Yearly Archive October 25, 2021

Byসরোয়ার আলম

১০ দেশের রাষ্ট্রদূত বহিষ্কারে কঠোর অবস্থানে তুরস্ক

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি এবং ফ্রান্সসহ দশটি দেশের রাষ্ট্রদূতদের তুরস্কে অবাঞ্চিত ঘোষণা করার যে হুমকি দিয়েছেন দেশটির রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগান, তা নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে এখন নতুন পরিকল্পনা চলছে। 

জার্মানি জানিয়েছে যে, তুরস্কের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে তারা অন্য সব দেশের আলোচনা করবে। 

গত সোমবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স, কানাডা, নেদারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক এবং নিউজিল্যান্ডের তুরস্কে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতরা এক যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেন। সেখানে তারা তুরস্কে আটক ওসমান কাভালা নামক এক তুর্কি ব্যবসায়ীর অনতিবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তির দাবি করেন।

বিবৃতিতে তারা জানান যে, চার বছর ধরে জেলে থাকা কাভালার এই পরিস্থিতি প্রমাণ করে যে তুরস্কে আইনের শাসন এবং গণতন্ত্র হুমকির মুখে। 

আদালতে বিচারাধীন এক তুর্কি নাগরিককে ‘অনতিবিলম্বে মুক্তির’ এই দাবিকে আঙ্কারা দেখছে তার দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের হস্তক্ষেপ হিসেবে। 

যদিও কাভালাকে পশ্চিমা মিডিয়া এবং রাষ্ট্রদূত, সুশীল সমাজ, সাংবাদিকরা অনেক বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ একজন ‘সমাজকর্মী’ এবং ‘জন হিতৈষী ব্যক্তি’ হিসেবে। কিন্তু তার আসল পরিচয় তিনি একজন ব্যবসায়ী। 

যে কারণে পশ্চিমাদের প্রিয়পাত্র কাভালা

যুক্তরাষ্ট্রে পড়ালেখা শেষ করার পর বাবার ব্যবসার হাল ধরেন। কট্টর বামপন্থি হিসেবে পরিচিত কাভালা পরবর্তীতে তার এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি গড়ে তোলেন বিভিন্ন ধরণের এনজিও। যেগুলো মূলত সংখ্যালঘুদের নিয়ে কাজ করে। যেমন কুর্দি বামপন্থি সংগঠন, আর্মেনীয় খ্রিস্টান গ্রুপ, সমকামী অধিকার প্রতিষ্ঠা গ্রুপসহ আরও অনেকে গোষ্ঠী তার এই সব এনজিও থেকে বিভিন্ন ধরণের ট্রেনিং এবং আর্থিক সহযোগিতা পেত। কাভালার এই সব এনজিওগুলোকে অর্থ সাপ্লাই দিতো পশ্চিমা অনেক বড় বড় সংস্থা। যাদের মধ্যে জর্জ সরোস এর ওপেন সোসাইটি অন্যতম। 

তুরস্ক যে কারণে কাভালাকে সাজা দিয়েছে

তুরস্ক সরকারের দাবি, কাভালা এবং তার এই এনজিওগুলো ২০১৩ সালে গেযি পার্ক বিক্ষোভে এবং ২০১৬ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পিছনে কলকাঠি নেড়েছে। এই এনজিওগুলো পশ্চিমাদের সহযোগিতায় এবং পশ্চিমাদের মদদে এই কাজগুলো করেছে তুরস্কের সরকারকে উৎখাত করতে। এমনকি কাভালা তুরস্কের সেই ২০১৬ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের সময় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর একজন গুপ্তচরের সঙ্গে বৈঠক করেন বলেও দাবি করছে সরকার।

এসব বিষয় নিয়ে তার বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা দায়ের করা হয়। তিনি ইতিমধ্যে দুইটি মামলায় খালাস পান। কিন্তু এখনো কিছু মামলা প্রক্রিয়াধীন আছে। অনেকে ধারণা করছেন যে, কাভালার বাকি মামলাগুলো থেকেও আগামী ২৪শে নভেম্বর খালাস পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। 

কিন্তু এরই মধ্যে পশ্চিমা ১০টি দেশের এই ধরণের বিবৃতি আসলে তার এই বিচার প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলল। তাদের এই বিবৃতিকে তুরস্কের সরকার তার স্বাধীন বিচার বিভাগের ওপর বহির্বিশ্বের হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছে। 

কড়া অবস্থানে তুরস্ক

ওই বিবৃতির প্রতিক্রিয়ায় তুরস্কের রাষ্ট্রপতি এরদোগান ওই রাষ্ট্রদূতদেরকে তুরস্ক থেকে বহিষ্কারের ইঙ্গিত দিয়েছেন। 

তিনি জানান, দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে তিনি আদেশ দিয়েছেন এই সব ডিপ্লোম্যাটদের যেন ‘অবাঞ্ছিত ঘোষণা’ করা হয়। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় যদি সত্যিই তাদেরকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করে এবং তুরস্ক থেকে বহিষ্কার করে তাহলে সেটা হবে তুরস্কের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত। দেশটি এর আগে কখনও এতোগুলো বিদেশী কূটনীতিকের বিরুদ্ধে একত্রে এ ধরণের সিদ্ধান্ত নেয়নি। তাই এখন এ ধরণের সিদ্ধান্ত নিলে তুরস্কের সাথে পশ্চিমাদের বড় ধরণের দ্বন্দ্ব লাগার আশংকা প্রকটা 

যদিও এখানে আসল প্রশ্নটি হচ্ছে, কেন ওই ১০ রাষ্ট্রদূত এই মুহূর্তে এ ধরনের একটা বিবৃতি দিয়ে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর প্রয়োজন অনুভব করলেন? তারা কি আসলেই কাভালাকে অনেক বেশি ভালোবাসেন? তাহলে তার প্রতি তাদের এতো দরদ কেন? আর যদি তারা সত্যি সত্যিই আইনের শাসন আর গণতন্ত্রের প্রতি তাদের অগাধ শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা থেকে এই কাজটি করেন তাহলে আরও কিছু প্রশ্ন সামনে আসে। 

পশ্চিমাদের দ্বিমুখী নীতি

সেগুলো হলো, গণতন্ত্র আর আইনের শাসন কি শুধু তুরস্কের বিষয় আসলেই তাদের ঘাড়ে চেপে বসে? তা না হলে মিশরে, সৌদি আরবে, অন্যান্য দেশে যত লোককে জেলে পুরে রাখা হয়েছে, ফাঁসি দেয়া হয়েছে, তখন তাদের এই গণতন্ত্র আর আইনের শাসনের বুলি কোথায় ছিল? কাভালা তো একজন ব্যবসায়ী, এমনকি কোন রাজনৈতিক নেতাও না। যদিও পশ্চিমা মিডিয়া এবং এই সুশীলরা তাকে এক জন

জনহিতৈষী এবং এরদোগান বিরোধী হিসেবে পরিচিত করার চেষ্টা করছে। কারণ এভাবে পরিচিত করতে পারলে সরকারকে দোষ দেয়া সহজ।

কিন্তু মিশরে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে জেলে রাখলো সামরিক জান্তা, সেখানে কয়েকশ মানুষকে মেরে ফেলা হল। সৌদি আরবে বিরোধীদের নিরাপদে চলাফেরা তো দূরের কোথা মুখ খুলে কথা বলতে পর্যন্ত দেয়া হয় না। সেখানে তারা কেন তুরস্ককে গণতন্ত্র শিখাতে আসেন? 

যেখানে ইউরোপের সবচেয়ে নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার ক্ষমতায় এসেছে। এবং সব বিরোধী দল এবং তাদের নেতাকর্মীরা (যদি সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে তাদের কোন সরাসরি যোগসাজশ না থাকে) মুক্তভাবে তাদের রাজনীতি, মিছিল মিটিং, মিডিয়া প্রোপাগান্ডা করে যাচ্ছে। তুরস্কে এখনো যে পত্রিকা বা টিভিগুলো বেশি দেখা হয় তাদের শুরুতেই আছে কট্টর বিরোধী ঘরানার মিডিয়া। 

এসব কারণে সরকার ধারণা করছে, ওই দশ রাষ্ট্রদূতের বিবৃতির আসল উদ্দেশ্য তুরস্কের আইনের শাসন বা গণতন্ত্র নিয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ না। এমনকি কাভালার মুক্তিও না। কারণ তারা যদি সত্যি সত্যি কাভালার মুক্তি চাইতো তাহলে এই বিষয়ে তুরস্কের সাধারণ মানুষকে টার্গেট করে এই ধরণের একটা বিবৃতি তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিত না। বরং তারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তব্যস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারতো। এবং সেক্ষেত্রে তারা এই বিচার প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণেরও আবেদন করতে পারতো। কিন্তু সেটা না করে তারা অনেক কৌশল করেই তুরস্কের জনগণকে একটা মেসেজ দেয়ার জন্য এই কাজটি করছে বলে সরকার মনে করছে। বিশেষ করে তুরস্কের বিরোধী দলকে একটা মেসেজ দেয়ার চেষ্টা করছে তারা। 

যে কারণে কঠোর অবস্থানে এরদোগান সরকার

এই বিবৃতির তিন দিন আগে প্রধান বিরোধী দল সিএইচপি -এর নেতা কামাল ক্লিচদারওগ্লু একটা বিবৃতি দেন এবং সেখানে তিনি সরকারী আমলাদের হুমকি দেন। সেখানে তিনি বলেন, “আগামী ১৮ অক্টোবর থেকে তুরস্কে নতুন যুগের সূচনা হবে। আপনারা (আমলারা) সাবধান হয়ে যান। ওই দিনের পর থেকে কোন আমলা যদি এরদোগানের (সরকারের) কথায় কাজ করে তাহলে তাদেরকে ছাড় দেয়া হবে না।” 

