অবশেষে আফগানিস্তান ছাড়লো মার্কিন সেনারা। ৩১ আগস্ট শুরু হওয়ার আগেই ৩০ আগস্ট রাত ১১টা ৫৯ মিনিটে শেষ সেনাটি ত্যাগ করে কাবুল বিমানবন্দর।
রাতের অন্ধকারে মাথা নিচু করে শেষ সৈন্যের সেই হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য দেখে থমকে গেছে বিশ্ব। ওই রাতের অন্ধকারেও আমেরিকার অসহায় চিত্রটি ভেসে উঠেছে সারা বিশ্বের দরবারে।
হলিউড বলিউড এবং হাজার হাজার মিডিয়ার মাধ্যমে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করা অপ্রতিরোধ্য আমেরিকা যে কতোটা অসহায় এবং দুর্বল তা আরেকবার প্রমাণিত হল আফগানিস্তানে। আমেরিকার এক পঙ্গু সৈন্য সেদিন আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘এই দিন দেখার জন্যই কি আমরা এত কিছু হারালাম।’
আমেরিকা কোন দিন দেখার জন্য কী হারাল তা জানি না। তবে ২০০১ সালের পর থেকে মুসলিম বিশ্বে যে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। লক্ষ লক্ষ নারী পুরুষ শিশুর গগণ বিদায়ী ফরিয়াদ হয়তো তাদের বম্বিংয়ের আওয়াজ ভেদ করে মুসলমান নেতাদের কানে পৌঁছেনি।
তবে ঠিকই জায়গামত পৌঁছেছে সে কান্না, আহাজারি, আর অসহায় মানুষগুলোর ফরিয়াদ। আজ তাদেরই চোখের সামনে বিশ্বের সবচেয়ে পরাশক্তি রাতের অন্ধকারে মাথা নিচু করে পালিয়ে যেতে দেখে কি অনুভূতি হয়েছিল আমি জানি না। তবে লক্ষ লক্ষ মুসলিমের হৃদেয়ের রক্তক্ষরণ হয়তো কিছুটা হলেও বন্ধ হবে এখন।
যেমন দম্ভভরে তারা এসেছিল তেমন চোরের মতই পালিয়ে গেল। আর এর মাধ্যমেই বাহ্যিকভাবে দখলমুক্ত হলো আফগানিস্তান।
যদিও প্রকৃতপক্ষে কবে পুরোপুরি দখলদার মুক্ত হবে দেশটি নাকি আদৌ হবে কি না কেউ জানে না। তবে এখন শুরু হবে তালেবানের সরকার গঠন এবং প্রতিশ্রুতি পূরণের পালা। তালেবানের জন্য আসল পরীক্ষা এখন শুরু হবে।
মার্কিন সেনারা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দেয়া হয় কাবুল বিমানবন্দর। সেখানে সব কিছু নষ্ট করে বিমানবন্দরটিকে প্রায় অকেজো করে রেখে যায় তারা। বিমানবন্দর এখন যেন এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। কন্ট্রোল সিস্টেম থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের প্রযুক্তি এবং যন্ত্রপাতি বোমা মেরে বা গুলি করে নষ্ট করে দিয়েছে।
এই বিমানবন্দর পুনর্গঠন এবং পরিচালনার মত প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি এবং যোগ্য জনবল তালেবানের নেই। তারা এখন, তুরস্ক এবং কাতারের স্মরনাপন্ন হয়েছে।দুই দেশ একত্রে একটা খসড়া চুক্তি প্রস্তুত করেছে বলেও খবর বেরিয়েছে।
কিন্তু এই বিমানবন্দর পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার ক্ষেত্রে গড়িমসি করছে তুরস্ক। যেই দায়িত্ব নেয়ার জন্য একসময় হুমড়ি খেয়ে পড়তো, এখন সেই দেশটিই গড়িমসি করছে। কিন্তু কেন?
