হাইপারসনিক গতির এরিয়াল সিস্টেম ডিজাইন ও ইঞ্জিনিয়ারিং এ রাশিয়া, চীন এবং আমেরিকার মধ্যে ব্যাপক মাত্রায় প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। তবে মার্কিন বিমানবাহিনী সাম্প্রতিক সময়ে জানিয়েছে যে, গত দুই সপ্তাহ আগে তাদের একটি উচ্চ প্রযুক্তির এজিএম-১৮৩এ হাইপারসনিক মিসাইল পরীক্ষা ব্যর্থ হয়ে গেছে। মূলত আকাশে বি-৫২ হেভি স্ট্যাটিজিক বোম্বার বিমান থেকে মিসাইলটি ফায়ার করলে এর সাথে যোগাযোগ বা নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

এক হাজার মাইল রেঞ্জের এজিএম-১৮৩এ হাইপারসনিক মিসাইলটি প্রযুক্তিগত কিছু ত্রুটির কারণে অষ্টম বারের মতো পরীক্ষামূলক ফ্লাইট টেস্টে সফল হতে পারেনি। যার ফলে হাইপারসনিক গতির প্রযুক্তি উদ্ভাবনের প্রতিযোগিতায় আমেরিকা কিন্তু এক রকম নিশ্চিতভাবেই রাশিয়া ও চীনের অনেকটাই পেছনে পড়ে গেল। হাইপারসনিক টেকনোলজি উন্নয়ন ও এ প্রজেক্ট বাস্তবায়নে মার্কিন প্রশাসন অনেক আগেই ৫ বিলিয়ন ডলারের অধিক অর্থ বরাদ্দ দিয়েছিল।

তবে এয়ার লঞ্চড বেসড এ্যারো ব্যালেস্টিক হাইপারসনিক মিসাইল পরীক্ষায় এ পর্যন্ত ৮ বার সফল হতে না পারলেও অদূর ভবিষ্যতে হাইপারসনিক মিসাইলের আরও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা সম্পন্ন করবে আমেরিকার বিমানবাহিনী। তাছাড়া তবে কিছুটা দেড়িতে হলেও বিশ্বের এক নম্বর সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করেছে হাইপারসনিক গ্লাইড বডি (সি-এইচজিবি) সিরিজের এডভান্স হাইপারসনিক মিসাইল সিস্টেম। যার গতি হবে কিনা অবিশ্বাস্যভাবে প্রায় ১৭.০ ম্যাক। যদিও আমেরিকার এই প্রজেক্টও এখনো পর্যন্ত গবেষণা ও উন্নয়নের স্তরে রয়েছে।

হাইপারসনিক গতির প্রযুক্তি অর্জনে এখনো পর্যন্ত সারা বিশ্বের মধ্যে মাত্র ৬টি দেশ নিজেদের মধ্যে প্রবল প্রতিযোগিতা করে যাচ্ছে। যার মধ্যে আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ইরান, উত্তর কোরিয়া এবং ভারতের নাম উঠে এসেছে সবার উপরে। যদিও চূড়ান্তভাবে সফল হয়েছে শুধুমাত্র রাশিয়া ও চীন। আবার একেবারে বাস্তব যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের দিক দিয়ে একমাত্র সফল দেশ হচ্ছে রাশিয়া। ভারত, ইরান ও উত্তর কোরিয়া এই জাতীয় প্রযুক্তির সফল পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে বলে দাবি করলেও তারা কিন্তু এখনো পর্যন্ত হাইপারসনিক টেকনোলজি উদ্ভাবন ও গবেষণার ডেভলপমেন্ট স্তরে রয়েছে। অথচ এশিয়া ও ইউরোপের অনেক উন্নত ও প্রযুক্তি সমৃদ্ধ দেশ কিন্তু আজ অব্ধি হাইপারসনিক মিসাইল টেকনোলজি অর্জন করতে পারেনি।

