বৈশ্বিক রপ্তানি আয় এবং পর্যটন শিল্প খাতের উপর নির্ভর করে শক্তিশালী হচ্ছে তুরস্কের জাতীয় অর্থনীতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। বিশেষ করে গত ২০২২ সালে চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মহামন্দার মুখেও তুরস্ক পর্যটন শিল্প ও রপ্তানি আয়ে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। গত ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাস শেষে তুরস্কের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১২১.২ বিলিয়ন ডলার (লিকুইড ফরেন কারেন্সি ৭৫.৪ বিলিয়ন ডলার ও সোনার রিজার্ভ ৪৫.৮ বিলিয়ন ডলার) পৌঁছে যায় যেখানে গত আগস্ট মাসে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১০৭ বিলিয়ন ডলার। তাছাড়া ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে তুরস্কের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১১৫.১৪ বিলিয়ন ডলার।
আসলে তুরস্ক গত ২০২২ সালে সারা বিশ্বে রেকর্ড পরিমাণ মোট ২৫৪.২ বিলিয়ন ডলারের পন্য রপ্তানি করে। যা ছিলা কিনা আগের ২০২১ সাল অপেক্ষা ১২.৮% বেশি রপ্তানি আয়। যেখানে তুরস্ক গত ২০২১ সালে ২২৫.৩ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয় করে। তাছাড়া দেশটি গত ২০২০ সালে ১৬৯.৬ বিলিয়ন ডলার এবং গত ২০১৯ সালে ১৮০.৮ বিলিয়ন ডলারের পন্য সারা বিশ্বে রপ্তানি করেছিল।
তবে আন্তর্জাতিক অস্ত্র বাজারে দেশটির সুনাম বৃদ্ধি পাওয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে দেশটি অস্ত্র রপ্তানি অবিশ্বাস্য গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ২০২২ সালের ১২ মাসে অবিশ্বাস্যভাবে ৪.৩ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ও সামরিক সাজ সরঞ্জাম রপ্তানি করে এক নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে। আবার এরদোয়ান সরকার ২০২৩ সালের জন্য ৬ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ও সামরিক সাজ সরঞ্জাম রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। যদিও দেশটি তাছাড়া গত ২০২১ সালে দেশটি সামরিক সাজ সরঞ্জাম ও সিস্টেম রপ্তানি করে ৩.২ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল।
তুরস্ক মূলত বিগত তিন দশকে অত্যন্ত পরিকল্পনা মাফিক বৈদেশিক পর্যটক নির্ভর শক্তিশালী পর্যটন শিল্প খাত গড়ে তুলে। ২০২০ সালে করোনা মহামারিক কারণের দেশটির পর্যটন শিল্প খাত বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়লেও ২০২২ সালে এ খাতটি আবারো ইতিবাচক ধারায় ফিরে আসে। গত ২০২২ সালের তুরস্কে সারা বিশ্ব থেকে ৪ কোটি ৪৬ লক্ষ পর্যটক ঘুরতে আসেন। আর এ খাত থেকে দেশটি আয় করে ৪৬.৩ বিলিয়ন ডলার। যা ছিল কিনা গত ২০২১ সাল অপেক্ষা ৫৩.৪% বেশি। যেখানে পর্যটন খাত থেকে তুরস্ক গত ২০২১ সালে ৩০.২ বিলিয়ন ডলার, ২০২০ সালে মাত্র ১৪.৮ বিলিয়ন ডলার এবং গত ২০১৯ সালে ৩৮.৪ বিলিয়ন ডলার আয় করে।
তবে ২০২০ সাল থেকে চলা করোনা মহামারী এবং ২০২২ সালের শুরু থেকেই ইউক্রেন যুদ্ধের বিরুপ প্রভাবে তুরস্কে লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি এবং ডলারের বিপরীতে ক্রমাগত তুর্কী মুদ্রা লিরার মান হ্রাস পেতে থাকে। যার ফলস্বরূপ তুরস্কের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ২০২০-২১ সালের দিকে অনেকটাই সংকুচিত হয়ে যায়। গত ২০২২ সালের শেষের দিকে তুরস্কের জাতীয় অর্থনীতি অনেকটা স্বস্তি ফিরে আসলেও ডলারের বিপরীতে দেশটির মুদ্রা লিরার মানের ব্যপক হ্রাস পেতে থাকে। চলতি ২০২৩ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি এক ডলারের বিপরীতে তুর্কী মুদ্রার মান ছিল ১৮.৮২ লিরা। এদিকে বিশ্বের অধিকাংশ দেশই যখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টানতে ধারাবাহিকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হার বৃদ্ধি করে যাচ্ছে। সেখানে কিনা তুরস্কের এরদোয়ান সরকার ঠিক তার উল্টো পথেই হাঁটতে শুরু করে। তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত ২০২২ সালের ১৮ই আগস্ট সুদের হার ১৪% থেকে কমিয়ে ১৩% এ নির্ধারণ করলে তার্কিস মুদ্রা লিরার মান ১ ডলারের বিপরীতে কিছুটা কমে ১৮.০৯ লিরায় নেমে আসে।
