বর্তমান সময়ে তুরস্ক বাংলাদেশের অন্যতম সামরিক অংশিদার।২০১৭-১৮ সালের আগের দিনগুলোতে বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের সাথে তুরস্কের বুঝাপড়া তেমন একটা ভাল যায়নি। অবস্থার উন্নতি শুরু হয় ২০১৬ সালে তুরস্কে ঘটে যাওয়া ব্যার্থ সামরিক অভ্যুন্থানের পর থেকে। ঐ সময়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তড়িঘড়ি করে এরদোগানের প্রতি তার অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যাক্ত করেন। এবং ঐ অভ্যুন্থানচেষ্টার নিন্দা জানান।
একদিকে দু’দেশের সম্পর্ক উন্নতি হতে থাকে অপরদিকে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নের লক্ষ্যে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করে বহুল আলোচিত forces goal 2030. এর অধীনে সরকার সামরিক বাহিনীকে যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে দীর্ঘ মেয়াদি বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রনয়ণ করে। পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সমরাস্ত্র ঘাটতি পুরা করতে বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম যুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের সামরিক ঘাটতি পূরণে বিভিন্ন ধরনের সমরাস্ত্র সরবরাহের প্রস্তাব দেয় দেয় তুরস্ক। বাংলাদেশের জন্যও আদর্শ ছিল তুরস্কের সমরাস্ত্রের বাজার, কারণ তারা পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় অনেক সহজ শর্তে অস্ত্র বিক্রি করে। পাশাপাশি তাদের সমরাস্ত্রের দামও কম এবং যথেষ্ট আধুনিক। অপর দিকে তুরস্ক মুসলিম দেশ হওয়ায় যুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশের পাশে থাকবে।
শুরু হয় দুই দেশের মাঝে সামরিক সম্পর্ক। ২০১৮ সালের আগে তুরস্ক বাংলাদেশের সমরাস্ত্রের বাজারে তেমন উল্লেখযোগ্য কোন নাম ছিল না। ১৮ সালের পর থেকে শুরু হয় পটপরিবর্তন। দুদেশের সম্পর্কের পালে বসন্তের হাওয়া লাগতে শুরু করে।
অন্যদিকে তুরস্কের সামরিক সক্ষমতাও বাড়তে থাকে জ্যামিতিক হাড়ে। নিজেদের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি প্রচুর পরিমানে অস্ত্র রপ্তানি শুরু করে দেশটি। তারা এখন বিশ্বের ১২ তম বৃহৎ অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশে পরিনত হয়েছে। তাদের সমরাস্ত্র বিক্রির পরিমাণ বিশ্বের মোট সমর বানিজ্যের ১.১ শতাংশ। তুরস্কের রপ্তানি বাজার দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে।
গত পাঁচ বছরে তাদের রপ্তানি ৫৭৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২২ সালে তারা অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙে বিশ্বে মোট ৪ বিলিয়ন ডলারের সমরাস্ত্র সরবরাহে করেছে। এবছর তারা ৬ বিলিয়ন ডলারের সমরাস্ত্র রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
তুরস্কের রপ্তানি বাজারের অন্যতম গন্তব্য এখন বাংলাদেশ, ২০২১ সালে বাংলাদেশ তুরস্কের ৫ম বৃহৎ রপ্তানি গন্তব্যে পরিনত হয়েছে।
গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার রেংকিং অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪০ তম শক্তিশালী রাষ্ট্র। এবং ২৪ তম বৃহৎ অস্ত্র আমদানিকারক। এতদিন ধরে বাংলাদেশের সমরাস্ত্রের বাজারে একাধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিল চীন। কারণ এত অধিক দামে পশ্চিমা অস্ত্র কেনার সামর্থ্য বাংলাদেশের ছিল না।
সেই দিন এখন বদলাতে শুরু করেছে বাংলাদেশ তার সমরাস্ত্রে বৈচিত্রতা আনতে চাইছে, তুরস্কের সাথে সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করছে।বিভিন্ন সামরিক আমদানির ক্ষেত্রে তুরস্ককে প্রাধান্য দিচ্ছে বাংলাদেশ। ২০১৯ সাল থেকে ২০২২ সাল এ চার বছরে বাংলাদেশের অস্ত্রের যোগানদাতা দেশগুলোর মাঝে তুরস্ক কখনো দ্বিতীয় কখনো তৃতীয় অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল তুরস্ক থেকে কেনা অনেক সমরাস্ত্রের লেনদেনের বিষয়টি পাবলিশ করা হয় না। যারা বাংলাদেশর সমরাস্ত্র সম্পর্কে গভীর নজরদারি করে থাকেন,তারা বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে কোন কোন নতুন অস্ত্র যুক্ত হয়েছে এবং এর দাম কত এর উপর ভিত্তি করে বলছেন তুরস্ক এখন বাংলাদেশের প্রধান সামরিক সরঞ্জাম যোগানদাতা দেশ। যদিও এসকল কথার নির্ভরযোগ্য প্রমাণ তাদের কাছে নেই।
নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশে সামরিক রপ্তানির ক্ষেত্রে তুরস্কের এ স্থান ধরে রাখতে অনেক কঠিন হবে, কারণ এখন বাংলাদেশ ভারী সমরাস্ত্র ক্রয়ের দিকে ঝুকছে।সেক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলোকে প্রাধান্য দেয়া হবে। আর তুরস্ক থেকে কেনা অধিকাংশই ছিল হালকা সমরাস্ত্র। পশ্চিমা সমরাস্ত্র ক্রয় করতে এখন বাংলাদেশ অনেকটা বাধ্যই বলা যায়। কারণ পশ্চিমা ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে বাংলাদেশ সরকারের দিশেহারা অবস্থা। তাদের সাথে অস্ত্র কেনার চুক্তি করলে তারা এ চাপ বহুলাংশে কমিয়ে দিবে।
তুরস্ক কিভাবে এই বিশাল বিপ্লব ঘটিয়ে আজকের এ স্থানে আসল,চলুন বিষয়টা আমার জীবনে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা দিয়ে শুরু করা যাক।
সময়টি সম্ভবত ২০০৯-২০১০. বাংলাদেশের বিমানবাহিনীর একজন উইং কমান্ডার এসেছেন তুরস্কে প্রশিক্ষণ নিতে। তিনি ইস্তানবুলের মিলিটারি একাডেমীতে ট্রেনিং নিয়েছেন এক বছর। তার সাথে আমাদের ভালো সম্পর্ক ছিল। ঐ সময়ে ইস্তানবুলে অধ্যয়নরত ১২-১৫ জন ছাত্র ছিলাম আমরা। উইকেন্ডে আমরা একত্র হতাম। তিনিও আসতেন। প্রায়ই কথা হত বিভন্ন বিষয় নিয়ে। খুব ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার সাথে। তার ট্রেনিং শেষে যখন দেশে যাবেন তার আগে আমাদের সাথে শেষ দেখা করলেন। সেদিন তিনি খুবই এক্সাইডেড ছিলেন। তিনি অনেক উৎসাহ নিয়ে আমাদেরকে বললেন যে গত ৩-৪ দিনে তিনি এবং সাথে অন্য দেশেরও সেনা সদস্যরা যারা ট্রেনিং শেষ করেছে তারা তুরস্কের অস্ত্র তৈরির কারখানাগুলো পরিদর্শন করেছেন। তিনি তখন তুরস্কের অনেক গুলো কোম্পানিরও নাম বলেন। নামগুলোর সবগুলোর শেষেই – সান থাকায় এখন মিলাতে পারছি সেগুলোর নাম। যেমন আসেলসান, রকেটসান, হাভেলসান, মেতেকসান, এগুলো। তিনি এদের অস্ত্রের বর্ণনা দিলেন আমাদেরকে। আর বললেন সরওার তোমরা ধারনাও করতে পারবে না যে এরা কত ধরণের অস্ত্র তৈরি করছে আর কত দ্রুত এগুচ্ছে। আমরা তখন এগুলোর নাম তো দূরের কথা তুরস্ক রাইফেল আর বন্দুকের বাইরে কিছু তৈরি করতে পারে সেই ধারণাই ছিলনা। আমি অবশ্য একটু আগ বাড়িয়েই তাকে বললাম ভাই আপনি মনে হয় প্রথম কোন অস্ত্র কারখানায় গেছেন তাই আপনার উৎসাহ এত বেশি। আর আপনি এতো উদ্দীপনা অনুভব করছেন। তিনি বলেন সরওয়ার দেখো আর দশ বছরের মধ্যে তুরস্ক সামরিক শিল্প যে কোন পর্যায়ে পৌছাবে তোমরা ধারণাও করতে পারবে না।
আমরা তখন তার কথার মর্ম বুঝিনি। আসলেই বুঝিনি। সেই ভাই এখন বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। তখন যে তুরস্কের নিজস্ব তৈরি সমরাস্ত্র সম্পর্কে নিজ দেশেই কেউ কিছু জানতো না বা সে রকম আহামরি টাইপের কিছু তৈরি করতে পারে বলে ধারণা করতো না। মাত্র দশ বছরের মাথায় এখন তুরস্কের নিজস্ব তৈরি ড্রোনের দিকে সারা দুনিয়া বিস্ময় ভরে তাকিয়ে থাকে। তুরস্কের সামরিক শিল্প এখন বিশ্বের প্রধান কয়েকটি দেশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। সত্যিই অবিশ্বাস্য। ভাবলে স্বপ্নের মত মনে হয়।
১৫ বছর আগেও তুরস্কের ব্যবহৃত অস্ত্রের ৮০ ভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হত। আর এখন তুরস্কের সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত অস্ত্রের ৭৫ ভাগই দেশের তৈরী। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করছে নিজস্ব প্রযুক্তির অস্ত্র । আমরা যদি গত পাঁচ বছরের অস্ত্র রপ্তানির পরিমাণ দেখি তাহলে বিষয়টি আরেকটু স্পষ্ট হবে।
তুরস্কের মোট সামরিক রপ্তানি
২০১৬ – ১,৬৮ বিলিয়ন ডলার (১,৬৭৭,১১৬,১৫০)
২০১৭ – ১.৭৪ বিলিয়ন ডলার (১,৭৩৮,৫১২,০০০)
২০১৮- ২ বিলিয়ন (২,০৩৫,৯৫৬,০০০)
২০১৯- ২,৭ বিলিয়ন (২,৭৪০,৬৯৪,০০০ ডলার)
২০২০- ২,৩ বিলিয়ন (২,২৭৯,০২৭,০০০ ডলার)
২০২১ -এ বছরের প্রথম ৯ মাসে ২,১ বিলিয়ন (২,১০৯,৪৭৮,০০০ ডলার (জানুয়ারী – সেপ্টেম্বর)
২০২২- এ মোট ৪ বিলিয়ন ডলার
ডলারের অস্ত্র রপ্তানি হয়েছে। ডিফেন্স নিউজ ম্যাগাজিন প্রকাশিত ২০২০ সালের বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১০০ অস্ত্র প্রস্তুতকারক কোম্পানির মধ্যে তুরস্কের ৭ টি কোম্পানি স্থান পেয়েছে। মুসলিম বিশ্বের মধ্যে একমাত্র তুরস্কই আছে এই তালিকায় । যেখানে বিশ্বের শীর্ষ ১০০ কোম্পানির তালিকায় ভারতের মাত্র ২ টি কোম্পানি স্থান পেয়েছে ।