তুরস্ক গত সপ্তাহে কাবুল বিমানবন্দর থেকে তার সৈন্যদের প্রত্যাহার করার পরে তালেবানের পক্ষ থেকে তুরস্কের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।
তালেবানের একটা প্রতিনিধিদল তুরস্কের কাবুল দূতাবাসে তুর্কি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে এবং সেখানে তারা তুরস্ককে কাবুল বিমানবন্দরের দায়িত্ব নেয়ার অনুরোধ করেন। তালেবান আসলে শুরুতে কাবুল বিমানবন্দরের দায়িত্ব নেয়া নিয়ে কাতারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিন্তু কাতার একা এই দায়িত্ব নিতে পারবে না বলে জানায়।
পরবর্তীতে তারা যোগাযোগ করে তুরস্কের সঙ্গে এবং এক্ষেত্রে তুরস্ক এবং কাতারকে একত্রে দায়িত্ব নেয়ার জন্য অনুরোধ করে। তুরস্ক এ বিষয়ে কাতারের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং একটা খসড়া চুক্তি প্রস্তুত করে। সেটি হয়তো এরদোগানের অনুমতির অপেক্ষায় আছে।
তুরস্ক তো সেই শুরু থেকেই কাবুল বিমানবন্দরে দায়িত্ব নেয়া নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে। কিন্তু তখন তুর্কি সেনারা সেখানে ন্যাটোর অংশ হিসেবে থাকার কারণে তালেবান তাদেরকে মেনে নেয়নি। ফলে তুরস্ক তার সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করে নিয়ে আসে। তারপরে সেখানে অনেক কিছু ঘটে যায়। কাবুল বিমানবন্দরে হামলা হয়। কয়েকশো মানুষ মারা যায়। তারপরে আবার হামলা হয়। তারপরে আবার হামলা হয়। বিমানবন্দরের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ধ্বংসের মাধ্যমে বিমানবন্দরকে অকেজো করা হয়।
শেষ পর্যন্ত কাবুল বিমানবন্দরকে অরক্ষিত এবং অনিরাপদ একটা জায়গায় পরিণত করে ফেলে রেখে যায়।
এখন কাবুল বিমানবন্দরের দায়িত্ব নেয়া সম্পর্কে গড়িমসি করছে তুরস্ক।
এর কারণ হিসেবে প্রথম হচ্ছে কাবুল বিমানবন্দরে নিরাপত্তার বিষয়টি। তালেবান তুরস্ককে শুধুমাত্র কাবুল বিমানবন্দর পরিচালনার দায়িত্ব দিতে চায় এবং নিরাপত্তার দায়িত্ব পুরোপুরি তালেবান সদস্যদের হাতে রাখতে চায়। কিন্তু গত কয়েকদিনের একের পর এক হামলা বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে তুরস্ককে ভাবিয়ে তুলছে।
কারণ, বিমানবন্দরের দায়িত্বে যদি বেসামরিক লোক পাঠায়, তাদের নিরাপত্তার কী হবে? সেখানে যদি কোনো হামলা হয় এবং সে হামলায় যদি বিমানবন্দর পরিচালনায় নিয়োজিত কোন তুর্কি নাগরিক নিহত হয় তাহলে বিষয়টি তুরস্কের সরকারকে ভালোই বেকায়দায় ফেলবে। কোনো জায়গার নিরাপত্তায় সামরিক বাহিনী বা নিরাপত্তাকর্মীদের নিহত হওয়া হয়তো মেনে নেয়া যায়। কিন্তু অরক্ষিতভাবে বেসামরিক লোকদের সেখানে নিয়োগ দেয়া এবং সে নিয়োগের পরে সেখানে হামলায় ওই বেসামরিক লোকদের মৃত্যু কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে না সরকারের পক্ষে।
একারণেই তুরস্ক চাচ্ছে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা যেন তাদের কাছেই ছেড়ে দেয়া হয়; কিন্তু তালেবান সেটা ছাড়বে না। শেষ পর্যন্ত হয়ত তুরস্কের কোন বেসামরিক নিরাপত্তা সংস্থা হতে পারে সেটা সাদাত বা অন্য কোনো কোম্পানি তাদের নিরাপত্তা রক্ষীদের নিয়োগ দেবে সেখানে। আর বিমানবন্দর পরিচালনায় কাজ করবে সরকার নিয়োজিত কর্মীরা যাদের মধ্যে হয়তো গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনও থাকবে।
আরেকটা বিষয় হল-তুরস্ক এই চুক্তি স্বাক্ষরের আগে ন্যাটো তথা আমেরিকার সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করবে এবং তাদের কাছ থেকে সবুজ সঙ্কেত পাওয়ার পরই স্বাক্ষর করবে এই চুক্তি। কারণ, তুরস্ক একা ওখানে পা দিয়ে নতুন কোনো ঝামেলায় জড়াতে চায় না।
