বর্তমানে সারা বিশ্বে এমন কিছু দেশ রয়েছে, যারা একেবারে শুন্য হাতে স্বাধীন হয়ে ২০০০ সালের পূর্বেই উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর কাতারে পৌঁছে গেছে। এই উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া এবং সিঙ্গাপুর হচ্ছে অন্যতম দুটি দেশ। বিশেষ করে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দিক দিয়ে উন্নয়নশীল দেশের জন্য রোল মডেল হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের শান্তিপ্রিয় একটি দেশ দক্ষিণ কোরিয়াকে।
২৫শে জুন ১৯৫০ সাল থেকে ২৭শে জুলাই ১৯৫০ সাল পর্যন্ত চলমান অত্যন্ত প্রাণঘাতী ও ভয়াবহ যুদ্ধের কারণে দক্ষিণ কোরিয়ার ভৌত অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা একেবারেই ধ্বংস হয়ে যায়। অথচ হাজারো সমস্যা ও ধ্বংসস্তুপের উপর উন্নয়নের অগ্রযাত্রা শুরু করে মাত্র তিন দশকেই বিশ্বমঞ্চে নিজের যোগ্য স্থান করে নিয়েছে দেশটি। আজ এক বিংশ শতাব্দীর ২০২২ সালে এসে দক্ষিণ কোরিয়ার সুপরিকল্পিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনী সক্ষমতা দেখলে যে কেউ অবাক হতে বাধ্য।
বর্তমানে প্রায় ৫ কোটি ১৪ লক্ষ জনসংখ্যার দেশ দক্ষিণ কোরিয়ার নমিনাল জিডিপির আকার ১,৮৬০ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সাল থেকে চলমান করোনা মহামারী ও বৈশ্বিক মহামন্দার মধ্যেও চলতি ২০২২ সালের জুন মাসের হিসেব অনুযায়ী দেশটির হাতে ৪৩৮.২৮ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মজুত ছিল। দেশটি ২০২১ সালে সারাবিশ্বে মোট পন্য রপ্তানি করে ৬৪৪.৫৪ বিলিয়ন ডলার এবং একই সময়ে সারা বিশ্ব থেকে পন্য ও রপ্তানি পন্যের কাঁচামাল আমদানি করে মোট ৬১৫.১ বিলিয়ন ডলার। সে হিসেবে দেশটি ২০২১ সালে মোট বৈদেশিক বানিজ্যে ২৯.৪৪ বিলিয়ন ডলারের পজিটিভ ট্রেডিং ব্যালেন্স অর্জন করে।
তাছাড়া দেশটি কিন্তু বিগত কয়েক দশক থেকে সুপরিকল্পিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি মেধার যথাযথ ব্যবহার ও কঠোর পরিশ্রম করে বিশ্ব মানের কিছু ব্রান্ড, কর্পোরেশন বা গ্রুপ অব কোম্পানি গড়ে তুলেছে। যার মধ্যে এলিজি, স্যামস্যাং, হুন্দাই, দাইউ হেভী ইন্ডাস্ট্রিজ এর মতো বিশ্ব বিখ্যাত কিছু ব্রান্ড বা কোম্পানি দক্ষিণ কোরিয়ার গর্বের প্রতীক হিসেবে বিশ্বের কাছে নিজ দেশের পরিচয় তুলে ধরেছে। প্রতি বছর দেশটির বিশ্ব মানের ব্রান্ডের কোম্পানি বা কর্পোরেশনগুলো সারা বিশ্বে বানিজ্য করে নিজেরা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার মুনাফা অর্জন করার পাশাপাশি নিজ দেশ এবং সরকারকে অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা করে যাচ্ছে।
বর্তমানে বিশ্বে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন, গবেষোণা ও উন্নয়নে আমেরিকা এবং চীন শত বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করলেও এ খাতে বিনিয়োগে শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে উঠে এসেছে দক্ষিণ কোরিয়ার নাম। দক্ষিণ কোরিয়া বর্তমানে সরকারী এবং বেসরকারীভাবে প্রতি বছর প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি অর্থ বিনিয়োগ করে শুধু নতুন নতুন প্রযুক্তি পন্য ও সেবা উদ্ভাবন, গবেষণা, ডিজাইন ও তৈরিতে। এ কাজে তারা দেশের বড় বড় কর্পোরেশন এবং গ্রুপ অব কোম্পানির মাধ্যমে নিজস্ব গবেষণার পাশাপাশি দেশের সেরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যায়গুলোর সাথে সমন্বয় করে কাজ করে থাকে এবং এ খাতে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে।
এ মুহুর্তে আপনার বা আমার হাতে থাকা স্যামস্যাং এর লেটেস্ট মডেলের স্মার্টফোন এবং ট্যাবের কোন সূক্ষ্ম প্রযুক্তি, যন্ত্রাংশ কিংবা ডিভাইস ডিজাইন করা হয়েছে হয়ত দক্ষিণ কোরিয়ারই কোন এক প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে। যেখানে কার্যত কাজ করেন সম্মিলিতভাবে সম্মানিত শিক্ষক, গবেষক এবং মেধাবী শিক্ষার্থীরা।