যাহোক, এবার আসি বাংলাদেশের তুরস্কের সম্পর্কে। গত দশ বছর ধরে বাংলাদেশের সাথে তুরস্কের রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্কে অনেক উত্থান পতন হলেও, সামরিক সম্পর্কে সেগুলোর প্রভাব পড়েনি বললে একটুও ভুল হবে না। তুরস্ক বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে থাকায় এবং গত কয়েক বছর আগে পর্যন্তও বাংলাদেশের গণমাধ্যমে তুরস্কের গুরুত্ব না থাকায় এই দুই দেশের মধ্যের সামরিক বেসামরিক অনেক গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক তেমন একটা প্রচার হয়নি। যেমন, সেই ২০০০ সালে তুরস্কের Netaş (নেতাশ) টেলিকমুনিকেশন বাংলাদেশের BTCL এর সাথে একটা চুক্তি হয়। তখন BTCL এর নাম ছিল বাংলাদেশ টেলিগ্রাম এন্ড টেলিফোন বোর্ড বা বিটিটিবি। সেই চুক্তি অনুযায়ী ১০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ঢাকা থেকে বগুড়ার মধ্যে অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল বসানোর কাজ পায় তুরস্কের এই কোম্পানিটি।
এরপর এই দুই কোম্পানির মধ্যে আরকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ২০০৪ সালের দিকে। তখন তুরস্কের এই কোম্পানিটি সারা দেশে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য অবকাঠামো উন্নয়নের দায়িত্ব পায়।
২০০৮ সালে আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সে চুক্তি অনুযায়ী ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন লিংকের ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি এবং ওই লাইনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে অতিরিক্ত আরেকটা লাইন বসানোর জন্য ১,৯ (প্রায় ২ মিলিয়ন) ডলারের কাজ পায় তুরস্কের এই কোম্পানিটি।
২০১৪ সালে, ইন্টারনেট লাইনের ক্যাপাসিটি বৃদ্ধির জন্য ৩ মিলিয়ন ডলারের আরেকটি কাজ পায়।
এভাবে এই নেতাশ বাংলাদেশের ইন্টারনেট লাইন স্থাপনে গত ১৬ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে। এরকম অনেক কোম্পানি আছে যারা বাংলাদেশে কাজ করে যাচ্ছে বহু বছর ধরে।
অন্যদিকে ১৯৮১ সালের ঢাকায় উভয় দেশ সামরিক প্রশিক্ষণ, শিক্ষা ও সেনাবাহিনীর যৌথ সহায়তার বিষয়ে একটি চুক্তি সাক্ষর করে। সে চুক্তির উপর ভিত্তি করে তুরস্কের সাথে বাংলাদেশের নৌ বাহিনীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠে। তুরস্ক নৌবাহিনী বহু বছর বাংলাদেশের নৌবাহিনীর স্পেশাল অপারেশন ফোর্স SWADS কে ট্রেনিং দিয়ে আসছে।
সেই আশির দশক থেকেই বাংলাদেশ তুরস্কের তৈরি অস্ত্র ব্যবহার করছে। তখন বিশেষ করে ভারী অস্ত্র বা আর্টিলারি গান কিনেছে বাংলাদেশ।
তবে দু দেশের মধ্যে সামরিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় হতে শুরু করে ২০০৪ সালের পর থেকে। কারণ ওই বছর তুরস্ক এবং বাংলাদেশের মধ্যে সামরিক প্রশিক্ষণ সম্পর্কিত একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সে চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের সেনা বিমান এবং নৌবাহিনীর ৩০০০ অফিসারকে ট্রেনিং দেয় তুরস্ক।এদের মধ্যে অনেকেই তুরস্ক এসে স্বল্প মেয়াদে এবং দীর্ঘ মেয়াদে প্রশিক্ষণ নেন। এই ভিডিওর শুরুতে বিমানবাহিনীর যে অফিসারের কথা বললাম তিনিও ওই ট্রেনিং কর্মসূচির আওতায়ই তুরস্কে আসে। তারা তুরস্ক ভাষা শিখতে বাধ্য। এ কারণে বাংলাদেশ এখন ট্রেনিংএর জন্য তুরস্কে সেনা পাঠানো কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে।
