এজিয়ান সাগরে তুরস্ক গ্রীসের সমস্যা কী? ওই সাগরের দ্বীপগুলো গ্রীস কখন কিভাবে দখল করেছে? এখন কেন সেগুলো নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে? এই সমস্যা কি তুরস্ক-গ্রিস যুদ্ধে মোড় নিতে পারে? এগুলো নিয়ে আলোচনা করব আজ।
তুরস্কের সাথে গ্রীসের সমস্যা অনেক। সাইপ্রাস নিয়ে সমস্যা, ভূমধ্য সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে সমস্যা, গ্রীসে বসবাসরত সংখ্যালঘু মুসলিম তথা তুর্কিদের উপড়ে গ্রীসের আক্রমণ নিয়ে সমস্যা, তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানে গ্রীসের ভেটো নিয়ে সমস্যা, আয়া সফিয়াকে আবার মসজিদে রূপান্তর নিয়ে সমস্যা এবং এজিয়ান সাগরের দ্বীপগুলো নিয়ে সমস্যা। আজ আমরা এই দ্বীপগুলো নিয়ে আলোচনা করব।
তুরস্ক এবং গ্রীসের মধ্যে অবস্থিত ছোট্ট একটা সাগর হল এজিয়ান সাগর। কৃষ্ণ সাগর থেকে তুরস্কের মধ্যের দুটি প্রণালী দিয়ে ভূমধ্য সাগরে আসতে এই সাগর পাড়ি দিতে হয়। এই সাগরে ছোট বড় প্রায় তিন হাজার ২০০ দ্বীপ আছে। এ কারণে এই সাগরটিকে দ্বীপের সাগর বলা হয়।
এই দ্বীপ গুলোর ৩০৫০ টি গ্রীসের দখলে আর ১০০ এর মত আছে তুরস্কের অধীনে ।
এই তিনহাজারেরও অধিক দ্বীপের মধ্যে মাত্র অল্প কিছু দ্বীপে মানুষ বসবাস করে। বেশিরভাগ দ্বীপই জনমানবহীন। অনেকগুলো আবার এতই ছোট যে দূর থেকে খালি চোখে দেখা যায় না।
আসুন আমরা মানচিত্রে একটু চোখ বুলিয়ে নেই।
এখন প্রশ্ন হলো, উভয় দেশেরই প্রায় সমপরিমাণ সমুদ্রসীমা থাকলেও কেন প্রায় সবগুলো দ্বীপই গ্রীসের অধীনে। এমনকি তুরস্কের তীরবর্তী দ্বীপগুলোও কিভাবে এই হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে থাকা গ্রীসের হয়ে গেলো। এই বিষয়টি বুঝতে হলে আমাদের ২০০ বছর আগে ফিরে যেতে হবে।
শুরুতেই বলে রাখি উসমানীয় সম্রাজ্যের সাথে ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি যুদ্ধ হয়েছে রাশিয়ার। ১৫৬৮ সাল থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত রাশিয়া উসমানীয় সম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ১২ বার যুদ্ধ করে যার ৭ বার রাশিয়া বিজয়ী হয় আর ৫ বার উসমানীয়রা বিজয়ী হয়।
১২৯৯ সালে ওসমান গাজির হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় উসমানী সালতানাত ১৬৯৯ সাল পর্যন্ত অটোম্যান সম্রাজ্য বিস্তৃতি লাভ করে বহুবার তা শেষ পর্যন্ত ভিয়েনার দরজায় গিয়ে ঠেকে।উসমানীয় বাহিনী কৃষ্ণ সাগর, এজিয়ান সাগর, ভূমধ্য সাগর, লোহিত সাগর এবং পারস্য উপসাগরে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।