পশ্চিমা বিশ্বের শত বাধা ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তুরস্ক তার নতুন প্রজন্মের টিএফ-এক্স স্টেলথ এয়ার সুপিউরিটি জেট ফাইটার প্রজেক্ট বাস্তবায়নে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বিশেষ করে নিজস্ব প্রযুক্তিগত সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে তুরস্কের টার্কিস অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ (টিএআই) আজ ১৮ই মার্চ পঞ্চম প্রজন্মের টিএফ-এক্স এর প্রটোটাইপ কপি যুদ্ধবিমানের রানওয়েতে সিরিজ ট্যাক্সি টেস্ট সফলভাবে শেষ করেছে এবং তা চলামান থাকবে। এটিকে অবশ্যই তুরস্কের জন্য একটি মাইলফলক অর্জন হিসেবে দেখা হচ্ছে।

মূলত গত ফেব্রুয়ারি মাসে তুরস্কে ভূমিকম্পের ব্যাপক প্রাণহানী ও ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির পর অনেকেই আশঙ্কা করেছিল যে, তুরস্কের চলমান সকল বড় বড় প্রকল্প ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন হয়ত থমকে যাবে। কিন্তু সে আশঙ্কাকে একেবারে ভুল প্রমাণ করে সামরিক ও প্রতিরক্ষা শিল্পের প্রযুক্তিগত উন্নয়নকে তরান্বিত করতে বদ্ধপরিকর দেশটি। তারই ধারাবাহিকতায় দেশটি এবার পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে টিএফ-এক্স প্রটোটাইপ কপি যুদ্ধবিমানের সিরিজ রানওয়ে ট্যাক্সি রান কয়েক ধাপে টেস্ট সম্পন্ন করবে।

তবে এটা ঠিক যে, তুরস্ক যুদ্ধবিমান তৈরির ক্ষেত্রে এখনো পর্যন্ত হাইলি এডভান্স জেট ইঞ্জিন তৈরি বা ডিজাইন করতে পারেনি। বিশেষ করে নিজস্ব প্রযুক্তির জেট ইঞ্জিন তৈরির যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাতে বড় ধরণের কোন সফলতা অর্জন করতে পারেনি। তাই আপাতত তুরস্কের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন টার্কিস এ্যারোস্পেস ইন্ডাস্টিজ (টিএআই) এর তৈরি এই উচ্চ প্রযুক্তির টিএফ-এক্স যুদ্ধবিমানে ব্যবহার করা হচ্ছে আমেরিকার জেনারেল ইলেক্ট্রিক কোম্পানির তৈরি শক্তিশালী এফ-১১০ আফটার টার্বোফ্যান জেট ইঞ্জিন।

একেবারে নিজস্ব প্রযুক্তির তৈরি এই হাইলী এডভান্স স্টেলথ জেট ফাইটারের প্রজেক্ট নিয়ে তুরস্ক আজ থেকে এক দশক আগেই শুরু করে দেয়। তবে এর ম্যাসিভ প্রডাকশন লাইন চালু করে এটিকে পূর্ন মাত্রায় সার্ভিসে নিয়ে আসতে আগামী ২০২৭ সাল পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। আবার ভবিষ্যতে সার্ভিসে আসলেও তুরস্ককে ম্যাসিভ প্রডাকশন লাইন বা গণ উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু করতে হয়ত আরো কিছু বেশি সময় অপেক্ষা করতে হতে পারে।

একজন পাইলট দ্বারা চালিত টিএফ-এক্স এডভান্স এয়ার সুপিউরিটি জেট ফাইটারের দৈর্ঘ্য ১৯ মিটার (৬২ ফুট ৪ ইঞ্চি), উইংস্পেন ১২ মিটার (৩২ ফুট ৪ ইঞ্চি) এবং উইং এরিয়া ৬০ মিটার (৬৫০ বর্গ ফুট)। এর সর্বোচ্চ টেকঅফ ওয়েট ২৭,২১৫ কেজি। এটিতে নিজস্ব প্রযুক্তির জেট ইঞ্জিন ব্যবহারের কথা থাকলেও আপাতত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফ-১১০ আফটার টার্বোফ্যান জেট ইঞ্জিন ইনস্টল করা হয়েছে।