এর পর শুরু হয় তুরস্ক থেকে অস্ত্র কেনার পালা। তুরস্কের Otokar কোম্পানি থেকে ২০০৭-৮ সালে পরীক্ষার জন্য ২৪ টি কোবরা হাল্কা সাঁজোয়া যান নেয় বাংলাদেশ। ২০১০ সালে বাংলাদেশ পুলিশ ৭ টি কোবরা কিনে। ২০১৩ সালে আরও ২২ টি কোবরা কিনে বাংলাদেশ। ২০১৭-১৮ সালে আরও ৬৭ টি কোবরা পায় বাংলাদেশ। ২০১৩ সালে তুরস্কের Otokar কোম্পানি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে xxx টি কোবরা হাল্কা সাঁজোয়া যান সরবরাহ করে।
২০১৫ সালে তুরস্ক বাংলাদেশকে জি২জি চুক্তির মাধ্যমে গাইডেড মিসাইল ফ্রিগেট অফার করে। যদিও বাংলাদেশ সেদিকে ধীর গতিতে অগ্রসর হয়। এবং সে প্রস্তাবে এখনো হ্যাঁ, না কিছুই বলেনি।
২০১৭ সালে তুরস্কের Delta ডিফেন্স নামক কোম্পানি বাংলাদেশে ৬৮০ টি TUR-K সাঁজোয়া যান সরবরাহের একটা কাজ পায় ১ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে। এবং ২০১৯ সালের মধ্যে সেগুলোকে সরবরাহ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে। বর্তমানে বাংলাদেশ তুরস্কের, রাশিয়ার এবং সার্বিয়ার তৈরি সাঁজোয়া যান ব্যবহার করছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আছে তুরস্কের তৈর যান।
২০১৮ সালে তুরস্কের Dronmarket নামক একটা কোম্পানি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ১,৫ (দেড়) বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ৫০০ টি ড্রোন সরবরাহ করে।
তুরস্কের সামরিক সিমুলেটর তৈরিকারী কোম্পানি Simsoft এর সাথে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ২০১৬ সালে। সে চুক্তি অনুযায়ী তুরস্কের এই কোম্পানিটি বাংলাদেশের জন্য সাঁজোয়া যান সিমুলেটর তৈরী, সরবরাহ এবং ট্রেনিংয়ের চুক্তি হয়। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে আরও দুটি নতুন চুক্তি হয়। সে অনুযায়ী Simsoft বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে আর্মার্ড পার্সোনাল ক্যারিয়ার ভেহিকেল শুটিং অ্যান্ড ড্রাইভিং ট্রেনিং সিমুলেটর এবং এয়ার ডিফেন্স ওয়েপন ট্রেনিং সিমুলেটর সরবরাহ করে। একই সাথে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের ট্রেনিং দেয়।
২০১৮ সালে তুরস্কের METEKSAN কোম্পানির তৈরি ৬ টি Retinar PTR রেটিনার পিটিআর নামক স্থল নজরদারি রাডার কিনে বাংলাদেশ।
২০১৯ সালে তুরস্কের কোম্পানি ইলেকট্রোল্যান্ড ডিফেন্স থেকে ৫ টি খান নামক রিমোট কন্ট্রোলড বোম্ব ডিসপোসাল রোবট কিনে বাংলাদেশ। সেবছর একই কোম্পানি থেকে ৬টি বোমা নিষ্ক্রিয়কারী ব্যারেলও কিনে। পরের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে আরও ২ টি বোম্ব ডিসপোসাল রোবট এবং ১০ টি বোমা নিষ্ক্রিয়কারী ব্যারেলের অর্ডার দেয়।
তুরস্ক থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র কেনার চুক্তি হয় ২০১৯ সালে।
সে বছর ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারেক আহমেদ সিদ্দিকী এবং তখনকার সেনা প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ তুরস্ক সফর করেন। সেসময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩১-জনের একটা দল তুরস্কের KIS-2019 নামক বহুজাতিক শীতকালীন সামরিক মহড়ায় অংশগ্রহণ করে। তখন এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও সে মহড়া পরিদর্শন করেন।