এই ঘোষণার তিন দিন পর, অর্থাৎ ১৮ই অক্টোবর এই দশ দেশের রাষ্ট্রদূতরা কাভালাকে নিয়ে ওই বিবৃতি প্রকাশ করে। তাই ধারণা করা হয় ওই রাষ্ট্রদূতদের বিবৃতি আসলে কাভালার মুক্তির চেয়েও বরং বিরোধীদেরকে একটা মেসেজ দেয়া, যে আমরা তোমাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করছি। কেননা, ওই বিবৃতি প্রকাশের পরে তুরস্কের সরকার যে এর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিক্রিয়া দেখাবে সেটা আপনার আমার মতো সাধারণ মানুষরা বুঝতে পারলে ওই সব রাষ্ট্রদূতরা কি আসলেই বুঝতে পারেননি। তারা কি এটা হিসেব করেনি যে এই বিবৃতির পরে এরদোগান আরও কঠিন পদক্ষেপ নিবে? অবশ্যই হিসেব করেছে এবং সে হিসেবেই তাকে ক্ষেপানোর জন্য এই পন্থা অবলম্বন করেছে। অর্থাৎ এখানে কাভালা আসলে একটা উছিলা আসল উদ্দেশ্য তার মুক্তি বা তুরস্কের গণতন্ত্র না। আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে তুরস্কের আগামী নির্বাচনে এরদোগানের পতন তরান্বিত করতে নতুন একটা চাল। 

এখন, এ ধরণের একটা পদক্ষেপের বিরুদ্ধে এরদোগান কেন তাদেরকে বহিষ্কারের মত এত কড়া সিদ্ধান্ত নেয়ার হুমকি দিলেন? তিনি কি জানেন না যে এই দশ দেশের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার মানে হচ্ছে পুরা পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষানর শামিল? তিনি কি জানেন না যে এই সিদ্ধান্ত নিলে ওই দেশগুলো আরও বেশি কঠোর পদক্ষেপ নিবে তুরস্কের বিরুদ্ধে। কারণ ওই দেশগুলোর সবগুলোই OECD সদস্য, এদের সাতটা ন্যাটো সদস্য, ছয়টা ইইউ সদস্য, চারটা জি-৭ এর সদস্য, দুটো জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দেয়ার ক্ষমতা রাখে, আর এদের মধ্যে পাঁচটি তুরস্কের গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী অংশীদার। 

আসলে পশ্চিমাদের এই ধরণের বিবৃতিগুলো শত্রু দেশের সরকারকে ক্ষেপিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে দেয়া হয়। কারণ ওই সরকারকে যতই ক্ষেপানো যাবে ততই সে ভুল সিদ্ধান্ত নিবে এবং পশ্চিমারা তা থেকে ফায়দা লুটবে। এ কারণে পশ্চিমাদের এই ধরণের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে রাশিয়া তাৎক্ষনিক কোন পদক্ষেপ নেয় না। মোক্ষম সময়ের জন্য অপেক্ষা করে। কারণ আপনার শত্রু এরপর আপনি কি পদক্ষেপ নিতে পারেন সেটা আগেই হিসেব করে তাদের পরবর্তী করণীয় ঠিক করে রাখে। অর্থাৎ তারা আপনার থেকে সবসময় এক ধাপ এগিয়ে থাকে। এ কারণে এই ধরণের পদক্ষেপের পরে সাথে সাথেই বড় কোন সিদ্ধান্ত না নিয়ে চুপ থাকা উত্তম। তাতে শত্রুরা বিভ্রান্ত হয়। 

কিন্তু এরদোগান সে পথে হাঁটেননি। তিনি ডাইরেক্ট একশনে যাচ্ছেন। এর পরিনাম কী হবে কেউ আন্দাজ করতে পারছে না। 

পশ্চিমারা এখন কী করবে?

পশ্চিমারা এর বিরুদ্ধে কি ধরণের পদক্ষেপ নিবে, তুরস্ক সেই পদক্ষেপের জবাব কিভাবে দিবে? এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে পশ্চিমারা তুরস্কের দুর্বল পয়েন্টে আঘাত করবে আর এখনকার সবচেয়ে দুর্বল পয়েন্ট হচ্ছে অর্থনীতি। সেখানেই আঘাত করবে। ইতিমধ্যে অবশ্য সে আঘাত শুরু হয়ে গেছে। 