এর সর্বোচ্চ গতি ম্যাক ২.০ এবং কমব্যাট রেঞ্জ হতে পারে প্রায় ৭০০ মাইল। এটিকে আকাশে উপর সর্বোচ্চ ৫৫ হাজার ফুট উচ্চতায় উড্ডয়ন করার উপযোগী করে ডিজাইন করেছে তার্কিস এ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ (টিএআই)। এর টোটাল প্রোগ্রাম কস্ট ধরা হয় প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার এবং পার ইউনিট প্রোটোটাইপ ম্যানুফ্যাকচারিং কস্ট হতে পারে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার।

এডভান্স রাডার ও সেন্সর হিসেবে আপ কামিং যুদ্ধবিমানে তুরস্কের নিজস্ব প্রযুক্তির তৈরি ইলেক্ট্রনিক্যালী স্ক্যান এ্যারী (এইএসএ) গ্যালিয়াম নাইট্রাইড (GaN) প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে তুরস্ক। তাছাড়া এভিয়নিক্স সিস্টেম হিসেবে এনএফভির এনক্রিপ্ট ডাটালিঙ্কন সিস্টেম ইনস্টল করা হয়েছে। তার পাশাপাশি হাইলী এডভান্স এই এয়ার সুপিউরিটি যুদ্ধবিমানে খুব সম্ভবত তার্কিস এ্যাসেনসালেরর নিজস্ব রাডার রিসিভার (আরডাব্লিউআর), মিসাইল ওয়ার্নিং সিস্টেম (এমডব্লিউএস), লেজার ওয়ার্নিং সিস্টেম (এলডব্লিউএসএস), চাফ এবং ফ্লেয়ার ম্যানেজমেন্ট, ডিসপেন্সিং সিস্টেম এবং ডিজিটাল রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি মেমরি (ডিআরএফএম) ভিত্তিক জ্যামিং সিস্টেমের অতি আধুনিক সেন্সর ইনস্টল করে এক নতুন প্রজন্মের যুদ্ধবিমান বিশ্বের সামনে প্রকাশ করতে বদ্ধপরিকর তুরস্ক।

বর্তমানে সকল বাধাকে ছাপিয়ে তুরস্ক কিন্তু বৈশ্বিক পর্যায়ে বেশ প্রভাবশালী এবং সামরিক সক্ষমতা সম্পন্ন দেশ হিসেবে নিজেকে জড়ালো ভাবেই আত্মপ্রকাশ করেছে। তবে বর্তমানে তুরস্কের বিমান বাহিনীর এয়ার কমব্যাট ফ্লীট (এক্টিভ যুদ্ধবিমান) মোটেও কিন্তু আমেরিকা বা উন্নত কোন দেশের সাথে তুলনা করা যায় না। বিশেষ করে তুরস্কের বিমান বাহিনীতে মার্কিন এফ-১৫, ফ্রান্সের ডেসাল্ট রাফায়েল এবং জার্মানির ইউরোফাইটার তাইফুন লেভেলের টুইন ইঞ্জিনের হাইলি এডভান্স জেট ফাইটার নেই।

তাছাড়া তুরস্কের বিমান বাহিনীতে বর্তমানে ২৪৫টি এফ-১৬সি/ডি ব্লক-৩০/৪০/৫০ সিরিজের যুদ্ধবিমান এবং ৪৮টি এফ-৪ ফ্যান্টম পুরনো যুদ্ধবিমান ছাড়া আপাতত আর কিছু নেই। যদিও তুরস্ক তার এফ-১৬ যুদ্ধবিমান বহরের একটি বড় অংশকে নিজস্ব প্রযুক্তিগত সক্ষমতাকে ব্যবহার করে ব্লক ৫২ বা এর উন্নত পর্যায়ে আপগ্রেডিং কার্যক্রম সম্পন্ন করে নিয়েছে। তাছাড়া এর আগে ইসরাইলের সহায়তায় ৪৮টি পুরনো এফ-৪ ফ্যান্টম যুদ্ধবিমানগুলোকে পর্যায়ক্রমে আধুনিকায়ন করে নিয়েছে।

