Monthly Archive August 27, 2022

BySherazur Rahman

ভয়াবহ ঋনের ফাঁদে বিপর্যস্ত পাকিস্তানের জাতীয় অর্থনীতিঃ

পাকিস্তানের চলমান ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সৌদি আরব সরকার আগের দেয়া ৩.০০ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋনের সুদ মাফ এবং আসল পরিশোধের সময় বাড়ানোর বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করছেন। তাছাড়া অর্থ সহায়তা প্যাকেজের আওতায় পাকিস্তানকে দেয়া ৩.০০ বিলিয়ন ডলারের ঋন নবায়নের বাহিরে আবারো নতুন করে ১.০০ বিলিয়ন ডলারের জ্বালানী তেল সরবহারের বিষয়টি বিবেচনা করছে সৌদি আরব। যা কিনা পাকিস্তানের জ্বালানী তেল খাতে ১০ মাসের জন্য প্রতি মাসে ১০০ মিলিয়ন ডলার করে প্রদান করবে বা তেল সরবরাহের মাধ্যমে সমন্বয় সাধন করা হবে।

মনে করা হয়, পাকিস্তানকে দেয়া আইএমএফ এর প্রস্তাবিত বেল-আউট প্যাকেজের ৪.০০ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋন পেতে সহায়তা করবে সৌদি আরবের নতুন অর্থিক ঋন সহায়তা প্যাকেজ। যদিও পাকিস্তানে নতুন সরকার আশা করে যে, আগামী ২৯শে আগস্ট আইএমএফ এর নির্বাহী পরিষদ বৈঠক বসলে ৪.০০ বিলিয়ন ডলারের প্রথম কিস্তি হিসেবে ১.১৮ বিলিয়ন ডলারের তহবিল চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করবে আইএমএফ। এক্ষেত্রে অবশ্য আমেরিকার বাইডেন প্রশাসনের গোপন গ্রীন সিংনাল বা সম্মতি পেয়েছে ইমরান সরকারের পতনের পর।

স্বল্প আয়ের একটি দেশের জন্য দীর্ঘ মেয়াদী বৈদেশিক ঋন ও দেনা কতটা বিপদজনক হতে পারে তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার দেশ পাকিস্তান। দেশটি মুলত নিজেদের বেল-আউট ঠেকাতে বিগত চার দশক থেকেই সৌদি আরব ও চীনসহ বিশ্বের একাধিক দেশ, বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি এবং জাইকার মতো ঋন প্রদানকারী বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এখনো পর্যন্ত নির্বিচারে বৈদেশিক ঋন নিয়েই যাচ্ছে।

স্টেট ব্যাংক অফ পাকিস্তানের দেয়া তথ্যমতে, ২০২২ সালের জুনের শেষে পাকিস্তানের মোট বৈদেশিক ঋন এবং দেনার স্থিতির পরিমাণ ১৩০.২০ ছিল বিলিয়ন ডলার। যেখানে ২০২১ সালের একই সময়ে দেশটির মোট বৈদেশিক ঋনের স্থিতির পরিমাণ ছিল ১১৬.৩১ বিলিয়ন ডলার। ২০০৮ সাল থেকে পাকিস্তান এ পর্যন্ত তাদের বৈদেশিক ঋন এবং দেনার বোঝা অবিশ্বাস্যভাবে ২০০% পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছে। যেখানে দেশটির ২০০৮ সালে বৈদেশিক ঋনের পরিমাণ ছিল ৪৫.৪ বিলিয়ন ডলার। তাছাড়া ২০২২ অর্থবছরে পাকিস্তানের সরকার নতুন করে আরও ৮.০০ বিলিয়ন ডলার থেকে ১০.০০ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋন পাবে বলে আশা করছে।

স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের তথ্য অনুযায়ী চলতি ২০২২ সালের ২৯শে জুলাই এর হিসেব অনুযায়ী পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১৪.২০৮ বিলিয়ন ডলার। তবে এই রিজার্ভের আবার ৬০% কিনা আবার বৈদেশিক ঋন ও আর্থিক সহায়তার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। আর দেশটির বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋন ও দেনার বিবেচনায় ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ কিন্তু মোটেও যথেষ্ঠ নয় বলেই প্রতিয়মান হয়।

পাকিস্তান বর্তমানে বিভিন্ন দেশ ও বৈশ্বিক ঋন প্রদানকারী সংস্থা থেকে যে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋন নিচ্ছে বা নিবে, তার ৬০% পর্যন্ত নিশ্চিতভাবেই সরাসরি ব্যয় করতে হবে আগে থেকে অন্য দেশ এবং সংস্থা থেকে নেয়া বৈদেশিক ঋনের আসল ও সুদ বাবদ পরিশোধ করতে। তার মানে পাকিস্তান বর্তমানে অন্য দেশে থেকে নেয়া পূর্বের ঋনের কিস্তি এবং এর সুদ বাবদ পরিশোধ করতে নতুন করতে আরেক দেশ বা আন্তর্জাতিক কোন সংস্থা থেকে নির্বিচারে এবং কঠিন শর্তের মুখে ঋন নিতে বাধ্য হচ্ছে। যা বর্তমানে অন্যান্য স্বল্প আয়ের এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বৈদেশিক ঋন ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি চরম সতর্ক বার্তা বহন করে।

এদিকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পর্যাপ্ত ভালো উৎস বা খাত না থাকলেও পাকিস্তান তার চীরবৈরী ভারতের সাথে সামরিক শক্তিতে পাল্লা দিতে গিয়ে আধুনিক ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ক্রয় এবং আধুনিকায়নে নির্বিচারে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে যাচ্ছে। তাছাড়া দেশটিতে চলমান একাধিক উন্নয়ন প্রকল্পসহ ৬২.০০ বিলিয়ন ডলারের চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি) প্রকল্পে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের কারণে বর্তমানে অবিশ্বাস্যভাবে পাহাড় সমান বৈদেশিক ঋন ও দেনায় জড়িয়ে গেছে পাকিস্তান।

চীন কিন্তু ইতোমধ্যেই সুবিশাল ৬২ বিলিয়ন ডলারের চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর প্রকল্পে আনুমানিক প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি অর্থ বিনিয়োগ করে বসে আছে। এটাকে ঠিক বিনিয়োগ নয় বরং এটিকে চড়া সুদে বৈদেশিক ঋন বলাই শ্রেয়। যা হোক পাকিস্তানের বর্তমান অর্থনৈতিক সক্ষমতার বিচারে এই বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋন পরিশোধ করার আদৌ কোন সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। তবে এর দায় কিন্তু ঠিকই আগামী ১০০ বছর পর্যন্ত হয়ত পাকিস্তানের সাধারণ দরিদ্র জনগণকে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে।

এখানে প্রকাশ থাকে যে, ঋন শোধ করতে না পাড়লে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, সামুদ্রিক ও স্থল বন্দর পর্যায়ক্রমে দীর্ঘ মেয়াদে চীনের মতো দেশের হাতে তুলে দেয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প রাস্তা খোলা থাকবে বলে মনে হয় না। আর বকেয়া ঋন আদায়ের নামে এভাবে হয়ত দেশটির গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বন্দর ও স্থাপনা নিজ নিয়ন্ত্রনে নিয়ে এগুলোর প্রধান ব্যবহারকারী বা অদূর ভবিষ্যতে সুবিধাভোগী হতে যাচ্ছে পাকিস্তানের চীর অকৃত্রিম ও পরীক্ষিত বন্ধুদেশ চীন।

সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক ও লেখক, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com

BySherazur Rahman

রাশিয়া ও আমেরিকার একগুঁয়েমির কারণে নতুন করে ভয়ানক স্নায়ুযুদ্ধের কবলে সারা বিশ্বঃ

বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে একেবারে শেষের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে একটি অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যা ছিল আসলে ‘মাধ্যমিক পর্যায়ের পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি’ বা ইন্টারমিডিয়েট-রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস (আইএনএফ) চুক্তি। ১৯৮৭ সালের ৮ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান এবং সোভিয়েত জেনারেল সেক্রেটারি মিখাইল গর্বাচেভ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। তবে যাই হোক না কেন, সাবেক মার্কিন ট্রাম্প প্রশাসন গত ১লা ফেব্রুয়ারী ২০১৯ সালে প্রথম এই চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয় এবং একই পথ অনুসরণ করে রাশিয়া ২রা আগস্ট ২০১৯ সালে এই চুক্তি পুরোপুরি বাতিল করে দেয়।

এ চুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সভিয়েত ইউনিয়নের হাতে থাকা সব পারমাণবিক ও প্রচলিত ভূমি থেকে নিক্ষেপ যোগ্য মিডিয়াম রেঞ্জ ব্যালেস্টিক এন্ড ক্রুজ মিসাইল চিরস্থায়ীভাবে পর্যায়ক্রমে সরিয়ে ফেলা এবং সমাঝোতার মাধ্যমে তা পরিত্যাগ করা। এখানে ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ মিসাইল বলতে সাধারণত ৫০০ থেকে ৫,০০০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত আঘাত হানতে সক্ষম নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড নির্ভর ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাকে বোঝানো হয়েছে।

