তুরস্কের দ্যা ডেইলী সাবাহ নিউজের দেয়া তথ্যমতে, গত ২২শে জুন তুরস্কের নিজস্ব প্রযুক্তির তৈরি বায়রাক্তার আকিনসি-বি সিরিজের কমব্যাট ড্রোন (ইউসিএভি) এক টেস্ট ফ্লাইটে সর্বোচ্চ ৪৫,১১৮ ফুট বা ১৩.৭ কিলোমিটার উচ্চতায় উড্ডয়ন করে নতুন এক রেকর্ডের সৃষ্টি করেছে। এটি একটানা ২০ ঘন্টা ২৩ মিনিট আকাশে উড্ডয়ন করে ৬,৪০৬ কিলোমিটার দুরত্ব অতিক্রম করে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে। যদিও এর সর্বোচ্চ রেঞ্জ ৭,৫০০ কিলোমিটার।

চলতি ২০২২ সালের ১১ই মার্চ বায়রাক্তার আকিনসি-বি (ইউসিএভি) কমব্যাট ড্রোন আকাশে সর্বোচ্চ ৪০,১৭০ ফুট উচ্চতায় উড্ডয়ন করেছিল। তাছাড়া গত ২০২১ সালের ৮ই মার্চ তুর্কী বায়কার মাকিনার তৈরি বায়রাক্তার আকিনসি-এ সিরিজের কমব্যাট ড্রোন (ইউসিএভি) আকাশে সর্বোচ্চ ৩৮,০৩৯ ফুট উচ্চতায় ফ্লাইট টেস্ট সম্পন্ন করে।

তুরস্কের সফল ড্রোন ম্যানিফ্যাকচারিং কোম্পানি বায়কার মাকিনার তৈরি বায়রাক্তার ‘আকিনসি’ সিরিজের কমব্যাট ড্রোন হচ্ছে মুলত হাই অল্টিটিউট এণ্ড লং ইন্ডিউরেন্স কমব্যাট ড্রোন (ইউসিএভি)। যেটিকে মুলত আকাশের অত্যন্ত উচ্চতায় উড্ডয়নের পাশাপাশি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আকাশে তার কমব্যাট মিশন পরিচালনা করার বিশেষ উপযোগী করে ডিজাইন করা হয়েছে। বর্তমানে এটি হচ্ছে বিশ্বে সার্ভিসে থাকা অন্যতম বৃহৎ আকৃতির কমব্যাট ড্রোনগুলোর মধ্যে একটি। যা কিনা একাধারে এয়ার টু এয়ার মিসাইল এবং এয়ার লঞ্চড বেসড স্ট্যান্ড অফ ক্রুজ মিসাইল (এসওএম) বহন ও হামলার করতে সক্ষম।

‘আকিনসি’ কমব্যাট ড্রোনের দৈর্ঘ্য ১২.৫ মিটার, দুই ডানার মাঝের দূরত্ব ২০ মিটার এবং উচ্চতা ৪.১০ মিটার। এর ম্যাক্সিমাম টেকঅফ ওয়েট ৫,৫০০ কেজি। ডেডিকেটেড এই কমব্যাট ড্রোনে দুটি ইউক্রেনের ইভশেঙ্কো প্রগ্রেসের তৈরি ৭৫০ হর্স পাওয়ারের (৫৬০কিলোওয়াট) এআই-৪৫০টি টার্বোপ্রোপ ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে। যা ড্রোনটিকে ভূমি থেকে ৪০ হাজার ফিটের অধিক উচ্চতায় সর্বোচ্চ ১৩০ থেকে ১৯৫ নটিক্যাল মাইল বা ৩৬১.১৪ কিলোমিটার বেগে উড়ার ব্যাপক সক্ষমতা প্রদান করে। বর্তমানে ড্রোন প্রযুক্তির বিচারে ৩৬১.১৪ কিলোমিটার গতিকে অনেকটাই বেশি গতি সম্পন্ন এরিয়াল (ইউসিএভি) সিস্টেম হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

এভিয়নিক্স সিস্টেম হিসেবে এই কমব্যাট ড্রোন (ইউসিএভি) তে নিজস্ব দেশীয় প্রযুক্তির (এইএসএ) রাডার, ইলেকট্রনিক্স সাপোর্ট পড এবং সাইট এণ্ড স্যাটালাইট কমিউনিকেশন সিস্টেম, এসানসাল কমন এপারচার টার্গেটিং সিস্টেম এবং ইলেকট্রনিক্স ওয়ারফার সিস্টেম ইনস্টল করা হয়েছে।

আবার ‘আকিনসি’ কমব্যাট ড্রোনের মেরিটাইম স্টাইক সক্ষমতা যাচাই করলে দেখা যায় যে, এটি বাস্তবিক অর্থেই অনেক লাইট যুদ্ধবিমান থেকেও এগিয়ে রয়েছে। তাছাড়া এর নিজস্ব (এইএসএ) রাডার সিস্টেম এবং ডাটা লিংক প্রযুক্তির সাহায্যে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সমুদ্রে থাকা শত্রু পক্ষের যুদ্ধজাহাজ কে ডিটেক্ট করতে সক্ষম। তাছাড়া এটি এন্টিশীপ মিসাইল হিসেবে এয়ার লাউঞ্চড বেসড (এসওএম) স্ট্যাণ্ড অফ ক্রুজ মিসাইল ব্যবহার করে সমুদ্রে থাকা যুদ্ধজাহাজ কে ধংস করে দিতে পারবে।