চলতি ২০২২ সালের ১৭ই ডিসেম্বরের হিসেব অনুযায়ী এক ডলারের বিপরীতে ১৮.৬৪ তুর্কী লিরাতে লেনদেন করা হয়। তাছাড়া গত ২০২১ সালের ২৬শে অক্টোবরে ১ ডলারের বিপরীতে তুর্কী মুদ্রা ৯.৬১ লিরাতে লেনদেন করা হয়। যেখানে কিনা তার মাত্র কয়েক দিন আগেই ২০২১ সালের ১০ই অক্টোবর ১ ডলারের বিপরীতে ৮.৯৬ লিরা এবং গত বছরের ১২ই আগস্ট ৮.৪৪ লিরাতে লেনদেন করা হয়। অথচ ২০১৬ সালের ১৩ই জানুয়ারি ডলারের বিপরীতে তুরস্কের মুদ্রার মূল্য ছিল ০.৩৩ লিরা এবং ২০১৫ সালের ১লা জানুয়ারিতে ছিল ২.৩৩ লিরা।
গত ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাস শেষে তুরস্কের গড় মুদ্রাস্ফিতির হার ছিল ৬৪.২৭%। যদিও দেশটির এরদোয়ান সরকার চলতি ২০২৩ সালে গড়ে ৪৩.২% এর মুদ্রাস্ফীতি থাকতে পারে বলে মনে করে। আবার গত ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে তুরস্কের সার্বিক মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৮৫.৫১%, জুলাই মাসে ছিল ৭৯.৬%, এপ্রিল মাসে ৬৯.৯৭%। যা ছিল কিনা ২০০২ সালের পর সবচেয়ে বেশি মাত্রায় মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির ঘটনা। তাছাড়া গত ২০২২ সালের মার্চ মাসে এই মুদ্রাস্ফীতি ছিল কিন্তু ৬১%। তুরস্কের এহেন চরম মাত্রায় মুদ্রাস্ফীতি কিন্তু দেশটির সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতাকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
এদিকে ইউকীপিডিয়ার দেয়া তথ্যমতে, ৮ কোটি ৪৭ লক্ষ জনসংখ্যার দেশ তুরস্কের ২০২৩ সালে নমিনাল জিডিপি’র আকার দেখানো হয়েছে ৯৪২ বিলিয়ন ডলার এবং মাথাপিছু আয় ১০,৮৬২ ডলার। অবশ্য দেশটির সরকার আশা করে যে, ২০২৩ সাল শেষে বিশ্বের ১০ম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে তুরস্কের জিডিপির আকার হবে প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার। তাছাড়া গত ২০১৩ সালে দেশটির নমিনাল জিডিপির আকার ছিল ৯৫৭.৮ বিলিয়ন ডলার। চলতি ২০২৩ সালে দেশটির সার্বিক বেকারত্বের হারও কিছুটা হ্রাস পেয়ে গড়ে ১০% এ নেমে আসতে পারে। যদিও অবশ্য গত ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে বেকারত্বের হার ছিল ১০.২% এবং গত বছরের এপ্রিল মাসে এ হার ছিল প্রায় ১১.৩%।
বর্তমানে তুরস্কের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিদেশী শরনার্থী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী কুর্দী সমস্যা। বিশেষ করে দীর্ঘ এক যুগ থেকে দেশটিতে অবস্থানরত প্রায় ৪ মিলিয়ন সিরীয় বা অন্যান্য দেশের শরণার্থীর বোঝা চেপে থাকায় তা কিন্তু সরাসরি তুরস্কের জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ধরণের বাধা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কের সম্মানিত এরদোয়ান সরকার সিরিয়ার আসাদ সরকার ও রাশিয়ার সাথে নতুন সমাঝোতা করে শত্রুতা ও বৈরী মনোভাব হ্রাস করতে চায়। তাছাড়া আসাদ সরকারের সাথে দীর্ঘ মেয়াদী শান্তি চুক্তি করে হলেও সিরিয়ার শরণার্থীদের পর্যায়ক্রমে দেশে পাঠিয়ে এ দায় থেকে মুক্তি পেতে চায় তুরস্ক।
সিরাজুর রহমান, (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক ও লেখক, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com