যে কারণে কৃষ্ণ সাগরে রাশিয়ার ঢোকার পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। কারণ রাশিয়ার যতগুলো সমুদ্র বন্দর ছিল সেগুলো শীতে জমে বরফ হয়ে যায়। সারা বছর সেগুলোতে জাহাজ নোঙর করতে পারে না। এ কারণে রাশিয়া উষ্ণ জলে নামার পথ খোঁজে। এবং বার বার ক্রাইমিয়া দখলে উসমানীয়দের সাথে যুদ্ধ লিপ্ত হয়। উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ক্রাইমিয়া এবং আজব সাগরের তীরবর্তী অঞ্চলগুলো দখল করে নেয়। এভাবে কৃষ্ণ সাগরের গুরুত্বপূর্ণ একটি বন্দর তার দখলে আসে। কিন্তু কৃষ্ণ সাগর দিয়ে ভূমধ্য সাগরে আসতে যে সব সাগর এবং প্রণালী ছিল সেগুলো সবই ছিল উসমানীয়দের দখলে। কিন্তু ইস্তানবুল যেহেতু উসমানীয়দের রাজধানী তাই সেটা তো দখল করা সম্ভব না। তাই এজিয়ান সাগরকে মুক্ত করতে গ্রীসের স্বাধীনতায় উঠে পরে লাগে রাশিয়া। এক দিকে উসমানীয়দের অধীনে থাকা বলকান অঞ্চলে বিদ্রোহ উস্কে দেয় আরেক দিকে গ্রীকদের বিদ্রোহে ইন্দন দেয়। তিনদিক থেকে উসমানীয়রা বিদ্রোহ দমনে দিশেহারা।
এই অবস্থায় ১৮২০ সালের দিকে রাশিয়ার সাথে যোগ দেয় ব্রিটেন এবং ফ্রান্স। এবার তারা অটোম্যান সম্রাজ্যকে ভাঙ্গার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামে। সে পরিকল্পনার একটি ছিল গ্রীকদের দিয়ে বিদ্রোহ করানো এবং গ্রীসকে স্বাধীন করানো। এরই অংশ হিসেবে ওই সময়ে উসমানীয় সম্রাজের অধীনে থাকা গ্রীসের বিভিন্ন অংশে বিদ্রোহ শুরু হয়। ১৮২২ সালে গ্রীকরা হেলেনিক রিপাবলিক নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়। সংখ্যালঘু মুসলিম তুর্কিদের উপর অত্যাচার শুরু করে । তুর্কিদের অধীনে থাকা গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস করে দেয় এবং লাখ লাখ তুর্কি হত্যা করা হয়। কোন কোন সোর্সে নিহত তুর্কিদের সংখ্যা ৫ লাখ বলেও দাবি করা হয়। এরই মধ্যে ১৮২৭ সালে রাশিয়া ব্রিটেন এবং ফ্রান্স অটোম্যানদের কাছে গ্রীসকে স্বাধীন করে দেওয়ার দাবি করে। কিন্তু অটোম্যান সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ তাদের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তখন ভূমধ্যসাগরে অটোমানদের নৌ বাহিনীর দাপটে অ্যাজিয়ান সাগর, পূর্ব ভূমধ্য সাগর এবং দক্ষিণ কৃষ্ণ সাগরে কেউ প্রভাব খাঁটাতে পারতো না। সে সময়ে বাল্টিক সাগর থেকে রাশিয়া তার নৌ বহরের একটি অংশ পাঠায় ভূমধ্য সাগরে। রাশিয়ার সাথে ব্রিটেনের নৌবহর যোগ দেয় ভূমধ্য সাগরে এসে। তাদের সাথে যোগ দেয় ফ্রান্সের নৌবহর। এই দিন দেশের নৌবহর একত্রে সুযোগ খুঁজতে থাকে অটোম্যানদের নৌবহরে আঘাত হানার। সেসময় অটোম্যান এবং মিশরের নৌবহর তখনকার নাভারিনো বন্দর যা বর্তমান গ্রীসের পাইলোস বন্দরে নামে পরিচিত সেখানে অবস্থান করছিলো। তারা নাভারিনো বন্দরে থাকা অটোম্যান নৌবহরকে ঘেরাও করে ফেলে। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন ব্রিটিশ অ্যাডমিরাল এডওয়ার্ড কড্রিংটন। সেখানে অটোম্যানদের ৭৮টি ছোট বড় যুদ্ধ জাহাজ ছিল। এগুলোকে ঘেরাও করার পর মুক্তিপণ হিসেবে গ্রীসকে স্বাধীন করার দাবি জানায় তারা। ওসমানী সুলতান এই দাবিও প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তীতে একটা নামকাওয়াস্তে সমঝোতা হয় এবং তারা ওই বন্দরের অবরোধ উঠিয়ে নেয়। এবং যুদ্ধ না করার ঘোষণা দেয়। ওসমানী শক্তির কাছে বন্দরে নোঙরের অনুমতি চায়। নোঙরের অনুমতি দিলে তাদের জাহাজ গুলো বন্দরে এসে তারপর অতর্কিত হামলা করে উসমানীয় নৌ বহরে। সে যুদ্ধে উসমানীয়দের সব জাহাজ ধ্বংস হয় এবং প্রায় ৪১০৯ জন নাবিক হতাহত হয়।
