তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগানের সঙ্গে এক বৈঠকে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লেয়েনকে চেয়ারে না বসিয়ে বরং সোফায় বসানো হয়েছিল। এ ঘটনাকে ইউরোপে “সোফাগেট” স্কান্ডেল নামে অভিহিত করা হয়।
এপ্রিলের ৭ তারিখ ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রধান চার্লস মিশেল এবং ভন ডের লেয়েন রাষ্ট্রীয় সফরে তুরস্কে এসে এরদোগানের সঙ্গে বৈঠক করেন। সে বৈঠকে এরদোগান এবং চার্লস মিশেল পাশাপাশি চেয়ারে বসেন আর ভন ডের লেয়েনের এবং তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত চাভুসওগলু মুখোমুখি সোফায় বসেন।
ভন ডের লেয়েনের এই সোফায় বসা নিয়ে হুলুস্থুল কাণ্ড শুরু হয়েছে ইউরোপে।
ইউরোপীয় গণমাধ্যম, বিশেষ করে জার্মান এবং ব্রিটিশ মিডিয়া, বিষয়টি নিয়ে প্রচুর মুখরোচক খবর ছাপায় এবং তুরস্কের ওপর একচেটিয়া দোষ চাপায়। তুরস্ক নাকি ইচ্ছে করেই তাকে চেয়ারে না বসিয়ে সোফায় বসিয়েছে। এটা নাকি এরদোগানের গোঁয়ার্তুমির কারণেই হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
এমনকি ইতালির প্রধানমন্ত্রী এ নিয়ে এরদোগানকে ডিক্টেটর (স্বৈরাচার) পর্যন্ত বলতেও দ্বিধাবোধ করেননি।
অথচ তুরস্কের পক্ষ থেকে এবং ইউরোপীয় কমিশনের পক্ষ থেকে বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে যে তুরস্কের এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রটোকল কর্মকর্তারা আলোচনা করেই আসন বিন্যাস ঠিক করেছেন।
কূটনৈতিক প্রোটকলের নিয়ম অনুযায়ী কোনো রাষ্ট্রপ্রধান অন্য কোনো দেশে গেলে সফরকারী দেশ থেকে প্রোটকল কর্মকর্তারা গিয়ে সফরের সব কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খুঁটিয়ে দেখেন।
সফরকারী নেতা কোথায়, থাকবেন, কী খাবেন, কার সঙ্গে দেখা করবেন, কোন চেয়ারে বসবেন, চেয়ারের উচ্চতা কতটুকু হবে, এমনকি চেয়ার, টেবিল এবং বৈঠক রুমের রং কী হবে, কোন দেশের পতাকা কোথায় থাকবে ইত্যাদি সব কিছু নির্ধারণ করেন তারা।
সে প্রথা অনুযায়ী ৭ এপ্রিল ওই বৈঠকের আগে ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রধান চার্লস মিশেলের অফিস থেকে প্রোটকল কর্মকর্তা আঙ্কারায় এসে সব কিছু ঠিক ঠাক করে যান। তখন তারা আসন বিন্যাসে চার্লসের জন্য চেয়ারের ব্যাবস্থা এবং ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট ভন ডের লেয়েনের জন্য সোফার ব্যবস্থা দেখেও সন্তুষ্ট হন। তখন ইউরোপীয় প্রোটকল কর্মকর্তারা ভন ডের লেয়েনের জন্য চেয়ারের দরকারবোধ করেননি। সুতরাং বিষয়টি নিয়ে আসলে তুরস্ককে দোষ দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।
অথচ ইউরোপে বিষয়টি নিয়ে এখনও তোলপাড় চলছে। সবকিছু এত স্পষ্ট করে দেওয়ার পরেও ইউরোপের কতক মিডিয়া এবং ভন ডের লেয়েনের ভক্ত কিছু ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্যরা এ নিয়ে নিত্য নতুন সুর তুলছেন তুরস্কের বিরুদ্ধে।
এমনকি তারা বিষয়টি নিয়ে এমনই পানি ঘোলা করতে থাকেন যে কয়েকদিন আগে এরদোয়ানকে নারী বিদ্বেষীও বলেছেন। তিনি নাকি এই নারী বিদ্বেষের কারণেই ভন ডের লেয়েনকে চেয়ারে বসাননি। কারণ, ভন ডের লেয়েন একজন নারী।
জার্মান এই সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিজেও বলতে দ্বিধাবোধ করেননি যে তিনি নারী হওয়ার কারণেই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এবং ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান এই দুই পুরুষ মিলে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করেছেন! আর এটা নাকি হয়েছে মূলত এরদোগানের নারীবিদ্বেষের কারণে!
আর এরদোগান যে নারী বিদ্বেষী তার প্রমাণ নাকি তিনি দিয়েছেন ইস্তান্বুল কনভেনশন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে!
