ইউক্রেনে রাশিয়ার ভয়াবহ সামরিক আগ্রাসন ও দীর্ঘ মেয়াদি যুদ্ধ পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে সারা বিশ্বব্যাপী গত ২০২২ সালে আনুমানিক ৩০০ বিলিয়ন ডলারের (প্রকৃত অবস্থা নয়) প্রাণঘাতী অস্ত্র এবং সামরিক সাজ সরঞ্জামের ব্যাপক বানিজ্য, রপ্তানি ও সমাঝোতা চুক্তি হয়েছে। মোট কথা একক কোন বছর হিসেবে সারা বিশ্বের অস্ত্র বানিজ্য বিগত ৪ দশকের সকল রেকর্ডকে ছাপিয়ে গেছে ২০২২ সাল। তাছাড়া একই সময়ে সারা বিশ্বের দেশগুলো একত্রে মোট প্রায় ২.২ ট্রিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ ব্যয় করে সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতে। আর এহেন অস্থিতিশীল যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে বিশ্বের স্বল্প আয়ের দেশগুলো চরম মাত্রায় ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে। চলমান বৈশ্বিক মহামন্দা ও অর্থনৈতিক সংকটের মুখেও তাদেরকে নিজ দেশের সুরক্ষায় বেশি পরিমাণে অর্থ বরাদ্দ দিতে বাধ্য করা হচ্ছে।

এদিকে চলতি ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পোল্যান্ড অবিশ্বাস্যভাবে আমেরিকার সাথে ১০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র ক্রয়ের চুক্তি সম্পন্ন করেছে। আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট কিন্তু ইতোমধ্যেই পোল্যান্ডের কাছে বিশাল আকারের ১০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র রপ্তানির চুক্তি অনুমোদন দিয়েছে। নতুন এই চুক্তির আলোকে পোল্যান্ড লকহিড মার্টিন কর্পোরেশনের তৈরি বিপুল পরিমাণ হিমার্স রকেট সিস্টেম (এমএলআরএস) এবং অন্যান্য প্রাণঘাতী অস্ত্র ক্রয় করবে। যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন থেকে নিজেকে রক্ষা করা। তবে সুবিশাল আকারের এই বৈশ্বিক অস্ত্র বানিজ্যের মূল সুবিধাভোগী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে বিশ্বের এক নম্বর সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে বিশ্বের মোট অস্ত্র বানিজ্যের প্রায় ৭০% অর্থ চলে যাচ্ছে আমেরিকার বড় বড় অস্ত্র উৎপাদনকারী কর্পোরেশনের পকেটে।

বৈশ্বিক পর্যায়ের স্টোকহোম বেসড ইন্টারন্যাশনাল পীস রিসার্চ ইনিস্টিউট, ডিফেন্স জেন্স রিপোর্ট, গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার, বিজনেস ইনসাইডারসহ একাধিক ডিফেন্স থিংক ট্যাংক ও সামরিক গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো বৈশ্বিক অস্ত্র বানিজ্য নিয়ে যে তথ্য উপাত্ত প্রকাশ করে তা কিন্তু বাস্তবতার সাথে মোটেও সামাঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তারা আসলে অনেকটা অনুমানের উপর ভিত্তি করে বৈশ্বিক অস্ত্র বানিজ্যের প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। এ সংক্রান্ত বিষয়ে সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া সম্ভব না হলেও বৈশ্বিক অস্ত্র রপ্তানির প্রায় ৪০% পর্যন্ত চলে যায় মধ্যপ্রাচ্যের বাদশা ও আমির শাসিত আরব দেশগুলোতে।

আসলে গত ২০২২ সালে রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান সামরিক হুমকি মোকাবিলায় ইউরোপের দেশগুলো অবিশ্বাস্যভাবে তাদের সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট ক্ষেত্র বিশেষে প্রায় দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ বৃদ্ধি করেছে। এদিকে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে চীন ও উত্তর কোরিয়ার ফাঁকা সামরিক হুঙ্কার ও পেশিশক্তি প্রদর্শনের কারণে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলো অত্যন্ত প্রাণঘাতী অস্ত্র সংগ্রহের জন্য শত বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে যাচ্ছে। আর এসল ক্ষেত্রেই মূল সুবিধাভোগী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে ঘুরেফিরে সেই আবার আমেরিকা। বিশেষ করে ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে জাপান অবিশ্বাস্যভাবে ৫ বছর মেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় ৩২০ বিলিয়ন ডলারের সুবিশাল সামিরিক সামরিক বাজেট ঘোষণা করে সারা বিশ্বকে একেবারে চমকে দিয়েছে।

