ইন্দোনেশিয়া সাম্প্রতিক সময়ে ফ্রান্সের কাছ থেকে ২.৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ১৮টি হাইলি এডভান্স রাফায়েল (এফ-৪) সিরিজের যুদ্ধবিমান ক্রয়ের চুক্তি সম্পন্ন করেছে। তাছাড়া ইন্দোনেশিয়া গত ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ১.১ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে প্রথম ধাপে ৬টি একই সিরিজের এডভান্স রাফায়েল যুদ্ধবিমান ক্রয়ের চুক্তি করেছিল। যদিও ইন্দোনেশিয়ার বিমান বাহিনী পর্যায়ক্রমে মোট ৪২টি রাফায়েল টুইন ইঞ্জিন ফাইটার জেট সার্ভিসে আনার পরিকল্পনা করেছে এবং ফ্রান্সের ডেসাল্ট এভিয়েশন কর্পোরেশন খুব সম্ভবত আগামী ২০২৭ সাল থেকে এই যুদ্ধবিমান সরবরাহ শুরু করবে।

বর্তমানে রাফায়েল জেট ফাইটার অপারেট করার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ১০২টি রয়েছ ফ্রান্সের বিমান বাহিনীতে। তাছাড়া ভারত ৩৬টি মিশর ২৪টি, কাতার ২৭টি (আরো ৯টি অর্ডার করা আছে) এবং গ্রীস ১৮টি রাফায়েল জেট ফাইটার অপারেট করে। তবে চলিতি বছরেই সংযুক্ত আরব আমিরাত ৮০টি, মিশর ৩০টি এবং ইন্দোনেশিয়া ৪২টি রাফায়েল জেট ফাইটার ক্রয়ের চুক্তি সম্পন্ন করেছে।

আসলে ফ্রান্সের ডেসাল্ট এভিয়েশনের তৈরি রাফালে ৪++ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান হিসেবে ইউরোফাইটার তাইফুন, রাশিয়ার এসইউ-৩৫ এবং মার্কিন এফ-১৫এক্স এর পাশাপাশি সবার উপরে রয়েছে রাফালের নাম। তাছাড়া ফ্রান্স কিন্তু অনেক আগেই ইউরোফাইটার তাইফুন প্রজেক্ট থেকে বের হয়ে গিয়ে একেবারে নিজস্ব উচ্চ প্রযুক্তির হাইলি এডভান্স রাফায়েল জেট ফাইটার সার্ভিসে আনে।

রাফায়েল সিরিজের যুদ্ধবিমানের প্রধান অস্ত্র হিসেবে ৪ ম্যাক গতির ১১০ কিলোমিটার পাল্লার মেটওর ও মিকা এয়ার টু এয়ার (বিভিআর) মিসাইলের পাশাপাশি ম্যাজিক-২ এয়ার টু এয়ার মিসাইল অপারেট করে। এদিকে আকাশ থেকে ভূমিতে হামলা চালানোর উপযোগী এসসিএএলপি-ইজি ও হাম্মার এয়ার টু গ্রাউণ্ড মিসাইল সিস্টেম ব্যবহার করা হয়। হাম্মার বা Highly Agile Modular Munition Extended Range (HAMMER) হচ্ছে একটি মধ্যম পাল্লার গ্রাউণ্ড এ্যাটাক মিসাইল সিস্টেম। তাছাড়া এয়ার লঞ্চড বেসড এএম-৩৯ এস্কোট এন্টিশীপ মিসাইল এতে ইনস্টল করা হয়। প্রয়োজনে এতে এএসএমপি-এ নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড ক্যাপবল মিসাইল বহন করতে সক্ষম।

এদিকে ফ্রান্সের ডেসাল্ট এভিয়েশন কর্পোরেশন হাইলি আপগ্রেড করে রাফায়েল সিরিজের ক্যারিয়ার বেসড ভার্সন রাফায়েল-এম যুদ্ধবিমান বিশ্বের সামনে প্রকাশ করেছে। এই সিরিজের মাল্টিরোল যুদ্ধবিমানের ম্যাক্সিমাম পেলোড ক্যাপাসিটি ৯.৫ টন। তাছাড়া বর্ধিত রেঞ্জের এয়ার কমব্যাট মিশন পরিচালনা করার জন্য এই সিরিজের যুদ্ধবিমানে অতিরিক্ত ৬.৭ টন ওজনের তিনটি ৫২৪ গ্যালন (২ হাজার লিটার) জ্বালানী ট্যাঙ্কও বহন করে। এই জ্বালানি ট্যাঙ্কগুলি আবার অন্যান্য এরিয়াল সিস্টেমে রিফুয়েলিং এ ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি কিন্তু নেভাল স্ট্রাইক মিশনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ভূমিকা পালন করে।

ফ্রান্সের রাফাল-এম সিরিজের যুদ্ধবিমানের ১৩টি হার্ডপয়েন্টে মিকা ও স্ক্যাল্প ক্রুজ মিসাইলের পাশাপাশি মেটওর এয়ার টু এয়ার (বিভিআর) মিসাইল এবং গ্রাউন্ড এ্যাটাক হ্যাম্মার এয়ার টু গ্রাউন্ড মিসাইল বহন করে। তাছাড়া অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে জিইউবি-১২/২৪ লেজার-গাইডেড বোম্বস, এএস-৩০এল, মার্ক-৮২ জিইউবি-৪৯ জিপিএস গাইডেড বোম্বস ব্যবহার করে। তাছাড়া মেরিটাইম স্ট্রাইক মিশনের জন্য রাফায়েল-এম যুদ্ধবিমান এয়ার লঞ্চড বেসড এক্সোসেট এএম-৩৯ ব্লক-২ অ্যান্টি-শিপ মিসাইল বহন করতে পারে।

এখানে প্রকাশ থাকে যে, গত ২০২০ সালের জুলাই কিংবা আগস্ট মাসে লিবিয়ায় থাকা তুরস্কের সামরিক ঘাঁটিতে খুব সম্ভবত ফ্রান্সের তৈরি বেশকিছু রাফাল জেট ফাইটার এয়ার স্টাইক চালিয়ে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে একেবারেই নিরাপদে পালিয়ে যায়। তাছাড়া গত ২০১০ সালের দিকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে লিবিয়ার তৎকালীন গাদ্দাফি সামরিক বাহিনীর এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম এবং যুদ্ধবিমান ধ্বংস করে বিশ্ব মিডিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল ফ্রান্সের ড্যাসাল্ট রাফায়েল যুদ্ধবিমান। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যৌথভাবে ইরাক এভং সিরিয়ায় অসংখ্য বার কমব্যাট এয়ার মিশনে সফলতার সাথে অংশগ্রহণ করে।

ইন্টারনেটের একাধিক সূত্রে ফ্রান্সের রাফায়েল জেট ফাইটারের পার ইউনিট কস্ট ৮০ থেকে ৯০ মিলিয়ন ডলার দেখানো হলেও বাস্তবে এর দাম কিন্তু ওয়েপন্স, লজিস্টিক সাপোর্ট এন্ড ট্রেনিং প্যাকেজসহ ২০০ মিলিয়ন ডলারের অধিক হয়ে যায়। আবার এর পার আওয়ার ফ্লাইট এন্ড অপারেটিং কস্ট প্রায় ১৮ হাজার ডলার। যেখানে কিনা মার্কিন এফ-৩৫ স্টেলথ জেট ফাইটারের পার আওয়ার অপারেটিং কস্ট প্রায় ৩৬ হাজার ডলার এবং ইউরোপের মাল্টিনেশন প্রজেক্ট ইউরোফাইটার তাইফুন জেট ফাইটারের পার আওয়ার অপারেটিং কস্ট ১৬-১৮ হাজার ডলার দেখানো হয়েছে।

বর্তমান যুগে আধুনিক যুদ্ধবিমানের রাডার ক্রস সেকশন বা (আরসিএস)-কে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে দেখা হয়। যে যুদ্ধবিমানের আরসিএস যতই কম হবে তা শত্রু পক্ষের রাডারে যুদ্ধবিমান সনাক্ত করাটা ততই জটিল ও কঠিন একটি কাজ হবে। তাই আরসিএস সক্ষমতার বিবেচনায়, আমেরিকার চতুর্থ প্রজন্মের এফ-১৬ সিরিজের যুদ্ধবিমানের আরসিএস ৩-৫ স্কোয়ার মিটার। যেখানে ইউরোফাইটার তাইফুনের আরসিএস ০.৫ স্কোয়ার মিটার এবং এডভান্স রাফায়েল জেট ফাইটারের আরসিএস ১.০ স্কোয়ার মিটার দেখানো হয়েছে। আবার মার্কিন বোয়িং কর্পোরেশনের ৪.৫ জেনারেশনের এফ/এ-১৮ সুপার হর্নেট যুদ্ধবিমানের আরসিএস ১ স্কোয়ার মিটার। এদিক থেকেও রাফায়েল জেট ফাইটার কিন্তু অনেকটাই এগিয়ে থাকবে।

এদিকে ফ্রান্সের ড্যাসাল্ট এভিয়েশন কর্পোরেশনের তরফে জানানো হয়েছে যে, রাফায়েল জেট ব্যবহারকারী দেশগুলোকে আগামী ২০৭০ সাল পর্যন্ত রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত, সার্ভিসিং এর পাশাপাশি প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্ট ও স্পেয়ার পার্টস সরবরাহের বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত করা হবে। তাছাড়া আগামী ২০৩৫ থেকে ২০৪০ এর মধ্যেই ৬ষ্ঠ প্রজন্মের অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান Future Combat Air System (FACS) উৎপাদনে যেতে এক রকম বদ্ধপরিকর ফ্রান্সের দ্যাসাল্ট এভিয়েশন কর্পোরেশন। সে সময় ফ্রান্স নিজেদের বহর থেকে রাফালে যুদ্ধবিমান অবসরে পাঠানো শুরু করবে। তবে বাকি ক্রেতারা যাতে নিশ্চিন্তে দীর্ঘ মেয়াদে রাফালে উড়িয়ে যেতে পারে সে জন্য আরও ২টি বড় ধরনের আপগ্রেড প্যাকেজ পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ফ্রান্স।

সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক ও লেখক, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com