চলতি ২০২২ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি হতে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন শুরুর পর থেকেই রাশিয়া দাবি করে যাচ্ছে যে, তাদের সামরিক বাহিনী ইতোমধ্যেই অসংখ্যবার নতুন প্রযুক্তির লেজার গান ব্যবহার করে ইউক্রেনের বেশকিছু ড্রোন ধ্বংস করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাশিয়া তার কথিত লেজার গান প্রযুক্তি বিশ্বের সামনে প্রকাশ করলেও এ সংক্রান্ত কোন ভিডিও বা বাস্তব সম্মত কোন তথ্য উপাত্ত এখনো পর্যন্ত মিডিয়ায় উন্মোচন করতে পারেনি।
এদিকে মার্কিন পেন্টাগনের অস্ত্র বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইউক্রেনে সামরিক হামলার ক্ষেত্রে রাশিয়া যে ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করেছে বা এখনো পর্যন্ত করে যাচ্ছে, তাতে কিন্তু লেজার গান প্রযুক্তি ব্যবহারের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। ফলে রাশিয়ার লেজার গান ব্যবহারের বিষয়টি এক রকম প্রোপাগান্ডা বলেই প্রতিয়মান করছে আমেরিকা। রাশিয়া প্রচার করে যে, তারা ইউক্রেনের বহু ড্রোন নষ্ট করেছে হাইলী এডভান্স টেকনোলজির লেজার গান দিয়ে।
তবে রাশিয়া বাস্তবে যুদ্ধক্ষেত্রে লেজার গান ব্যবহার করুক না না করুক, বিশ্বে কিন্তু সীমিত পরিসরে হলেও নতুন কনসেপ্টের এই লেজার ওয়েপন্স ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে গত ২০২১ সাল থেকেই। আর এই নতুন প্রজন্মের লেজার প্রযুক্তির অস্ত্র ব্যবহারকারী দেশ হিসেবে বিশ্বের বড় বড় প্রযুক্তি সমৃদ্ধ সুপার পাওয়ার দেশগুলোকে পিছনে ফেলে সবার উপরে উঠে এসেছে তুরস্কের নাম।
মুলত গত ২০২১ সালের মার্চ মাসের দিকে লিবিয়ায় হাফতার বিদ্রোহী সামরিক মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে বিশ্বের প্রথম কোন দেশ হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি লেজার গান বা নেক্সড জেনারেশন ওয়েপন্সের সফলভাবে প্রয়োগ করে তুরস্ক সারা বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছে।
সেই সময়ে খুব সম্ভবত সংযুক্ত আরব আমিরাতের গোপন কোন সামরিক ঘাঁটি থেকে লিবিয়ায় আসা চীনের তৈরি একটি উইং লুং-২ কমব্যাট ড্রোনকে ভূমিতে থাকা তুর্কী লেজার গান দিয়ে সফলভাবে আকাশেই ধ্বংস করে দেয়া হয়। তাই একেবারে সীমিত পরিসরে এবং পরীক্ষামুলক হলেও এটি ছিল বাস্তব যুদ্ধক্ষেত্রে ভবিষ্যতের অস্ত্র লেজার গানের প্রথম কোন সফল ব্যবহার।
তুরস্কের ডিফেন্স সিস্টেম ম্যানুফ্যাকচারিং ফার্ম ‘মেটেকসান’ ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিজ ২০২১ সালে তাদের নিজস্ব প্রযুক্তির তৈরি নতুন প্রজন্মের গ্রাউণ্ড বেসড ‘নাজার’ লেজার গান ওয়েপন্স সিস্টেম বিশ্বের সামনে উম্মোচন করে। তাছাড়া তুরস্কের সামরিক বাহিনী যতটা সম্ভব এবং সুযোগ মতো তার নিজস্ব প্রযুক্তির ডিফেন্স সিস্টেম বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারে চেষ্টার কোন কমতি রাখছে না।
তুরস্ক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি লেজার গান প্রযুক্তি নিয়ে রাশিয়া, ইসরাইল, ভারত এবং চীনের নাম বার বার মিডিয়ার সামনে আসলেও তারা মুলত নতুন এই প্রযুক্তি উন্নয়নের একেবারে প্রাথমিক স্তরেই রয়েছে। আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় চীন তাদের তৈরি লেজার গান দিয়ে গোপনে তাইওয়া এবং জাপানের বেশকিছু যুদ্ধবিমান ধ্বংস করেছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়লেও চীনের তরফে এ নিয়ে কিন্তু কোন তথ্যই প্রকাশ করা হয়নি।
তবে ইসরাইল কিন্তু তার নিজস্ব প্রযুক্তির তৈরি হাইলী এডভান্স টেকনোলজির লেজার গানের বেশকিছু পরীক্ষা ইতোমধ্যেই সম্পন্ন করে ফেলেছে। যার মধ্যে ইসরাইল সর্বশেষ পরীক্ষাটি চলায় চলতি ২০২২ সালের ১৪ই এপ্রিল। ইসরাইল কার্যত আকাশ পথে আগত শত্রু পক্ষের রকেট আকাশেই লেজার গান দিয়ে ধ্বংস করে দিতে চায়। এই নতুন কনসেপ্টের ডিফেন্স সিস্টেম ডিজাইন ও তৈরিতে অনেকটাই সফল হয়েছে ইসরাইল।
তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুব সম্ভবত ২০১৬ সালের দিকে স্টেলথ যুদ্ধবিমানে ব্যবহারের উপযোগী লেজার গান উদ্ভাবনের ঘোষনা দিয়েছিল। যা হয়ত আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী তাদের জেট ফাইটারে লেজার গান-সহ অন্যান্য নতুন প্রযুক্তির অস্ত্র সংযোজন করতে সক্ষম হবে। নতুন উদ্ভাবিত এই লেজার গান থেকে ১৫০ কিলোওয়াটের বিদ্যুৎ তরঙ্গের প্রবাহ শত্রুর যুদ্ধবিমান বা যানের উপর বর্ষিত হবে।
এখন মার্কিন সামরিক বাহিনী যে সমস্ত উচ্চ প্রযুক্তির বৈদ্যুতিক হাতিয়ার ব্যবহার করে তার থেকে দশগুণ ছোট এই নয়া অস্ত্রের ধংসক্ষমতা অন্তত কয়েকগুণ বেশি হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকোর হোয়াইট স্যান্ডস মিসাইল রেঞ্জ গ্রাউন্ডে এই অস্ত্রের গোপন গবেষনা ও পরীক্ষামূলক ব্যবহারিক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে মার্কিন বিমানবাহিনী।
তবে পরিশেষে যাই হোক না কেন, সারা বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে এক রকম নিরবেই নতুন নতুন প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও গবেষণায় ব্যাপক সাফল্য লাভ করেছে তুরস্ক। বিশেষ করে সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে নিজস্ব প্রযুক্তির লেজার গান সফল প্রয়োগ করে নিজেদের উচ্চ মানের ডিফেন্স প্রযুক্তির সক্ষমতা বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছে তুরস্ক।
সিরাজুর রহমান, (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক ও লেখক, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com