তাছাড়া পাকিস্তান ও চীনের সাথে চরম বৈরি সম্পর্ক এবং বিবাদের জেরে ভারতকে প্রতি বছর জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার স্বার্থে বিপুল পরিমাণ ও মূল্যের যুদ্ধাস্ত্র এবং সামরিক সাজ সরঞ্জাম এখনো পর্যন্ত বিদেশ থাকে আমদানি করতে হচ্ছে। যদিও ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনিস্টিউটের দেয়া তথ্যমতে, ভারতের নিজস্ব প্রযুক্তির অস্ত্র ও সামরিক সাজ সরঞ্জাম উৎপাদন সক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় অন্য কোন দেশ থেকে যুদ্ধাস্ত্র আমদানি প্রায় ৩৩% পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে। তাছাড়া বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ সামরিক খাতে ব্যয়কারী দেশ হিসেবে গত ২০২২ সালে সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতে ৭৬.৬ বিলিয়ন ডলারের বিশাল বাজেট বরাদ্দ দেয় ভারত।

আবার ২০২০-২১ সালের হিসেব অনুযায়ী, বিশ্ব অস্ত্র বানিজ্যের শতকরা হারের হিসেবে বিশ্বের দুই সামরিক পরাশক্তিধর দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একাই ৩৫% এবং রাশিয়া ২৩% সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে। তাছাড়া বিশ্বের অন্যতম উদীয়মান অর্থনৈতিক এবং সামরিক পরাশক্তি চীন ৫%, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্ত দেশগুলো সম্মিলিতভাবে ২০% এবং এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষুদ্রতম দেশ ইসরাইল বিশ্ব অস্ত্র বানিজ্যের প্রায় ২.৫% নিজ দখলে নিয়ে ব্যাপক চমক সৃষ্টি করে। অবশ্য জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ব্রাজিলসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলো মিলে বিশ্ব অস্ত্র বাণিজ্যের ১০% নিয়ন্ত্রণ করে। তবে এ বৈশ্বিক অস্ত্র বানিজ্যের তথ্য উপাত্ত কিন্তু যুক্তিসঙ্গত কারণেই অনেকটাই কম বা বেশি হতে পারে।

এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী গণমাধ্যম ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের দেয়া তথ্যমতে, ২০০১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রায় দুই দশকব্যাপী সারা বিশ্বে সামরিক আগ্রাসন ও শান্তি মিশন পরিচালনার নামে মার্কিন প্রশাসন সাধারণ জনগণের ট্যাক্সের প্রায় ১৪ ট্রিলিয়ন ডলার বা ১৪ লাখ কোটি ডলার ব্যয় করে ফেলেছে। আর এই অর্থের আনুমানিক এক-তৃতীয়াংশ কিংবা তার অর্ধেক পরিমাণ অর্থ কিনা সরাসরি চলে গেছে আমেরিকার প্রথম সারির সকল অস্ত্র উৎপাদনকারী কোম্পানি বা কর্পোরেশনের পকেটে। এই তালিকায় রয়েছে বিখ্যাত সব অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান যেমন লকহীড মার্টিন, রেইথন, বিএই সিস্টেমস এবং বোয়িং এর মতো বিশ্বের সেরা সব অস্ত্র তৈরির কোম্পানি।

এখানে প্রকাশ থাকে যে, সারা বিশ্বব্যাপী সামরিক উত্তেজনা বা যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ না করলে বিশ্বের ধনী আরব দেশগুলোসহ বিশ্বের অন্যান্য সকল দেশই ব্যাপকভাবে অস্ত্র আমদানি করবে না এটা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো খুব ভালো করেই জানে। আর একেবারে অপ্রয়োজনে দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে অস্ত্র কিনতে উৎসাহিত হবার কোন সুনির্দিষ্ট কারণ থাকতে পারে না। তাই সেই বিষয়টিকে মাথায় রেখে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো বিভিন্ন বিতর্কিত ইস্যু, অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে চরম বিরোধ ও অস্থিতিশীল যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে হলেও তাদের অতি লাভজনক অস্ত্র ব্যবসা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো যে কোন ভাবেই হাতছাড়া করবে বলে মনে হয় না। এখানে কৃত্রিম সৃষ্ট ভয়াবহ যুদ্ধে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ মৃত্যুবরণ করলেও তাতে এই সাম্রাজ্যবাদী ও অতি উৎসাহী অস্ত্র ব্যবসায়ী দেশগুলোর কিছুই যায় আসে না।

সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com