যে কারণে কঠোর অবস্থানে এরদোগান

এখন এরদোগান হয়তো ভাবছেন, যে এই পশ্চিমা কূটনীতিকদের মুখ এখনই বন্ধ করতে না পারলে, তাদেরকে এখনই সমুচিত জবাব না দিলে আগামীতে তারা তুরস্কের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আরও বেশি নাক গলাবে। সামনের নির্বাচনে বিরোধীদের সাপোর্ট দিতে বিভিন্ন ঠুনকো বিষয়ে সরকারের বিরুদ্ধে আরও বেশি ছুড়ি ঘুরানোর চেষ্টা করবে। তাই এখনই যে কোনো মূল্যে তাদের টুঁটি চেপে ধরতে চাইছেন হয়তো। এখন যদি তিনি নমনীয় হন তাহলে ভবিষ্যতে হয়ত ১৫ দেশ ২০ দেশ বা পুরো ইইউ, ন্যাটো, OECD সদস্য দেশগুলো একত্র হয়ে তুরস্কের বিরুদ্ধে বিশেষ করে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে একত্রে চড়াও হবে। 

তুরস্কের বিষয়ে ইউরোপীয় নেতারা দ্বিধাবিভক্ত

তবে এখানে, আরেকটা বিষয় লক্ষণীয় যে, রাষ্ট্রদূতদের ওই বিবৃতিতে অনেকগুলো ইউরোপীয় দেশই স্বাক্ষর করেনি বা যোগ দেয়নি। তাদের মধ্যে ব্রিটেন, স্পেন, ইতালি, বেলজিয়াম, গ্রীস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যদিও গ্রীসের ওই দলে যোগ না দেয়াটা পুরোটাই কৌশলগত। কিন্তু অন্যদের যোগ না দেয়ার ব্যাপারটি তাদের সাথে তুরস্কের ভালো সম্পর্কের ফলাফল হিসেবে দেখছেন অনেকেই। সুতরাং দেখা যায় তুরস্কের বিষয়ে ইউরোপও দ্বিধাবিভক্ত। এরদোগান হয়তো এই সুযোগটিও কাজে লাগাতে চাইবেন।  

লড়াইয়ে কি পেরে উঠতে পারবেন এরদোগান?

কিন্তু এরদোগানের এই সিদ্ধান্তে কতটুকু মূল্য দিতে হবে তুরস্কের অর্থনীতির এবং সাধারণ মানুষের সেটাই দেখার বিষয়। যদিও তুরস্কের সাধারণ মানুষ সবসময়ই পশ্চিমা খবরদারির বিরোধিতা করে। কিন্তু এবারের এই বিবৃতিতে খুশি হয়েছে সবগুলো বিরোধী দল যা এর আগে খুব একটা দেখা যায়নি। 

২০২৩ সালের নির্বাচনের মাঠের লড়াইয়ের আগেই শুরু হয়ে গেলো কূটনৈতিক লড়াই। এই লড়াইয়ে কি পেরে উঠতে পারবেন এরদোগান? নাকি এর মধ্যমেই শুরু হবে তার ২০ বছরের তুরস্ক শাসনের ইতিটানা। 

বিদ্রঃ সরোয়ার আলমের এই লেখাটি ২৫ অক্টোবর ২০২১ তারিখ যুগান্তর অনলাইনে ছাপানো হয়।

Byসরোয়ার আলম

তুরস্ক কেন কাবুল বিমানবন্দরের দায়িত্ব নিতে গড়িমসি করছে?

অবশেষে আফগানিস্তান ছাড়লো মার্কিন সেনারা। ৩১ আগস্ট শুরু হওয়ার আগেই ৩০ আগস্ট রাত ১১টা ৫৯ মিনিটে শেষ সেনাটি ত্যাগ করে কাবুল বিমানবন্দর। 

রাতের অন্ধকারে মাথা নিচু করে শেষ সৈন্যের সেই হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য দেখে থমকে গেছে বিশ্ব। ওই রাতের অন্ধকারেও আমেরিকার অসহায় চিত্রটি ভেসে উঠেছে সারা বিশ্বের দরবারে। 

হলিউড বলিউড এবং হাজার হাজার মিডিয়ার মাধ্যমে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করা অপ্রতিরোধ্য আমেরিকা যে কতোটা অসহায় এবং দুর্বল তা আরেকবার প্রমাণিত হল আফগানিস্তানে। আমেরিকার এক পঙ্গু সৈন্য সেদিন আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘এই দিন দেখার জন্যই কি আমরা এত কিছু হারালাম।’ 

আমেরিকা কোন দিন দেখার জন্য কী হারাল তা জানি না। তবে ২০০১ সালের পর থেকে মুসলিম বিশ্বে যে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। লক্ষ লক্ষ নারী পুরুষ শিশুর গগণ বিদায়ী ফরিয়াদ হয়তো তাদের বম্বিংয়ের আওয়াজ ভেদ করে মুসলমান নেতাদের কানে পৌঁছেনি।

তবে ঠিকই জায়গামত পৌঁছেছে সে কান্না, আহাজারি, আর অসহায় মানুষগুলোর ফরিয়াদ। আজ তাদেরই চোখের সামনে বিশ্বের সবচেয়ে পরাশক্তি রাতের অন্ধকারে মাথা নিচু করে পালিয়ে যেতে দেখে কি অনুভূতি হয়েছিল আমি জানি না। তবে লক্ষ লক্ষ মুসলিমের হৃদেয়ের রক্তক্ষরণ হয়তো কিছুটা হলেও বন্ধ হবে এখন। 
 