সেই নৌ বহর হারিয়ে উসমানীয় নৌবাহিনী অনেক দুর্বল হয়ে পড়ে যা কাটিয়ে উঠতে পারেনি গত দুইশ বছরেও। অর্থাৎ ২০০০ সালের শুরুর দিক পর্যন্ত তুর্কিদের নৌবাহিনী অনেক দুর্বল ছিল। যাই হোক সেই নাভারিনোর যুদ্ধের পর দুর্বল নৌবাহিনী এজিয়ান সাগরে গ্রীকদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তখন গ্রীকরা মাত্র একটা যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে এজিয়ান সাগরের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ দখল করে নেয়। সে সময় অটোম্যান সুলতান রুশদের জন্য চানাক্কালে প্রণালী বন্ধ করে দিলে শুরু হয় রাশিয়ানদের সাথে অটোম্যানদের নবম যুদ্ধ। ১৮২৮ থেকে ১৮২৯ সাল পর্যন্ত সে যুদ্ধ চলে। আসল উদ্দেশ্য অটোম্যানদের দুর্বল করা যাতে গ্রীকরা আরও জায়গা দখল করতে পারে। উসামানিয়রা সেই যুদ্ধে রাশিয়ার কাছে পরাজিত হয়ে ১৮২৯ সালে এদিরনে চুক্তির মাধ্যমে গ্রীসের স্বাধীনতাকে মেনে নেয়।
তখন এই সাগরের দখলকৃত দ্বীপগুলোর বাইরেও নতুন নতুন দ্বীপ দখল করতে শুরু করে গ্রীস। পরে উসমানীয় খেলাফত যতই দুর্বল হতে থাকে ততই এই দ্বীপগুলো হাতছাড়া করতে বাধ্য হয়। কখনো গ্রীসের কাছে, কখনো ইতালির কাছে কখনো বা ব্রিটেনের কাছে।
যেমন ১৮২৯ সালে এদিরনে চুক্তির মাধ্যমে এজিয়ান সাগরের পশ্চিম দিকের দ্বীপগুলো গ্রীসের কাছে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ১৮৩২ সালে লন্ডন চুক্তির মাধ্যমে উত্তর স্পোরাত দ্বীপগুলো গ্রীসের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়। ১৮৯৮ সালে গ্রিত দ্বীপ গ্রীস দখল করে নেয়। ১৯১১-১২ সালে তুর্ক-ইতালি যুদ্ধে ওনইকি দ্বীপ নামক একগুচ্ছ দ্বীপ ইতালি দখল করে নেয়। আর ১৯১২-১৩ সালে উস্মানিয়রা যখন বলকান অঞ্চল রক্ষায় ব্যস্ত অর্থাৎ বলকান যুদ্ধে ব্যাস্ত তখন পূর্ব অ্যাজিয়ানের সবগুলো দ্বীপ দখল করে নেয় গ্রীস। পরে আর উসমানীয়রা ওই দ্বীপগুলো পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয় নি। ১৯১৩-১৯১৪ সালে ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, জার্মানি, ইতালি, এবং অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি এই ছয় দেশ লন্ডন চুক্তি এবং লন্ডন কনফারেন্সের মাধ্যমে এই দ্বীপগুলোতে গ্রীক কর্তৃত্বকে মেনে নেয় এবং ওসমানীয়দের সেই চুক্তি মানতে বাধ্য করে। অর্থাৎ প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের আগেই বিশেষ করে সুলতান আব্দুল হামিদকে খমতাচ্যুতির পরপরই এজিয়ান সাগরের প্রায় সবগুলো দ্বীপ গ্রীস এবং ইতালির দখলে চলে যায়।
এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। অটোম্যান সম্রাজ্য ভেঙ্গে খান খান। ব্রিটিশ, ফ্রান্স এবং রাশিয়া সহ পরাশক্তিরা উসমানীয়দের প্রায় সবটুকু ভূমি ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছে নিজেদের মধ্যে। ইস্তাম্বুলে সুলতান তখন ব্রিটিশদের হাতের পুতুল। একদল তুর্কিরা তখন কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে স্বাধীনতার লড়াই শুরু করে। শেষ পর্যন্ত ১৯২৩ সালে লুজান চুক্তি হয়। সেই লুজান চুক্তির ৬, ১২, ১৩, ১৪, ১৫, এবং ১৬ নম্বর ধারা অনুযায়ী তুর্কিরা আরও একবার মেনে নিতে বাধ্য হয় যে এই দ্বীপগুলোর কর্তৃত্ব গ্রীস এবং ইতালিরই। তবে সেই চুক্তির ৬ নম্বর ধারা অনুযায়ী তাদের অধীনে থাকা দ্বীপগুলো ছাড়াও দুই দেশের অর্থাৎ গ্রীস এবং তুরস্কের মূল ভূখণ্ডের তিন নটিক্যাল মাইলের মধ্যে যে দ্বীপগুলো আছে সেগুলোর কর্তৃত্ব ওই দেশের কাছে ছেড়ে দিতে হবে। সে অনুযায়ী তুরস্ক অল্প কয়েকটি দ্বীপের অধিকার পায়। আর ১৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী তুরস্কের নিকটবর্তী যে সব দ্বীপ গ্রীসের অধীনে আছে যেমন মিদিল্লি, সাকিজ, সিসমান, এবং আহিকেরিয়া এগুলো থেকে গ্রীস সব ধরণের অস্ত্র এবং সামরিক বাহিনী সরিয়ে নিবে। দেশটি এইসব দ্বীপে ভবিষ্যতে কখনোই সামরিক উপস্থিতি ঘটাবে না। সেগুলোতে কোন সামরিক ঘাঁটিও করতে পারবে না। এছাড়া ছোট ছোট যে সব জনমানবহীন দ্বীপ আছে সেগুলোতেও সামরিক ঘাঁটি বা বসতি স্থাপন করতে পারবে না।
এর পর ১৯৪৭ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে ইতালি এবং গ্রীসের মধ্যে একটা চুক্তি হয় সেই চুক্তি অনুযায়ী ইতালি এজিয়ান সাগরে তার অধীনে থাকা সবগুলো দ্বীপ গ্রীসের হাতে ছেড়ে দেয়। এভাবেই গ্রীস হয়ে উঠে এজিয়ান সাগরের প্রায় সবগুলো দ্বীপের একক অধিপতি। অন্যদিকে তুরস্ক শুধু তার সমুদ্র তীর থেকে তিন নটিক্যাল মাইল বা প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে যে দ্বীপগুলো আছে সেগুলোর অধিকার পায়। এই হল দ্বীপের অধিকার বা দ্বীপ দখলের ইতিহাস।
ঝামেলা কোথায়?
ঝামেলা হচ্ছে দুটো জায়গায় এবং সেগুলো লুজান চুক্তিতে নিহিত।
এক নম্বরঃ লুজান চুক্তির সময় বলা হয়েছে গ্রীস এই দ্বীপগুলোতে কোন সামরিক ঘাঁটি বা সেনা এবং অস্ত্র উপস্থিতি ঘটাতে পারবে না। কিন্তু গ্রীস গত কয়েক দশক ধরে সেই দ্বীপগুলোতে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তুলছে এবং অস্ত্র বৃদ্ধি করছে। তুরস্ক এটায় বাঁধা দিতে চায়।