এর এক মাস পরে ২০১৯ সালের মার্চ মাসে তুরস্কের মিসাইল প্রস্তুত কারক কোম্পানি রকেটসানের সাথে বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে মাঝারি পাল্লার গাইডেড মাল্টিপল রকেট লাঞ্চার দেয়ার কথা। এই চুক্তির পরিমাণ প্রায় ৬০ মিলিয়ন ডলার। এটাই তুরস্ক এবং বাংলাদেশের মধ্যে এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় সামরিক চুক্তি। এরই অংশ হিসেবে বাংলদেশ সেনাবাহিনীর ৪১ জন সদস্য TRG-300 Kasirga MLRS এর উপর তুরস্কে ট্রেনিং নেয়। ২০২১ সালের জুন মাসে রকেটসান তার TRG-300 Kaplan/টাইগার MLRS রকেট লাঞ্চার সিস্টেম বাংলাদেশকে সরবরাহ করে। ১২০ কিলোমিটার পাল্লার এই TRG-300 kaplan মিসাইলের ১৮টি ইউনিট পায় বাংলাদেশ। এটাই এখন বাংলাদেশের হাতে সবচেয়ে লম্বা পাল্লার । বাংলাদেশ তুরস্ক থেকে ১ রেজিমেন্ট (১৮ ইউনিট) T-300 kasirga মাল্টিপল রকেট লাঞ্চার সিস্টেম কিনেছে।
এই সিস্টেমের আছে চারটি ৩০০ মিমি. রকেটের লাঞ্চার টিউব। আর এই সিস্টেমের রকেট সর্বোচ্চ ১২০ কিলোমিটার দূরে আঘাত হানতে সক্ষম।
করোনার কারণে ২০২০ সালে এই সেক্টরে নতুন চোখে পড়ার মত তেমন কোন কর্মকাণ্ড দেখা যায়নি। তবে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করেছে দুই দেশ। যার উপর ভিত্তি করে ২০২২ সালটি তুরস্ক-বাংলাদেশের সামরিক সম্পর্কের এযাবৎ কালের সবচেয়ে সবচেয়ে ফলপ্রসূ বছর হিসেবে সামনে চলে আসে।
এ বছর এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল মাসিহুজ্জামান সেরনিয়াবাত ৬ দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে তুরস্কে আসেন। এবং তুরস্ক সেনা নৌ ও বিমান বাহিনী কমান্ডারদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন এবং বাংলাদেশ ও তুরস্ক বিমান বাহিনীর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচনা করেন।
এর পরে মে-জুন মাসে বাংলাদেশের নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল এম শাহীন ইকবাল ৮ দিনের সফরে তুরস্ক আসেন। সে সফরে তিনি তুরস্কের সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে জাহাজ নির্মাণ, সাইবার নিরাপত্তায় পারস্পারিক সহযোগিতা বাড়ানোসহ বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেন।
এর পরে আগস্ট মাসে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ ৮ দিনের সরকারী সফরে তুরস্কে আসেন। সেখানে তিনি তুরস্কের সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে দুই দেশের সামরিক এবং তুরস্কের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে সামরিক সরঞ্জামাদিসহ সব প্রকার সহযোগিতা এবং সহায়তার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।