হায়রে ইউরোপ, হায়রে দুনিয়া! বাংলাদেশে একটা কথা আছে- কিসের সঙ্গে কী পান্তা ভাতে ঘি!
প্রোটকলের নিয়ম, সোফায় বসা, এরদোগান, নারী বিদ্বেষ, ইস্তান্বুল কনভেনশন এতগুলো বিষয়কে কিভাবে একত্রে লিংক করিয়ে দিলেন!
অথচ এমন ভুরিভুরি উদাহরণ আছে যেখানে এরদোগানের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের নেতৃত্বে থাকা নারী লিডাররা বসে বৈঠক করেছেন। যেমন জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মারকেল, সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে ছাড়াও আরও অনেকে। তাদেরকে কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও প্রটোকল অনুযায়ী যতটুকু সম্মান দেওয়া দরকার তার সর্বোচ্চটাই দেখিয়েছেন এরদোগান। এ নিয়ে এর আগে কখনও প্রশ্ন উঠেনি। এবার কী হলো যে, এরদোগানকে নারীবিদ্বেষী বা ডিক্টেটর পর্যন্ত বলা হলো?
এখানে আসলে মূল বিষয় হচ্ছে ভন ডের লেয়েন এবং চার্লস মিশেলের মধ্যকার রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই।
এপ্রিলের ২৯ তারিখ পলিটিকো ইউরোপে এ নিয়ে বিস্তারিত এক আর্টিকেল ছাপানো হয়।
“প্রেসিডেন্সিয়াল পাওয়ার ওয়ার: ভন ডের লেয়েন বনাম মিশেল” শিরোনামের ওই খবরে বলা হয় তাদের দুজনের মাঝে এই “পাওয়ার ওয়ার” বা শক্তির লড়াই শুরু হয় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে যখন তারা উভয়েই ইইউর গুরুত্বপূর্ণ দুই পদে আসীন হন।
দ্বন্দ্বের মূলে ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃত্বের লড়াই। এই জোটটির মূল লিডার কি কমিশনের প্রধান নাকি কাউন্সিলের প্রধান?
ভন ডের লেয়েন জার্মানির সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এবং ইইউ কমিশনের ইতিহাসের প্রথমবার নির্বাচিত নারী নেত্রী আর চার্লস মিশেল বেলজিয়ামের সাবেক প্রধানমন্ত্রী যে দেশটিতে ইইউর হেডকোয়ার্টার অবস্থিত।
দুইজনই চাচ্ছেন তার নিজের পদকে ইইউর সর্বোচ্চ পদ হিসেবে দেখাতে। এ কারণে তারা বিদেশ সফর করতেন আলাদা আলাদা। দুজনকেই যেন তখন আলাদাভাবে ইইউ নেতার মর্যাদা দেওয়া হয়। কিন্তু তুরস্ক সফরে আসলেন তারা একত্রে। আর ঝামেলাটা লাগলো এখানেই।
চার্লস মিশেলের প্রোটকল টিম তুরস্কে এসে সবকিছু ঠিক ঠাক করে গেলেন এবং কৌশলে তারা ভন ডের লেয়েনকে মেসেজটা দিয়ে দিলেন যে লিডার তুমি না বরং ইইউর লিডার একজনই তিনি হলেন মিশেল, তাই তুরস্কের লিডারের পাশে চেয়ারে বসার অধিকার শুধু মিশেলেরই আছে।
অথচ ইউরোপের এই নারী নেত্রী ঘটনাটিকে নিয়ে তার ক্ষমতায় থাকা সংস্থার প্রধানকে দোষারোপ না করে বরং দোষ দিলেন এরদোগানের।
উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে!
আসলে তুরস্ক এবং এরদোগান ইউরোপে এমন এক হট টপিক যে যদি কেউ ওখানে পপুলার হতে চায় সে তুরস্ক এবং এরদোগানের বিরুদ্ধে কিছু একটা বলতে পারলেই হলো অমনি তার সমর্থন বেড়ে যাবে। যেমন ব্রেক্সিট ভোটের সময়, জার্মানিতে, নেদারল্যান্ডে, হাঙ্গেরিতে নির্বাচনের সময় ভোটারদের মনোযোগ আকর্ষণে তুরস্ক এবং এরদোগান বিরোধী বক্তব্য, ব্যানার ফেস্টুন ব্যবহার করা হয়েছিল বারবার।
আর ভন ডের লেয়েনও তাই ইউরোপীয় পার্লামেন্টে তার নেতৃত্বের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য সোফায় বসানোর বিষয়টিকে নিয়ে তুরস্কের বিরুদ্ধে চড়াও হচ্ছেন।
বিদ্রঃ সরোয়ার আলমের এই লেখাটি ০১ মে ২০২১ তারিখ যুগান্তর অনলাইনে ছাপানো হয়।