যেমন দম্ভভরে তারা এসেছিল তেমন চোরের মতই পালিয়ে গেল। আর এর মাধ্যমেই বাহ্যিকভাবে দখলমুক্ত হলো আফগানিস্তান।

যদিও প্রকৃতপক্ষে কবে পুরোপুরি দখলদার মুক্ত হবে দেশটি নাকি আদৌ হবে কি না কেউ জানে না। তবে এখন শুরু হবে তালেবানের সরকার গঠন এবং প্রতিশ্রুতি পূরণের পালা। তালেবানের জন্য আসল পরীক্ষা এখন শুরু হবে।

মার্কিন সেনারা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দেয়া হয় কাবুল বিমানবন্দর। সেখানে সব কিছু নষ্ট করে বিমানবন্দরটিকে প্রায় অকেজো করে রেখে যায় তারা। বিমানবন্দর এখন যেন এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। কন্ট্রোল সিস্টেম থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের প্রযুক্তি এবং যন্ত্রপাতি বোমা মেরে বা গুলি করে নষ্ট করে দিয়েছে। 

এই বিমানবন্দর পুনর্গঠন এবং পরিচালনার মত প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি এবং যোগ্য জনবল তালেবানের নেই। তারা এখন, তুরস্ক এবং কাতারের স্মরনাপন্ন হয়েছে।দুই দেশ একত্রে একটা খসড়া চুক্তি প্রস্তুত করেছে বলেও খবর বেরিয়েছে। 

কিন্তু এই বিমানবন্দর পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার ক্ষেত্রে গড়িমসি করছে তুরস্ক। যেই দায়িত্ব নেয়ার জন্য একসময় হুমড়ি খেয়ে পড়তো, এখন সেই দেশটিই গড়িমসি করছে। কিন্তু কেন?

তুরস্ক গত সপ্তাহে কাবুল বিমানবন্দর থেকে তার সৈন্যদের প্রত্যাহার করার পরে তালেবানের পক্ষ থেকে তুরস্কের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।

তালেবানের একটা প্রতিনিধিদল তুরস্কের কাবুল দূতাবাসে তুর্কি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে এবং সেখানে তারা তুরস্ককে কাবুল বিমানবন্দরের দায়িত্ব নেয়ার অনুরোধ করেন। তালেবান আসলে শুরুতে কাবুল বিমানবন্দরের দায়িত্ব নেয়া নিয়ে কাতারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিন্তু কাতার একা এই দায়িত্ব নিতে পারবে না বলে জানায়।

পরবর্তীতে তারা যোগাযোগ করে তুরস্কের সঙ্গে এবং এক্ষেত্রে তুরস্ক এবং কাতারকে একত্রে দায়িত্ব নেয়ার জন্য অনুরোধ করে। তুরস্ক এ বিষয়ে কাতারের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং একটা খসড়া চুক্তি প্রস্তুত করে। সেটি হয়তো এরদোগানের অনুমতির অপেক্ষায় আছে। 

তুরস্ক তো সেই শুরু থেকেই কাবুল বিমানবন্দরে দায়িত্ব নেয়া নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে। কিন্তু তখন তুর্কি সেনারা সেখানে ন্যাটোর অংশ হিসেবে থাকার কারণে তালেবান তাদেরকে মেনে নেয়নি। ফলে তুরস্ক তার সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করে নিয়ে আসে। তারপরে সেখানে অনেক কিছু ঘটে যায়। কাবুল বিমানবন্দরে হামলা হয়। কয়েকশো মানুষ মারা যায়। তারপরে আবার হামলা হয়। তারপরে আবার হামলা হয়। বিমানবন্দরের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ধ্বংসের মাধ্যমে বিমানবন্দরকে অকেজো করা হয়।

শেষ পর্যন্ত কাবুল বিমানবন্দরকে অরক্ষিত এবং অনিরাপদ একটা জায়গায় পরিণত করে ফেলে রেখে যায়। 

এখন কাবুল বিমানবন্দরের দায়িত্ব নেয়া সম্পর্কে গড়িমসি করছে তুরস্ক। 

এর কারণ হিসেবে প্রথম হচ্ছে কাবুল বিমানবন্দরে নিরাপত্তার বিষয়টি। তালেবান তুরস্ককে শুধুমাত্র কাবুল বিমানবন্দর পরিচালনার দায়িত্ব দিতে চায় এবং নিরাপত্তার দায়িত্ব পুরোপুরি তালেবান সদস্যদের হাতে রাখতে চায়। কিন্তু গত কয়েকদিনের একের পর এক হামলা বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে তুরস্ককে ভাবিয়ে তুলছে। 

