তুরস্কের রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশে আসবেন ব্যাপারটি প্রথমে আলোচনায় আসে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে। শুরু হয় তার সফর নিয়ে নানা জল্পনা কল্পনা। বিশেষ করে দেশের সাধারণ জনগণের আগ্রহের কোন সীমা ছিল না। বিষয়টি নিয়ে নানাবিধ পর্যালোচনা শুরু হয় সবার মাঝে।

ইউটিউব কিংবা ফেসবুক সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রব উঠে তাহলে কবে আসছেন এরদোয়ান। তার এই বিপুল জনপ্রিয়তার বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ঘোর তুরস্ক-বিরুধী মিডিয়াগুলোও এরদোয়ান ও তুরস্কেকে নিয়ে ইতিবাচক সংবাদ প্রচার করতে শুরু করে।

বাংলাদেশ সহ বিশ্বের সকল মুসলমানদের কাছে এরদোয়ান একটি প্রিয় নাম। সবার ভালবাসার পাত্র।
ভালবাসার সেই উদ্দীপনা থেকে কেউ তাকে বলছে সুলতান, কেউ বলছে খলিফা, কেউবা আবার বলছে তিনিই হলেন মুসলিম বিশ্বের একমাত্র অবিসংবাদিত নেতা।

এমনই একজন নেতাকে কাছ থেকে এক পলক দেখার সপ্ন বুকে লালন করেন অনেকেই। তাই এরদোয়ানের সফর বাংলাদেশের মানুষের কাছে আলাদা গুরুত্ব বহন করে।

এই সফরের বিষয়টি প্রথম মিডিয়ায় আসে গতবছর(২০২১)সেপ্টেম্বর মাসে যখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন তার আঙ্কারা সফরকালে এরদোগানের সাথে সাক্ষাত করেন এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণ পত্র তুরস্কের প্রেসিডেন্টের কাছে হস্তান্তর করেন। 

তখন প্রচার করা হয় যে এরদোগান “আগামী বছর মুজিব বর্ষ সমাপনী অনুষ্ঠান এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশে আসছেন”। 

তখন এ খবর বাংলাদেশের পাঠক শ্রেণির মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়

পাঠক সংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতায় গণমাধ্যমও তখন খবরটিকে আরও ফলাও করে প্রচার করতে থাকে । বাংলাদেশ থেকে অনেকে আমার কাছে এ বিষয়ে জানতে চান। আমি তাদেরকে বলি, তুরস্ক সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এখনো আসেনি। সুতরাং তার সফরের বিষয় নিয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আঙ্কারায় অবস্থানকালে বিষয়টি নিয়ে তার সাথে আলোচনা করলে তিনি বলেন, ” এরদোগান যেন বাংলাদেশ সফর করেন সে ব্যাপারে আমি তার কাছে আমাদের আগ্রহের কথা জানিয়েছি। 

এক রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষ থেকে আরেক রাষ্ট্রপ্রধানকে যখন আমন্ত্রণ পত্র দেওয়া হয় তখন স্বাভাবিক ভাবেই প্রাপক প্রেরকে ধন্যবাদ দেন এবং ওই দেশ ভ্রমণের আগ্রহ প্রকাশ করেন। এটা কূটনৈতিক শিষ্টাচারেরও একটি অংশ। কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধানদের সফরের জন্য শুধু একটু মৌখিক সম্মতি বা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের কারণে ভ্রমণের  আগ্রহ প্রকাশই যথেষ্ট নয়। 

বিষয়টি আমি আমার বাংলাদেশি সাংবাদিক বন্ধুদের বুঝানোর চেষ্টা করলাম। এ নিয়ে আমার ফেইসবুক পেইজেও স্ট্যাটাস দিলাম। কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিজ্ঞপ্তি আকারে বিষয়টি জানানো হয়েছে  তাই আমার যুক্তি তাদের কাছে ধোপে টিকল না। 

এক মাস পরে এরদোগানের সফরের বিষয়টি আবার বাংলাদেশের মিডিয়ায় আসে ফলাও হয়ে।  যখন বাংলাদেশে নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মুস্তাফা ওসমান তুরান করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে তুরস্কের প্রসিডেন্টের পক্ষ থেকে চিকিৎসা সামগ্রী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নিকট হস্তান্তর করতে তার কার্যালয়ে আসেন। তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে ঘোষণা আসে যে, “এরদোগান বাংলাদেশে আসছেন”। এবার বলা হয় কোভিড-১৯ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ২০২১ সালের গোরার দিকে বাংলাদেশে আয়োজিত ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে বাংলাদেশে যেতে পারেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান। 

