেরে ফেলা হল। সৌদি আরবে বিরোধীদের নিরাপদে চলাফেরা তো দূরের কোথা মুখ খুলে কথা বলতে পর্যন্ত দেয়া হয় না। সেখানে তারা কেন তুরস্ককে গণতন্ত্র শিখাতে আসেন?
যেখানে ইউরোপের সবচেয়ে নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার ক্ষমতায় এসেছে। এবং সব বিরোধী দল এবং তাদের নেতাকর্মীরা (যদি সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে তাদের কোন সরাসরি যোগসাজশ না থাকে) মুক্তভাবে তাদের রাজনীতি, মিছিল মিটিং, মিডিয়া প্রোপাগান্ডা করে যাচ্ছে। তুরস্কে এখনো যে পত্রিকা বা টিভিগুলো বেশি দেখা হয় তাদের শুরুতেই আছে কট্টর বিরোধী ঘরানার মিডিয়া।
এসব কারণে সরকার ধারণা করছে, ওই দশ রাষ্ট্রদূতের বিবৃতির আসল উদ্দেশ্য তুরস্কের আইনের শাসন বা গণতন্ত্র নিয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ না। এমনকি কাভালার মুক্তিও না। কারণ তারা যদি সত্যি সত্যি কাভালার মুক্তি চাইতো তাহলে এই বিষয়ে তুরস্কের সাধারণ মানুষকে টার্গেট করে এই ধরণের একটা বিবৃতি তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিত না। বরং তারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তব্যস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারতো। এবং সেক্ষেত্রে তারা এই বিচার প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণেরও আবেদন করতে পারতো। কিন্তু সেটা না করে তারা অনেক কৌশল করেই তুরস্কের জনগণকে একটা মেসেজ দেয়ার জন্য এই কাজটি করছে বলে সরকার মনে করছে। বিশেষ করে তুরস্কের বিরোধী দলকে একটা মেসেজ দেয়ার চেষ্টা করছে তারা।
যে কারণে কঠোর অবস্থানে এরদোগান সরকার
এই বিবৃতির তিন দিন আগে প্রধান বিরোধী দল সিএইচপি -এর নেতা কামাল ক্লিচদারওগ্লু একটা বিবৃতি দেন এবং সেখানে তিনি সরকারী আমলাদের হুমকি দেন। সেখানে তিনি বলেন, “আগামী ১৮ অক্টোবর থেকে তুরস্কে নতুন যুগের সূচনা হবে। আপনারা (আমলারা) সাবধান হয়ে যান। ওই দিনের পর থেকে কোন আমলা যদি এরদোগানের (সরকারের) কথায় কাজ করে তাহলে তাদেরকে ছাড় দেয়া হবে না।”
এই ঘোষণার তিন দিন পর, অর্থাৎ ১৮ই অক্টোবর এই দশ দেশের রাষ্ট্রদূতরা কাভালাকে নিয়ে ওই বিবৃতি প্রকাশ করে। তাই ধারণা করা হয় ওই রাষ্ট্রদূতদের বিবৃতি আসলে কাভালার মুক্তির চেয়েও বরং বিরোধীদেরকে একটা মেসেজ দেয়া, যে আমরা তোমাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করছি। কেননা, ওই বিবৃতি প্রকাশের পরে তুরস্কের সরকার যে এর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিক্রিয়া দেখাবে সেটা আপনার আমার মতো সাধারণ মানুষরা বুঝতে পারলে ওই সব রাষ্ট্রদূতরা কি আসলেই বুঝতে পারেননি। তারা কি এটা হিসেব করেনি যে এই বিবৃতির পরে এরদোগান আরও কঠিন পদক্ষেপ নিবে? অবশ্যই হিসেব করেছে এবং সে হিসেবেই তাকে ক্ষেপানোর জন্য এই পন্থা অবলম্বন করেছে। অর্থাৎ এখানে কাভালা আসলে একটা উছিলা আসল উদ্দেশ্য তার মুক্তি বা তুরস্কের গণতন্ত্র না। আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে তুরস্কের আগামী নির্বাচনে এরদোগানের পতন তরান্বিত করতে নতুন একটা চাল।