এদিকে আমরা এতদিন মনে করতাম যে, আমেরিকার লাইসেন্স নিয়ে তুরস্ক নিজেই এফ-১৬ সিরিজের যুদ্ধবিমান নিজ দেশের মাটিতেই তৈরি করে। তবে প্রকাশ থাকে যে, তুরস্ক আমেরিকার লাইসেন্স নিয়ে নিজ দেশে এফ-১৬ এসেম্বল করলেও এর ইঞ্জিন, রাডার এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ, অস্ত্র ও প্রযুক্তি সেই আমেরিকা থেকেই আমদানি করতে হয়। যদিও তুরস্ক এর কাঠামো, ল্যান্ডিং গিয়ার, মিসাইল, ডিসপ্লে ও ককপিটসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি নিজেই ম্যানুফ্যাকচারিং করে। তবে তা সত্ত্বেও তুরস্ক কিন্তু আজো এফ-১৬ বা এই টাইপের আরো আধুনিক যুদ্ধবিমানের শতভাগ প্রযুক্তি নিজেই কিন্তু তৈরি করার সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি।

এর আগে তুরস্ক আমেরিকার কাছে ৪০টি পুরনো এফ-১৬ যুদ্ধবিমানের মর্ডানাইজেশন কিটস সরবরাহের অনুরোধ জানালে মার্কিন প্রশাসন কিন্তু নানা বাহানায় কিংবা জটিল কিছু শর্ত জুড়ে দিয়ে তার সরবরাহ পিছিয়ে দিচ্ছে কিংবা এক রকম পরিকিল্পিতভাবেই তুরস্কের বিমান বাহিনীর আধুনিকায়ন বাধাগ্রস্থ করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গেছে। যদিও আশার কথা হলো যে, ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের কারণে তুরস্ককে এবার নিজ শিবিরে ধরে রাখতে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান মর্ডানাইজেশনের জন্য কিটস সরবরাহের সকল বাধা সরিয়ে নিয়েছে মার্কিন প্রশাসন।

এদিকে তুরস্ক অনেক আগেই অন্যতম অংশীদার হিসেবে আমেরিকার লকহীড মার্টিন কর্পোরেশনের এফ-৩৫ স্টেলথ জেট ফাইটার প্রজেক্টে ১.৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে। তবে রাশিয়া থেকে এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয় করার জন্য এই প্রজেক্ট থেকে তুরস্ককে সরিয়ে দেয় সাবেক মার্কিন ট্রাম্প প্রশাসন। আবার শুরু থেকেই আমেরিকা তুরস্কের বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত দিতেও চরম অনীহা প্রকাশ করে। তাছাড়া তুরস্কের নিজস্ব চাহিদা মাফিক কাস্টমাইজড করা ৮টি এফ-৩৫ জেট ফাইটার ২০১৯ সালে সরবরাহের কথা থাকলেও তা বন্ধ করে দেয়া হয়। এমনিক এফ-৩৫ স্টেলথ জেট ফাইটার পরিচালনার জন্য আমেরিকায় পাঠানো তুর্কী পাইলটদের দেশে ফিরিয়ে আনতে হয়। আর এখন তুরস্ক সীমিত পরিসরে হলেও নিজস্ব প্রযুক্তির টিএফ-এক্স সিরিজের হাইলী এডভান্স সার্ভিসে নিয়ে আসলে তা হবে পশ্চিমা চক্রান্তের শক্ত জবাব।

সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক ও লেখক, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com