তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগান গত সপ্তাহে উদ্বোধন করেছেন ইস্তাম্বুল খালের ব্রিজের কাজ। এই খাল নিয়ে তুরস্কের ভিতরে ও বাইরে চলছে তুমুল বিতর্ক। অটোম্যান (উসমানীয় খেলাফতের) সুলতান সুলায়মান থেকে এরদোগান পর্যন্ত এই খাল খননের ইতিহাস নিয়ে এর আগে আমি আগের লেখায় বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
আজ আলোচনা করবো এই খালের বিপক্ষের এবং পক্ষের যুক্তিগুলো নিয়ে।
এই খাল খননের বিপক্ষে যারা রয়েছে তারা হলো- তুরস্কের প্রধান বিরোধী দল CHP সহ, দ্বিতীয় বিরোধী দল, এরদোগান সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আহমেত দাভুতওগ্লুর রাজনৈতিক দল, এরদোগান সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী আলি বাবাজানের রাজনৈতিক দল, কুর্দি রাজনৈতিক দল, ইস্তাম্বুলের মেয়র এবং পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংস্থা। দেশের বাইরে থেকেও আছে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা।
আর পক্ষে আছেন তুরস্কের রাষ্ট্রপতি এরদোগান, তার সরকারের অংশীদার কট্টর জাতীয়তাবাদী দল এমএইচপি এবং তাকে সমর্থনকারী কোটি কোটি জনগণ।
বিরোধী গ্রুপের যুক্তি গুলো হলো-
বসফরাস প্রণালি থাকতে এই খালের কি দরকার ।
আর খালের পক্ষে যারা আছেন তাদের যুক্তি হল- বসফরাস অনেক হুমকির মুখে। বসফরাসের নিরপদ পারাপারের পরিমাণ বছরে পঁচিশ হাজার জাহাজ আর এখন এই প্রণালিটি ব্যবহার করে বছরে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার জাহাজ। এছাড়াও দৈনিক লাখ লাখ যাত্রী পার হয় এই প্রণালি দিয়ে। তাই কার্গো শিপের সঙ্গে সাধারণ যাত্রীবাহী লঞ্চের সংঘর্ষে অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে এই বসফরাসের।
বসফরাসে গত তিন বছরে ছোটবড় প্রায় পঞ্চাশটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। ২০১৯ সালে বসফরাস পার হওয়ার সময় একটি কার্গো শিপের স্টিয়ারিং সিস্টেম লক হয়ে গেলে জাহাজটি বসফরাসের তীরে ঐতিহাসিক হেকিমবাশি সালিহ এফেন্দি ম্যানশনটির সঙ্গে ধাক্কা খায়। এতে ম্যানশনটি ধ্বংস হয়ে যায়।
এখনও পর্যন্ত বসফরাসে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বৃহত্তম দুর্ঘটনাটি ঘটে ১৯৭৯ সালে। ‘ইন্ডিপেন্ডেন্টা’ নামক একটি রোমানিয়ান অপরিশোধিত তেলের ট্যাঙ্কার ছিয়ানব্বই হাজার টন তেল নিয়ে একটা গ্রিক ফ্রেইটারের সঙ্গে ধাক্কা খায়। সব তেল সমুদ্রের পানিতে ছড়িয়ে পরে। এক মাস ধরে জ্বলে সেই আগুন। ট্যাঙ্কারের ক্রু সদস্যদের মধ্যে ৪৩ জন মারা যায়। বসফরাস ভারী বায়ু এবং সমুদ্র দূষণ হয়। বায়ু দূষণের তীব্রতায় আকাশ কালো হয়ে থাকে মাসের পর মাস, বেশিরভাগ সামুদ্রিক প্রানি মারা যায়। পানির উপরিভাগে অপরিশোধিত তেলের আস্তর জমে যায়।
দিন যত যাচ্ছে বসফরাসে এ ধরণের দুর্ঘটনার আশঙ্কা আরো বাড়ছে। কারণ মানুষ পারাপারের হার বাড়ছে। তাই সরকার বলছে , বসফরাসের বিকল্প তৈরি করা এখন সময়ের দাবি।
এ খাল খনন সম্পন্ন করতে ১৫ বিলিয়ন ডলার দরকার হবে।
