সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে তুরস্কের নিজস্ব প্রযুক্তির তৈরি ‘টিসিজি আনাদুল’ লাইট এয়ার ক্রাফট ক্যারিয়ার (মাল্টি-পারপাস এ্যাম্ফিবিয়াস এ্যাসাল্ট শিপ) তুর্কী নৌবাহিনীতে কমিশনিং লাভ করেছে। তার সাথে এটি হচ্ছে তুরস্কের সর্ব বৃহৎ আকারের ড্রোন ক্যারিয়ার ফ্লাগশীপ জাহাজ।তবে এটিতে প্রচলিত এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের মতো কোন ফিক্সড উইংস যুদ্ধবিমান আপাতত অপারেট করবে না তুরস্কের নৌবাহিনী। তবে এর বিকল্প হিসেবে তুরস্কের ফিক্সড উইংস যুদ্ধবিমানের পরিবর্তে বিভিন্ন সিরিজের কমব্যাট, রিকর্নিসেন্স এন্ড সার্ভেলাইন্স ড্রোন ও বিভিন্ন সিরিজের এডভান্স হেলিকপ্টার অপারেট করার উপযোগী করে ক্যারিয়ারটিকে মডিফাইড করে নিয়েছে তুরস্ক।

টিসিজি আনাদুলু (এল-৪০০) লাইট কমব্যাট এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারে বর্তমানে প্রায় শতাধিকের কাছাকাছি ‘আলতাই’ মেইন ব্যাটল ট্যাংক ও ‘জাহা’ সামরিক যান পরিবহনের পাশাপাশি পাইলট বিহীন এরিয়েল সিস্টেম যেমন ‘কিঝিলএলমা’ ও বায়রাক্তার টিবি-৩ কমব্যাট ড্রোন (ইউসিএভি) অপারেট করবে। তাছাড়া এই ক্যারিয়ারে এস-৭০বি সী-হক হেলিকপ্টারসহ এএইচ-১ডাব্লিউ সুপার কোবরা ও টি-১২৯ এ্যাটাক হেলিকপ্টার বহন করার বিশেষ উপযোগী করে ডিজাইন করেছে তুরস্ক। ঠিক এই কারণেই বর্তমানে এটিকে বলা হচ্ছে বিশ্বের প্রথম কোন সুপার ড্রোন ক্যারিয়ার। তাছাড়া টিসিজি আনাদুলু (এল-৪০০) লাইট কমব্যাট এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারে ৩০ শয্যা বিশিষ্ট একটি মিনি হাসপাতাল ও ২টি অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটার স্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া এটিতে একই সাথে ১,৪৩৩ জন সেনা ও ক্রু অবস্থান করতে পারবেন।

‘টিসিজি আনাদুলু’ (ল্যান্ডিং হেলিকপ্টার ডক) লাইট কমব্যাট এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারটি তুরস্কের নিজস্ব চাহিদা ও কাস্টমাইজড অনুযায়ী তৈরি ও ডিজাইন করা হয়েছে। তুরস্কের ইস্তাম্বুল ভিত্তিক সাদেফ শিপ বিল্ডিং ইন-কর্পোরেশন এটি ডিজাইন ও তৈরি করলেও এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করতে প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করেছে স্পেনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ‘নাভান্তিয়া’ শীপ বিল্ডিং কোম্পানি। এটিকে প্রথমে মার্কিন লকিহীড মার্টিন কর্পোরেশন তৈরি এফ-৩৫ স্টেলথ জেট ফাইটার অপারেটের উপযোগী করে বেশ শক্তপোক্ত ভাবেই তৈরি করে তুরস্ক। যদিও রাশিয়ার এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয়ের কারণে সাবেক মার্কিন ট্রাম্প প্রশাসন ২০১৯ সালের দিকে তুরস্ককে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান প্রজেক্ট থেকে বাদ দেয়।