ইন্টারমিডিয়েট-রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস (আইএনএফ) চুক্তিটির মাধ্যমে মূলত প্রথম বারের মতো বিশ্বের দুই প্রধান সামরিক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সভিয়েত ইউনিয়ন উভয়ই সম্মত হয়েছিল যে, তাঁদের হাতে মজুত থাকা বিপুল পরিমাণ নিউক্লিয়ার ওয়েপন্স এন্ড ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ স্ট্রটিজিক মিসাইল কমিয়ে আনা এবং নিউক্লিয়ার এন্ড থার্মোনিউক্লিয়ার অস্ত্র ভান্ডারের একটি বড় অংশ একেবারেই নিষ্ক্রিয় করে দেয়া। সরিয়ে দিতে। পারস্পারিক আলোচনা এবং চুক্তির ভিত্তিতে এই দুই পরাশক্তি একে অপরের নিউক্লিয়ার ডেভলপমেন্ট সাইট পর্যবেক্ষেণ এবং যাচাইয়ের জন্য নিয়মিত পরিদর্শনের সুযোগ সৃষ্টি করতে সম্মত হয়েছিল।

১৯৮৭ সালে করা ইন্টারমিডিয়েট-রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস (আইএনএফ) চুক্তির আওতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৯১ সালের ১ জুন পর্যন্ত ২,৬৯২টি স্বল্প এবং মধ্যম পাল্লার নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড এবং মিসাইল সিস্টেম ধ্বংস করে দেয়। ২০০১ সাল পর্যন্ত চুক্তি অনুযায়ী দেশ দুটির মধ্যে চলমান আলোচনা এবং সমাঝোতার ভিত্তিতে নিউক্লিয়ার ওয়েপন্স ডেভলপমেন্ট সাইট পরিদর্শন করা হতো। তবে ২০০২ সাল থেকে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত স্যাটেলাইটের সিস্টেমের মাধ্যমে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা হতো উভয় দেশের পক্ষ থেকে। তবে এখন তা সম্পূর্ণভাবে বাতিল হয়ে গেছে।

তবে দীর্ঘ দিন থেকেই মার্কিন প্রশাসন এবং প্রতিরক্ষা বিভাগ প্রকাশ্যেই অভিযোগ করে আসছিল যে, তাদের কাছে যথেষ্ঠ তথ্য প্রমাণ রয়েছে যে, রাশিয়া অত্যন্ত গোপনেই (আইএনএফ) চুক্তি লঙ্ঘন করে চুক্তিতে যে পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে, সেই নিউক ওয়ারহেড ক্যাপবল ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জের মিসাইল সিস্টেম ব্যাপকভাবে তৈরি করে যাচ্ছে। যদিও রাশিয়া মার্কিন প্রশাসনের এমন অভিযোগ বার বার প্রত্যাখান করে উল্টো এই চুক্তি বাতিলের জন্য আমেরিকাকে দায়ী করে।

মার্কিন ও তার ন্যাটো জোটের ভাষ্যমতে, সাম্প্রতিক সময়ে পুতিনের সামরিক বাহিনী যে উচ্চ প্রযুক্তির ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জের মোবাইল ইস্কেন্দার-এম (৯এম৭২৯) নিউক ওয়ারহেড ক্যাপবল ট্যাক্টিক্যাল মিসাইল সিস্টেম পূর্ব ইউরোপের বিশাল সীমান্ত জুড়ে মোতায়েন সম্পন্ন করেছে। যার ন্যাটো রিপোটেড কোড নেম এসএসসি-৮। এটিকে কার্যত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ন্যাটো জোট ১৯৮৭ সালে করা ইন্টারমিডিয়েট-রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস (আইএনএফ) চুক্তির চূড়ান্ত লংঘন হিসেবে বিবেচনা করেছে। তাছাড়া, এ ধরনের অস্ত্র প্রতিযোগিতার ব্যাপারে ইউরোপীয় দেশগুলো সবসময়ই রাশিয়াকে দায়ী করে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছিল।

এখানে প্রকাশ থাকে যে, রাশিয়ার মোবাইল লাউঞ্চ ইস্কেন্দার-এম (৯এম৭২৯) নিউক ওয়ারহেড ক্যাপবল ট্যাক্টিক্যাল মিসাইল সিস্টেম খুব সহজেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বহন করা যায়। এটি আকারে ছোট হওয়ায় শনাক্ত করাও কিন্তু যথেষ্ঠ কঠিন। এখানে সবচেয়ে বড় বিপদ এ জাতীয় ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জের নিউক মিসাইল সিস্টেম ইউরোপের যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় এবং শহরে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে ভয়ঙ্কর নিউক আঘাত হানতে সক্ষম।

মার্কিন ট্রাম্প প্রশাসনের অভিযোগের বিপরীতে আইএনএফ চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে রাশিয়ার পুতিন প্রশাসন অভিযোগ করে বলেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে পূর্ব ইউরোপে রাশিয়াকে একেবারে ঘিরে ফেলার জন্য অত্যাধুনিক দীর্ঘ পাল্লার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম (টিএইচএএডি) ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রতিরোধী ব্যবস্থা স্থাপন করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে।

ইউরোপের তুরস্ক, জার্মানী, বেলজিঊয়াম এবং নেদারল্যান্ডে থাকা মার্কিন চারটি সামরিক ঘাঁটিতে প্রায় ২ থেকে ৩ শতাধিক বি-৬২ জাতীয় নিউক্লিয়ার অস্ত্র এবং এফ-২২ স্টেলথ জেট ফাইটার মোতায়েন স্পষ্টই আইএনএফ চুক্তির লঙ্ঘন বলে মনে করে ক্রেমিলিন সরকার। আর এই পাল্টা পাল্টি আইএনএফ চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে প্রথমে কূটকৌশলী মার্কিন ট্রাম্প প্রশাসনের আমলেই ২০১৯ সালে এ চুক্তি থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। এর তীব্র প্রতিবাদ স্বরূপ রাশিয়াও একই বছরের শেষের দিকে পাল্টা বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে আইএনএফ চুক্তি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। তবে এ চুক্তি থেকে মার্কিন ট্রাম্প প্রশাসন প্রথমে নিজেকে সরিয়ে নিলেও এই আইএনএফ চুক্তি অকার্যকর বা বাতিল হওয়ার পেছনে এই দুই সুপার পাওয়ার দেশকেই সমান ভাবে দায়ী করা চলে।

এখানে প্রকাশ থাকে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ইউরোপীয় ন্যাটো জোটকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা এবং নিজস্ব সামরিক সক্ষমতা বজায় রাখার স্বার্থে রাশিয়ার এই আইএনএফ চুক্তি লঙ্ঘন করে হলেও দুই দশক আগে থেকেই অত্যন্ত গোপনে ইন্টার মিডিয়েট রেঞ্জের মিসাইল ডেভলপ করা ব্যাতিত বিকল্প কোন রাস্তা খোলা ছিল না। বিশেষ করে ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জের নিউক ওয়ারহেড ক্যাপবল মিসাইল সিস্টেমকে ভয়াবহ যুদ্ধে গেম চেঞ্জার ওয়েপন্স হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এমনিতে অর্থনৈতিক সংকটের কবলে পড়ে রাশিয়ার ডিফেন্স ডেভলপমেন্ট প্রজেক্টগুলো খুব বেশি দূর আর এগোতে পারছিল না।

এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেখানে ২০০৭ সাল থেকে তাঁদের সুপার স্টিলথ টেকনোলজির এফ-২২, এফ-৩৫ এর মতো ডেডিকেটেড সার্ভিসে এনে ফেলেছে এবং তারা এখন ৬ষ্ঠ প্রজন্মের জেট ফাইটার ডেভলপমেন্টের প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। ঠিক সেই সময় রাশিয়া তার স্টেলথ প্রযুক্তির এসইউ-৫৭ জেট ফাইটার একেবারে সীমিত পরিসরে সার্ভিসে এনেছে। মনে করা হয়, আগামী ২০২৮-৩০ সালের মধ্যেই মার্কিন ৬ষ্ঠ প্রজন্মের জেট ফাইটার কিম্বা বোম্বার সার্ভিসে আনতে পারে। তাছাড়া মার্কিন নিউক্লিয়ার পাওয়ারড ১২টি সুপার এয়ার ক্র্যাফট ক্যারিয়ার এখনো পর্যন্ত কিন্তু সারা বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সেখানে কিনা রাশিয়ার অতি পুরনো একমাত্র কনভারশনাল ক্যারিয়ার আজ বাতিল বা স্ক্র্যাপিং হওয়ার পথে।

তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া পাল্টা পাল্টি অভিযোগের মুখে আইএনএফ চুক্তি বাতিল হয়ে যাওয়ার কারণে ৫০০ থেকে ৫,০০০ কিলোমিটার পাল্লা পর্যন্ত ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জের নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড ক্যাপবল মিসাইল সিস্টেম এক রকম প্রকাশ্যেই রাশিয়া তার নিজ ভূমিতে কিম্বা পূর্ব ইউরোপরে সীমান্ত বরাবর মোতায়েন করেছে এবং ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী কনভেনশনাল ওয়ারহেড ক্যাপবল বিভিন্ন সিরিজের ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জের প্রায় ৩ হাজারের কাছাকাছি ক্রুজ এন্ড ব্যালেস্টিক মিসাইল ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে।

তাছাড়া একই সময়ে পোল্যান্ড থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্টের অত্যাধুনি দীর্ঘ পাল্লার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম (টিএইচএএডি) ব্যালিস্টিক নিউক মিসাইল প্রতিরোধী ব্যবস্থা এবং তার আশপাশের এলাকার অদূর ভবিষ্যতে যে কোন যুদ্ধকালীন মুহুর্তে একেবারেই প্রথমে রাশিয়ান নিউক হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত যে হবে না তা কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। তাই আইএনএফ চুক্তি অকার্যকর হয়ে পড়ায় ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন ভুক্ত দেশগুলো এবং বিশেষ করে তাঁদের ন্যাটো ও রাশিয়ার মধ্যে নতুন করে আবার অতি ভয়ানক নিউক্লিয়ার অস্ত্র প্রতিযোগিতা বা স্নায়ুযুদ্ধের আলামত বেশ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে।

এদিকে অনেক আগেই ইন্টারমিডিয়েট-রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস (আইএনএফ) চুক্তিটি অকার্যকর হয়ে পড়ায় রাশিয়া এবং চীনকে কৌশলগতভাবে মোকাবেলা করার জন্য বর্তমানে মার্কিন প্রশাসন ইউরোপের পাশাপাশি এশিয়া প্যাসিফি অঞ্চলে বিশেষ করে জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় ব্যাপক মাত্রায় নিউক্লিয়ার ওয়েপন্স এন্ড মিসাইল সিস্টেম ডিপ্লয় করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। এতে করে আমেরিকা ও রাশিয়ার জন্য এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলসহ গোটা বিশ্ব আবারো নতুন করে এক ভয়ানক স্নায়ুযুদ্ধের কবলে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়।

সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক ও লেখক, ছোট চৌগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com

BySherazur Rahman

কোন পথে তুরস্কের জাতীয় অর্থনীতি?

