২০১২ সালে আবুধাবির যুবরাজ শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ ও তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগান আঙ্কারায় একটি বৈঠকে মিলিত হন। ফাইল ছবি: রয়টার্স
২০১২ সালে আবুধাবির যুবরাজ শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ ও তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগান আঙ্কারায় একটি বৈঠকে মিলিত হন। ফাইল ছবি: রয়টার্স

কাতারের সঙ্গে সৌদি নেতৃত্বাধীন আরব জোটের মধ্যে সমঝোতা মুসলিম বিশ্বে স্বস্তি নিয়ে আসলেও সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মিসর কিছুটা অস্বস্তিতে ভুগছে। 

২০১৭ সালে সৌদি আরবের নেতৃত্বে আমিরাত, বাহরাইন, এবং মিসর  কাতারের ওপর যে অবরোধ দিয়েছিল তাতে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিল মিসর এবং আরব আমিরাত। 

গত তিন বছরে এই অবরোধের কারণে আমিরাত এবং মিসর দাবিয়ে বেড়িয়েছে এই অঞ্চল।  সৌদি আরবকে পাস কাটিয়ে আমিরাতই যেন হয়ে উঠেছিল মধ্যপ্রাচ্যের মোড়ল। 

বিশেষ করে ২০১৩ সালে মিসরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সামরিক জান্তা সিসিকে সরাসরি সমর্থন এবং সৌদি যুবরাজ সালমানের ওপরে প্রভাব আবুধাবি রাজতন্ত্রকে আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল।  আত্মবিশ্বাসী এবং অহংকার এতটা তুঙ্গে উঠেছিল যে, অন্যান্য মুসলিম দেশের ওপর চড়াও হওয়ারও চেষ্টা করেছিল বারবার।  এমনকি তুরস্কের বিরুদ্ধে এত আক্রমণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল যার দ্বিতীয় উদাহরণ মুসলিম বিশ্বে বিরল।  

সেই আমিরাত এখন তুরস্কের সঙ্গে সুসম্পর্ক পুনরায় স্থাপনের, সম্পর্কোন্নয়নের আহ্বান জানাচ্ছে।

আরব আমিরাতের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনোয়ার গারগাশ আবুধাবি ভিত্তিক স্কাইনিউজ আরবি চ্যানেলকে বলেছেন যে, সংযুক্ত আরব আমিরাত পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে  তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চায়। 

তার সর্বশেষ সাক্ষাৎকারে, তিনি তিন তিনবার জোর দিয়ে বলেন যে, ‘সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে তুরস্কের দ্বন্দ্ব কিংবা মতবিরোধ কোন পক্ষের জন্য কল্যাণকর হবে না। আমরা আরব বিশ্বে তুরস্কের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার … আমাদের সঙ্গে তুরস্কের কোন সীমান্ত সমস্যা নেই … আমাদের মধ্যে অবশ্যই নতুন করে সেতুবন্ধন তৈরী করতে হবে।”

মধ্যপ্রাচ্যে শান্তিকামী, শান্তিপ্রিয় মানুষের মনে আশা জাগানোর মতো কিছু বিবৃতি।চমৎকার সব শব্দ দিয়ে গড়া সময়োপযোগী কিছু বাক্য বিন্যাস! কিন্তু এই বিবৃতি মিথ্যা আশা দেখানোর, মনোযোগ অন্যদিকে ফিরানোর ব্যর্থ প্রয়াস কিনা তা ভেবে দেখার বিষয়। 

কারণ উপরোক্ত কথাগুলোর পরেই তিনি ঝুলি থেকে আসল বেড়ালটি বের করেছেন। 

তিনি বলেন, আবুধাবি চায় তুরস্ক যেন আরব বিশ্বের সঙ্গে তার সম্পর্কের কম্পাস পুনরায় ঠিক করে।  তুরস্ক যেন মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রধান সমর্থক না হয়। তুরস্কের সঙ্গে আমিরাতের সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে তুরস্ক আরব দেশগুলোতে তার ভূমিকা প্রসারিত করতে চায়।  

আসলে এই কথার মাধ্যমে তিনি আরব আমিরাতকে আরব বিশ্বের নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করছেন।  আর আরব বিশ্বের পক্ষে তুরস্ককে কিছু শর্তও জুড়ে দিয়েছেন। 

আরব বিশ্বের সমস্যার পেছনে তুরস্ক এবং আমিরাতের ভূমিকা 

আরব বিশ্বের নেতা কে? সে প্রসঙ্গে নাই বা গেলাম।  বরং আসুন দেখা যাক আরব বিশ্বের সমস্যার পেছনে তুরস্ক এবং আমিরাতের ভূমিকা কী ছিল? 

ইয়েমেনকে ধ্বংস করা, সেখানে হাজার হাজার লোককে হত্যা করা, লক্ষ লক্ষ মানুষকে বাস্তুহারা করা কাতারের উপরে অবৈধভাবে অবরোধ আরোপ করা, মিসরের নির্বাচিত এবং বৈধ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পেছনে আসল কলকাঠি কে নেড়েছিল? তুরস্ক নাকি আরব আমিরাত? 

কোটি কোটি আরব জনগণ এবং ফিলিস্তিনদের বিরোধিতা সত্ত্বেও ইসরাইলের সঙ্গে আমিরাতসহ অন্য আরব দেশগুলোর সম্পর্ক স্থাপন কি তুরস্কের কাজ? 

