তুরস্ক সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে নতুন করে ৪০টি লকহিড মার্টিন নির্মিত সিঙ্গেল ইঞ্জিনের এফ-১৬ ব্লক-৭০/৭২ ভাইপার জেট ফাইটার কেনার প্রবল আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে মার্কিন আইন প্রণেতারা একটি আইন অনুমোদন করেছে, যা ভবিষ্যতে তুরস্কের কাছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের এফ-১৬ ফাইটার জেট বিক্রির পরিকল্পনায় বড় ধরণের বাধার সৃষ্টি করতে পারে। তুরস্কের বিরুদ্ধে আনীত নিউ জার্সির আইনপ্রণেতা ফ্রাঙ্ক প্যালোন প্রস্তাবিত সংশোধনীটি কংগ্রেসে ২৪৪-১৭৯ ভোটে পাস হয়। তাছাড়া মার্কিন আইন প্রণেতারা নিশ্চয়তা চান যে তুরস্ককে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান দেয়া হলেও তা ভবিষ্যতে মার্কিন শিবিরের বন্ধুভাবাপন্ন দেশ গ্রীসের বিরুদ্ধে কখনো ব্যবহার করা হবে না।

মুলত রাশিয়া থেকে এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয়ের তীব্র বিরোধিতা করে মার্কিন প্রশাসন গত ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে বিশ্বের সর্বোচ্চ ব্যয়বহুল এফ-৩৫ জয়েন্ট স্টাইক ফাইটার প্রোগ্রাম থেকে তুরস্ককে চূড়ান্তভাবে বাদ দেয়। ১.৫৩ ট্রিলিয়ন ডলারের এফ-৩৫ স্টিলথ জেট ফাইটারের মাল্টিনেশন জয়েন প্রজেক্টে আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি, নেদারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, কানাডা এবং নরওয়ের অংশিদ্বারিত্বের ভিত্তিতে ২০০৬ সালে চুক্তিবদ্ধ হয়। আর তুরস্ক এই প্রজেক্টে অংশগ্রহণ করে ২০০৭ সালের ২৬শে জানুয়ারি। যদিও এই প্রজেক্টে তুরস্ক ১.৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে এবং এখান থেকে ভবিষ্যতে পর্যায়ক্রমে তুরস্কের মোট ১০০টি এফ-৩৫এ সিরিজের এডভান্স স্টেলথ জেট ফাইটার ক্রয়ের কথা ছিল।

এক বিংশ শতাব্দীর ২০২২ সালে এসেও একটি শক্তিশালী সামরিক সক্ষমতা সম্পন্ন দেশ তুরস্কের বিমান বাহিনীকে মাত্র দুই ক্যাটাগরির জেট ফাইটার বা যুদ্ধবিমানের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। বর্তমানে তুরস্কের বিমান বাহিনীতে মোট ২৩৮টি এফ-১৬ সি/ডি সিরিজের ফাইটিং ফ্যালকন যুদ্ধবিমান অপারেশনাল রয়েছে। সত্তরের দশকের পুরনো এফ-৪ ফ্যান্টম-২ রয়েছে ৪৮টি। এই দুই ক্যাটাগরির যুদ্ধবিমান ব্যাতিত ফাস্ট এ্যাটাক এরিয়াল সিস্টেম হিসেবে তুর্কী বিমান বাহিনীতে আপাতত আর কোন যুদ্ধবিমানই নেই। তাছাড়া ভবিষ্যত প্রজন্মের টিএফ-এক্স সিরিজের এডভান্স জেট ফাইটার সার্ভিসে আনতে তুরস্ককে আগামী ২০৩০ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে।

সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়ায় এবং বিশেষ করে আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তার এবং তার পাশাপাশি তুরস্কের নিজস্ব প্রযুক্তির সামরিক ও প্রতিরক্ষা সাজ সরঞ্জাম তৈরির সক্ষমতার বিষয়টিকে মোটেও সুনজরে দেখছে না মার্কিন প্রশাসন এবং তার মিত্র পশ্চিমা বিশ্ব। তাই অনেকটা ভীত হয়ে হলেও তুরস্কের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্থ করতে উঠে পড়ে লেগেছে তারা। এখানে এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয়ের বিষয়টিকে বার বার সামনে আনা হলেও এই চক্রান্তের অংশ হিসেবে আমেরিকা বিগত কয়েক বছর আগে থেকেই কিন্তু তুরস্কে চালু থাকা এফ-১৬ ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্টে চুক্তি ভঙ্গ করে হলেও ইঞ্জিন, এভিয়নিক্স, মর্ডানাইজেশন কিটস এবং রাডার সিস্টেমসহ এর মিসাইল ও অন্যান্য অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ বা রপ্তানি সীমিত করে দেয়। এতে করে দীর্ঘদিন থেকেই তুরস্কে এফ-১৬ উৎপাদন এবং পুরনো এফ-১৬ আধুনিকায়ন প্রক্রিয়া এক রকম বন্ধ হয়ে গেছে।