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় সুপার পাওয়ার দেশগুলোর পাশাপাশি তুরস্কের নাম সবার উপরে উঠে এসেছে। বিশেষ করে দেশটির সম্মানিত প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণভাবে মার্কিন ও রাশিয়া উভয় শিবিরের সাথে সখ্যতা ও বন্ধুবাবাপন্ন সম্পর্ক বজায় রাখার কৌশল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। তবে যাই হোক না কেন, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও পররাষ্ট্র নীতিতে তুরস্ক ব্যাপক অগ্রগতি বা সফলতা লাভ করলেও সার্বিক অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেশটির সরকার গুরুত্ব সহকারে নজর দিচ্ছেন বলে মনে হয় না। এদিকে বর্তমানে বিশ্বের সর্বোচ্চ ২০টি অর্থনৈতিক ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় উঠে এসেছে তুরস্কের নাম।

২০২০ সাল থেকে চলা করোনা মহামারী এবং ইউক্রেন যুদ্ধের বিরুপ প্রভাবে লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি এবং ডলারের বিপরীতে ক্রমাগত তুর্কী মুদ্রা লিরার মান হ্রাস পাওয়ায় তুরস্কের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ২০২২ সালে এসে অনেকটাই সংকুচিত হয়ে গেছে। এদিকে বিশ্বের অধিকাংশ দেশই যখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টানতে ধারাবাহিকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হার বৃদ্ধি করে যাচ্ছে, সেখানে তুরস্কের এরদোয়ান সরকার ঠিক তার উল্টো পথেই হাঁটতে শুরু করেছেন। তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আজ ১৮ই আগস্ট সুদের হার ১৪% থেকে কমিয়ে ১৩% এ নির্ধারণ করলে তার্কিস মুদ্রা লিরার মান ১ ডলারের বিপরীতে কিছুটা কমে ১৮.০৯ লিরায় নেমে আসে।

তাছাড়া গত ২০২১ সালের ২৬শে অক্টোবরে ১ ডলারের বিপরীতে তুর্কী মুদ্রা ৯.৬১ লিরাতে লেনদেন করা হয়েছিল। যেখানে কিনা তার মাত্র কয়েক দিন আগেই ২০২১ সালের ১০ই অক্টোবর ১ ডলারের বিপরীতে ৮.৯৬ লিরা এবং গত বছরের ১২ই আগস্ট ৮.৪৪ লিরাতে লেনদেন করা হয়। অথচ ২০১৬ সালের ১৩ই জানুয়ারি ডলারের বিপরীতে তুরস্কের মুদ্রার মূল্য ছিল ০.৩৩ লিরা এবং ২০১৫ সালের ১লা জানুয়ারিতে ছিল ২.৩৩ লিরা।

আল জাজিরা নিউজের দেয়া তথ্যমতে, গত জুলাই মাসে তুরস্কের সার্বিক মুদ্রাস্ফীতির হার ইতিহাসে সর্বোচ্চ পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়ে বিপদজনকভাবে ৭৯.৬% এ পৌঁছে যায়। যেখানে কিনা চলতি ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে দেশটির মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৬৯.৯৭%। আর ২০০২ সালের পর এটা সবচেয়ে বেশি মাত্রায় মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির ঘটনা। তাছাড়া গত মার্চ মাসে এই মুদ্রাস্ফীতি ছিল কিন্তু ৬১%।

দীর্ঘ মেয়াদী করোনা মহামারির পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন ভয়াবহ যুদ্ধ, বৈশ্বিক মহামন্দা এবং জ্বালানি তেলের ব্যাপক মূল্য বৃদ্ধির কারণে সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কে আশাঙ্খাজনক হারে মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছে। তাছাড়া দীর্ঘ দিন থেকেই দেশটিতে অবস্থানরত প্রায় ৪ মিলিয়ন সিরীয় বা অন্যান্য দেশের শরণার্থীর বোঝা চেপে থাকায় তা কিন্তু সরাসরি তুরস্কের জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ধরণের বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে করোনা মহামারির কারণে দেশটিতে বিদেশী নির্ভর পর্যটন শিল্পখাতে ধস নামার কারণে সার্বিকভাবে জাতীয় অর্থনীতি মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

ইউকীপিডিয়ার দেয়া তথ্যমতে, ২০২২ সালে তুরস্কের নমিনাল জিডিপির আকার ৬৯২ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখানে ২০১৩ সালে দেশটির নমিনাল জিডিপির আকার ছিল ৯৫৭.৮ বিলিয়ন ডলার। তার মানে ২০১৩ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রায় ৯ বছরে তুরস্কের জিডিপির আকার ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা প্রায় ২৬৫.৮ বিলিয়ন ডলার হ্রাস পেয়েছে। তার পাশাপাশি একই সময়ে ডলারের বিপরীতে তুরস্কের নিজস্ব মুদ্রা লিরার মানের পতন হয়েছে প্রায় ৩০০% পর্যন্ত।

চলতি ২০২২ সালের এপ্রিল মাসের হিসেব অনুযায়ী তুরস্কের সার্বিক বেকারত্বের হার ছিল প্রায় ১১.৩% এবং চলতি আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১০৮.৬৪ বিলিয়ন ডলার। অথচ ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে তুরস্কের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১১৫.১৪ বিলিয়ন ডলার। গত কয়েক বছরে তুরস্কের রিজার্ভের প্রায় ১২৮ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যা তুর্কি সরকারের মতে দেশটির মুদ্রার মানের পতন ঠেকিয়ে রাখতে ব্যবহার করা হয়েছে৷

তুরস্কের সার্বিক অর্থনীতিতে দীর্ঘ মেয়াদী নেতিবাচক প্রবণতা দেখা গেলেও বৈদেশিক বানিজ্যে সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। ২০২১ সালে তুরস্কের মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২২৫ বিলিয়ন ডলার। যা কিনা ২০২০ সাল অপেক্ষা ৩২.৯% বেশি। তাছাড়া একক বছর হিসেবে ২০২১ সালে ইতিহাসে সর্বোচ্চ পরিমানে ২০০ বিলিয়ন ডলারের অধিক পন্য সারা বিশ্বে রপ্তানি করতে সক্ষম হয় দেশটি। যদিও তুরস্কের সরকারের তরফে বৈশ্বিক রপ্তানির টার্গেট ছিল ২০২১ সালে ১৮৪ বিলিয়ন ডলার, ২০২২ সালের টার্গেট ছিল ১৯৮ বিলিয়ন এবং ২০২৩ সালের রপ্তানির টার্গেট নির্ধারণ করা হয় ২১০ বিলিয়ন ডলার। সে হিসেবে তুরস্ক রপ্তানি বানিজ্যে গত বছরই ২০২৩ সালের টার্গেটে পৌঁছে গেছে। বর্তমানে তুর্কী এরদোয়ান সরকার ২০২৩ সালের জন্য সারা বিশ্বে ৩০০ বিলিয়ন ডলারের পন্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে নতুন পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছেন।

তবে ২০২১ সালে তুরস্কের রপ্তানি আয় ইতিবাচকভাবে বৃদ্ধি পেলেও থেমে নেয় দেশটির সার্বিক আমদানি ব্যয়। গত ২৪শে ফেব্রুয়ারি থেকে চলমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের মধ্যেও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে দেশটির আমদানি ব্যয়। ২০২১ সালে তুরস্ক মোট ২৭১ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে সারা বিশ্ব থেকে পন্য, কাঁচামাল, ক্যামিক্যাল, ও জ্বালানী তেল ও গ্যাস আমদানি করতে। তবে ২০২১ সালে আমাদানি-রপ্তানি বানিজ্যে ব্যাপক ঘাটতি থাকলেও বৈদেশিক আমদানি ও রপ্তানি বানিজ্য ভারসাম্যে কিন্তু ইতিবাচক উন্নতি লাভ করেছে দেশটি। আবার বৈদেশিক বাণিজ্যে ডলারের ঘাটতি ৭.৮% হ্রাস পেয়ে ৪৫.৯ বিলিয়ন ডলারে এসে পৌঁছেছে। যা কিনা ২০০৯ সালের পরে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন রেকর্ড ছিল।