কারণ, বিমানবন্দরের দায়িত্বে যদি বেসামরিক লোক পাঠায়, তাদের নিরাপত্তার কী হবে? সেখানে যদি কোনো হামলা হয় এবং সে হামলায় যদি বিমানবন্দর পরিচালনায় নিয়োজিত কোন তুর্কি নাগরিক নিহত হয় তাহলে বিষয়টি তুরস্কের সরকারকে ভালোই বেকায়দায় ফেলবে। কোনো জায়গার নিরাপত্তায় সামরিক বাহিনী বা নিরাপত্তাকর্মীদের নিহত হওয়া হয়তো মেনে নেয়া যায়। কিন্তু অরক্ষিতভাবে বেসামরিক লোকদের সেখানে নিয়োগ দেয়া এবং সে নিয়োগের পরে সেখানে হামলায় ওই বেসামরিক লোকদের মৃত্যু কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে না সরকারের পক্ষে।

একারণেই তুরস্ক চাচ্ছে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা যেন তাদের কাছেই ছেড়ে দেয়া হয়; কিন্তু তালেবান সেটা ছাড়বে না। শেষ পর্যন্ত হয়ত তুরস্কের কোন বেসামরিক নিরাপত্তা সংস্থা হতে পারে সেটা সাদাত বা অন্য কোনো কোম্পানি তাদের নিরাপত্তা রক্ষীদের নিয়োগ দেবে সেখানে। আর বিমানবন্দর পরিচালনায় কাজ করবে সরকার নিয়োজিত কর্মীরা যাদের মধ্যে হয়তো গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনও থাকবে।

আরেকটা বিষয় হল-তুরস্ক এই চুক্তি স্বাক্ষরের আগে ন্যাটো তথা আমেরিকার সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করবে এবং তাদের কাছ থেকে সবুজ সঙ্কেত পাওয়ার পরই স্বাক্ষর করবে এই চুক্তি। কারণ, তুরস্ক একা ওখানে পা দিয়ে নতুন কোনো ঝামেলায় জড়াতে চায় না।

তালেবানকে যতই মনে মনে সমর্থন করুক বাস্তবতায় ওখানে সৈন্য প্রেরণ, লোকজন প্রেরণ এবং তালেবানকে স্বীকৃতির ক্ষেত্রে তুরস্ক এককভাবে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে না। তুরস্কে এক্ষেত্রে পশ্চিমাদের মনোভাব বুঝে ধীরেসুস্থে পা ফেলতে চাইছে। কারণ যদি তালেবান-সরকারকে পশ্চিমারা তথা আমেরিকা ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন স্বীকৃতি না দেয় তাহলে তুরস্ক সে ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঝামেলায় পড়বে।

তখন এককভাবে কাবুল বিমানবন্দরে থাকলে তুরস্কের ওপরেও বড় ধরনের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আসতে পারে। তুরস্ক এই জিনিসটাই চাচ্ছে না। একারণেই এর আগেরবার তুরস্ক ন্যাটো এবং ইউরোপ ইউনিয়নের কোনো একটা সদস্যকে নিয়ে সেখানে থাকতে চেয়েছিল যেন ন্যাটো অথবা ইউরোপ ইউনিয়ন তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক করার বাহানায় তুরস্কের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা না দিতে পারে। এবার যদিও পাকিস্তানের পরিবর্তে কাতারকে নিয়ে একত্রে সেখানে থাকতে চাচ্ছে কিন্তু কাতার এমন কোন দেশ না যে পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞাকে ঠেকাতে পারবে। তাই তুরস্ক এনিয়ে পশ্চিমাদের সঙ্গে কোন ঝামেলায় জড়াতে চাচ্ছে না।

আরেকটা বিষয় হল, আমেরিকা চলে যাওয়ার পর ওখানে রাশিয়া এবং চীনের শক্তি বৃদ্ধি। সিরিয়া, লিবিয়া এবং আজারবাইজানে মূলত রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে তুরস্ক। রাশিয়ার শত শত ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ধংস করেছে তুর্কি সেনারা। অন্যদিকে সিরিয়ায় রাশিয়া অনেক তুর্কি সেনা হত্যা করেছে।

সিরিয়া এবং লিবিয়ায় এখনও তুরস্ক-রাশিয়া মুখোমুখি অবস্থানে। এখন কাবুল বিমানবন্দরের দায়িত্ব নেয়া মানে হচ্ছে ওখানেও তুরস্কের পরোক্ষভাবে রাশিয়া এবং চীনের স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। ওই বিমানবন্দরে কোন ঝামেলা হলে বা ওখানে রাশিয়ার স্বার্থে কোনও আঘাত হলে রাশিয়া তাদের প্রক্সি বা ভাড়াটিয়াদের দিয়ে সিরিয়ায় তুর্কি সেনাদের ওপর আঘাত হানবে। অতীতে এরকম হয়েছে।

এছাড়াও রাশিয়ার তুরস্কের সঙ্গে আছে মাল্টি বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা। তুরস্কের পর্যটন খাত অনেকাংশই রাশিয়া নির্ভর। সবকিছু মিলিয়ে তুরস্কের কাবুল বিমানবন্দরের দায়িত্ব নেয়া রাশিয়া তুরস্কের বৈরী সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে পারে। 