তালেবানকে যতই মনে মনে সমর্থন করুক বাস্তবতায় ওখানে সৈন্য প্রেরণ, লোকজন প্রেরণ এবং তালেবানকে স্বীকৃতির ক্ষেত্রে তুরস্ক এককভাবে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে না। তুরস্কে এক্ষেত্রে পশ্চিমাদের মনোভাব বুঝে ধীরেসুস্থে পা ফেলতে চাইছে। কারণ যদি তালেবান-সরকারকে পশ্চিমারা তথা আমেরিকা ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন স্বীকৃতি না দেয় তাহলে তুরস্ক সে ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঝামেলায় পড়বে।
তখন এককভাবে কাবুল বিমানবন্দরে থাকলে তুরস্কের ওপরেও বড় ধরনের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আসতে পারে। তুরস্ক এই জিনিসটাই চাচ্ছে না। একারণেই এর আগেরবার তুরস্ক ন্যাটো এবং ইউরোপ ইউনিয়নের কোনো একটা সদস্যকে নিয়ে সেখানে থাকতে চেয়েছিল যেন ন্যাটো অথবা ইউরোপ ইউনিয়ন তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক করার বাহানায় তুরস্কের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা না দিতে পারে। এবার যদিও পাকিস্তানের পরিবর্তে কাতারকে নিয়ে একত্রে সেখানে থাকতে চাচ্ছে কিন্তু কাতার এমন কোন দেশ না যে পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞাকে ঠেকাতে পারবে। তাই তুরস্ক এনিয়ে পশ্চিমাদের সঙ্গে কোন ঝামেলায় জড়াতে চাচ্ছে না।
আরেকটা বিষয় হল, আমেরিকা চলে যাওয়ার পর ওখানে রাশিয়া এবং চীনের শক্তি বৃদ্ধি। সিরিয়া, লিবিয়া এবং আজারবাইজানে মূলত রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে তুরস্ক। রাশিয়ার শত শত ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ধংস করেছে তুর্কি সেনারা। অন্যদিকে সিরিয়ায় রাশিয়া অনেক তুর্কি সেনা হত্যা করেছে।
সিরিয়া এবং লিবিয়ায় এখনও তুরস্ক-রাশিয়া মুখোমুখি অবস্থানে। এখন কাবুল বিমানবন্দরের দায়িত্ব নেয়া মানে হচ্ছে ওখানেও তুরস্কের পরোক্ষভাবে রাশিয়া এবং চীনের স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। ওই বিমানবন্দরে কোন ঝামেলা হলে বা ওখানে রাশিয়ার স্বার্থে কোনও আঘাত হলে রাশিয়া তাদের প্রক্সি বা ভাড়াটিয়াদের দিয়ে সিরিয়ায় তুর্কি সেনাদের ওপর আঘাত হানবে। অতীতে এরকম হয়েছে।
এছাড়াও রাশিয়ার তুরস্কের সঙ্গে আছে মাল্টি বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা। তুরস্কের পর্যটন খাত অনেকাংশই রাশিয়া নির্ভর। সবকিছু মিলিয়ে তুরস্কের কাবুল বিমানবন্দরের দায়িত্ব নেয়া রাশিয়া তুরস্কের বৈরী সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে পারে।
আবার ওখানে তুরস্কের থাকা মানে চীনের বেল্ট এ্যন্ড রোড প্রকল্পের জন্য পরোক্ষভাবে হুমকি স্বরূপ। তাই চীনও চাইবে তুরস্ককে অর্থনৈতিক ভাবে চাপে ফেলতে। এখন তুরস্কের পূর্ব পশ্চিম উভয় মেরুর বিরুদ্ধে গিয়ে ওখানে থাকা কতটা নিরাপদ এবং যুক্তিসংগত।
প্রশ্ন করতে পারেন এতই যখন ঝামেলা তাহলে তুরস্ক কেন কাবুলে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করছে। তুরস্কে খুব বিখ্যাত একটা প্রবাদ আছে সেটা হল আঙ্কারা নিরাপত্তা শুরু হয় কাবুল থেকে অর্থাৎ কাবুল যদি নিরাপদ থাকে, কাবুলে যদি তুরস্কের কোন প্রভাব থাকে তাহলে আঙ্কারা কে নিরাপদ রাখা সম্ভব। এর অনেক ঐতিহাসিক কারণ এবং ব্যাখ্যা আছে।
পূর্ব দিক থেকে আসা যেকোনো ধরনের আগ্রাসন যদি এখানেই ঠেকানো যায় তাহলে আঙ্কারা নিরাপদ থাকবে আর যদি সে আগ্রাসনকে কাবুলে ঠেকানো না যায় তাহলে তার চোট লাগবে আঙ্কারায়ও। হতে পারে সেটা চীন-রাশিয়া বা অন্য কোনও দেশ। তাইতো তুরস্ক চায় কাবুলে যেন তার একটা চোখ সব সময় থাকে।
এছাড়াও মধ্য এশিয়ার তুর্কি দেশগুলোকে নিয়ে যে বৃহত্তর ঐক্যের স্বপ্ন দেখছেন এরদোগান এবং আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ, সে স্বপ্ন বাস্তবায়নেও কাবুলে তুরস্কের উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ।
বিদ্রঃ সরোয়ার আলমের এই লেখাটি যুগান্তর পত্রিকায় ০২ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখ প্রকাশ করা হয়।