সে সফরের পর তুরস্ক এবং বাংলাদেশের মধ্যে আরেকটা g2g চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যার আওতায় তুরস্কের রকেটসান বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করবে। চুক্তির পরিমাণ এবং ধরণ সম্পর্কে স্পষ্ট কোন কিছু জানানো হয়নি। তবে ধারণা করা হয় এই চুক্তি এর আগের চুক্তির চেয়েও বড় একটা চুক্তি। এবং এই চুক্তির অধীনে রকেটসান বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সাথে একত্রে বাংলাদেশে গোলাবারুদ এবং রকেট ও মিসাইল উৎপাদন করবে।
এই চুক্তির কয়েকমাস পরে বাংলাদেশ সফর করেন রকেটসানের বড় একটা প্রতিনিধি দল। প্রায় ৩২ জনের সেই দলে আছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং ইঞ্জিনিয়ার। তাদের সফর বা তারা বাংলাদেশে কি করবেন এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কিছু জানানো হয়নি। তাই আমিও বিস্তারিত কিছু বলা থেকে বিরত থাকাকেই যৌক্তিক মনে করছি। তবে রকেটসানের সাথে বাংলাদেশের বিগত চুক্তি গুলো পর্যালোচনা করলে এই ফলাফলে উপনীত হওয়া যায় যে তুরস্কের এই প্রতিনিধিদল দুইটি কাজে বাংলাদেশে যেতে পারেন, একটা হচ্ছে রকেটসান থেকে বাংলাদেশ যে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কিনছে সেটার পরিক্ষামূলক উৎক্ষেপণ করা। আরেকটা হচ্ছে, বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর অস্ত্র উৎপাদন কারখানায় রকেটসানের অস্ত্র উদপাদন লাইন স্থাপন করা।
এ বছরের মাঝামাঝি সময় দু দেশের মধ্যে আরেকটি জি২জি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সে চুক্তি অনুযায়ী তুরস্কের REPKON কোম্পানি বাংলাদেশের সামরিক শিল্প তৈরি প্রতিষ্ঠানের জন্য ১০৫ এবং ১৫৫ মিলিমিটারের ক্যানন-বল বডি এবং শেল প্রডাকশন লাইন স্থাপন করে দিবে।
এছাড়াও meteksan থেকে সিমুলেটর, অন্য কোম্পানি থেকে গোলাবারুদ, বন্ধুকের বিভিন্ন অংশ, আরও কিছু আনআর্মড ড্রোন সহ আরও অনেক সামরিক অস্ত্র কিনছে তুরস্ক থেকে।
কিছু অসমর্থিত সূত্রমতে বাংলাদেশ তুরস্ক থেকে রকেটসানের HISAR-O নামক মাঝারি পাল্লার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। এই সিস্টেম থেকে নিক্ষিপ্ত মিসাইল সর্বোচ্চ ২৫ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁতভাবে আঘাত হানতে সক্ষম।
ভবিষ্যতে, বাইরাক্তার টিবি-২, ( বাংলাদেশ এখন এ ড্রোন কিনেছে) ভেস্টেল কারায়েল সহ আরও কিছু ড্রোন কোম্পানি থেকে ড্রোন কিনতে পারে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ যে ছয়টা ফ্রিগেট জাহাজ কেনার টেন্ডার দিয়েছে সেখানেও তুরস্ক আবেদন জমা দিয়েছে। অনেক খবরে অবশ্য বলা হয়েছে যে এই টেন্ডারটি তুরস্ক পাবে। কিন্তু এখনো এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোন ঘোষণা আসেনি।
তুরস্ক থেকে বাংলাদেশের সামরিক সরঞ্জাম আমদানির পরিমাণ
২০১৩- ৩,০০০,০০০ (৩০ লাখ ডলার)
2016- 323,790 ( ৩ লাখ ডলার)
২০১৭ – ১৬,৩৭৫,০০০ (১ কোটি ৬৪ লাখ ডলার)
২০১৮ – ২৪,১১৩,০০০ ( ২ কোটি ৪১ লাখ ডলার)
২০১৯ – ২,৩২২,৯৪০ (২৩ লাখ ডলার)
২০২০ – ১,৩০৪,০৪০ ( ১৩ লাখ ডলার)
২০২১ – ৫৯,৩২৫,০৪০ ( ৬ কোটি ডলার) (জানুয়ারী সেপ্টেম্বর)