এই ড্রোনের ৬টি হার্ড পয়েন্টে মোট ১,৩৫০ কেজি পর্যন্ত মিসাইল, গাইডেড এণ্ড আনগাইডেড বম্বস বহন করতে সক্ষম। তাছাড়া ক্রুজ মিসাইল বহন করার পাশাপাশি এয়ার টু এয়ার মিসাইল ফায়ার করে আকাশেই শত্রু পক্ষের যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার ধ্বংস করার উপযোগী করে তৈরি করায় তুরস্কের এই কমব্যাট ড্রোনটিকে বিশ্বের বুকে একটি শ্রেষ্ঠ কমব্যাট ড্রোনের স্থানে নিয়ে গেছে।

এই কমব্যাট ড্রোনটিতে তুরস্কের নিজস্ব প্রযুক্তির তৈরি এমএএম-এল, এমএএম-সি, জাভেলিন, এল-ইউএমটিএএস, বোজক, এমকে-৮১, এমকে-৮২, এমকে-৮৩, উইংড গাইডেন্স কিট (ইউপিএস) এমকে-৮২ ডিভাইসের পাশাপাশি গুলুকান, বোজডোয়ান এবং এসওএম-এ স্ট্যাণ্ড অফ ক্রুজ মিসাইল (এয়ার লাউঞ্চ ক্রুজ মিসাইল) দ্বারা সজ্জিত করা হয়েছে। তাছাড়া রকেটসানের তৈরি (এল-ইউএমটিএএস) এন্টি ট্যাংক মিসাইল এটিতে ইনস্টল করা হয়েছে।

এই কমব্যাট ড্রোননটিকে পূর্বের টিবি-২ ড্রোনের মতোই এডভান্স অটোনোমাস কন্ট্রোলিং সিস্টেমের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এটি অটোনোমাস রোবটের মতো নিজে নিজেকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে টেকঅফ এবং ল্যাণ্ডিং করার বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে। তাছাড়া ড্রোনটির রানওয়ে বা বেইস নির্দিষ্ট করা থাকে এবং আগে থেকেই এটির ভৌগলিক অবস্থান ড্রোনটির সফটওয়ার প্রোগ্রামে ইনস্টল থাকে৷ তাই আপদকালীন মুহুর্তে ল্যাণ্ড বেসড কমাণ্ড সেন্টারের সাথে ড্রোনটির যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে, সেক্ষেত্রে ড্রোনটি তার স্যাটালাইট নেটওয়ার্কিং সিস্টেম ও নিজস্ব জিপিএস সিস্টেম ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার নির্ধারিত রানওয়ে বা ঘাঁটিতে ফিরে আসার উপযোগী করে নতুন কিছু গোপন প্রযুক্তি ইনস্টল করেছে তুর্কী বায়কার মাকিনা কোম্পানি।

এই কমব্যাট ড্রোনের উৎপাদন খরচ বা আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য কত হতে পারে কৌশলগত কারণে তার কোন তথ্য প্রতিষ্ঠানটি প্রকাশ না করলেও মনে করা হয় এর আনুমানিক উৎপাদন ব্যয় খুব সম্ভবত ১৫ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। তবে এই জাতীয় ৬টি কমব্যাট ড্রোন, ২টি ল্যাণ্ড স্টেশন এবং প্রশিক্ষণসহ এর রপ্তানির আনুমানিক মূল্য হতে পারে ১২০-১৫০ মিলিয়ন ডলার।

এর প্রথম সফল ফ্লাইট টেস্ট সম্পন্ন করে ২০১৯ সালের ৬ই ডিসেম্বর। সকল প্রকার প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, ব্যাপক গবেষণা ও পরীক্ষা শেষে তুরস্কের হেভি ড্রোন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি বায়কার মাকিনা তাদের হাইলী এডভান্স বায়রাক্তার আকেনসি কমব্যাট ড্রোন (ইউসিএভি) ২০২১ সালের ২৯শে আগস্ট থেকে তুর্কী সামরিক বাহিনীর হাতে চূড়ান্তভাবে তুলে দে্যা শুরু করে। এ পর্যন্ত মোট ৯টি আকিনসি কমব্যাট ড্রোন (ইউসিএভি) ইউনিট তৈরি করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ৩টি প্রটোটাইপ কপি এবং ৬টি সিরিয়াল প্রডাকশন। বর্তমানে তুরস্কের বিমান বাহিনী ৩টি, সেনা বাহিনী ১টি এবং তুর্কী ন্যাশনাল ইন্টালিজেন্স অর্গানাইজেশন ১টি করে লং রেঞ্জের ডেডিকেটেড আকিনসি সিরিজের কমব্যাট ড্রোন (ইউসিএভি) অপারেট করে।

চলতি ২০২২ সালের ২রা এপ্রিল তুরস্ক তাদের নতুন প্রযুক্তির তৈরি ‘আকেনসি’ ড্রোন আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানির বিষয়টি ঘোষণা করে এবং পাকিস্তান হতে যাচ্ছে এই হেভি কমব্যাট ড্রোনের প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রেতা। তুরস্ক খুব সম্ভবত ২০২৩ সালের দিকে প্রথম ব্যাচে কিছু সংখ্যক আকিনসি-এ সিরিজের কমব্যাট ড্রোন পাকিস্তানে রপ্তানি করতে পারে।

সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman) সহকারী শিক্ষক ও লেখক, গ্রামঃ ছোট চৌগ্রাম, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com