Sherazur Rahman

BySherazur Rahman

ভারত খুব সম্ভবত রাশিয়ার কৌশলগত টিইউ-১৬০ হেভী সুপার বোম্বার পেতে যাচ্ছেঃ

ইউরেশিয়া টাইমস নিউজের দেয়া তথ্যমতে, রাশিয়া ভারতকে তাদের লং রেঞ্জের কৌশলগত টিইউ-১৬০ হেভী সুপার বোম্বার এয়ারক্রাফট অফার করেছে। রাশিয়া আপাতত ভারতকে ৬টি এই জাতীয় হেভী বোম্বার এয়ারক্রাফট লিজ দিতে চায়। এর ন্যাটো রিপোটেড কোড নেম হচ্ছে ‘ব্লাকজ্যাক’। বর্তমানে রাশিয়ার বিমান বাহিনীতে মোট ১৫টি টিইউ-১৬০ হেভী সুপার বোম্বার অপারেশনাল রয়েছে এবং এটিই হচ্ছে কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগামী ও বিশাল আকারের বোম্বার বা সামরিক বিমান।

রাশিয়া ইতোমধ্যেই তার বিমান বহরে থাকা ১৫টি পুরনো সুপারসনিক গতির টিইউ-১৬০ বোম্বারকে নতুন প্রযুক্তির সমন্বয়ে আপগ্রেড করে টিইউ-১৬০এম২ সিরিজে উন্নীত করেছে। তাছাড়া নতুন করে আরো ১০টি এই সিরিজের হেভী বোম্বার অর্ডার দিয়ে রেখেছে রাশিয়ার বিমান বাহিনী। এই হেভী বোম্বার এয়ার ক্রাফটের একমাত্র যোগ্য প্রতিদ্বন্দী হচ্ছে আমেরিকার বি-১বি ল্যান্সার সুপার বোম্বার।

সভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর চলতি ২০২২ সালের ১২ই জানুয়ারি রাশিয়ার কাজান এভিয়েশন এন্টারপ্রাইজের প্রডাকশন প্লান্টে তৈরি হওয়া প্রথম হাইলী আপগ্রেডেড এণ্ড লং রেঞ্জের স্ট্যাট্রিজিক টিইউ-১৬০ এম সিরিজের হেভি সুপার বোম্বার রাশিয়ার বিমান বাহিনীর হাতে হস্তান্তর করা হয়। আর রাশিয়ার পুতিন সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট ও তার ন্যাটো জোটকে আকাশ পথে কার্যকরভাবে প্রতিহত করার জন্য আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে এরুপ ৫০টি নতুন প্রজন্মের হেভী সুপার বোম্বার সার্ভিসে আনার মহা পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

রাশিয়ার নতুন প্রজন্মের টিইউ-১৬০ এম বোম্বারকে স্বয়ংক্রিয় চালিত অত্যাধুনিকত প্রতিরক্ষামূলক এইড স্যুট, আপগ্রডেড জ্যামিং প্রতিরোধ সিস্টেমসহ এবং অনন্য অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দ্বারা সজ্জিত করা হয়েছে। পাশাপাশি এটিতে একটি উন্নত এবং নির্ভরযোগ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা ইনস্টল করেছে রাশিয়া। যা স্ট্র্যাটিজিক বোম্বারটিকে যে কোন ধরণের প্রচলিত এবং নিউক্লিয়ার যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ১২,৩০০ কিলোমিটার রেঞ্জে সুপারসনিক গতিতে কমব্যাট মিশন পরিচালনা করার সক্ষমতা প্রদান করে। তাছাড়া রাশিয়ার এতে সর্বাধুনিক এভিয়েশন, রেডার, কমিউনিকেশন এন্ড নেভিগিয়েশন প্রযুক্তি সংযুক্ত করেছে।

রাশিয়া বর্তমানে তাদের উচ্চ প্রযুক্তির টিইউ-১৬০ এম সিরিজের যে হেভী বোম্বারটির ম্যাসিভ প্রডাকশন লাইন চালু করেছে তা আসলে সভিয়েত আমলের কৌশলগত তুপলেভ টিইউ-১৬০ (ব্লাকজ্যাক) লং রেঞ্জ বোম্বারের উন্নত এবং আধুনিক ভার্সন। মুলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত বি-১বি ল্যান্সার এবং নেক্সড জেনারেশন বি-২১ এর যোগ্য কাউন্টার হিসেবে এই হেভী সুপার বোম্বার সার্ভিসে আনতে অত্যাধুনিক টিইউ-১৬০ এম সুপারসনিক গতির পারমাণবিক বোম্বারের প্রডাকসন লাইন চালু করেছে রাশিয়া। তবে কাজান এভিয়েশন প্লান্টে প্রতি বছর মাত্র ১টি থেকে ২টি এই জাতীয় হেভী সুপার বোম্বার উৎপাদন করা সম্ভব।

টিইউ-১৬০ এম রাশিয়ান বোম্বারে পূর্বের চারটি পুরোনো ইঞ্জিনের পরিবর্তে নতুন প্রজন্মের অত্যন্ত শক্তিশালি এনকে-৩২ (Kuznetsov NK-৩২ afterburning turbofan) সিরিজ-২ আফটার বার্নিং টার্বোফ্যান জেট ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে। আর টিইউ-১৬০ বোম্বারের ইন্জিন হচ্ছে বর্তমান বিশ্বে সার্ভিসে থাকা এয়ারক্রাফট গুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ইন্জিন। এনকে -৩২ এর প্রতিটি জেট ইঞ্জিন ৩ হাজার ৪শত কেজি ওজনে ৩০০ কেএন পর্যন্ত থ্রাষ্ট উৎপন্ন করতে সক্ষম। যা এফ-২২ র‍্যাপটারের এর দুই ইন্জিনের মিলিত থ্রাষ্টের চেয়েও প্রায় দ্বিগুণ। আবার এ রকম ৪টি ইন্জিন টিইউ-১৬০ এম স্ট্যাটিজিক বোম্বারে ইন্সটল করা হয়েছে। চারটি এনকে-৩২ সুপার থ্রাস্ট ইঞ্জিনের বদৌলতে এটিই হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগামী বোম্বার এয়ারক্রাফট। টিইউ-১৬০ এম সিরিজের সুপার বোম্বার ম্যাক ২.০২ গাতিতে ৪০ টন ওজনের নিউক্লিয়ার এণ্ড নকভেনশোনাল যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে বিরতী না দিয়েই একটানা ১২,৩০০ কিলোমিটারের দীর্ঘ আকাশ পথ পাড়ি দিতে সক্ষম।

রাশিয়ার কাজান এভিয়েশন এন্টারপ্রাইজ এর প্রডাকশন প্লান্টে টিইউ-১৬০ এম সিরিজের প্রতিটি সুপার বোম্বারের ইউনিট কস্ট ধরা হয়ছে ১৬ বিলিয়ন রুবল বা ২৮০-৩০০ মিলিয়ন ডলার। তাছাড়া এর প্রজেক্ট কস্ট নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮০ বিলিয়ন রুবল বা তিন বিলিয়ন ডলার প্রায়। প্রাথমিকভাবে সংক্ষিপ্ত সময়ে রাশিয়ার স্টাটিজিক নিউক বিমান বাহিনীর জন্য আগামী ২০২৭-২৮ সালের মধ্যেই নুন্যতম ১০টি এই সিরিজের স্ট্যাটিজিক সুপার বোম্বার সরবরাহ করবে কাজান এভিয়েশন এন্টারপ্রাইজ।

এখানে আসলে নতুন প্রজন্মের টিইউ-১৬০ এম সুপার বোম্বার উৎপাদনের ক্ষেত্রে রাশিয়া বিমানের স্টেলথ টেকনোলজির মতো বিষয়কে গুরুত্ব না দিয়ে এর সর্বোচ্চ গতি, ম্যাসিভ ওয়েপন্সস ক্যাপাবিলিটি এবং লং রেঞ্জের মতো প্রযুক্তিগত বিষয়গুলোকে গুরুত্ব প্রদান করে বিশেষভাবে ডিজাইন ও তৈরির কাজে মনোযোগ দিয়েছে। তাই শত্রুর রাডারে ধরা পড়লেও একে ইন্টারসেপ্ট করাটা খুবই কঠিন একটি কাজ হয়ে যাবে। সভিয়েত আমলের তোপলেভ টিইউ-১৬০ এর সর্বোচ্চ গতিবেগ ২.০০ ম্যাক হলেও নতুন প্রজন্মের টিইউ-১৬০এম সুপার বোম্বারের সর্বোচ্চ গতিবেগ ম্যাক ২.৫ পর্যন্ত বা এর এর কাছাকাছি হতে পারে।

১৩,২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাল্লার টিইউ-১৬০ এম২ এর ম্যাক্সিমাম পেলোড ক্যাপাসিটি প্রায় ৪০ হাজার কেজি বা ৪০ টন। এর কম্ব্যাট রেডিয়াস ৭৩০০ কিলোমিটার এবং সার্ভিস সিলিং ১৬ হাজার মিটার। এটি একই সাথে ২০০ কিলোটন ক্ষমতা সম্পন্ন ১২টি ৩০০ কিলোমিটার পাল্লার কেএইচ-৫৫ (প্রচলিত ও পারমাণবিক ওভারহেড) অথবা ১২টি পারমাণবিক ওভারহেড সমৃদ্ধ ৩০০ কিলোমিটার পাল্লার কেএইচ-১৫ ক্রুজ মিসাইল বহন করতে পারবে। তাছাড়া এটি কমপক্ষে ১২টি ক্ষেপনাস্ত্রসহ প্রচলিত গাইডেড এন্ড আইগাইডেড হেভী বোম্বস এন্ড ওয়েপন্সস সিস্টেম বহন করতে পারে।

আসলে তৎকালীন সোভিয়েত আমলে ১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত প্রোটোটাইপ কপিওশ মোট ৩৬টি টিইউ-১৬০ তৈরি করা হয়। পরবর্তী সময়ে চরম আর্থিক সংকটের মুখে এই স্টাটিজিক সুপার বোম্বারের উৎপাদন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয় রাশিয়া। বর্তমানে রাশিয়ার বিমান বাহিনীতে মোট ১৫টি কৌশলগত টিইউ-১৬০ (ব্লাকজ্যাক) বোম্বার, ৩২টি টার্বোপ্রোপ টিইউ-৯৫ বিয়ার এবং ৬৯টি টিইউ-২২এম বোম্বার এয়ারক্রাফট অপারেশনাল রয়েছে।

