তুরস্কের হাত ধরে ডিফেন্স প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাক আমাদের সোনার বাংলাদেশঃ

সাম্প্রতিক সময়ে উচ্চ প্রযুক্তির ড্রোন ডিজাইন ও ইঞ্জিনিয়ারিং এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের মতো দেশ অনেকটাই এগিয়ে গেলেও তুরস্ক এবং ইরানের মত মুসলিম দেশগুলো কিন্তু অতি সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক সাফল্য লাভ করেছে। বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধে অবিশ্বাস্যভাবে রাশিয়ার পক্ষে ইরানের সাহাব ড্রোন এবং ইউক্রেনের পক্ষে তুরস্কের তৈরি বায়রাক্তার টিবি-২ কমব্যাট ড্রোন বড় ধরণের ভূমিকা পালন করে বিশ্বকে একেবারেই চমকে দিয়েছে।

যেখানে কিনা কমব্যাট ড্রন ডিজাইন এন্ড ম্যানুফ্যাকচারিং এ রাশিয়া, ভারত এবং চীনের মতো দেশগুলো খুব একটা এগিয়ে যেতে পারেনি। তবে রেড জায়ান্ট চীন নিজেও হাজার হাজার কমব্যাট, সার্ভেলাইন্স এন্ড রিকর্নিসেন্স ড্রোন ম্যানুফ্যাকচারিং এবং অপারেট করলেও বাস্তবে জটিল কোন যুদ্ধে গেম চ্যেঞ্জার ওয়েপন্স হিসেবে আজ অব্ধি তার যোগ্য স্থান করে নিতে পারেনি। অবশ্য ড্রোন টেকনোলজির আঁতুড়ঘর হিসেবে ইসরাইলকেই মান্য করা হয়।

এমনকি শুধুমাত্র আমেরিকা ও ইসরাইল ব্যাতিত পশ্চিমা বিশ্বের অনেক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ দেশই এখন কিন্তু তুরস্কের তৈরি কমব্যাট ও নজরদারি ড্রোন সংগ্রহ বা ক্রয় করতে মড়িয়া হয়ে পড়েছে। অথচ আজ থেকে এক দশক আগেও ডিফেন্স টেকনোলজিতে একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় ছিল এই পশ্চিমাদের। আর সেই আধিপত্য এখন কিনা তুরস্ক এবং ইরানের মতো দেশের প্রযুক্তির কাছে হার মানতে বাধ্য হচ্ছে। তাই আর কোন উপায় না পেয়ে, এখন পশ্চিমা বিশ্ব এই দেশ দুটিকে শতাধিক অর্থনৈতিক অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ধ্বংস করার এক অশুভ পাঁয়তারা করে যাচ্ছে।

এখানে প্রকাশ যোগ্য যে, তুরস্ক কিন্তু বর্তমানে প্রায় ১৮ থেকে ২০টি বা তার কাছাকাছি সিরিজের বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্টের কমব্যাট, রিকর্নিসেন্স, সার্ভেলেন্স, স্পাই এন্ড কামিকাজি ড্রোন ডিজাইন এবং ম্যানুফ্যাকাচারিং করে। তাছাড়া ইরান কিন্তু ২০১৯ সালের ২০শে জুন পৃথিবীর সবচেয়ে দামী এবং স্টেলথ প্রযুক্তির মার্কিন বিমান বাহিনীর আরকিউ-৪এ গ্লোবাল হক সার্ভেলাইন্স ড্রোন আকাশেই সনাক্ত করে নিজস্ব এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের ইন্টারসেপ্টর মিসাইল দিয়ে ধ্বংস করে দিয়ে নিজের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছে।

আর আমেরিকার ভাষ্যমতে, একটি আরকিউ-৪এ গ্লোবাল হক সিরিজের সার্ভেলাইন্স স্টেলথ ড্রোনের আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার বা বাংলাদেশী টাকায় যা কিনা প্রায় ২,০০০ কোটি টাকার সমান হয়। অবশ্য এরপর মার্কিন সামরিক বাহিনী ইরানের আকাশে গোপনে আর কোন নজরদারি এরিয়াল সিস্টেম পাঠানোর কথা চিন্তাও করেনি।

তাছাড়া ২০২১ সালের শেষের দিকে জাতিসংঘ যুদ্ধক্ষেত্রে প্রথম অটোনোমাস ওয়েপন্স বা কিলার রোবট কিংবা ড্রোনের সফল ব্যবহার হিসেবে লিবিয়ায় চলা গৃহযুদ্ধকে চিহ্নিত করেছে। জাতিসংঘের দেয়া তথ্যমতে, ২০২১ সালের মার্চ মাসের দিকে তুরস্ক তাদের উচ্চ প্রযুক্তির একেবারে ছোট আকারের ‘কারগু’ সুসাইডাল অটোনোমাস কিলার ড্রোন দিয়ে লিবিয়ায় বেশকিছু সামরিক স্থাপনা এবং ঘাঁটিতে সফলভাবে হামলা চালায়। যা ছিল আসলে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রথম কোন অটোনোমাস ওয়েপন্স বা কিলার রোবটের সফল ব্যবহার। আর বর্তমানে তুরস্কের কমব্যাট ড্রোন ইউক্রেনে কি করছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

আমি মনে করি বন্ধুভাবাপন্ন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কিন্তু তুরস্কের সাথে অংশীদ্বারিত্বের ভিত্তিতে ডিফেন্স রিলেটেড টেকনোলজিক্যাল সেক্টরে একসাথে কাজ করা ও বিনিয়োগের যথেষ্ঠ সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের সম্মানিত সরকার দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত মেধাবী শিক্ষার্থী, গবেষক এবং প্রযুক্তিবিদদের সম্পৃক্ত করে তুরস্কের সাথে কাজ করে যেতে পারে নিজ দেশের কল্যাণে। প্রয়োজন সীমিত পরিসরে হলেও তুরস্ক থেকে প্রযুক্তি এনে নিজ দেশের মাটিতে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও গবেষণায় আত্মনিয়োগ বা কঠোর পরিশ্রম করার বিকল্প আর কিছু হতে পারে না। এজন্য আমাদের অবশ্যই সীমিত সংখ্যক হলেও দেশের প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যায়গুলোতে নিবীড় গবেষণা ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে বড় অংকের ফান্ড বা বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে। এজন্য শুধু সরকার নয় বরং তার পাশাপাশি দেশের বড় আকারের গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ এবং স্বচ্ছল বেসরকারি সংস্থাগুলোকে সুপরিকল্পিতভাবে বিনিয়োগ করতে হবে।

তাছাড়া চলতি ২০২২ সালের ৩রা জুলাই আমাদের সম্মানিত সরকার উত্তরবঙ্গের লালমনিরহাটে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়ে’র স্থায়ী ক্যাম্পাস চালু করেছেন। যা অদূর ভবিষ্যতে আমাদের দেশের মেধাবী শিক্ষার্থী ও গবেষকদের হাত ধরে নিজস্ব এভিয়েশন টেকনোলজি অর্জনে এবং আমাদের বন্ধুভাবাপন্ন দেশ তুরস্ক বা অন্য কোন দেশের সাথে প্রযুক্তি শেয়ারিং এর মাধ্যমে একেবারে নিজস্ব প্রযুক্তির এরিয়াল সিস্টেম ডিজাইন ও তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে ইনসাআল্লাহ।

সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman) সহকারী শিক্ষক ও লেখক, গ্রামঃ ছোট চৌগ্রাম, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com