রাশিয়া মূলত দুই ক্যাটাগরির হাইপারসনিক মিসাইল বিশ্বের সামনে উন্মোচন করেছে। প্রথমটি এয়ার লঞ্চড বেসড ম্যাক ১০ বা প্রতি ঘন্টায় ১২,৩০০ কিলোমিটার গতির ‘কিনঝাল’ (কেএইচ-৪৭এম২) হাইপারসনিক ব্যালেস্টিক মিসাইল। তাছাড়া দ্বিতীয়টি হলো যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিন ভিত্তিক ‘জিরকন’ হাইপারসনিক ক্রুজ মিসাইল। ১ হাজার কিলোমিটার রেঞ্জের স্ক্যামজেট ইঞ্জিন চালিত রাশিয়ার ‘জিরকন’ ক্রুজ মিসাইলের সর্বোচ্চ গতি হচ্ছে ৯.০ ম্যাক বা ১১,০২৫ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ২০২৩ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত রাশিয়া প্রায় এক ডজনের কাছাকাছি ‘কিনঝাল’ হাইপারসনিক ব্যালেস্টিক মিসাইল ইউক্রেনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাটি ও স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে।

এদিকে আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দিয়ে চীন তৈরি করেছে তার নিজস্ব উচ্চ প্রযুক্তির এয়ার লঞ্চড বেসড ১০.০ ম্যাক গতির সিএইচ-এএস-এক্স-১৩ হাইপারসনিক মিসাইল সিস্টেম। তাছাড়া বর্তমানে অপারেশনাল থাকা বিভিন্ন দেশের তৈরি হাইপার বা সুপারসনিক মিসাইলের গতি সৃষ্টির জন্য কিন্তু র‍্যামজেট বা স্ক্যামজেট ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়। তবে চীনের নিজস্ব প্রযুক্তির তৈরি ডিএফ-১৭ হাইপারসনিক মিসাইল গ্লাইড করে গ্রাভিটিকে কাজে লাগিয়ে অবিশ্বাস্য গতি অর্জন করে।

এদিকে চলতি ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতের ডিফেন্স রিসার্চ এন্ড ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ডিআরডিও) এর নিজস্ব প্রযুক্তির তৈরি নতুন প্রজন্মের হাইপারসনিক মিসাইল বা হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকল (এইচজিভি) সিস্টেমের সফল পরীক্ষা চালিয়ে উচ্চ প্রযুক্তির এলিট শ্রেণীর নতুন প্রতিযোগিতায় নিজেকে সামিল করে নেয়। আর স্ক্যামজেট ইঞ্জিন চালিত ভারতের নতুন প্রযুক্তির এই হাইপারসনিক এরিয়াল সিস্টেমের গতি ছিল প্রায় ম্যাক ৬ বা ৭,৪০৮.৮ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা। যদিও ভারত কিন্তু এর আগেও হাইপারসনিক মিসাইল বা এরিয়াল সিস্টেমের গুরুত্বপূর্ণ সফল পরীক্ষা চালিয়েছিল।

হাইপারসনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ দেশগুলো এখন পর্যন্ত তিন ধরনের হাইপারসনিক এরিয়াল সিস্টেম নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। প্রথমটি হাইপারসনিক অ্যারো ব্যালিস্টিক মিসাইল। এই জাতীয় মিসাইল যুদ্ধবিমান ও হেভি স্ট্যাটিজিক বোম্বার বিমান থেকে ফায়ার করা হয়। যেমন রাশিয়ার কেএইচ-৪৭এম২ ‘কিনঝাল’ একটি একটি হাইপারসনিক অ্যারো ব্যালিস্টিক মিসাইল।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকল (এইচজিভি)। এই জাতীয় মিসাইল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইলের মতো ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেক উচ্চতায় নিক্ষেপ করা হয়। প্রয়োজনীয় উচ্চতায় পৌঁছে এটি নিচু হয়ে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে টার্গেটের দিকে ধেয়ে যায়। এই জাতীয় মিসাইল সিস্টেম প্রয়োজনে ভেসে থাকতে (গ্লাইড করতে) পারে এবং লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার আগে গতি বাড়াতে-কমাতে কিংবা দিক পরিবর্তন করতে পারে। তাছাড়া তৃতীয় শ্রেণির হাইপারসনিক মিসাইল সিস্টেমটি হচ্ছে হাইপারসনিক ক্রুজ মিসাইল (এইচসিএম)। এটিকে হাইব্রিড র‍্যামজেট বা স্ক্যামজেট ইঞ্জিন দ্বারা চালিত করা হয় এবং এটি প্রয়োজনে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে টার্গেটের দিকে যাত্রাপথ কিছুটা পরিবর্তন করতে পারে।

Sherazur Rahman