আবার ওখানে তুরস্কের থাকা মানে চীনের বেল্ট এ্যন্ড রোড প্রকল্পের জন্য পরোক্ষভাবে হুমকি স্বরূপ। তাই চীনও চাইবে তুরস্ককে অর্থনৈতিক ভাবে চাপে ফেলতে। এখন তুরস্কের পূর্ব পশ্চিম উভয় মেরুর বিরুদ্ধে গিয়ে ওখানে থাকা কতটা নিরাপদ এবং যুক্তিসংগত। 

প্রশ্ন করতে পারেন এতই যখন ঝামেলা তাহলে তুরস্ক কেন কাবুলে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করছে। তুরস্কে খুব বিখ্যাত একটা প্রবাদ আছে সেটা হল আঙ্কারা নিরাপত্তা শুরু হয় কাবুল থেকে অর্থাৎ কাবুল যদি নিরাপদ থাকে, কাবুলে যদি তুরস্কের কোন প্রভাব থাকে তাহলে আঙ্কারা কে নিরাপদ রাখা সম্ভব। এর অনেক ঐতিহাসিক কারণ এবং ব্যাখ্যা আছে।

 পূর্ব দিক থেকে আসা যেকোনো ধরনের আগ্রাসন যদি এখানেই ঠেকানো যায় তাহলে আঙ্কারা নিরাপদ থাকবে আর যদি সে আগ্রাসনকে কাবুলে ঠেকানো না যায় তাহলে তার চোট লাগবে আঙ্কারায়ও। হতে পারে সেটা চীন-রাশিয়া বা অন্য কোনও দেশ। তাইতো তুরস্ক চায় কাবুলে যেন তার একটা চোখ সব সময় থাকে।

এছাড়াও মধ্য এশিয়ার তুর্কি দেশগুলোকে নিয়ে যে বৃহত্তর ঐক্যের স্বপ্ন দেখছেন এরদোগান এবং আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ, সে স্বপ্ন বাস্তবায়নেও কাবুলে তুরস্কের উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ।

বিদ্রঃ সরোয়ার আলমের এই লেখাটি যুগান্তর পত্রিকায় ০২ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখ প্রকাশ করা হয়।

Byসরোয়ার আলম

তুরস্ক যা পারেনি তা করে দেখাল ইরান

তুরস্ক যা পারেনি তা করে দেখাল ইরান
ছবি: সংগৃহীত

ইরানের রাজধানী তেহরানে তালেবানের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আফগান সরকারের প্রতিনিধিদল বৈঠক করেছে।

বুধবার ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যস্থতায় এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় বলে জানা গেছে।

তুরস্ক গত এপ্রিল মাসে ইস্তানবুলে এ রকম একটি শান্তি আলোচনার চেষ্টা চালিয়েছিল। এমনকি তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিন-তারিখও ঘোষণা করেছিলেন। এ নিয়ে ব্যাপক প্রস্তুতি চলছিল তুরস্কে। কিন্তু তালেবান এতে রাজি না হওয়ায় তখন স্থগিত এবং পরে বাতিল করতে হয় সেই বৈঠক। 

বুধবার ইরানের এই বৈঠকে আফগান সরকার থেকে সরাসরি বড় কোনো ব্যক্তি না থাকলেও বর্তমান সময়ে এ রকম একটি আলোচনার আয়োজন করতে পারা এবং উভয়পক্ষকে এক বৈঠকে বসাতে পারা কম সফলতার বিষয় নয়। 

এই বৈঠক, ভবিষ্যৎ আফগানিস্তানে ইরান আরও বেশি শক্তিশালী হওয়ার ইঙ্গিত বহন করে।

গত মাসের শেষে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি কারিগরি দল আফগান ইস্যুতে তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় একটি বৈঠক করেছে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। দেশটি থেকে মার্কিনিদের নেতৃত্বে ন্যাটো সৈন্যরা চলে গেলে কাবুল হামিদ কারজাই বিমানবন্দরের দায়িত্ব নিতে চায় তুরস্ক। কিন্তু এতে আপত্তি রয়েছে তালেবানের। 

তালেবানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে— ‘তুরস্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম রাষ্ট্র। আমরা তুরস্কের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়তে চাই। তুরস্কের সঙ্গে ভবিষ্যতে সম্পর্ক আরও উন্নত করতে চাই।’

তালেবানের একজন মুখপাত্র অবশ্য আমাকে জানান, বিদেশি সৈন্য থাকার বিষয়ে তাদের বক্তব্য স্পষ্ট। তবে তিনি তুরস্কের সঙ্গে তালেবানের বিভিন্ন চ্যানেলে যোগাযোগ হচ্ছে বলেও স্বীকার করেন। তার মতে, এ বিষয়ে আগামী পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে। 

আমার ধারণা, তুরস্ক ও তালেবান একটা সমঝোতায় আসবে। তবে সময় লাগবে। আর যদি সমঝোতায় না আসে, তা হলে তুরস্ক কি ওখানে থাকার জন্য তালেবানের বিরুদ্ধে গিয়ে অবস্থান নেবে? এখনই তা বলা মুশকিল।

