যুদ্ধক্ষেত্রে আধুনিক এন্টি ট্যাংক মিসাইল এবং কমব্যাট ড্রোনের দাপটে মেইন ব্যাটল ট্যাংকের উপযোগিতা অনেকটাই হ্রাস পেলেও এক বিংশ শতাব্দীতে এসে নতুন প্রযুক্তির ছোঁয়ায় মেইন ব্যাটল ট্যাংক হয়ে উঠেছে আরো আধুনিক এবং শক্তিশালী। বর্তমানে সারা বিশ্বে রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের পাশাপাশি তুরস্ক তাদের নিজস্ব প্রযুক্তির নতুন প্রজন্মের অত্যাধুনিক ‘আলতাই’ মেইন ব্যাটল ট্যাংকের ম্যাসিভ প্রডাকশন লাইন চালু করতে যাচ্ছে ২০২২ সালের শেষের দিকে।
চতুর্থ প্রজন্মের ট্যাংক হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়া কে-২ ব্লাক প্যান্থার ২০১৪ সালে এবং জাপান ২০১২ সালেই টাইপ-১০ সিরিজের এডভান্স মেইন ব্যাটল ট্যাংক সার্ভিসে এনেছে। তবে রাশিয়া নতুন প্রজন্মেরে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির টি-১৪ আরমাটা মেইন ব্যাটল ট্যাংকের উতপাদন শুরু করে ২০১৫ সালে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আনুমানিক মোট ৩০-৫০টি টি-১৪ আরমাটা মেইন ব্যাটল ট্যাংক সার্ভিসে এনেছে রাশিয়া।
তুরস্কের বিখ্যাত আর্মি জেনারেল ফাহরেত্তিন আলতায় এর নাম অনুসারে তুর্কী সরকার এই ট্যাংকটির নামকরণ করেছে ‘আলতাই’ নেক্সড জেনারেশন মেইন ব্যাটল ট্যাংক। এর হাইলী এণ্ড ইমপ্রুভড ফায়ারপাওয়ার সিস্টেম, মোবিলিটি এবং প্রটেকশন সিস্টেম ব্যবস্থা খুবই উন্নত করে ডিজাইন করা হয়েছে। তাছাড়া এর চেসিসটি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং এর ম্যানুভারিটিও বেশ ভালো মানের বলে জানিয়েছে তুরস্ক। এটি প্রথম ২০১১ সালে ইস্তানবুল ডিফেন্স শো/২০১১ তে উম্মোচন করে তুরস্ক।
আসলে তুরস্কের তৈরি আলতাই মেইন ব্যাটল ট্যাংকটিকে বর্তমানে বিশ্বের সেরা এডভান্স এণ্ড নেক্সড জেনারেশনের মেইন ব্যাটল ট্যাংক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এটি তৈরিতে তুরস্ক সর্বোচ্চভাবে যতটা সম্ভব নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। যদিও ২০০৮ সালে দক্ষিন কোরিয়ার হুন্দাই রটেম তার কে-২ ব্লাক প্যান্থার ট্যাংকের ট্র্যান্সমিশনসহ গুরত্বপূর্ণ প্রযুক্তি তুরস্কে সরবরাহের চুক্তি সম্পন্ন করে। আর দক্ষিণ কোরিয়ার প্রযুক্তিগত সহায়তায় তুরস্ক তার নতুন প্রজন্মের আলতাই মেইন ব্যাটল ট্যাংকের প্রটোটাইপ কপি তৈরির প্রজেক্ট হাতে নেয় ২০১০ সালে। তবে তুরস্ক ২০১৭ সালে একেবারে সীমিত পরিসরে এই ট্যাংকের পরীক্ষামুলক উতপাদন শুরু করে এবং ২০২০ সাল পর্যন্ত মোট ১০টি এই জাতীয় ট্যাংকের প্রটোটাইপ কপি তৈরি করেছে। আগামী ২০২২ সাল থেকে এর ম্যাসিভ প্রডাকশন লাইন চালু করা সম্ভব হবে এবং ২০২৩ সাল থেকেই এটি পর্যায়ক্রমে সার্ভিসে আনতে চায় তুরস্ক।