লিবিয়াতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারের বিরুদ্ধে নির্বিচারে নিরীহ মানুষ হত্যাকারী সন্ত্রাসী খলিফা হাফতারকে সমর্থন দিয়েছিল কি তুরস্ক নাকি আরব আমিরাত? সিরিয়াতে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে সাহায্য করায় আমিরাতের ভূমিকা, আর বাকি ছোটখাটো কর্মকাণ্ডের কথা নাহয় নাই বা বললাম। 
এ সবগুলোর পিছনে আরব আমিরাত প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।  আর এই কাজের কোনটিই আরব জনগণের স্বার্থে ছিল না। 

অথচ তুরস্ক ৪০ লাখেরও বেশি সিরিয় শরণার্থী আশ্রয় দিয়ে, কাতারের পক্ষে অবস্থান নিয়ে, ইয়েমেনে ত্রাণ পাঠিয়ে, লিবিয়ায় বৈধ সরকারের পক্ষে দাঁড়িয়ে, মিসরের জনগণের ভোটে নির্বাচিত বৈধ সরকারকে সমর্থন করে, ফিলিস্তিনের পক্ষে সোচ্চার হয়ে সমগ্র আরব বিশ্বের সাধারণ মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছে। 

কাতার ভিত্তিক একটি আরব জনমত জরিপ সংস্থা গত বছরের নভেম্বরে ১৩টি আরব দেশে ২৮ হাজার লোকের ওপরে একটি জরিপ চালায়।  ওই জরিপের অনেক প্রশ্নের মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল আরব বিশ্বে কোন দেশের প্রভাব (বিদেশ নীতি) ইতিবাচক বা কম ক্ষতিকারক।  ইরান, আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, চীন নাকি তুরস্ক? আশ্চর্যের বিষয় হল, জরিপে উঠে এসেছে- আরব বিশ্বে তুরস্কের বৈদেশিক নীতিকে সবচেয়ে কম ক্ষতিকর হিসেবে মনে করে মধ্যপ্রাচ্যের নাগরিকরা।  জরিপে অংশগ্রহণকারী শতকরা ৫৮ ভাগ আরব লোক তাদের এলাকায় তুরস্কের নীতিকে ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করেন।   

এই যখন বাস্তব অবস্থা তখন গারগাশের উক্তি অতিরঞ্জিত বৈ কি।  

আর তিনি যদি সত্যই তুরস্কের সঙ্গে তার দেশের সম্পর্কের উন্নতি চান।  তবে তার দেশকে আগে তুরস্ক বিরোধী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা উচিত নয় কি? 

আন্তর্জাতিকভাবে তুরস্কবিরোধী যে বিশাল প্রোপাগান্ডা নেটওয়ার্ক তারা তৈরি করেছেন তার ইতি টানবে কি আবুধাবি? 

যেমন আমিরাতের যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ইউসুফ আল ওতাইবা আমেরিকাতে তুরস্ক বিরোধী যে লবি চালাচ্ছেন তার কি হবে? তুরস্কবিরোধী তার কর্মকাণ্ড ফাঁস হওয়া অনেক ডকুমেন্টের মাধ্যমে প্রমাণিত।  তিনি যে আমেরিকার নতুন প্রশাসনের কাছে আঙ্কারা বিরোধী লবি চালিয়ে যাবেন না তার নিশ্চয়তা কী? 

আমিরাতের টাকায় তুরস্কের ভিতরে ও বাইরে প্রতিষ্ঠিত ভুয়া সংবাদের কারখানাগুলো কি বন্ধ হবে?

গত কয়েক বছর ধরে আমিরাতি টাকায় পরিচালিত তুর্কি, আরবি এবং ইংরেজি ভাষায় বিভিন্ন নামধারী এবং নামকাওয়াস্তের গণমাধ্যম গুলোতে তুরস্ক সম্পর্কে ভুয়া, মিথ্যা সংবাদের পাশাপাশি কট্টর তুরস্ক বিরোধী প্রচারণা চালিয়েছে দেধারছে। সেই সঙ্গে সমর্থন দিয়েছে ফেতুল্লাহ গুলেনের সন্ত্রাসী সংগঠন, পিকেকে সন্ত্রাসী সংগঠনসহ আরও অনেক তুরস্ক বিরোধী নিষিদ্ধ গ্রুপকে।আমিরাতের টাকায় ইউরোপ এবং আমেরিকাতে পরিচালিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে তুর্কি বিরোধী প্রচারণাগুলো কি বন্ধ হবে? 

এছাড়াও তুরস্কের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নাক গলানো, বাধা প্রদান, তুরস্ক বিরোধী জোটকে সমর্থন, তুরস্কের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর সঙ্গে এক জোটে কাজ করা ইত্যাদির কী হবে? অর্থাৎ আবুধাবি তুরস্ক বিরোধী যে বিশাল প্রোপাগান্ডা মেশিন নিয়ে আটঘাট বেধে নেমেছিল তা গুঁটিয়ে ফেলতে পারবে কি? 

আরব আমিরাত যদি সত্যি সত্যিই তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন চায় তাহলে এই সংশোধনমূলক পদক্ষেপগুলো নেয়া উচিত।  কিন্তু আরব আমিরাতের এত বছর ধরে তিলে তিলে গড়া এই তুরস্ক-বিরোধী ষড়যন্ত্রের জাল কি এত সহজে গুঁটিয়ে নেওয়ার বিষয়? 

আমরা ইতিবাচক হতে চাই।  আমরা মনে করি আমিরাতি মন্ত্রী তার কথায় যথেষ্ট নিষ্ঠাবান।  আমরা তার কথায় আস্থা রাখতে চাই।  আমরা চাই মুসলিম বিশ্ব বন্ধুত্ব, ভ্রাতৃত্ব এবং একে অপরকে সম্মানের মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে এগিয়ে যাক। শান্তি ফিরে আসুক এ অঞ্চলে।