এবার বিরোধীদের প্রশ্ন: ৪৫ কিলোমিটার লম্বা, ৩০০ মিটার চওড়া এবং ২১ মিটার গভীর এই খাল খননে যে টাকা দরকার হবে তা আসবে কোত্থেকে? দেশের অর্থনীতির অবস্থা খারাপ। বিদেশিরা এখানে বিনিয়োগ করলে তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়বে দেশ।
সরকারি পক্ষের উত্তর: তুরস্কের নিজস্ব অর্থায়নেই এই প্রকল্প করা সম্ভব। দেশের মধ্যে অনেক বড় বড় কোম্পানি আছে যারা এই কাজ করতে আগ্রহী। আর বিদেশী বিনিয়োগ দেশে আসলে তো দেশেরই ভালো। জিম্মি হওয়ার প্রশ্নই আসে না। সারা দুনিয়ার সব দেশই তো বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে চায়।
এ উত্তরেও বিরোধীরা সন্তুষ্ট না। এবার তারা সরাসরি হুমকি দিচ্ছে এই কাজের টেন্ডারে যেন কোনো কোম্পানি না আসে। তাদের সাফ কথা, কেউ যদি এই কাজের টেন্ডার নেয় তাহলে বিরোধী দল ক্ষমতায় আসলে তাদের টেন্ডার বাতিল করে দেওয়া হবে এবং একটা টাকাও ফেরত দেয়া হবে না।
আমার মতে, এখানে বিরোধীদল ভুল করছে। প্রজেক্টের বিরুদ্ধে যুক্তি দিতে পারে, বিতর্কে জড়াতে পারে। কিন্তু টেন্ডারের অংশগ্রহণকারী কোম্পানিকে হুমকি দেওয়াটা রাজনৈতিক শিষ্টাচারে পরে না। আর এতে এই প্রকল্পের গুনগত মানের কোন উন্নতি হবে না বরং শুধু শুধু টেন্ডারে যে কোম্পানি ঢুকতে আগ্রহী তাদের মনে ভয় ঢুকিয়ে সরকারকে আরও বেশি লসে ফেলে দিবে।
এবার বিরোধীদের কথা যদি এই টেন্ডার কোনো কোম্পানি পায় এবং কাজ শুরুও করে। তাহলেও এই কাজ করতে লাগবে সাত থেকে ১০ বছর। ওখান থেকে আসবে হাজার হাজার কোটি টন মাটি। এই মাটি ফেলতে ব্যবহার হবে হাজার হাজার ট্রাক। এই মাটি খনন তখন ব্যাপক বায়ু দূষণ করবে। এই বিশাল পরিমাণ মাটি তখন কোথায় ফেলবে। আর এই ট্রাকগুলো ইস্তাম্বুলের যাতায়াত ব্যবস্থাকে পুরো অচল করে দেবে।
সরকারের যুক্তি হলো: বায়ু দূষণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এই ট্রাকগুলো ইস্তাম্বুলের যাতায়াত ব্যবস্থাকে বাইপাস করে বিকল্প পথ ব্যবহার করবে। সেজন্য খাল খননের আগেই রাস্তাঘাট এবং ব্রিজ তৈরি করা হচ্ছে। আর এই বিশাল পরিমাণ মাটি এই খালের তীরবর্তী শহর গড়তে এবং কৃষ্ণ সাগরে মাটি ভরাট করে একটি পোর্ট নির্মাণ করা হবে।
এবার বিরোধীদের যুক্তি: এই খাল খনন করলে মারমারা সাগরের জলজ প্রাণীগুলো হুমকির মুখে পড়বে। কারণ কৃষ্ণ সাগর এবং মারমারা সাগরের পানির তাপমাত্রার পার্থক্য অনেক। আর পানির উচ্চতা এবং লবণাক্ততারও তারতম্য আছে। সুতরাং এই দুই সাগরের পানির মিশ্রণ ঘটলে ওই অঞ্চলের জলজ প্রাণীর জীবন হুমকির মুখে পড়বে।
সরকারের উত্তর: এই যুক্তি ভিত্তিহীন। কারণ এই দুই সাগর তো ইতিমধ্যে বসফরাস প্রণালির মাধ্যমে যুক্ত। ইকোলজিক্যাল সমস্যা বা পানির তাপমাত্রার সমস্যা হলে তো অনেক আগেই মারমারা সাগরের সব প্রাণী মারা যাওয়ার কথা। যদিও এখন সামুদ্রিক শ্লেষ্মা বা মিউসিকাস এর আক্রমণে মারমারা সাগর ভয়ংকর হুমকির মুখে তবুও সরকারের কথায় যুক্তি আছে।
বিরোধীদের আরেকটি যুক্তি হলো এই খাল খনন করলে ইস্তাম্বুলে খাবার পানির সংকট হবে। কারণ এই খালের প্রস্তাবিত রুটের ওপর আছে অনেকগুলো জলধারা যা ইস্তাম্বুলের খাবার পানি সরবরাহ করে।