এখন, এ ধরণের একটা পদক্ষেপের বিরুদ্ধে এরদোগান কেন তাদেরকে বহিষ্কারের মত এত কড়া সিদ্ধান্ত নেয়ার হুমকি দিলেন? তিনি কি জানেন না যে এই দশ দেশের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার মানে হচ্ছে পুরা পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষানর শামিল? তিনি কি জানেন না যে এই সিদ্ধান্ত নিলে ওই দেশগুলো আরও বেশি কঠোর পদক্ষেপ নিবে তুরস্কের বিরুদ্ধে। কারণ ওই দেশগুলোর সবগুলোই OECD সদস্য, এদের সাতটা ন্যাটো সদস্য, ছয়টা ইইউ সদস্য, চারটা জি-৭ এর সদস্য, দুটো জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দেয়ার ক্ষমতা রাখে, আর এদের মধ্যে পাঁচটি তুরস্কের গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী অংশীদার।
আসলে পশ্চিমাদের এই ধরণের বিবৃতিগুলো শত্রু দেশের সরকারকে ক্ষেপিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে দেয়া হয়। কারণ ওই সরকারকে যতই ক্ষেপানো যাবে ততই সে ভুল সিদ্ধান্ত নিবে এবং পশ্চিমারা তা থেকে ফায়দা লুটবে। এ কারণে পশ্চিমাদের এই ধরণের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে রাশিয়া তাৎক্ষনিক কোন পদক্ষেপ নেয় না। মোক্ষম সময়ের জন্য অপেক্ষা করে। কারণ আপনার শত্রু এরপর আপনি কি পদক্ষেপ নিতে পারেন সেটা আগেই হিসেব করে তাদের পরবর্তী করণীয় ঠিক করে রাখে। অর্থাৎ তারা আপনার থেকে সবসময় এক ধাপ এগিয়ে থাকে। এ কারণে এই ধরণের পদক্ষেপের পরে সাথে সাথেই বড় কোন সিদ্ধান্ত না নিয়ে চুপ থাকা উত্তম। তাতে শত্রুরা বিভ্রান্ত হয়।
কিন্তু এরদোগান সে পথে হাঁটেননি। তিনি ডাইরেক্ট একশনে যাচ্ছেন। এর পরিনাম কী হবে কেউ আন্দাজ করতে পারছে না।
পশ্চিমারা এখন কী করবে?
পশ্চিমারা এর বিরুদ্ধে কি ধরণের পদক্ষেপ নিবে, তুরস্ক সেই পদক্ষেপের জবাব কিভাবে দিবে? এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে পশ্চিমারা তুরস্কের দুর্বল পয়েন্টে আঘাত করবে আর এখনকার সবচেয়ে দুর্বল পয়েন্ট হচ্ছে অর্থনীতি। সেখানেই আঘাত করবে। ইতিমধ্যে অবশ্য সে আঘাত শুরু হয়ে গেছে।
যে কারণে কঠোর অবস্থানে এরদোগান
এখন এরদোগান হয়তো ভাবছেন, যে এই পশ্চিমা কূটনীতিকদের মুখ এখনই বন্ধ করতে না পারলে, তাদেরকে এখনই সমুচিত জবাব না দিলে আগামীতে তারা তুরস্কের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আরও বেশি নাক গলাবে। সামনের নির্বাচনে বিরোধীদের সাপোর্ট দিতে বিভিন্ন ঠুনকো বিষয়ে সরকারের বিরুদ্ধে আরও বেশি ছুড়ি ঘুরানোর চেষ্টা করবে। তাই এখনই যে কোনো মূল্যে তাদের টুঁটি চেপে ধরতে চাইছেন হয়তো। এখন যদি তিনি নমনীয় হন তাহলে ভবিষ্যতে হয়ত ১৫ দেশ ২০ দেশ বা পুরো ইইউ, ন্যাটো, OECD সদস্য দেশগুলো একত্র হয়ে তুরস্কের বিরুদ্ধে বিশেষ করে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে একত্রে চড়াও হবে।
তুরস্কের বিষয়ে ইউরোপীয় নেতারা দ্বিধাবিভক্ত
তবে এখানে, আরেকটা বিষয় লক্ষণীয় যে, রাষ্ট্রদূতদের ওই বিবৃতিতে অনেকগুলো ইউরোপীয় দেশই স্বাক্ষর করেনি বা যোগ দেয়নি। তাদের মধ্যে ব্রিটেন, স্পেন, ইতালি, বেলজিয়াম, গ্রীস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যদিও গ্রীসের ওই দলে যোগ না দেয়াটা পুরোটাই কৌশলগত। কিন্তু অন্যদের যোগ না দেয়ার ব্যাপারটি তাদের সাথে তুরস্কের ভালো সম্পর্কের ফলাফল হিসেবে দেখছেন অনেকেই। সুতরাং দেখা যায় তুরস্কের বিষয়ে ইউরোপও দ্বিধাবিভক্ত। এরদোগান হয়তো এই সুযোগটিও কাজে লাগাতে চাইবেন।
লড়াইয়ে কি পেরে উঠতে পারবেন এরদোগান?
