বিশ্বের এভিয়েশন জায়ান্ট মার্কিন বোয়িং ও ইউরোপের এয়ারবাসের সাথে পাল্লা দিতে চীন তৈরি করেছে নিজস্ব প্রযুক্তির সি-৯১৯ প্যাসেঞ্জার জেট লাইনার। চীনের কমার্শিয়াল এয়ারক্র্যাফ্ট কর্পোরেশন অব চায়না (সিওএমএসি) এর সি-৯১৯ যাত্রী পরিবহন বিমানটি ইতোমধ্যেই চীনের অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রী পরিবহনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। চীন মনে করে যে, বর্তমানে বিশ্বের কিছু দেশ তাদের বিমান বহরে এই নতুন সিরিজের হাইলি এডভান্স জেট লাইনার সংযোজনের বিষয়টি বিবেচনা করছে।

চীনের সর্ববৃহৎ বিমান সেবা প্রদানকারী সংস্থা ‘চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইন্স’ কাছে গত ২০২২ সালের ৯ই ডিসেম্বর একটি সি-৯১৯ইআর প্যাসেঞ্জার জেট লাইনার হস্তান্তর করা হয়। তাছাড়া বর্তমানে তাদের বিমান বহরে প্রায় ৮০০টি বিভিন্ন ক্যাটাগরির যাত্রী পরিবহন বিমান অপারেশনাল রয়েছে। সংস্থাটি বিশ্ব মানের এয়ারলাইন্স সংস্থার সাথে পাল্লা দিতে আগামী ২০৩০-৩৫ সালের মধ্যে তাদের বহরে থাকা পুরনো সকল বিমান রিপ্লেস করে নতুন প্রজন্মের এবং আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত বিমান সার্ভিসে আনতে চায়।

তবে আন্তর্জাতিক রুটে চীনের তৈরি বিমান খুব সহজে স্থান পাওয়া নিয়ে সন্দেহ থাকলেও দেশটির অভ্যন্তরীণ এয়ার রুটের বিশাল চাহিদা থাকায় অদূর ভবিষ্যতে নিজ দেশের অন্যতম সেরা জেট লাইনার হয়ে আত্মপ্রকাশ করতে পারে সি-৯১৯ইআর জেট লাইনারটি। যদিও অবশ্য এই সিরিজের যাত্রী পরিবহণ বিমানটির প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও মান কতটুকু ভালো হবে তা কিন্তু এখনো পর্যন্ত চীনের বাহিরে অন্য কোন দেশে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।

চলতি ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে চীনের কমার্শিয়াল এয়ারক্র্যাফ্ট কর্পোরেশন অব চায়না (সিওএমএসি) এর দেয়া তথ্যমতে, চীনের অভ্যন্তরীণ যাত্রী পরিবহন বিমান পরিচালনাকারী ও এয়ার লিজিং সংস্থাগুলো এ পর্যন্ত নাকি এই সিরিজের মোট ৩০০ বা তার অধিক জেট লাইনারের অর্ডার দিয়েছে। আর এদিকে চীনের বিমান ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি আগামী ৫ বছরের মধ্যে বার্ষিক প্রডাকশন ক্যাপাবিলিটি আনুমানিক ১৫০টি তে উন্নীত করার বিষয়ে প্রবলভাবে আশাবাদী। সব ঠিক থাকলে এটি বানিজ্যিকভাবে আকাশে যাত্রা শুরু করবে আগামী ২০২৪ সালের শুরু থেকেই।

চীনের মিডিয়ার দেয়া তথ্যমতে, আফ্রিকার সবেচেয়ে বড় বিমান পরিবহন সংস্থা ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্স অদূর ভবিষ্যতে চীনের সি-৯১৯ যাত্রী পরিবহন বিমান যুক্ত করার কথা বিশেষভাবে বিবেচনা করছে। ইথোপিয়ান এয়ারলাইন্স অবশ্য তাদের বহরে নতুন প্রজন্মের ন্যারো সেপের এই বিমানটি সংযুক্ত করার আগে এর গুণগত মান ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয়েছে কিনা তা যথাযথভাবে নিশ্চিত হতে চায়।

চীনের তৈরি মিডিয়াম রেঞ্জের এই অত্যাধুনিক জেট লাইনারটি প্রথম সফল পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন সম্পন্ন করে ২০১৭ সালের ৫ই মে এবং ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোট ১০টি মাত্র এই জাতীয় বিমান তৈরি করেছে চীনের কমার্শিয়াল এয়ারক্রাফট কর্পোরেশন অব চায়না (সিওএমএসি) লিমিটেড। এই জেট লাইনারের অধিকাংশ প্রযুক্তি ও ডিভাইন চীন নিজে তৈরি করলেও বাস্তবে এখনো পর্যন্ত এর ইঞ্জিন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ ও সিস্টেম কিন্তু এখনো পর্যন্ত আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলো দেশগুলো থেকে আমদানি করে ইনস্টল করে থাকে চীন।

চীনের সি-৯১৯ইআর সিরিজের যাত্রী পরিবহণ বিমানের দৈর্ঘ্য ৩৮.৯ মিটার এবং উইন্সপেন ৩৩.৬ মিটার। এর স্টান্ডার্ড পেলোড ক্যাপাসিটি ১৫ টন এবং এর স্টান্ডার্ড অপারেশনাল রেঞ্জ ৫,৫৭৬ কিলোমিটার। আকাশে এই বিমানের উড়ে চলা ও শক্তি উৎপাদনের জন্য ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের যৌথভাবে তৈরি ২টি সিএফএম ইন্টারন্যাশনাল এলইএপি-১সি সিরিজের শক্তিশালী টার্বোফ্যান জেট ইঞ্জিন ব্যাবহার করা হয়েছে। এটিকে ১২ হাজার ১০০ মিটার উচ্চতায় উড্ডয়ন করার উপযোগী করে ডিজাইন করা হয়েছে। এর ম্যাক্সিমাম পেলোড ক্যাপাসিটি ১৮ হাজার ৬০০ কেজি ও ফুয়েল ক্যাপাসিটি ৬,৫৮২ (ইউএস) গ্যালন।

এটিকে ১৬৪টি সিটের ক্যাপাসিটি অনুযায়ী ডিজাইন করেছে চীনের কমার্শিয়াল এয়ারক্রাফট কর্পোরেশন অব চায়না (সিওএমএসি) এভিয়েশন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি। যার মধ্যে ৮টি বিজনেস ক্লাস এবং ১৫৬টি ইকোনোমী ক্লাস আসন অনুযায়ী সজ্জিত করা হয়েছে। এর ম্যাক্সিমাম রেঞ্জ ৫,৫৭৬ কিলোমিটার বা ৩,০১১ নটিক্যাল মাইল। অনেকটাই খরচ সাশ্রয়ী ও স্বল্প মূল্যের এই ন্যারো সেপের সি-৯১৯ বিমান দিয়ে অদূর ভবিষ্যতে বোয়িং ও এয়ারবাসকে টেক্কা দিয়ে আন্তর্জাতিক যাত্রী পরিবহন জেট লাইনারের বাজার দখলে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে রেড জায়ান্ট চীন।

সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক ও লেখক, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com