নতুন প্রজন্মের এই ট্যাংকটির ডিজাইন ও প্রটোটাইপ কপি তৈরিতে তার্কিস অটোকার কোম্পানি যুক্ত থাকলেও এর মেইন কন্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করছে তুরস্কের বিএমসি কোম্পানি। তাছাড়া তুরস্কের প্রায় সকল প্রথম সারির ডিফেন্স রিলেটেড ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাবগুলো যেমন তার্কিস এ্যাসেলসান, এমকেইকে, রকেটসান, হাবিলসান কর্পোরেশনের পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম এবং হুন্দাই ইউইয়া কর্পোরেশন অনেক আগে থেকেই এই প্রজেক্টের সাথে ২০০৮ সাল থেকেই জড়িত রয়েছে।
তুরস্ক প্রথম দিকে তার আলতাই ট্যাংকের জন্য আমেরিকা ও জার্মানির কাছে এর ইঞ্জিন ও ট্রান্সমিশন প্রযুক্তিসহ নিতে চাইলে মার্কিন প্রশাসন এবং জার্মান সরকার তা সরবরাহ করতে সরাসরি অস্বীকৃতি জানায়। পরবর্তীতে তুরস্ক দক্ষিণ কোরিয়ার তৈরি ইঞ্জিন এবং ট্রান্সমিশন প্রযুক্তি নিয়ে তাদের নিজস্ব ডিজাইনের আলতাই মেইন ব্যাটল ট্যাংক তৈরির প্রজেক্ট এগিয়ে নিয়ে যায়। আর এখন তুরস্ক নিজেই কিনা তার নিজ দেশের তৈরি ইঞ্জিন ও মেইনগানসহ অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ ও প্রযুক্তি নিজেই ডিজাইন ও তৈরি করতে শুরু করে দিয়েছে।
তুরস্ক ২০১৮ সালে ৩.৫ বিলিয়ন ডলার ব্যায়ে মোট ২৫০টি এই জাতীয় নেক্সড জেনারেশনের আলতাই ট্যাংকের জন্য চুক্তি করে। সে হিসেবে প্রতিটি ট্যাংকের দাম প্রায় ১৪ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যায়। যদিও বিশ্বের সবচেয়ে দামি মেইন ব্যাটল ট্যাংক হিসেবে জাপানের টাইপ-১০ সিরিজের ট্যাংকের ইউনিট কস্ট দেখানো হয়েছে ১৫ মিলিয়ন ডলার। তুরস্ক ভবিষ্যতে এই জাতীয় কমপক্ষে ১,০০০ হাইলী এডভান্স এণ্ড নেক্সড জেনারেশনের ট্যাংক পর্যায়ক্রমে সার্ভিসে আনবে। আর তুরস্ক সকল সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ২০২৩ সালের দিকে তার সেনাবাহিনীর হাতে সীমিত পরিসরে হলেও এই ট্যাংক তুলে দিতে বদ্ধপরিকর।
তাছাড়া সার্ভিসে না আসতেই মধ্যপ্রাচ্যের অত্যন্ত ছোট্ট এবং ধনী দেশ কাতার ২০১৯ সালের মার্চে তুরস্কের কাছ থেকে মোট ১০০টি চতুর্থ প্রজন্মের আলতাই মেইন ব্যাটল ক্রয়ের চুক্তি করে। সকল প্রকার পরীক্ষা এবং উন্নয়ন শেষে ২০২৩ সাল থেকে তুরস্ক এই ট্যাংকের একেবারে সর্বশেষ আপগ্রেড ভার্সন কাতারকে পর্যায়ক্রমে সরবরাহ করবে। তুরস্ক প্রথম ব্যাচে মোট ৪০টি এবং পরবর্তীতে দ্বিতীয় ব্যাচে মোট ৬০টি নতুন প্রজন্মের আলতাই মেইন ব্যাটল ট্যাংক কাতারের কাছে হস্তান্তর করবে। আর এর মাধ্যমে তুরস্কের নিজস্ব প্রযুক্তির তৈরি এই ব্যাটল ট্যাংকের প্রথম আন্তর্জাতিক ব্যবহারকারী দেশ হতে যাচ্ছে কাতার।
প্রায় ৬৫ টন ওজনের এই ট্যাংকের দৈর্ঘ্য ৭.৩ মিটার, প্রস্থ ৩.৯ মিটার এবং উচ্চতা ২.৬ মিটার। তাছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রে এই ট্যাংকটি পরিচালনা করতে ৪ জন ক্রু (কমাণ্ডার, গানার, লোডার এবং ড্রাইভার) প্রয়োজন। তাছাড়া এটিতে শক্তিশালী ও অত্যন্ত কার্যকর আর্মোর হিসেবে রকেটসানের তৈরি কম্পোজিট আর্মোর ব্যবহার করা হয়েছে।