কিন্তু এরদোগানের এই সিদ্ধান্তে কতটুকু মূল্য দিতে হবে তুরস্কের অর্থনীতির এবং সাধারণ মানুষের সেটাই দেখার বিষয়। যদিও তুরস্কের সাধারণ মানুষ সবসময়ই পশ্চিমা খবরদারির বিরোধিতা করে। কিন্তু এবারের এই বিবৃতিতে খুশি হয়েছে সবগুলো বিরোধী দল যা এর আগে খুব একটা দেখা যায়নি।
২০২৩ সালের নির্বাচনের মাঠের লড়াইয়ের আগেই শুরু হয়ে গেলো কূটনৈতিক লড়াই। এই লড়াইয়ে কি পেরে উঠতে পারবেন এরদোগান? নাকি এর মধ্যমেই শুরু হবে তার ২০ বছরের তুরস্ক শাসনের ইতিটানা।
বিদ্রঃ সরোয়ার আলমের এই লেখাটি ২৫ অক্টোবর ২০২১ তারিখ যুগান্তর অনলাইনে ছাপানো হয়।
অবশেষে আফগানিস্তান ছাড়লো মার্কিন সেনারা। ৩১ আগস্ট শুরু হওয়ার আগেই ৩০ আগস্ট রাত ১১টা ৫৯ মিনিটে শেষ সেনাটি ত্যাগ করে কাবুল বিমানবন্দর।
রাতের অন্ধকারে মাথা নিচু করে শেষ সৈন্যের সেই হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য দেখে থমকে গেছে বিশ্ব। ওই রাতের অন্ধকারেও আমেরিকার অসহায় চিত্রটি ভেসে উঠেছে সারা বিশ্বের দরবারে।
হলিউড বলিউড এবং হাজার হাজার মিডিয়ার মাধ্যমে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করা অপ্রতিরোধ্য আমেরিকা যে কতোটা অসহায় এবং দুর্বল তা আরেকবার প্রমাণিত হল আফগানিস্তানে। আমেরিকার এক পঙ্গু সৈন্য সেদিন আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘এই দিন দেখার জন্যই কি আমরা এত কিছু হারালাম।’
আমেরিকা কোন দিন দেখার জন্য কী হারাল তা জানি না। তবে ২০০১ সালের পর থেকে মুসলিম বিশ্বে যে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। লক্ষ লক্ষ নারী পুরুষ শিশুর গগণ বিদায়ী ফরিয়াদ হয়তো তাদের বম্বিংয়ের আওয়াজ ভেদ করে মুসলমান নেতাদের কানে পৌঁছেনি।
তবে ঠিকই জায়গামত পৌঁছেছে সে কান্না, আহাজারি, আর অসহায় মানুষগুলোর ফরিয়াদ। আজ তাদেরই চোখের সামনে বিশ্বের সবচেয়ে পরাশক্তি রাতের অন্ধকারে মাথা নিচু করে পালিয়ে যেতে দেখে কি অনুভূতি হয়েছিল আমি জানি না। তবে লক্ষ লক্ষ মুসলিমের হৃদেয়ের রক্তক্ষরণ হয়তো কিছুটা হলেও বন্ধ হবে এখন।
যেমন দম্ভভরে তারা এসেছিল তেমন চোরের মতই পালিয়ে গেল। আর এর মাধ্যমেই বাহ্যিকভাবে দখলমুক্ত হলো আফগানিস্তান।
যদিও প্রকৃতপক্ষে কবে পুরোপুরি দখলদার মুক্ত হবে দেশটি নাকি আদৌ হবে কি না কেউ জানে না। তবে এখন শুরু হবে তালেবানের সরকার গঠন এবং প্রতিশ্রুতি পূরণের পালা। তালেবানের জন্য আসল পরীক্ষা এখন শুরু হবে।
মার্কিন সেনারা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দেয়া হয় কাবুল বিমানবন্দর। সেখানে সব কিছু নষ্ট করে বিমানবন্দরটিকে প্রায় অকেজো করে রেখে যায় তারা। বিমানবন্দর এখন যেন এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। কন্ট্রোল সিস্টেম থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের প্রযুক্তি এবং যন্ত্রপাতি বোমা মেরে বা গুলি করে নষ্ট করে দিয়েছে।
এই বিমানবন্দর পুনর্গঠন এবং পরিচালনার মত প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি এবং যোগ্য জনবল তালেবানের নেই। তারা এখন, তুরস্ক এবং কাতারের স্মরনাপন্ন হয়েছে।দুই দেশ একত্রে একটা খসড়া চুক্তি প্রস্তুত করেছে বলেও খবর বেরিয়েছে।
কিন্তু এই বিমানবন্দর পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার ক্ষেত্রে গড়িমসি করছে তুরস্ক। যেই দায়িত্ব নেয়ার জন্য একসময় হুমড়ি খেয়ে পড়তো, এখন সেই দেশটিই গড়িমসি করছে। কিন্তু কেন?
তুরস্ক গত সপ্তাহে কাবুল বিমানবন্দর থেকে তার সৈন্যদের প্রত্যাহার করার পরে তালেবানের পক্ষ থেকে তুরস্কের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।
তালেবানের একটা প্রতিনিধিদল তুরস্কের কাবুল দূতাবাসে তুর্কি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে এবং সেখানে তারা তুরস্ককে কাবুল বিমানবন্দরের দায়িত্ব নেয়ার অনুরোধ করেন। তালেবান আসলে শুরুতে কাবুল বিমানবন্দরের দায়িত্ব নেয়া নিয়ে কাতারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিন্তু কাতার একা এই দায়িত্ব নিতে পারবে না বলে জানায়।
পরবর্তীতে তারা যোগাযোগ করে তুরস্কের সঙ্গে এবং এক্ষেত্রে তুরস্ক এবং কাতারকে একত্রে দায়িত্ব নেয়ার জন্য অনুরোধ করে। তুরস্ক এ বিষয়ে কাতারের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং একটা খসড়া চুক্তি প্রস্তুত করে। সেটি হয়তো এরদোগানের অনুমতির অপেক্ষায় আছে।
তুরস্ক তো সেই শুরু থেকেই কাবুল বিমানবন্দরে দায়িত্ব নেয়া নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে। কিন্তু তখন তুর্কি সেনারা সেখানে ন্যাটোর অংশ হিসেবে থাকার কারণে তালেবান তাদেরকে মেনে নেয়নি। ফলে তুরস্ক তার সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করে নিয়ে আসে। তারপরে সেখানে অনেক কিছু ঘটে যায়। কাবুল বিমানবন্দরে হামলা হয়। কয়েকশো মানুষ মারা যায়। তারপরে আবার হামলা হয়। তারপরে আবার হামলা হয়। বিমানবন্দরের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ধ্বংসের মাধ্যমে বিমানবন্দরকে অকেজো করা হয়।
শেষ পর্যন্ত কাবুল বিমানবন্দরকে অরক্ষিত এবং অনিরাপদ একটা জায়গায় পরিণত করে ফেলে রেখে যায়।
এখন কাবুল বিমানবন্দরের দায়িত্ব নেয়া সম্পর্কে গড়িমসি করছে তুরস্ক।
এর কারণ হিসেবে প্রথম হচ্ছে কাবুল বিমানবন্দরে নিরাপত্তার বিষয়টি। তালেবান তুরস্ককে শুধুমাত্র কাবুল বিমানবন্দর পরিচালনার দায়িত্ব দিতে চায় এবং নিরাপত্তার দায়িত্ব পুরোপুরি তালেবান সদস্যদের হাতে রাখতে চায়। কিন্তু গত কয়েকদিনের একের পর এক হামলা বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে তুরস্ককে ভাবিয়ে তুলছে।