দুই নম্বর সমস্যা হচ্ছে- সমুদ্র সীমা নির্ধারণ। অর্থাৎ এই দ্বীপের চারিদিকের কতটুকু অঞ্চল গ্রীসের অধীনে যাবে। গ্রীসের সমুদ্রসীমা কি মূল ভূখণ্ড থেকে হিসেব করা হবে নাকি এই দ্বীপ থেকে। অলুজান চুক্তি অনুযায়ী দ্বীপগুলোর চারিদিকে ৩ নটিক্যাল মাইল জায়গা দ্বীপের মালিকের অধীনে যাবে বাকি জায়গা আন্তর্জাতিক জলসীমায় পড়বে এবং অন্য সব দেশ সেখানে বিনা বাঁধায় তার জাহাজ বা বিমান চালাতে পারবে।
কিন্তু ১৯৩৬ সালে গ্রীস এক তরফা ভাবে লুজান চুক্তির ধারা ভঙ্গ করে তার জলসীমা ৩ নটিক্যাল মাইল থেকে ৬ নটিক্যাল মাইলে বৃদ্ধি করে। তুরস্ক তখন সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ভয়ে গ্রীসের এই অবৈধ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে টু শব্দ ও করে নি। ১৯৬৪ সালে সাইপ্রাসে সমস্যা শুরু হলে তুরস্ক তখন তার নিজের জলসীমাকেও ৬ নটিক্যাল মাইলে নির্ধারণ করে।
এরপর ১৯৭৪ সালে সাইপ্রাসের এক অংশ তুরস্ক তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলে গ্রীস তার জলসীমাকে বাড়িয়ে ১২ নটিক্যাল মাইল করার জন্য পদক্ষেপ নেয়। তখন তুরস্ক হুমকি দেয় যে গ্রীস একতরফা ভাবে এই সিদ্ধান্ত নিলে তুরস্ক ডাইরেক্ট যুদ্ধ শুরু করবে। তাই গ্রীস তখন সে সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসে।
কিন্তু ১৯৮২ সালে আন্তর্জাতিক সমুদ্রসিমা আইন অনুযায়ী সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ভূখণ্ড থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল।
গ্রীস সেই চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এবং দেশটির দাবি হচ্ছে সমুদ্রের এই প্রতিটি দ্বীপের চারিদিকে ১২ নটিক্যাল মাইল বা ২২ কিলোমিটার জায়গা ধরে গ্রীসের অধীনে যাবে। যদি তাই হয় তাহলে সমুদ্রে তুরস্কের পা ফেলার মত কোন জায়গা থাকেনা। আর তেমন কোন আন্তর্জাতিক জলসীমাও থাকে না বললেই চলে। এ কারণে তুরস্ক ১৯৮২ সালের সেই আন্তর্জাতিক সমুদ্রসিমা আইন স্বাক্ষর করেনি। যদিও ভেনিজুয়েলা, আমেরিকা, এবং ইসরাইলও তাদের নিজ নিজ এলাকায় নিজেদের স্বার্থের জন্য সেই চুক্তি স্বাক্ষর করেনি।
কিন্তু গ্রীস যেহেতু এই চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। তাই গ্রীস বলছে সে তার সমুদ্রসিমা ১২ নটিক্যাল মাইলে নিয়ে যাবে এবং সেগুলোর মধ্যে তাদের অনুমতি ছাড়া তুরস্কের কোন জাহাজ বা বিমান ঢুকতে পারবে না। যদি ঢুকে তাহলে সীমা লঙ্ঘনকারী বলে গণ্য হবে। এবং সেক্ষেত্রে গ্রীস তুরস্কের জাহাজ বা বিমানে আক্রমণ করবে।
আর তুরস্কের কথা হচ্ছে যেহেতু তুরস্ক ১৯৮২ সালের সেই চুক্তি স্বাক্ষর করেনি তাই ৬ নটিক্যাল মাইলকেই সীমানা ধরতে হবে। তাতেও কিন্তু বর্তমানে এই সাগরের ৪০% জল গ্রীসের অধীনে আছে। আর যদি গ্রীস তার জলসীমাকে ১২ নটিক্যাল মাইল বা ২২ কিলোমিটার করে নেয় তাহলে এজিয়ান সাগরের ৭০% পুরোপুরি গ্রীসের অধীনে চলে যাবে। তাতে আন্তর্জাতিক জলসীমা ৫১% থেকে কমে ১৯% এ নেমে আসবে। আর তুরস্কের অধীনে ওই সাগরের মাত্র ১০% জায়গা থাকবে। যেটা তুরস্ক কোন ভাবেই মানতে চাইছে না।
এখন তাহলে সমাধান কী?