এই ট্যাংকের গড় গতিবেগ অনেকটাই বেশি হওয়ার ফলে চলন্ত অবস্থায় এটিকে এন্টি ট্যাংক মিসাইলের (এটিজিএম) আঘাতে ক্ষতিগ্রস্থ করাটা খুব একটা সহজ হবে না। এটিতে আইসোলেটেড অ্যামিউনেশন কমপার্টমেন্ট থাকার ফলে ট্যাংকে থাকা ক্রুদেরকে বিভিন্ন ধরণের বিস্ফোরন থেকে বা ট্যাংক এক্সিডেন্ট থেকে সুনিশ্চিতভাবে সুরক্ষা দিবে।
সম্পূর্ণ অটো লোডিং সিস্টেম চালিত এই ট্যাংকের মেইন গান হিসেবে তার্কিস ম্যাকানিক্যাল এণ্ড ক্যামিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের তৈরি ৬.৬ মিটার দৈর্ঘ্যের এমকেই-১২০ এমএম ক্যালিবার স্মুথবোর গান ইনস্টল করা হয়েছে। তার পাশাপাশি সেকেণ্ডারি ওয়েপন্স হিসেবে ১২.৭ এমএম রিমোট কন্ট্রোল চালিত হেভী মেশিনগান এবং ৭.৬২ এমএম কক্সিয়াল লাইট মেশিনগান ইনস্টল করা হয়েছে।
বর্তমানে কাতারের জন্য তৈরিকৃত প্রথম ব্যাচের ৪০টি আলতাই মেইন ব্যাটল ট্যাংকে জার্মানীর তৈরি ১,৫০০ হর্স পাওয়ারের বিএমসি পাওয়ার বিএটিইউ ভি-১২ ১২ সিলিণ্ডারের ভি টাইপ সিরিজের মাল্টিফুয়েল টার্বো ডিজেল ইঞ্জিন ব্যবহার করা হবে। তাছাড়া পরবর্তীতে দ্বিতীয় ব্যাচে ৬০টি ট্যাংকে তুরস্কের নিজস্ব প্রযুক্তির তৈরি আরো শক্তিশালী ১,৮০০ হর্স পাওয়ারের (১,৩০০ কিলোওয়ার্ট) মাল্টিফুয়েল ইঞ্জিন ইনস্টল করা হবে। তুরস্ক এই ট্যাংকটিকে ৪.১ মিটার বা ১৩ ফুট পর্যন্ত পানির তলে সাবলীলভাবে কাজ করার উপযোগী করে বিশেষভাবে ডিজাইন করেছে।
আলতাই ট্যাংকের অপারেশনাল রেঞ্জ ৪৫০ কিলোমিটার এবং এটি যে কোন প্রতিকূল পরিবেশে প্রতি ঘন্টায় ৬৫ কিলোমিটার বেগে ছুটে যেতে সক্ষম। তবে ভবিষ্যতে ট্যাংকটিতে ১,৮০০ হর্স পাওয়ারের নিজস্ব প্রযুক্তির ইঞ্জিন ইনস্টল করা হলে এর গতি প্রতি ঘন্টায় সর্বোচ্চ ৭০ কিলোমিটারে পৌঁছে যাবে।
এই ট্যাংকে অত্যাধুনিক কম্পিউটারাইজড কমিউনিকেশন এণ্ড ইমেজিং সিস্টেম ব্যবহার করা হয়েছে। তাছাড়া প্রতিকূল পরিবেশের যুদ্ধক্ষেত্র বিশেষ করে রাসায়ানিক, তেজস্ক্রিয়তা, বায়োলজিক্যাল এণ্ড নিউক্লিয়ার হামলা থেকে ট্যাংকটিকে সুরক্ষা দিতে এটিতে Chemical, biological, radiological and nuclear defence (CBRN) বা (সিবিআরএন) ডিফেন্স সিস্টেম ইনস্টল করা হবে। প্রাথমিকভাবে তুরস্কের সেনাবাহিনী এর প্রধান ব্যবহারকারী হলেও অদূর ভবিষ্যতে কাতারের পাশাপাশি বন্ধুভাবাপন্ন দেশগুলোর কাছে সহজ শর্তে এবং অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে কমব্যাট ড্রোনের পাশাপাশি আলতাই মেইন ব্যাটল ট্যাংক রপ্তানির মহা পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তুরস্ক। তাছাড়া ডিফেন্স রিলেটেড ইন্ডাস্ট্রিজ সেক্টর থেকে তুরস্ক ২০২৫ সালের মধ্যে কমপক্ষে ৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় করতে পারবে।
সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman)