তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটা তিক্ত ছিল অনেকদিন। গত প্রায় ছয় বছর ধরে দুই দেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের কিছু সফর হলেও সম্পর্কে একটা শীতল ভাব বিরাজ করছিল।
বিশেষ করে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে তুরস্কের নাক গলানো ঢাকাকে এতটাই ক্ষুব্ধ করে যে বাংলাদেশী সরকার প্রকাশ্যে তুরস্ক বিরোধী শক্ত অবস্থান ব্যক্ত করে। কিছু মিডিয়াও বিষয়টি লুফে নিয়ে সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে, রঙ-চঙ অনেক চাটুকার খবর করে।
এমনকি অনেক দায়িত্বশীল পত্রিকা এবং সাংবাদিকরাও তুরস্কের বিরুদ্ধে একই হাওয়ায় পাল তুলে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের বিরুদ্ধে যাচ্ছেতাই মিথ্যাচার করে গেছে। একইভাবে তুরস্কের মিডিয়াও বাছ-বিচার না করেই যাচ্ছে তাই খবর রচনা করে যায়।
অন্যদিকে তুরস্ক থেকে একটি পুরনো সাবমেরিন কেনার বিষয়ে অনেকখানি এগোনের পরেও বাংলদেশ সরকার চীন থেকে দুটি সাবমেরিন এনে বাংলাদেশের নৌবহরে যুক্ত করলে আঙ্কারার সঙ্গে সম্পর্ক আরো খারাপ হয়।
বাংলদেশ তুর্কিদের ভিসা দিতে গড়িমসি করা, তুর্কিদের ঢাকা বিমানবন্দরে ঘন্টার পর ঘন্টা বসিয়ে রাখাসহ তাদেরকে বিভিন্ন ভাবে হেস্তন্যাস্ত করা হয়। সরকারি পর্যায় বা কূটনৈতিক পর্যায় থেকে বিষয়টিকে মিডিয়া এবং জনসাধারণের পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়।
বিরোধ শেষ পর্যন্ত এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে উভয় দেশ তাদের রাস্ট্রদুতকে নিজ নিজ দেশে ডেকে পাঠায়। অনেক দিন দু’দেশ রাষ্ট্রদূত ছাড়াই সম্পর্ক চালায়।
পরে দুই দেশের সরকার বিশেষ করে রাজনৈতিক মোড়লরা সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করলেও সে প্রচেষ্টা কিছু আমলা এবং কূটনৈতিকদের ব্যাপক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে। কিন্তু ২০১৬ সালে তুরস্কে ঘটে যাওয়া ব্যর্থ সামরিক অভ্যূত্থান এবং ২০১৭ সালে বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলদেশে আশ্রয় দেয়া দুই দেশকে অনেকটা কাছে নিয়ে আসে।
২০১৬ সালের ব্যর্থ সামরিক অভ্যূত্থানের পরপরই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ানের কাছে সমর্থন বার্তা পাঠান।
কয়েকদিন পরে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত ঢাকায় ফিরে গিয়ে তার দেশ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারসহ অন্যান্য অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলানোর ঘোষণা দেন।
ঘটনার মোড় ঘুরে মূলত ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে যখন তুরস্ক বাংলাদেশের পাশে থাকার ঘোষণা দেয়। তখন তুরস্কই ছিল একমাত্র দেশ যে স্পষ্টভাবে তার সমর্থন ব্যক্ত করে।
এরপরে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ফিলিস্তিনের উপরে ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) একটি বিশেষ শীর্ষ সম্মেলন যোগ দিতে তুরস্কে আসেন। কয়েকদিন পরে তুরস্কের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম ঢাকা ও কক্সবাজার সফর করেন। সেবার আমিও তার সফর সঙ্গী হয়েছিলাম।
তখন দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থানপন হয়। তারা দ্রুত সম্পর্ক উন্নয়নের ওপর আবারো জোর দেন। এরপরের বছরগুলোতে বাংলাদেশ থেকে কয়েকজন মন্ত্রী তুরস্কে আসেন এবং তুরস্ক থেকেও কয়েকজন বাংলাদেশে যান। কিন্তু সম্পর্ক উন্নয়নে বাঁধ সাধেন সেই আমলা আর কূটনৈতিকরা।
তুরস্ককে পরম শত্রু হিসেবে উপস্থাপন করা যেমন বাংলাদেশী কিছু আমলা-কূটনৈতিকদের প্রধান দায়িত্ব ছিল। তেমনি বাংলাদেশ সরকারকে তুরস্কের কাছে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরতেও অনেক তুর্কি আমলা আর কূটনৈতিকরা যথেষ্ট ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু তারা তখন ভুলে গেলেন যে, রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে আবেগের কোনো মূল্য নেই আর এক্ষেত্রে কেউ পরম বন্ধু বা পরম শত্রু হতে পারে না। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে রাষ্ট্রের স্বার্থ সবার উপরে। এখানে “উইন উইন পরিবেশ” গুরুত্বপূর্ণ।
পরবর্তীতে, রোহিঙ্গা বিষয় নিয়ে আমাদের ‘পরম মিত্র’ এবং ‘সামরিক মনিব’রা যখন তাদের নিজস্ব স্বার্থে ঢাকাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেন, বাংলাদেশ তখন বুঝলো যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ‘পরম বন্ধু’ বলে কিছু নেই। ওখানে আবেগের কোনো স্থান নেই। সবাই যার যার স্বার্থে অন্যকে ব্যবহার করে। তখন যদিও অনেক পানি গড়িয়ে গেছে বহু দূর।
গঙ্গা এবং তিস্তার পানি চুক্তি, আসামে প্রায় ২০ লক্ষ ‘অবৈধ বাংলাদেশী’কে ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনাসহ সাম্প্রতিক অনেক ঘটনায় প্রতিবেশীর বন্ধুসুলভ আচরণের পরিধিটা আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে উঠে।
সর্বশেষ ধাক্কাটা একেবারে নাড়িতে এসে যখন আঘাত করলো, ঢাকা তখন বুঝলো পেঁয়াজের ঝাঁজ কত ভয়ংকর।
পেঁয়াজ আমদানিতে শুধুমাত্র একটি বাজারের ওপর নির্ভরশীলতা যে কত মারাত্মক ভুল ছিল বাংলাদেশ সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। হন্যে হয়ে এখন অন্য বাজারের দিকে দৌড়াচ্ছি আমরা। পেঁয়াজের বাজারের আগুন নিভাতে এখন পাকিস্তান, তুরস্ক আর মিসরের দ্বারস্থ হচ্ছে বাংলাদেশ। জাহাজে করে নেওয়ার অপেক্ষায় থাকতে পারছেন না বাংলাদেশের মানুষ। পেঁয়াজকে এখন বিমানের ফার্স্ট ক্লাসে করে আদরে যত্নে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
মন্ত্রী-আমলাদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে। কূটনীতিবিদদের কথার সুর নরম হয়ে আসছে। আমার শত্রুর বন্ধু যে সব সময় আমার শত্রু হবে সে মন্ত্র থেকে সরে আসছে। সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করছে। তুরস্কের রাজধানীতে বাংলাদেশী মন্ত্রী-আমলাদের গত কিছুদিনের আনাগোনাতে অন্তত সে আভাসই দিচ্ছে। বাংলদেশী কূটনীতিবিদদের ভাবভঙ্গি, কথা-বর্তায় তা স্পষ্ট হচ্ছে।
পেঁয়াজের জন্য আমলারা এখন দিনের পর দিন আঙ্কারায় পরে থাকেন। সরকারের মন্ত্রী উপদেষ্টারা ঘন ঘন আঙ্কারায় আসা-যাওয়া করছেন। গত কয়েকদিনে অন্তত তিন চারজন মন্ত্রী, ডজনের উপরে আমলারা তুরস্ক সফর করছেন।
গত মাসে আঙ্কারায় প্রায় পাঁচ বছর পরে দুই দেশের মধ্যে বিজনেস কাউন্সিলের বৈঠক হয়েছে। তুরস্ক বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। দুদেশের মধ্যে কয়েকটি চুক্তিও স্বাক্ষর হয়েছে। অস্ত্র কেনার জন্য তুরস্কের সঙ্গে আলাপ আলোচনা হচ্ছে। বাংলাদেশী সামরিক কর্মকর্তারা তুরস্ক সফর করছেন।
আগামী বছর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় তুরস্কের নিজস্ব সামরিক ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জামাদি বাংলাদেশে প্রদর্শনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এগুলো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ইতিবাচক দিক। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষমাত্রায় পৌঁছাতে বিশ্বায়নের এই যুগে বিশ্ব বাজারের গুরুত্বপূর্ণ দেশ তুরস্কের সঙ্গে সবক্ষেত্রে সম্পর্কোন্নয়ন জরুরি। তবে এক্ষেত্রে দুই দেশেরই আবেগ আর সস্তা রাজনৈতিক স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে ‘উইন-উইন’ পন্থা অবলম্বন করা উচিত।
লেখক: সরোয়ার আলম, চিফ নিউজ কো-অর্ডিনেটর, এশিয়া প্যাসিফিক রিজিওন, আনাদলু এজেন্সি, তুরস্ক