তবে ১৯৯১ সালের পর ইউক্রেনের কাছে ১৯টি এই জাতীয় টিইউ-১৬০ সুপার বোম্বার ছিল। রাশিয়া থেকে গ্যাস রিলিফ পেতে ১৯৯৯ সালে ৮টি এই জাতীয় বোম্বার রাশিয়ার কাছে হস্তান্তর করে দেয়। অবশিষ্ট ১১টি বোম্বার আমেরিকার আর্থিক সহায়তা প্রাপ্তির চুক্তির আলোকে স্ক্যার্প হিসেবে নিজেই দেশেই ধ্বংস করে ফেলে ইউক্রেন।

সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক ও লেখক, গ্রামঃ ছোট চৌগ্রাম, সিংড়া, নাটোর। sherazbd@gmail.com

BySherazur Rahman

জার্মানির সাবমেরিন রপ্তানিঃ

১৯৬০ সাল থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা বিশ্বের মধ্যে একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক কনভেনশনাল পাওয়ারড ডিজেল ইলেক্টিক সাবমেরিন রপ্তানি করেছে জার্মানী। জার্মানী এই ছয় দশকের মধ্যে ১৭টি দেশে মোট প্রায় ১২০টি সাবমেরিন রপ্তানি করে।

যার মধ্যে জার্মান সবেচেয়ে বেশি সংখ্যক ১২টি করে মোট ২৪টি সাবমেরিন রপ্তানি করেছে তুরস্ক এবং দক্ষিণ কোরিয়ায়। ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনীতে বর্তমানে একটি মাত্র জার্মানীর তৈরি টাইপ-২০৯/১৩০০ সিরিজের (কেআরআই কাকড়া) ডিজেল ইলেক্ট্রিক এ্যাটাক সাবমেরিন অপারেশনাল রয়েছে।

তাছাড়া ইসরাইলে ডলফিন ক্লাস সাবমেরিন রপ্তানি করেছে মোট ৬টি। ভারত মোট ৪টি জার্মানির তৈরি টাইপ-২০৯ শিশুমার ক্লাস সাবমেরিন অপারেট করে। যার মধ্যে দুটি সার্ভিসে এসেছে ১৯৯০ সালে এবং ১৯৯২ সালে।

তবে আশ্চর্যজনক যে, বিগত প্রায় ৬০ বছরে জার্মান সারা বিশ্বের প্রায় ১২০টি বা তার কাছাকাছি সাবমেরিন সারা বিশ্বে রপ্তানি করলেও তাদের নিজের নৌবাহিনীতে টাইপ-২১২ ক্লাস সাবমেরিন আছে মাত্র ৬টি।

সাবমেরিন ডিজাইন ও তৈরিতে বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে ব্যাপক সুখ্যাতি লাভ করে জার্মানী। তাছাড়া জার্মানী তথা সারা বিশ্বের বিখ্যাত কনভেনশনাল এ্যাটাক সাবমেরিন ডিজাইন ও বিল্ডার কোম্পানি হচ্ছে thyssenkrupp Marine Systems (tkMS)। তাছাড়া সাবমেরিনের উন্নত মানের ডিজেল ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিন ম্যানুফ্যাকচারিং এ সবার উপরে উঠে এসেছে জার্মানীর নাম। এমনকি চীন নিজেও সাবমেরিন ডিজাইন ও তৈরি করলেও এর ইঞ্জিন কিন্তু জার্মানী থেকে আমদানি করে ইনস্টল করে।

জার্মান বর্তমানে টাইপ-২১২এ, টাইপ-২১৪ এবং ডলফিন ক্লাস সাবমেরিন তৈরি ও রপ্তানি করে থাকে। তবে অত্যন্ত দূঃখজনক হলেও সত্য যে, চলতি ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে ইন্দোনেশিয়া নৌবাহিনীর জার্মানির তৈরি ৪২ বছরের অতি পুরনো একটি টাইপ-২০৯ ক্লাসের (কেআরআই নাঙ্গালা) সাবমেরিন বালি সমুদ্রের গভীরে ধ্বংস হয়ে ৫৩ জন নিরীহ অফিসার এবং ক্রু মৃত্যুবরণ করেন।

Sherazur Rahman

BySherazur Rahman

একেবারে নতুন কনসেপ্টের এক ভয়ানক অস্ত্র ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক পালস বা (ইএমপি)ঃ

বর্তমানে বিশ্বের সামরিক শক্তিধর দেশগুলো নিউক্লিয়ার এন্ড থার্মোনিউক্লিয়ার অস্ত্রের আধুনিকায়নের পাশাপাশি একেবারেই নতুন কনসেপ্টের আরো মারাত্বক কিছু অস্ত্র তৈরির গোপন নেশায় মেতে উঠেছে। আর এই নতুন ভয়ানক অস্ত্রের নাম হচ্ছে ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক পালস বা (ইএমপি)। রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দীর্ঘ মেয়াদী অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে চীনও কিন্তু একেবারে নিজস্ব প্রযুক্তির ইলেকট্রোম্যাগনেটিক পালস (ইএমপি) প্রযুক্তি সমৃদ্ধ হাইপারসনিক গতির ক্ষেপণাস্ত্র বিশ্বের সামনে উম্মোচন করেছে। তবে এই নতুন প্রজন্মের অস্ত্র প্রতিযোগিতায় আমেরিকা, রাশিয়া এবং চিনের পাশাপাশি ভারতের নামও কিন্তু উঠে এসেছে। তাছাড়া অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা উত্তর কোরিয়াও কিন্তু এই জাতীয় মারাত্বক অস্ত্র তৈরিতে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে বলে মনে করা হয়।

নন-নিউক্লিয়ার ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক পালস (ইএমপি) রশ্মি ছুড়তে আসলে অত্যাধুনিক মিসাইল ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে ইলেক্ট্রন শক্তির প্রবল চাপ তৈরি করতে ব্যবহার করা হয় অতি শক্তিশালী মাইক্রোওয়েভ ওভেন। এই শক্তি বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রে, চুম্বকীয় ক্ষেত্রে, বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বিকিরণ ও বৈদ্যুতিক পরিচলন রূপে অতিক্রম করতে পারে। আর ইলেক্ট্রন ও চুম্বকীয় শক্তির উচ্চ মাত্রায় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ব্যাপক আলোক রশ্মির আঘাত করাই হলো ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক পালস (ইএমপি) অস্ত্রের মূল যাদুমন্ত্র।

একটি নিদিষ্ট এলাকায় ইএমপি অস্ত্র আঘাত হানার পর সেখানে রাসায়নিক বিস্ফোরণ ঘটায় এবং ফ্লাক্স কমপ্রেশন জেনারেটর নামে পরিচিত বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত চুম্বককে সংকুচিত করে ফেলে। যার ফলস্রুতিতে তৈরি হওয়া শক এনার্জি অত্যন্ত শক্তিশালী ইলেকট্রন এবং চুম্বকীয় শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। এটা অনেকটা লেজার রশ্মি বা বজ্রপাতের আঘাত জনিত একটি বিষয়ের মতো। একই সময়ে আকাশে লক্ষ লক্ষ বজ্রপাত হলে যে ভয়ানক আলোকরশ্মি সৃষ্টি হবে, ঠিক ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক পালস (ইএমপি) এর আঘাতে তার থেকে কয়েক গুন বেশি আলোক রশ্মি সৃষ্টি হতে পারে।

আকাশে মাত্রাতিরিক্ত বজ্রপাত যেমন ভূ-পৃষ্ঠে থাকা অবকাঠামো, পাওয়ার গ্রীড, রেডার এন্ড কমিউনিকেশন সিস্টেম নষ্ট করে দিতে পারে। ঠিক তেমনি ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক পালস (ইএমপি) রশ্মিও পাওয়ার গ্রীড, বৈদুতিক সাজ সরঞ্জাম এবং বিমান পরিবহণ ব্যবস্থা এক নিমেষেই ধ্বংস করে দিতে সক্ষম। এ রশ্মি সরাসরি সরল পথে এবং আঁকাবাঁকা পথে দু-ভাবেই চলতে পারে।

উচ্চ প্রযুক্তির হাইপারসনিক মিসাইল সিস্টেমের মাধম্যে শত্রু দেশের উপর হামলা করা হলে ইএমপি রশ্মি বায়ু মণ্ডলকে বিরাট ঝাকুনি দিতে দিতে ভূ-পৃষ্ঠে ভূপাতিত হবে এবং চারপাশ চরম মাত্রায় উত্তপ্ত করে ভূমি থেকে ৬০ মাইল উচু থেকে ১.৫ মিলিয়ন বর্গ মাইল এলাকায় থাকা ইলেক্ট্রিক ব্যবস্থা এবং ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতি এবং সাজ সরঞ্জাম ধ্বংস করে দিতে পারে এক নিমেষেই। আবার বৈদ্যুতিক তারের মাধম্যেও ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক পালস (ইএমপি) অস্ত্র প্রয়োগ করা সম্ভব জানিয়েছেন সামরিক প্রযুক্তিবিদেরা।

অন্যদিকে ইএমপি অস্ত্র ব্যবহারে নিশ্চিতভাবেই যে কোন দেশের জাতীয় নিরাপত্তা তথ্য ব্যবস্থা খুব দ্রুত হ্যাক বা ধ্বংস করা সম্ভব। এক গবেষণামুলক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ভবিষ্যতে রাশিয়া বা চিনের গোপন ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক পালস (ইএমপি) অস্ত্র হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় তথ্য এবং পাওয়ার গ্রীড ও সরবরাহ ব্যবস্থা ধ্বংস করা হলে তা পুনরুদ্ধারে প্রায় এক যুগ লেগে যাবে এবং খরচ হবে আনুমানিক প্রায় চার ট্রিলিয়ন ডলার।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০১২ সালে প্রথমবারের মতো এই নতুন প্রযুক্তির ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক পালস (ইএমপি) অস্ত্রের বেশকিছু গোপন পরীক্ষা চালায়। মার্কিন গণমাধ্যমের তথ্যমতে, মার্কিন বিমানবাহিনী ও বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠাতা বোয়িং কর্পোরেশন যৌথভাবে নন-নিউক্লিয়ার ইএমপি তৈরি্তে কাজ করেছে। ‘চ্যাম্প’ বা কাউন্টার-ইলেকট্রনিক্স হাই পাওয়ার্ড মাইক্রোওয়েভ অ্যাডভান্সড মিসাইল প্রজেক্টের অধীনে তৈরি করা হচ্ছে। আর ইতোমধ্যেই রাশিয়াও এ অস্ত্রের গোপন পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে।

চীন খুব সম্ভবত গত ২০২১ সালের শেষের দিকে ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক পালস (ইএমপি) প্রযুক্তি সমৃদ্ধ হাইপারসনিক মিসাইলের পরীক্ষা সম্পন্ন করেছিল। চীনের নিজস্ব প্রযুক্তির তৈরি ম্যাক ৭ গতি সম্পন্ন হাইপারসনিক মিসাইলের কার্যকরী রেঞ্জ হচ্ছে ৩,২০০ কিলোমিটার। এটি প্রচলিত ক্ষেপণাস্ত্রের মতো তার লক্ষবস্তুতে ওয়ারহেড হীট না করে বরং তার শত্রু পক্ষের নিদিষ্ট অবস্থানে রসায়নিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সেখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা, কম্পিউটার, রাডার সিস্টেম এণ্ড এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের সকল ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস ধ্বংস করার পাশাপাশি বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা একেবারে অচল করে দিতে পারে বলে চীনের মিডিয়ায় প্রচার করা হয়।

এদিকে ভারত কার্যত ২০০৪ সাল থেকেই তাদের নিজস্ব প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনী সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে কালি-৫০০০ নামে নতুন এই ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক পালস (ইএমপি) অস্ত্র তৈরি ও গবেষণায় অনেক দূর এগিয়ে গেছে বলে মনে করা হয়। যদিও ভারতের তরফে এ নিয়ে খুব একটা তথ্য মিডিয়ায় প্রচার করা হয় না।

Sherazur Rahman

BySherazur Rahman

রাশিয়ার নতুন প্রজন্মের আরএস-২৮ সারমাট ইন্টার কন্টিন্যান্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল (আইসিবিএম) বাস্তবতা নাকি প্রোপাগান্ডাঃ

ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসনের মধ্যেই রাশিয়া গত ২০শে এপ্রিল নতুন প্রজন্মের এক অত্যন্ত ভয়ঙ্কর আরএস-২৮ সারমাট ইন্টার কন্টিন্যান্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইলের সফল পরীক্ষা সম্পন্ন করে। মুলত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন নিজেই গণমাধ্যমে বিষয়টি প্রকাশ করেছিলেন। রাশিয়া বিরোধী শক্তি আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের সকল দেশকে সতর্ক বার্তা দিয়ে তিনি বলেছেন, “নিউক্লিয়ার এণ্ড থার্মোনিউক্লিয়ার ওয়ারহেড বহণে সক্ষম আরএস-২৮ সারমাট (সার্টান-২) ইন্টারকন্টিন্যান্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইলটি ক্রেমলিনের শত্রুদের কিছু করার আগে অবশ্যই দ্বিতীয়বার ভাবতে হবে”। তার ভাষায় এটি রাশিয়ার একটি ‘অপারেজয়’ অস্ত্র।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ন্যাটো জোটকে কৌশলগতভাবে মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যে নতুন প্রজন্মের আরএস-২৮ সারমাট (সার্টান-২) ইন্টার কন্টিন্যানটাল ব্যালেস্টিক মিসাইল (আইসিবিএম) বা নিউক্লিয়ার এন্ড থার্মোনিউক্লিয়ার ওয়ারহেড ক্যাপবল মিসাইল চলতি ২০২২ সালের শেষের দিকে সার্ভিসে আনতে ব্যাপকভাবে কাজ করে যাচ্ছে রাশিয়া। বর্তমানে রাশিয়ার স্ট্র্যাটিজিক রকেট ফোর্সেস ইউনিটের হাতে থাকা সভিয়েত আমলের পুরনো কথিত ১৬ হাজার কিলোমিটার রেঞ্জের আরএস-৩৬ ইন্টারকন্টিন্যান্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল (আইসিবিএম) এর রিপ্লেস হিসেবে আরো আধুনিক এবং অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ১৮ হাজার কিলোমিটার রেঞ্জের ২০টি আরএস-২৮ সারমাট (আইসিবিএম) সার্ভিসে আনতে চূড়ান্তভাবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিয়েছে রাশিয়া। যদিও রাশিয়া ২০০৯ সাল থেকে এই মিসাইল নিয়ে গবেষণা ও ডেভলপমেন্ট শুরু করে।

২০২০ সালের দিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন কোন এক সামরিক মহড়া চলাকালে জানিয়েছিলেন, রাশিয়ার অস্ত্র ভাণ্ডারে থাকা কৌশলগত আরএস-২৮ সারমাট (আইসিবিএম) মিসাইল কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমেরিকার টেক্সাস রাজ্য, ফ্রান্স কিংবা জার্মানীর মতো বড় একটি দেশকে পুরোপু্রি ধ্বংস বা মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে সক্ষম হবে। যদিও পুতিন কিন্তু প্রায়ই অন্য দেশে নিউক্লিয়ার অস্ত্র হামলার পরোক্ষ হুমকী দেয়া এবং তার পাশাপাশি অযৌক্তিক বা বারাবাড়ি রকমের বক্তব্য দিয়ে পশ্চিমা বিশ্বকে ভয় দেখিয়ে থাকেন। তাছাড়া মাঝে মধ্যের রাশিয়া ছাড়াও আরো দুটি দেশ পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়া তার শত্রু দেশের উপর নিউক্লিয়ার মিসাইল হামলার ফাঁকা হুমকী দিয়ে থাকে।

১০৮.১ টন ওজন বিশিষ্ট রাশিয়ার আরএস-২৮ বা (শয়তান) খ্যাত ইন্টার কন্টিন্যানট্যাল ব্যালেস্টিক মিসাইলটিকে ১০টি বড় আকারের কিংবা ১৫টি ছোট আকারের নিউক্লিয়ার এণ্ড থার্মোনিউক্লিয়ার ওয়ারহেড (এমআইআরভি) বহন করার উপযোগী করে বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছে। এর সর্বোচ্চ পেলোড ক্যাপাসিটি ১০ টনের কাছাকাছি। এর দৈর্ঘ্য ৩৫.৫ মিটার এবং ডায়ামিটার ৩ মিটার। তাছাড়া এই মিসাইলটি এভেনগার্ড হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকেল বহন করতে পারে। যা কিনা এটিকে একেবারে আরো ভয়ঙ্কর এবং অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে।

আর এটিকে মনে করা হচ্ছে সারা বিশ্বের দেশগুলোর হাতে থাকা এ পর্যন্ত যত পরমাণু অস্ত্রবাহী মিসাইল তৈরি করা হয়েছে আরএস-২৮ সারমাট (আইসিবিএম) মিসাইল হচ্ছে তাদের মধ্যে আকারে সবচেয়ে বড়। তিন স্তরের আরএস-২৮ (আইসিবিএম) মিসাইলটিকে সাইলো বেসড লঞ্চিং প্লটফর্ম থেকে অপারেট করা হয়। তিন স্তরের এই মিসাইলটিতে লিকুইড ফুয়েল হেভী রকেট ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে। রাশিয়ার মিডিয়ার এই মিসাইলের ওয়ারহেডের ধ্বংসক্ষমতা হিরোশিমা কিংবা নাগাসাকিতে ফেলা বোমার থেকে ২ হাজার গুণ বেশি ক্ষমতাসম্পন্নন বলে প্রচার করা হলেও বাস্তবে এটি রাশিয়ার নব্য প্রোপাগান্ডা ছাড়া আর কিছুই নয়।

রাশিয়ার সামরিক বিশেষজ্ঞ এবং প্রযুক্তিবিদদের মতে, আরএস-২৮ সারমাট (আইসিবিএম) মিসাইলটিকে সম্পূর্ণ স্টেলথ প্রযুক্তিতে  তৈরি করা হয়েছে। এটি বিশ্বের যে কোন রাডার সিস্টেমকে ফাঁকি দিয়ে টার্মিনাল ফেজে ২০.৭ ম্যাক গতিতে তার লক্ষ্যবস্তুকে একেবারে নিখুঁতভাবে আঘাত হানতে পারবে। তবে বাস্তবে রাশিয়ার এই অতি ভয়ঙ্কর আরএস-২৮ সারমাট ইন্টারকন্টিন্যান্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল কতটুকু কার্যকর হবে তা কিন্তু শতভাগ নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। তাছাড়া এখনো পর্যন্ত বাস্তব কোন যুদ্ধে এই জাতীয় প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করার সুযোগ পায়নি বিশ্বের কোন পরাশক্তি।

তবে যাই হোক, বিশ্বের বুকে আবারো নিউক্লিয়ার অস্ত্রের উত্তাপ ছড়িয়ে রাশিয়া এখন এক রকম প্রকাশ্যেই চলতি ২০২২ সালেই এই প্রাণঘাতী অস্ত্র সার্ভিসে আনার আগাম ঘোষণা দিয়ে নতুন এক স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা করল মাত্র। আর এখন রাশিয়াকে কৌশলগতভাবে মোকাবেলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার অস্ত্র ভান্ডারে থাকা পুরনো মিনিটম্যান ইন্টারকন্টিন্যান্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল আধুনিকায়নে প্রায় শত বিলিয়ন ডলারের কাছকাছি ফান্ড বরাদ্দ দিয়েছে।  

Sherazur Rahman

BySherazur Rahman

তাইওয়ানকে ঘিরে আমেরিকার উস্কানী কিংবা পাতানো যুদ্ধের ফাঁদে পা দিবে কী চীন?