তুরস্কের নৌবাহিনী ১লা জুন ২০১৫ সালে এরদোয়ান সরকারের কাছে একটি লাইট এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার সংযুক্তির জন্য আবেদন করে। এটি মুলত ডিজাইন ও নির্মান করছে তুরস্ক ভিত্তিক সেদেভ শীপবিল্ডিং কর্পোরেশন। এর নির্মাণ কাজ শুরু করা হয় ২০১৫-১৬ সালে এবং প্রথম লঞ্চড করা হয় ৩০শে এপ্রিল ২০১৯ সালে। দীর্ঘ প্রায় ৪ বছর ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করার পাশাপাশি নতুন করে বেশ কিছু প্রযুক্তি সংযোজন ও মডিফাইড সম্পন্ন করে পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক চলতি ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে তুর্কী নৌবাহিনীতে চূড়ান্তভাবে কমিশনিং লাভ করল। মূলত পশ্চিমা বিশ্বের শত বাধা ও চরম সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তুরস্ক তার নিজের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও সক্ষমতা বিশ্বের সামনে উন্মোচন করেছে।

তাছাড়া ২৭,৪৩৬ টন ওজনের এই লাইট এয়ারক্রাফটের প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপাদনের জন্য এটিতে ৫টি স্পেনের নাভান্তিয়া ম্যান ডিজেল ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে। যার প্রতিটি ইঞ্জিন ৮ হাজার কিলোওয়াট (১১ হাজার হর্স পাওয়ার) শক্তি উৎপন্ন করে। তার পাশাপাশি জার্মানির দুটি ১৫ হাজার হর্স পাওয়ার (১১ মেগাওয়াট) সক্ষমতার সিমেন্স (SiPOD) পাওয়ার জেনারেটর সিস্টেম এবং দুটি ২ হাজার হর্স পাওয়ার শক্তি উৎপন্ন করার উপযোগী পাওয়ার জেনারেশন সিস্টেম ইনস্টল করা হয়েছে।

২৩২ মিটার দৈর্ঘ্যের এই লাইট এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে ১টি আরএএম, ২টি ফ্যালানেক্স সিআইডাব্লিউএস এবং ৫টি ২৫ এমএম এ্যাসেলসান কোম্পানির তৈরি এসটিওপি আরসিডাব্লিউএস ডিফেন্স সিস্টেম ইনস্টল করা হয়েছে। এই ক্যারিয়ারের ম্যাক্সিমাম রেঞ্জ ৯ হাজার কিলমিটার এবং এটি প্রতি ঘন্টায় ২১ নটিক্যাল মাইল গতিতে সাগরের বুকে ছুটে চলতে সক্ষম। ক্যারিয়ারে একইসাথে আনুমানিক ১০টি হেলিকপ্টার ও ৫০টি কমব্যাট এন্ড নন-কমব্যাট বহন ও নিয়ন্ত্রন করা যাবে বলে মনে করে তুর্কী নৌবাহিনী। সর্বশেষ এটা বললে ভূল হবে না যে, সাম্প্রতিক সময়ে ‘টিসিজি আনাদুলু’ লাইট এয়ার ক্রাফট ক্যারিয়ার নৌ বহরে যুক্ত করে ভূমধ্যসাগরে একটি ত্রিমাত্রিক ও অত্যন্ত শক্তিশালী নৌবাহিনী নিয়ে আত্মপ্রকাশ করল তুরস্ক।

এই লাইট ক্যারিয়ারটিকে খুব সম্ভবত আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই গভীর সমুদ্রে কমব্যাট মিশনে প্রেরণ করতে যাচ্ছে তুর্কী নৌবাহিনী। বর্তমানে তুরস্কের নৌবাহিনীতে মোট যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিন অপারেশনাল রয়েছে ১৪৫টি। যার মধ্যে ১টি হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার, ১২টি সাবমেরিন, ১৬টি ফ্রীগেট, কর্ভেট ৯টি, ১৮টি ফাস্ট এ্যাটাক ক্রাফট, এ্যাম্ফিবিয়াস ওয়ারফার শীপ ৩৬টি এবং অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ছোট বড় মিলিয়ে শীপ রয়েছে মোট ৫৪টি। তাছাড়া চলতি ২০২৩ সাল থেকে আগামী ২০২৮ সালের মধ্যে প্রতি বছর ১টি করে অত্যাধুনিক ও উচ্চ প্রযুক্তির টাইপ-২১৪টিএন সিরিজের এডভান্স সাবমেরিন সার্ভিসে আনবে তুর্কী নৌবাহিনী।

Sherazur Rahman