এদিকে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক কিউএস ওয়াল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং ২০২৩ গত জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশ করে। এই র্যাংকিং বা তালিকায় সারা বিশ্বের মোট ১,৪২২টি বিশ্ববিদ্যায়ের নাম স্থান পায়। তবে বিশ্বের সেরা এলিট ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় আমেরিকা এবং যুক্তরাজ্যের ব্যাপক আধিপত্য থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশ চীনের ৬টি, জাপানের ৪টি, দক্ষিণ কোরিয়ার ৬টি, তাইওয়ানের ১টি এবং সিঙ্গাপুরের ২টি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম স্থান পেয়েছে। যদিও বিশ্বের সেরা ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার কোন দেশেরই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম স্থান পায়নি।
বিশ্বের সেরা ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ৮২.২ পয়েন্ট নিয়ে ২৯ তম স্থানে, কোরিয়ান এডভান্স ইউনিস্টিটিউট অব সাইন্স এণ্ড টেকনোলজি ৭৯.৩ পয়েন্ট নিয়ে ৪২ তম স্থানে এবং ৬৭.৭ পয়েন্ট নিয়ে পোহ্যাং ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স এন্ড টেকনোলজি রয়েছে ৭১ তম স্থানে। আর এ থেকেই দেশটির আধুনিক এবং বিশ্ব মানের প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার পরিচয় খুবই স্পষ্টভাবেই ফুঁটে উঠেছে।
বিগত তিন দশক থেকে আমেরিকার কাছ থেকে ধার করা প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের প্রথম সারির অনেক দেশকে পেছনে ফেলে দক্ষিণ কোরিয়া এবার একেবারেই নিজস্ব প্রযুক্তির কেএআই কেএফ-২১ নেক্সট জেনারেশন ফাইটার জেট বিশ্বের সামনে উন্মোচন করেছে। গত ১৯শে জুলাই দক্ষিণ কোরিয়া তাদের নিজস্ব প্রযুক্তির তৈরি নতুন প্রজন্মের কেএফ-২১ যুদ্ধবিমানের প্রথম সফল ফ্লাইট টেস্ট সম্পন্ন করে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। অবশ্য নতুন প্রজন্মের এই যুদ্ধবিমান প্রজেক্টে দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে যৌথভাবে অর্থ বিনিয়োগ করেছে ইন্দোনেশিয়া। মুলত দক্ষিণ করিয়ার নতুন প্রজন্মের কেএফ-২১ যুদ্ধবিমানের তৈরিতে কাজ করছে কোরিয়ান এ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ (কেএআই) এবং ইন্দোনেশিয়ান এ্যারোস্পেস।
১৯৯৪ সাল থেকে দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লকহীড মার্টিন কর্পোরেশনের লাইসেন্স নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ান এ্যারোস্পেস ইণ্ডাস্ট্রিজ (কেএআই) এর সাথে সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্যামস্যাং এ্যারোস্পেস, দাইউ হেভী ইন্ডাস্ট্রিজ এবং হুন্দাই স্পেস এণ্ড এয়ারক্রাফট কোম্পানি যৌথভাবে এবং অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সিঙ্গেল ইঞ্জিনের এফ-১৬ ফাইটার জেটের ব্ল-৫২ গ্রেডের একেবারে নিজস্ব ভার্সন কেএফ-১৬ যুদ্ধবিমান ম্যানুফ্যাকচারিং করে। আবার এই প্রযুক্তিগত সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেরাই কিন্তু টি-৫০ সিরিজের লাইট কমব্যাট এয়ারক্রাফট এবং এডভান্স জেট ট্রেইনার ডিজাইন ও তৈরি করছে সেই ২০০২ সাল থেকে। যা হোক সুসম সম্পদ বন্টন এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নে বিশ্বের উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ভালো কিছু শেখার ও অনুসরণ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় লুকিয়ে রয়েছে।
সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক ও লেখক, গ্রামঃ ছোট চৌগ্রাম, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com