গত ২ আগস্ট চীনের তীব্র বিরোধীতা এবং প্রবল আপত্তি উপেক্ষা করেই মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি চীনের তাইওয়ান অঞ্চল সফর করেন। এটি আসলে ‘এক চীন নীতি’ এবং চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার তিনটি ইশতেহারের গুরুতর লঙ্ঘন ছিল। যদিও রাশিয়া কিংবা আমেরিকার মতো সুপার পাওয়ার দেশগুলো নিজ স্বার্থে আন্তর্জাতিক আইন কতটুকু মেনে চলে তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ থেকেই যাচ্ছে।

তাইওয়ান থেকে ন্যান্সি পোলিসি চলে গেলে দেশটিকে ঘিরে চাইনিজ পিপলস লিবারেশন আর্মি ব্যাপক আকারের সামরিক মহড়া শুরু করেছে। অনেকে চীন তাইওয়ান যুদ্ধ শুরুর আকাঙ্খা প্রকাশ করলেও বাস্তবে চীন নিজের অর্থনৈতিক ক্ষতি করে এ মুহুর্তে কারো সাথেই যুদ্ধে জড়াবে না। এটাই হচ্ছে চীনের শি জিং পিং সরকারের বর্তমান মূল নীতি। তবে শত সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও চীনের বরাবর এই যুদ্ধ বর্জন নীতি এবং বৈশ্বিক কৌশলকে আমি সম্মান ও স্যালুট জানাচ্ছি।

তবে পেলোসি তাইওয়ান সফর শেষ করার কিছু পরেই দেশটির স্বঘোষিত আকাশ-প্রতিরক্ষা সীমার ভেতরে মিসাইল নিয়ে ঢুকে পড়েছিল চীনের ২৭টি জেট ফাইটার। অথচ চীন কিন্তু ইচ্ছে করলেই তীব্র প্রতিবাদের পাশাপাশি পোলসিকে বহনকারী বিমান বহরকে রাশিয়ার মতো ইন্টারসেপ্ট করার চেষ্টা করে দেখতে পারত। অবশ্য ৮টি মার্কিন এফ-১৫ জয়েন স্টাইক ঈগল জেট ফাইটার থাকায় চীনের বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলো তার ২০০ মাইলের মধ্যে উড্ডয়ন করার সাহস দেখাতে পারেনি। আর এখন হাজার হাজার ব্যারেল তেল পুড়িয়ে লাইভ মিলিটারি এক্সেসাইজ বা মহড়া চালিয়ে লোক হাসানোর কোন মানেই হয় না।

এটা বুঝতে হবে যে চীন কিন্তু নিজের অর্থনৈতিক ক্ষতি করে কারো সাথেই সরাসরি যুদ্ধে জড়াবে না। আর আমেরিকার বিরুদ্ধে তো প্রশ্নই উঠে না। এ পর্যন্ত দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে যত সামরিক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে তা মুলত তীব্র মৌখিক প্রতিবাদ এবং বড় ধরণের সামরিক মহড়ার মধ্যেই সীমিত থেকেছে। যুদ্ধ শুরু করার মতো কোন ভয়াবহ পরিস্থিতি আজও সৃষ্টি হয়নি।

এখানে প্রকাশ থাকে যে, বর্তমানে কিন্তু অতি মাত্রায় ব্যবসায়ী জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। তাই কোন দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসী বা সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার আগে ১০ বার ভেবে হিসাব নিকাশ করে চীন। তাছাড়া ১৯৭৯ সালে সংক্ষিপ্ত এক যুদ্ধে ভিয়েতনামের কাছে খুব করে পেদানি খাওয়ার পর পরবর্তী সময়ে আর কোন দিন সরাসরি কারো সাথেই যুদ্ধে জড়ায়নি রেড জায়ান্ট চীন। তবে অনেকটা অন্যায় করে হলেও ২০২০ সাল থেকে অতন্ত্য সুকৌশলে এবং এক রকম বিনা যুদ্ধেই কিন্তু ভারতের সীমান্ত সংলগ্ন দূর্গম কিছু এলাকা দখল করে রেখেছে চীন।

বিগত চার দশকে আমেরিকা এবং রাশিয়া অন্যায় করে হলেও প্রায় অর্ধ শতাধিক যুদ্ধে জড়িয়েছে। এসব অনৈতিক যুদ্ধে সারা বিশ্বে প্রায় এক কোটির কাছাকাছি সাধারণ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি এখানে সেই বিষয়ের দিকে যাব না। মুলত দীর্ঘ মেয়াদী যুদ্ধ পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতার বিচারে চীন কিন্তু অতি মাত্রায় যুদ্ধবাজ আমেরিকার কাছে কিছুই না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন সুবিশাল আকারের সামরিক বাহিনী গড়ে তুললেও ভয়াবহ যুদ্ধ ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞাতার বিচারে রাশিয়া বা আমেরিকার তুলনায় কম করে হলেও পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে আমার নিজ ধারণা বাস্তবের সাথে যৌক্তিকভাবে সঠিক নাও হতে পারে।

আমেরিকা বা রাশিয়ার মতো সামরিক সুপার পাওয়ার হতে না পারলেও চীন কিন্তু ঠিকই বিশ্বের এক নম্বর অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ২০২২ সালের হিসেব অনুযায়ী চীনের নমিনাল জিডিপির আকার ১৯.৯ ট্রিলিয়ন ডলার এবং দেশটি ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত মাত্র ছয় মাসে বৈদেশিক বানিজ্য বা আমদানি-রপ্তানি করে ২.৯৪ ট্রিলিয়ন ডলার বা ২,৯৪০ বিলিয়ন ডলার। আর এ থেকেই কিন্তু দেশটির সার্বিক অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং বৈশ্বিক গুরত্ব সুস্পষ্টভাবেই ফুঁটে উঠেছে। বর্তমানে সারা বিশ্বের আমদানি রপ্তানি বানিজ্যের ৪০-৫০% একাই নিয়ন্ত্রণ করছে রেড জায়ান্ট চায়না।

SSherazur Rahman

BySherazur Rahman

আমেরিকার কুখ্যাত হেলফায়ার মিসাইলঃ

গত ১লা আগস্ট স্থানীয় সময় ৬টা ১৮ মিনিটে আল কায়দার শীর্ষ নেতা জাওয়াহিরি মার্কিন বিমান বাহিনীর এমকিউ-৯ রিপার কমব্যাট ড্রোন থেকে ছোড়া কুখ্যাত হেলফায়ার (এজিএম-১১৪ আর৯এক্স) মিসাইলের আঘাতে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে লক্ষ্য করে ২টি শর্ট রেঞ্জের হেলফায়ার মিসাইল ফায়ার করা হয় মার্কিন কমব্যাট ড্রোন থেকে।

তাছাড়া ২০২০ সালের ৩ জানুয়ারি ইরাকের রাজধানী বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের কাছে ইরানের আইআরজিসি বিপ্লবী বাহিনীর প্রধান কাসেমি সোলাইমানিকে মার্কিন বিমান বাহিনীর এমকিউ-৯ রিপার কমব্যাট ড্রোন থেকে সেই কুখ্যাত হেলফায়ার মিসাইল হীটের মাধ্যমে হত্যা করে। এই এমকিউ-৯ রিপার কমব্যাট ড্রোন কাতারে অবস্থিত কোন গোপন মার্কিন সামরিক ঘাটি থেকে অপারেট করা হয়।

ইরানের আইআরজিসি বাহিনী কাসেম সোলাইমানীর হত্যার বদলা হিসেবে বিগত দুই বছরে পর্যায়ক্রমে ইরাকে মার্কিন সামরিক ঘাটিতে প্রায় শতাধিক ব্যালেস্টিক মিসাইল ছুড়লেও আজ পর্যন্ত দুই একটি সামরিক যান ধ্বংস হওয়া তো দূরের কথা একজন সেনা হতাহত হওয়ার কোন নজির খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি হেলফায়ার (এজিএম-১১৪) একেবারে স্বল্প পাল্লার ও হালকা ওজনের মিসাইল। যা কিনা বিশ্বের প্রথম কোন শতভাগ সফল একটি লেজার গাইডেড মিসাইল। এর উৎপাদন ১৯৭৪ সালে শুরু করা হলেও এটি প্রথম সার্ভিসে আসে ১৯৮৪ সালে। তখন থেকেই মার্কিন সামরিক বাহিনী এখন পর্যন্ত এই ভয়ংকর হেলফায়ার মিসাইল শতাধিক বার ব্যাবহার করেছে বিভিন্ন গোপন ও সামরিক মিশনে।