আবার ঢাকার সাংবাদিক পাড়ায় এ নিয়ে হইচই পড়ে যায়। 

এরদোগানের সফরে কি কি বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে? কোন সামরিক চুক্তি হবে কি না? রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো নিয়ে কোন সুরহায় আসবেন কিনা? ইত্যাদি নিয়ে বাংলাদেশী মিডিয়া আবার খবর প্রচার করতে সচেষ্ট হয়। অনেকে আবার আমাকেও জিজ্ঞেস করেন। 

আমার আবারও সেই একই জবাব, তুরস্কের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোন ঘোষণা আসেনি। 

তাঁরা বললেন ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত সরাসরি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছেন। আর কি আনুষ্ঠানিক ঘোষণার দরকার আছে? আমি নিশ্চুপ হয়ে যাই।  

বিষয়টি নিয়ে আমারও যে আগ্রহ ছিল না তা কিন্তু নয়। যে কোন রাষ্ট্রপ্রধানের বাংলাদেশ সফরই আমাদের জন্য সুসংবাদ। বিশেষ করে  সে অতিথি যদি হন এরদোগান, সে রাষ্ট্রপ্রধান যদি হন এমন একটি দেশের যেখানে আমি বসবাস করছি গত ১৭ বছর যাবৎ। 

তখন বিষয়টি নিয়ে তুরস্কের ঢাকাস্থ দূতাবাসে কথা বললাম। তাঁরা জানালেন যে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোন কিছুই বলা হয়নি। 

আঙ্কারায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসেও যোগাযোগ করলাম। তাঁরাও এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোন সবুজ সংকেত পাননি। 

দুদেশের দূতাবাস এবং বাংলাদেশে কর্মরত তুরস্কের বিভিন্ন সরকারি সংস্থার সাথে কথা বলে এবং তাদের কাজের গতিবিধি লক্ষ্য করে আমি নিশ্চিত হলাম যে এরদোগান মার্চ-এপ্রিল তো দূরের কথা খুব শিগগিরই বাংলাদেশে যাচ্ছেন না। 

২৬ শে মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আসবেন। তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় এসে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন এবং সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছেন। সে অনুষ্ঠানে এরদগানের যাওয়ার সম্ভবনা থাকলে তুরস্ক থেকেও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ঢাকায় গিয়ে সে ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করে তার সফরের বিষয়টি নিশ্চিত করতেন। কিন্তু তা হয়নি।  সুতরাং এরদোগান ২৬শে মার্চের অনুষ্ঠানে যে যাচ্ছেন না সেটা এখন মোটামুটি নিশ্চিত। 

বাকি থাকলো ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার বিষয়টি। বাংলাদেশে এ সম্মেলনটি গত বছর হওয়ার কথা থাকলেও করোনার কারণে তা কয়েকবার পিছিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত এ বছরের শুরুতে হওয়ার কথা ছিল তাও পিছিয়ে যায়। এবং সর্বশেষ বাংলাদেশ সরকার এই সম্মেলনটি এপ্রিলের ৪ তারিখে ভার্চুয়াল ভাবে করার সিদ্ধান্ত নেয়।  

যেহেতু সম্মেলনটি অনলাইনে হবে সেহেতু ডি-৮ ভুক্ত অন্য দেশের সরকার প্রধানদের মত এরদোগানেরও বাংলাদেশে যাওয়ার কোন সম্ভবনা নেই। 

করোনা ভাইরাসের মধ্যে এরদোগান বিদেশ ভ্রমণ অনেক কমিয়ে দিয়েছেন। শুধুমাত্র আজারবাইজান, কাতার ও তুর্কি সাইপ্রাস ছাড়া অন্য কোথাও যাননি। দেশের ভিতরের অনুষ্ঠানগুলোতেও বেশিরভাগ সময়ে অনলাইনে যোগদান করেন। তাই করোনার বিষয়টিকে মাথায় রেখে বাংলাদেশ সফরের বিষয়ে তাড়াতাড়ি কোন সিদ্ধান্তে আসতে চাচ্ছে না এরদোগান সরকার। 

তবে আঙ্কারা বাংলাদেশের সাথে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, সামরিক, এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে আগ্রহী। বাংলাদেশও তুরস্ককে বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে কাছে পেতে চায় সবসময়। সে দিক থেকে এরদোগান

বাংলাদেশ সফর করলে তা উভয় দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সারা বিশ্বে লক্ষকোটি মুসলিমের প্রাণের নেতা, শত কোটি যুবকের মনে আশার সঞ্চারকারী, মুসলিম বিশ্বের অবিসংবাদিত নেতা এরদোগানের বাংলাদেশ সফর শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্যই না, এই অঞ্চলের শোষিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত, মানুষের জন্য বিশেষ করে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সহ আরও অনেক দেশের জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। 

তাই এখন না হলেও অদূরভবিষ্যতে তার ঢাকা সফর হওয়া উচিত। আর সে সফর অনেক নতুন সম্ভবনার দ্বার উম্মুক্ত করবে।