তুরস্ক এই সমস্যার সমাধানে সমুদ্র বিষয়ক আন্তর্জাতিক আদালতে সুরহা চেয়ে আবেদন করেছে। অর্থাৎ কেস করেছে। কিন্তু গ্রীস এই আদালতে যেতে রাজি না।
এটা হচ্ছে সেই আদালত যেটি বাংলাদেশ এবং ভারতের সমুদ্রসিমা নির্ধারণে রায় দিয়েছিল। ওদিকে আবার লুজান চুক্তি অনুযায়ী গ্রীস তুরস্কের একেবারে ঘরের কাছে এসে ওই সব দ্বীপে সেনা ঘাঁটি করতে পারবে না, বলে তুরস্ক যে দাবি করছে সেটাও মানতে রাজি না গ্রীস।
এমনকি তুরস্কের অধীনে থাকা নতুন নতুন অনেক দ্বীপও দখল করে নিয়েছে বলে দাবি তুরস্কের। জনবসতি হীন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপেও গ্রীস বসতি গড়ে তুলছে, সামরিক ঘাঁটি গড়ছে এবং সেগুলোতে সেনা উপস্থিতি বাড়াচ্ছে।
এ কারণে এই দ্বীপগুলো ঘিরে অর্থাৎ এজিয়ান সাগর ঘিরে এখন দু দেশের মধ্যে উত্তেজনা চরমে। তুরস্ক বলছে গ্রীস যদি দখলকৃত দ্বীপগুলো ছেড়ে না দেয় ওই দ্বীপগুলো থেকে সামরিক উপস্থিতি সরিয়ে না নেয় এবং সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি অব্যাহত রাখে তাহলে তুরস্ক তার সামরিক শক্তি প্রয়োগ করবে। আবার গ্রীস বলছে তুরস্ক যদি ওই ১২ নটিক্যাল মাইলে ঢুকে তাহলে গ্রীস আক্রমণ করবে। ওদিকে আবার গ্রীস আমেরিকার কাছে নালিশ করেছে যে তুরস্ক সামরিক হুমকি দিচ্ছে, আমাদের সহযোগিতা করো। আমেরিকা গত দুই বছরে গ্রীসকে ব্যাপক আধুনিক অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করছে। বিশেষ করে f-35 যুদ্ধ বিমান এবং ট্যাঙ্ক।তুরস্কের সীমান্ত সংলঘ্ন অনেকগুলো সেনা ঘাঁটিতে প্রচুর অস্ত্র পাঠিয়েছে আমেরিকা। আবার তুরস্ককে এফ-৩৫ প্রকল্প থেকে বেড় করে দিয়েছে, এফ-১৬ যুদ্ধ বিমান কেনা প্রকল্প ঠেকিয়ে রেখেছে।
অন্যদিকে তুরস্ক তার নিজস্ব সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে মনোযোগ দিচ্ছে। বিশেষ করে নৌবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করছে। আর মানবহিনীর অস্ত্রেও যথেষ্ট মননিবেশ করছে।
ইতিমধ্যে এরদোয়ান গ্রীসের সাথে উচ্চ পর্যায়ের স্ট্রাটেজিক চুক্তি বাতিল করার ঘোষণা দিয়েছে। গ্রীস তাদের সেনাদেরকে তুর্কী বিরোধী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবার নির্দেশ দিয়েছে। অর্থাৎ এজিয়ান সাগরের পানি আস্তে আস্তে উত্তপ্ত হচ্ছে।
২০০ বছর আগে যেমন রাশিয়া প্রথম ক্রাইমিয়া দখল করে গ্রীকদেরকে উসমানীয়দের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়েছিল এবং পরবর্তীতে তাতে যোগ দিয়েছিল ব্রিটেন এবং ফ্রান্স। এখনো কি রাশিয়া ক্রাইমিয়া এবং ইউক্রেনের একটা অংশ দখল করে আমেরিকা ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের সাথে একজোট হয়ে গ্রীসকে উস্কানি দিয়ে তুরস্কের বিরুদ্ধে নতুন যুদ্ধের কোন পাঁয়তারা করছে কিনা? ওদিকে আবার সিরিয়ার বর্ডারে পিকেকে সন্ত্রাসীদেরকেও কিন্তু রাশিয়া এবং আমেরিকা সাপোর্ট দিচ্ছে। তাহলে কি ২০০ বছর আগের সেই ইতিহাসেরই পুনরাব্রিতি হতে যাচ্ছে? বেঁচে থাকলে দেখা যাবে।আজ তাহলে এই পর্যন্তই ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন আল্লাহ হাফেজ।