লকিহীড মার্টিন কর্পোরেশনের তৈরি মাত্র ৪৫ কেজি ওজনের প্রতিটি হেলফায়ার মিসাইলের ইউনিট কস্ট ১ লক্ষ ৬০ হাজার ডলার। সলিড ফুয়েল রকেট ইঞ্জিন চালিত এই সর্ট রেঞ্জের মিসাইলটিকে ড্রোন, হেলিকপ্টার কিংবা নেভাল প্লটফর্ম থেকেও ফায়ার করা যায়। এর গতি মাত্র ১.৩ ম্যাক।

১.৩ ম্যাক গতি সম্পন্ন হেলফায়ার মিসাইলের কার্যকর রেঞ্জ ০.৫ কিলোমিটার থেকে সর্বোচ্চ মাত্র ১১ কিলোমিটার (এক্সপোর্ট ভার্সন)। তবে খুব সম্ভবত মার্কিন সামরিক বাহিনী নিজেদের জন্য কাস্টমাইজড করা ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত রেঞ্জের এই মিসাইল অপারেট করে।

যুদ্ধক্ষেত্রে এটি এতটাই সফল যে একে মজা করে ফায়ার এণ্ড ফরগেট মিসাইল বলা হয়। বলা চলে সারা বিশ্বের একমাত্র শতভাগ সফল একটি মিসাইল হচ্ছে এয়ার লঞ্চড বেসড লাইট হেলফায়ার (এজিএম-১১৪) মিসাইল।

মার্কিন সামরিক বাহিনী কার্যত ল্যান্ড বেসড ট্যাংক ও সামরিক যান ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে হেলফায়ার (এজিএম-১১৪) মিসাইল ব্যবহার করলেও একেবারে সুনিদিষ্ট ব্যক্তিকে হত্যার উদ্দেশ্যে এর আরো আপডেট ভার্সন হেলফায়ার (এজিএম-১১৪ আর৯এক্স) মিসাইল ব্যবহার করে। নতুন এই মিসাইলে প্রচলিত বিষ্ফোরক ওয়ারহেডের পরিবর্তে ধারালো ৬টি ব্লেড (kinetic warhead with pop-out blades) ব্যবহার করা হয়েছে।

Sherazur Rahman

BySherazur Rahman

যুদ্ধবিমানের পেলোড ক্যাপাসিটি কত?

এভিয়েশন প্রযুক্তির ব্যবহার ও জয়যাত্রা ১৯০৩ সালে শুরু হলেও এই এক বিংশ শতাব্দীতে এসেও বিশ্বের মাত্র তিনটি দেশ একেবারে স্বাধীনভাবে শতভাগ নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে এডভান্স ফাইটার জেট ডিজাইন ও তৈরি করতে সক্ষম। এই তিনটি দেশ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং ফ্রান্স। আর এই তিনটি দেশ ব্যাতিত চীন নিজস্ব প্রযুক্তির জেট ফাইটার তৈরি করলেও ইঞ্জিনসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রযুক্তির জন্য এখনো পর্যন্ত রাশিয়া বা অন্য কোন দেশের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে রয়েছে।

তাছাড়া এই চারটি দেশ ব্যাতিত যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, তুরস্ক, সুইডেন, ভারত, পাকিস্তানের মতো দেশ যুদ্ধবিমান তৈরি করলেও এর প্রযুক্তি এবং বিভিন্ন ধরণের গুরুত্বপূর্ণের যন্ত্রাংশের ৫০% থেকে ৬০% পর্যন্ত অন্য কোন দেশ হতে আমদানি করে আনতে হয়। আবার ইউরোফাইটার তাইফুন যুক্তরাজ্য, জার্মান, ইতালী এবং স্পেন অংশীদ্বারিত্বের ভিত্তিতে ম্যানুফ্যাকচারিং করে। এটিও কিন্তু একক কোন দেশের পক্ষে তৈরি করার সুযোগ নেই।

তবে যাই হোক না কেন, ফাইটার জেটের পেলোড বা অস্ত্র বহণ করার সক্ষমতার বিচারে কাগজে কলমে হলেও সারা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে চীনের চেংদু জে-২০ স্টেলথ জেট ফাইটার। চীনের দেয়া ভাষ্যমতে, তাদের নতুন প্রজন্মের জে-২০ স্টিলথ জেট ফাইটার আনুমানিক ১১,০০০ কেজি বা ১১ টন পে-লোড বহণ করতে সক্ষম।

চীনের তরফে এক্ষেত্রে যাই বলা হোক না কেন, বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কিছু কথা। কারণ চীনের জে-২০ জেট ফাইটের ব্যাবহার করা হয়েছে সেই আশির দশকের রাশিয়ান পুরনো এএল-৩১এফ আফটার টার্বোফ্যান ইঞ্জিন বা চীনের নিজস্ব প্রযুক্তির তৈরি নিম্ন মানের ডাব্লিউএস-১০বি ইঞ্জিন। আর এই জাতীয় পুরনো টুইন ইঞ্জিন দিয়ে ১১টন ওজনের পে-লোড কোন স্টেলথ জেট ফাইটারের পক্ষে আকাশে উড্ডয়ন করা কতটুকু সম্ভব তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ঠ অবকাশ থেকেই যাচ্ছে। তবে অদূর ভবিষ্যতে চীন তাদের নতুন প্রজন্মের জেট ফাইটারে হাইলী এডভান্স জিয়ান ডাব্লিউএস-১৫ আফটার টার্বোফ্যান জেট ইঞ্জিন ব্যবহার শুরু করতে যাচ্ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সত্তরের দশকের জয়েন্ট স্টাইক এফ-১৫ এর পরীক্ষিত পে-লোড ক্যাপাসিটি বা অস্ত্র বহণ করার ক্ষমতা ১০,৪০০ কেজি বা ১০.৪ টন। যা কিনা যুদ্ধবিমানটিকে এক রকম নিশ্চিতভাবেই বিশ্বের শীর্ষ স্থানীয় সক্ষমতার জেট ফাইটারের স্থানে নিয়ে গেছে বহু আগেই। এফ-১৫ প্রায় চার দশক ধরে আকাশ যুদ্ধে রাজত্ব করে বেড়াচ্ছে।

আমেরিকার নতুন প্রজন্মের এফ-৩৫ জয়েন স্টাইক স্টেলথ জেট ফাইটারের মোট পেলোড ক্যাপাসিটি ৮,২০০ কেজি হলেও শুধু ‘ওয়েপন্স-বে’ তে এর ম্যাক্সিমাম পেলোড ক্যাপাসিটি ২,৬০০ কেজি এবং এফ-২২ র‍্যাপ্টারের ‘ওয়েপন্স-বে’ তে পেলোড ক্যাপাসিটি ২,২০০ কেজি।

বিশ্বের সেরা ২০০ কিলমিটার রেঞ্জের মেটওর এয়ার টু এয়ার (বিভিআর) মিসাইল সমৃদ্ধ ফ্রান্সের এডভান্স রাফায়েল জেট ফাইটারের ম্যাক্সিমাম পে-লোড ক্যাপাসিটি ৯.৫ টন। ইউরোফাইটার টাইফুনের পে-লোড ক্যাপাসিটি ৯ টন। আবার রাশিয়ার এসইউ-৫৭ সুপার স্টিলথ এয়ার সুপিউরিটি জেট ফাইটারের পে-লোড ক্যাপাসিটি ৯ টন, এসইউ-৩৫এস সিরিজের জেট ফাইটারের পে-লোড ক্যাপাসিটি ৮ টন, মিগ-৩৫ এর পে-লোড ক্যাপাসিটি ৬.৫ টন এবং এসইউ-৩০ এসএমই জেট ফাইটারের পে-লোড কযাপাসিটি ৮ টন।

এদিকে সিঙ্গেল ইঞ্জিনের জেট ফাইটারের বিবেচনায় মার্কিন এফ-১৬ এর পে-লোড ক্যাপাসিটি ৭.৭ টন বা ৭,৭০০ কেজি, সুইডিস গ্রোপেন-ই জেট ফাইটারের ম্যাক্সিমাম পে-লোড ক্যাপাসিটি ৫,৩০০ কেজি বা ৫.৩ টন, ভারতের তেজাস হাল লাইট জেট ফাইটারের পে-লোড ক্যাপাসিটি ৫,৭০০ কেজি বা ৫.৭ টন, চীন-পাকিস্তান জয়েন্ট প্রডাক্ট জেএফ-১৭ থাণ্ডার লাইট জেট ফাইটারের ম্যাক্সিমাম পে-লোড ক্যাপাসিটি ৫.৫ টন বা ৫,৫০০ কেজি এবং চীনের জে-১০ সিঙ্গেল ইঞ্জিন জেট ফাইটারের ম্যাক্সিমাম পে-লোড ক্যাপাসিটি ৭ টন বা ৭,০০০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকতে পারে।

তবে বিশ্বের এভিয়েশন প্রযুক্তি নির্ভর অনেক দেশকে ছাপিয়ে নতুন প্রজন্মের স্টেলথ জেট ফাইটারের সফল ফ্লাইট টেস্ট সম্পন্ন করেছে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশ দক্ষিণ কোরিয়া। দেশটি মুলত গত ১৯শে জুলাই বিশ্বের চতুর্থ একক দেশ হিসেবে তাদের কেএফ-২১ নেক্সড জেনারেশন ফাইটার জেটের পরীক্ষামুলক সফল উড্ডয়ন শেষ করে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার দেয়া তথ্যমতে, ২,৯০০ কিলোমিটার রেঞ্জের কেএফ-২১ নেক্সড জেনারেশন যুদ্ধবিমান আনুমানিক ৩ হাজার কেজি পর্যন্ত অস্ত্র ও মিসাইল ধারণ করতে সক্ষম।

Sherazur Rahman