এখানে প্রকাশ থাকে যে, তুরস্কের বিমান বাহিনীর এখনো পর্যন্ত মূল মেরুদণ্ড হচ্ছে আমেরিকার এফ-১৬ ব্লক-৪০/৫০ ফাইটিং ফ্যালকন যুদ্ধবিমান। দেশটি কার্যত এফ-১৬ জেট ফাইটার ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয় ১৯৮৩ সালে। ঠিক সেই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ১৩২টি এফ-১৬সি এবং ২৪টি এফ-১৬ডি সিরিজের জেট ফাইটার ক্রয়ের চুক্তি করেছিল তুরস্ক। চুক্তি অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে ৮টি এফ-১৬ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরাসরি আসার কথা ছিল এবং অবশিষ্ট ১৪৮টি এফ-১৬ জেট ফাইটার আমেরিকার প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং যন্ত্রাংশ সরবরাহের মাধ্যে তুরস্কের মাটিতে তৈরি করা হবে।

চুক্তি মোতাবেক তুরস্ক এফ-১৬সি ব্লক-৩০ সিরিজের প্রথম ২টি যুদ্ধবিমান গ্রহণ করে ১৯৮৭ সালের মার্চ মাসে এবং এফ-১৬ডি সিরিজের ১টি যুদ্ধবিমান গ্রহণ করে ১৯৮৭ সালের জুলাই মাসে। তাছাড়া তুর্কী  এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ (টিআইএ) ১৯৮৭ সাল থেকে মার্কিন যুক্ত্রাষ্ট্রের প্রযুক্তিগত সহায়তায় এফ-১৬ জেট ফাইটার এসেমব্লী শুরু করে। এটা আসলে ঠিক নিজে তৈরি করা বুঝায় না বরং সকল যন্ত্রাংশ, ইঞ্জিন এবং ডিভাইসসহ সবকিছু আমেরিকা থেকে নিয়ে এসে তুরস্কে জোড়া লাগিয়ে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান সংযোজন করার মতো একটা কাজ ছিল। তবে এর অল্প কিছু দিনের মধ্যে তুরস্ক আমেরিকার সাথে নতুন চুক্তির আলোকে লাইসেন্স নিয়ে তুর্কী এ্যারোস্পেস ইণ্ডাস্ট্রিজ (টিআইএ) এর এয়ারক্রাফট ম্যানুফ্যাকচারিং ফ্যাসালিটি প্লান্টে নিজেরাই উৎপাদন শুরু করে দেয়।

১৯৮৭ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তুরস্ক মোট ২৭০টি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান তৈরি করে। যার মধ্যে ব্লক-৩০ সি/ডি সিরিজের এফ-১৬ জেট ফাইটার ৪৩টি, ব্লক-৪০ সি/ডি সিরজের এফ-১৬ জেট ফাইটার ১১৭টি এবং ব্লক-৫০ সি/ডি সিরিজের এফ-১৬ জেট ফাইটার ১১০টি। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কখনোই তুরস্ককে এফ-১৬ ফাইটিং ফ্যালকনের হাইলী আপগ্রেড ভার্সন বা ব্লক ৭০/৭২ সিরিজের যুদ্ধবিমানের প্রযুক্তি সরবরাহ করেনি। অথচ এদিকে কিনা এফ-১৬ এর অত্যাধুনিক ভার্সন ব্লক-৬০ এর ই/এফ সিরিজের যুদ্ধবিমান একাই ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্যের ছোট্ট দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত।

বর্তমানে তুরস্ক এফ-১৬ জেট ফাইটারের প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ, ডিভাইস, মিসাইল, ডাটা লিংক, এয়ারফ্রেম ও সফটওয়্যার নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি করলেও এর ইঞ্জিন, রাডার, এআইএম-৭/৯ এবং এআইএম-১২০সি এয়ার টু এয়ার মিসাইল এবং এভিয়নিক্স সিস্টেম কিন্তু এখনো পর্যন্ত সেই আমেরিকা থেকে আমদানি করে চাহিদা মিটিয়ে থাকে।

তুরস্ক অবশ্য পরবর্তীতে মার্কিন বিমান বাহিনীর জন্য ৪০টি এফ-১৬ জেট ফাইটারের ডানা, ফিউসলেস তৈরির কন্ট্রাক লাভ করে এবং মার্কিন প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে মিশরের বিমান বাহিনীর জন্য ৪৬টি ব্লক-৪০ সিরিজের এফ-১৬ সি/ডি সিরিজের যুদ্ধবিমান তৈরি করে দেয়।

Sherazur Rahman