কারণ, বিমানবন্দরের দায়িত্বে যদি বেসামরিক লোক পাঠায়, তাদের নিরাপত্তার কী হবে? সেখানে যদি কোনো হামলা হয় এবং সে হামলায় যদি বিমানবন্দর পরিচালনায় নিয়োজিত কোন তুর্কি নাগরিক নিহত হয় তাহলে বিষয়টি তুরস্কের সরকারকে ভালোই বেকায়দায় ফেলবে। কোনো জায়গার নিরাপত্তায় সামরিক বাহিনী বা নিরাপত্তাকর্মীদের নিহত হওয়া হয়তো মেনে নেয়া যায়। কিন্তু অরক্ষিতভাবে বেসামরিক লোকদের সেখানে নিয়োগ দেয়া এবং সে নিয়োগের পরে সেখানে হামলায় ওই বেসামরিক লোকদের মৃত্যু কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে না সরকারের পক্ষে।
একারণেই তুরস্ক চাচ্ছে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা যেন তাদের কাছেই ছেড়ে দেয়া হয়; কিন্তু তালেবান সেটা ছাড়বে না। শেষ পর্যন্ত হয়ত তুরস্কের কোন বেসামরিক নিরাপত্তা সংস্থা হতে পারে সেটা সাদাত বা অন্য কোনো কোম্পানি তাদের নিরাপত্তা রক্ষীদের নিয়োগ দেবে সেখানে। আর বিমানবন্দর পরিচালনায় কাজ করবে সরকার নিয়োজিত কর্মীরা যাদের মধ্যে হয়তো গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনও থাকবে।
আরেকটা বিষয় হল-তুরস্ক এই চুক্তি স্বাক্ষরের আগে ন্যাটো তথা আমেরিকার সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করবে এবং তাদের কাছ থেকে সবুজ সঙ্কেত পাওয়ার পরই স্বাক্ষর করবে এই চুক্তি। কারণ, তুরস্ক একা ওখানে পা দিয়ে নতুন কোনো ঝামেলায় জড়াতে চায় না।
তালেবানকে যতই মনে মনে সমর্থন করুক বাস্তবতায় ওখানে সৈন্য প্রেরণ, লোকজন প্রেরণ এবং তালেবানকে স্বীকৃতির ক্ষেত্রে তুরস্ক এককভাবে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে না। তুরস্কে এক্ষেত্রে পশ্চিমাদের মনোভাব বুঝে ধীরেসুস্থে পা ফেলতে চাইছে। কারণ যদি তালেবান-সরকারকে পশ্চিমারা তথা আমেরিকা ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন স্বীকৃতি না দেয় তাহলে তুরস্ক সে ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঝামেলায় পড়বে।
তখন এককভাবে কাবুল বিমানবন্দরে থাকলে তুরস্কের ওপরেও বড় ধরনের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আসতে পারে। তুরস্ক এই জিনিসটাই চাচ্ছে না। একারণেই এর আগেরবার তুরস্ক ন্যাটো এবং ইউরোপ ইউনিয়নের কোনো একটা সদস্যকে নিয়ে সেখানে থাকতে চেয়েছিল যেন ন্যাটো অথবা ইউরোপ ইউনিয়ন তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক করার বাহানায় তুরস্কের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা না দিতে পারে। এবার যদিও পাকিস্তানের পরিবর্তে কাতারকে নিয়ে একত্রে সেখানে থাকতে চাচ্ছে কিন্তু কাতার এমন কোন দেশ না যে পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞাকে ঠেকাতে পারবে। তাই তুরস্ক এনিয়ে পশ্চিমাদের সঙ্গে কোন ঝামেলায় জড়াতে চাচ্ছে না।
আরেকটা বিষয় হল, আমেরিকা চলে যাওয়ার পর ওখানে রাশিয়া এবং চীনের শক্তি বৃদ্ধি। সিরিয়া, লিবিয়া এবং আজারবাইজানে মূলত রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে তুরস্ক। রাশিয়ার শত শত ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ধংস করেছে তুর্কি সেনারা। অন্যদিকে সিরিয়ায় রাশিয়া অনেক তুর্কি সেনা হত্যা করেছে।
সিরিয়া এবং লিবিয়ায় এখনও তুরস্ক-রাশিয়া মুখোমুখি অবস্থানে। এখন কাবুল বিমানবন্দরের দায়িত্ব নেয়া মানে হচ্ছে ওখানেও তুরস্কের পরোক্ষভাবে রাশিয়া এবং চীনের স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। ওই বিমানবন্দরে কোন ঝামেলা হলে বা ওখানে রাশিয়ার স্বার্থে কোনও আঘাত হলে রাশিয়া তাদের প্রক্সি বা ভাড়াটিয়াদের দিয়ে সিরিয়ায় তুর্কি সেনাদের ওপর আঘাত হানবে। অতীতে এরকম হয়েছে।
এছাড়াও রাশিয়ার তুরস্কের সঙ্গে আছে মাল্টি বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা। তুরস্কের পর্যটন খাত অনেকাংশই রাশিয়া নির্ভর। সবকিছু মিলিয়ে তুরস্কের কাবুল বিমানবন্দরের দায়িত্ব নেয়া রাশিয়া তুরস্কের বৈরী সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে পারে।
আবার ওখানে তুরস্কের থাকা মানে চীনের বেল্ট এ্যন্ড রোড প্রকল্পের জন্য পরোক্ষভাবে হুমকি স্বরূপ। তাই চীনও চাইবে তুরস্ককে অর্থনৈতিক ভাবে চাপে ফেলতে। এখন তুরস্কের পূর্ব পশ্চিম উভয় মেরুর বিরুদ্ধে গিয়ে ওখানে থাকা কতটা নিরাপদ এবং যুক্তিসংগত।
প্রশ্ন করতে পারেন এতই যখন ঝামেলা তাহলে তুরস্ক কেন কাবুলে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করছে। তুরস্কে খুব বিখ্যাত একটা প্রবাদ আছে সেটা হল আঙ্কারা নিরাপত্তা শুরু হয় কাবুল থেকে অর্থাৎ কাবুল যদি নিরাপদ থাকে, কাবুলে যদি তুরস্কের কোন প্রভাব থাকে তাহলে আঙ্কারা কে নিরাপদ রাখা সম্ভব। এর অনেক ঐতিহাসিক কারণ এবং ব্যাখ্যা আছে।
পূর্ব দিক থেকে আসা যেকোনো ধরনের আগ্রাসন যদি এখানেই ঠেকানো যায় তাহলে আঙ্কারা নিরাপদ থাকবে আর যদি সে আগ্রাসনকে কাবুলে ঠেকানো না যায় তাহলে তার চোট লাগবে আঙ্কারায়ও। হতে পারে সেটা চীন-রাশিয়া বা অন্য কোনও দেশ। তাইতো তুরস্ক চায় কাবুলে যেন তার একটা চোখ সব সময় থাকে।
এছাড়াও মধ্য এশিয়ার তুর্কি দেশগুলোকে নিয়ে যে বৃহত্তর ঐক্যের স্বপ্ন দেখছেন এরদোগান এবং আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ, সে স্বপ্ন বাস্তবায়নেও কাবুলে তুরস্কের উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ।
বিদ্রঃ সরোয়ার আলমের এই লেখাটি যুগান্তর পত্রিকায় ০২ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখ প্রকাশ করা হয়।