সরকারের উত্তর: ইস্তাম্বুলে নিত্য ব্যবহার্য পানি সরবরাহের জন্য ১০টি জলধারা আছে। আর ওই খালের রুটের উপর পড়েছে দুটি জলধারা। একটি পুরপুরি এই খালের মধ্যে চলে যাবে আরেকটির আংশিক যাবে এই খালের মধ্যে। তাতে ইস্তাম্বুলের মোট দরকারির পানির শতকরা ৩ ভাগ নষ্ট হবে। তবে সরকার পানি সংরক্ষনের জন্য মেলেন ড্যাম নামে একটি প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। সেটা এত বড় একটি পানি সংরক্ষণ প্রজেক্ট যে পুরো ইস্তাম্বুলের পানির চাহিদা মেটাতে এই একটি জলধারাই যথেষ্ট।
এর পরের যুক্তি হলো, এই খালের কারণে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি নষ্ট হয়ে যাবে। এতে বিপুল পরিমাণ খাদ্য সংকট হবে দেশে।
৭ লাখ ৩০ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই দেশে শুধু মাত্র ৩০০ মিটার প্রস্থের একটি খাল খননে খাদ্য সংকটে পড়বে কথাটা খুব যুক্তি সঙ্গত লাগে না।
বিরোধী পক্ষ বলছে, এই খালের কারণে ইস্তাম্বুলে ভূমিকম্প ঝুঁকির পরিমাণ বাড়বে। কারণ ইস্তাম্বুল খুবই ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা; তাই এই খাল খননের কারণে ভূমিকম্প প্লেটের উপর অনেক বড় প্রভাব ফেলবে এবং অনেক বড় ভূমিকম্প নিয়ে আসবে।
সরকারের কথা হলো- এই খাল যে রুটে খনন করা হচ্ছে সেই রুটে কোন ভূমিকম্প প্লেট নেই। এই ব্যাপারে তুরস্কের প্রায় আড়াইশো বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, বিশেষজ্ঞ এবং ৩৫টিরও বেশি সংস্থা একত্রে একটি রিপোর্ট বের করেছে। যে রিপোর্টেও এ ধরণের আশঙ্কাকে নাকচ করে দেয়া হয়েছে। আর ভূমিকম্প যে প্লেটের কারণে হয় তা থাকে ভূমির ১৫ থেকে ২৫ কিলোমিটার গভীরে। আর এই খালের গভীরতা মাত্র ২১ মিটার। অর্থাৎ এর গভীরতা একটি বিল্ডিং বা ব্রিজ করতে যতটুকু গভীরে যেতে হয় মাত্র ততটুকুই। তাই এই খাল খনন ভূমিকম্পের প্লেটে কোন ক্ষতি করবে না এবং ভূমিকম্পের প্রভাব ও বাড়াবে না।
আরেকটি যুক্তি, এই খাল খননের মাধ্যমে ইস্তাম্বুল এখন হয়ে যাবে একটি দ্বীপ। দুই দিকে দুই খাল মাঝখানে একটি দ্বীপ। এই দ্বীপে ভূমিকম্প বা অন্য কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে এই লাখ লাখ মানুষ দ্রুত কোথাও নিয়ে যাওয়াও কঠিন হবে।
এক্ষেত্রে উত্তর হল, ভূমিকম্পে মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে রাস্তায় অথবা খালি জায়গায় অবস্থান করে। ১০-১৫ কিলোমিটার দূরে দৌড়ায় না। আর ওই দ্বীপটাই ইস্তাম্বুলের প্রাণকেন্দ্র তাই ওখানে দুর্যোগ মোকাবেলায় সব ধরণের প্রস্তুতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
আসলে দুইও পক্ষের কথায় যুক্তি আছে। বিরোধীদেরকে ধন্যবাদ দেওয়া দরকার তারা এতগুলো খুঁটিনাটি বিষয় বের করে সরকারকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছেন। সরকারকে ধন্যবাদ দেওয়া দরকার কারণ এতো বেশি লোক দিয়ে গবেষণা করিয়েছেন এবং সব বিষয় ভেবে খেঁটে খুঁটে তারপর প্রকল্পে নেমেছেন।
বিরোধীদের একটাই দোষ যে তারা টেন্ডারে অংশগ্রহণকারী কোম্পানিদেরকে হুমকি ধামকি দিচ্ছে। এটা বাড়াবাড়ি।
বিদ্রঃ সরোয়ার আলমের এই লেখাটি ৩০ জুন ২০২১ তারিখ যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়।