Byসরোয়ার আলম

ইস্তাম্বুল খাল-২ খনন ও পক্ষ বিপক্ষ সমাচার

তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগান গত সপ্তাহে উদ্বোধন করেছেন ইস্তাম্বুল খালের ব্রিজের কাজ। এই খাল নিয়ে তুরস্কের ভিতরে ও বাইরে চলছে তুমুল বিতর্ক। অটোম্যান (উসমানীয় খেলাফতের) সুলতান সুলায়মান থেকে এরদোগান পর্যন্ত এই খাল খননের ইতিহাস নিয়ে এর আগে আমি আগের লেখায় বিস্তারিত আলোচনা করেছি।

আজ আলোচনা করবো এই খালের বিপক্ষের এবং পক্ষের যুক্তিগুলো নিয়ে।

এই খাল খননের বিপক্ষে যারা রয়েছে তারা হলো- তুরস্কের প্রধান বিরোধী দল CHP সহ, দ্বিতীয় বিরোধী দল, এরদোগান সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আহমেত দাভুতওগ্লুর রাজনৈতিক দল, এরদোগান সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী আলি বাবাজানের রাজনৈতিক দল, কুর্দি রাজনৈতিক দল, ইস্তাম্বুলের মেয়র এবং পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংস্থা। দেশের বাইরে থেকেও আছে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা।

আর পক্ষে আছেন তুরস্কের রাষ্ট্রপতি এরদোগান, তার সরকারের অংশীদার কট্টর জাতীয়তাবাদী দল এমএইচপি এবং তাকে সমর্থনকারী কোটি কোটি জনগণ।

বিরোধী গ্রুপের যুক্তি গুলো হলো-

বসফরাস প্রণালি থাকতে এই খালের কি দরকার ।

আর খালের পক্ষে যারা আছেন তাদের যুক্তি হল- বসফরাস অনেক হুমকির মুখে। বসফরাসের নিরপদ পারাপারের পরিমাণ বছরে পঁচিশ হাজার জাহাজ আর এখন এই প্রণালিটি ব্যবহার করে বছরে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার জাহাজ। এছাড়াও দৈনিক লাখ লাখ যাত্রী পার হয় এই প্রণালি দিয়ে। তাই কার্গো শিপের সঙ্গে সাধারণ যাত্রীবাহী লঞ্চের সংঘর্ষে অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে এই বসফরাসের।

বসফরাসে গত তিন বছরে ছোটবড় প্রায় পঞ্চাশটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। ২০১৯ সালে বসফরাস পার হওয়ার সময় একটি কার্গো শিপের স্টিয়ারিং সিস্টেম লক হয়ে গেলে জাহাজটি বসফরাসের তীরে ঐতিহাসিক হেকিমবাশি সালিহ এফেন্দি ম্যানশনটির সঙ্গে ধাক্কা খায়। এতে ম্যানশনটি ধ্বংস হয়ে যায়।

এখনও পর্যন্ত বসফরাসে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বৃহত্তম দুর্ঘটনাটি ঘটে ১৯৭৯ সালে। ‘ইন্ডিপেন্ডেন্টা’ নামক একটি রোমানিয়ান অপরিশোধিত তেলের ট্যাঙ্কার ছিয়ানব্বই হাজার টন তেল নিয়ে একটা গ্রিক ফ্রেইটারের সঙ্গে ধাক্কা খায়। সব তেল সমুদ্রের পানিতে ছড়িয়ে পরে। এক মাস ধরে জ্বলে সেই আগুন। ট্যাঙ্কারের ক্রু সদস্যদের মধ্যে ৪৩ জন মারা যায়। বসফরাস ভারী বায়ু এবং সমুদ্র দূষণ হয়। বায়ু দূষণের তীব্রতায় আকাশ কালো হয়ে থাকে মাসের পর মাস, বেশিরভাগ সামুদ্রিক প্রানি মারা যায়। পানির উপরিভাগে অপরিশোধিত তেলের আস্তর জমে যায়।

দিন যত যাচ্ছে বসফরাসে এ ধরণের দুর্ঘটনার আশঙ্কা আরো বাড়ছে। কারণ মানুষ পারাপারের হার বাড়ছে। তাই সরকার বলছে , বসফরাসের বিকল্প তৈরি করা এখন সময়ের দাবি।
এ  খাল খনন সম্পন্ন করতে ১৫ বিলিয়ন ডলার দরকার হবে।
এবার বিরোধীদের প্রশ্ন: ৪৫ কিলোমিটার লম্বা, ৩০০ মিটার চওড়া এবং ২১ মিটার গভীর এই খাল খননে যে টাকা দরকার হবে তা আসবে কোত্থেকে? দেশের অর্থনীতির অবস্থা খারাপ। বিদেশিরা এখানে বিনিয়োগ করলে তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়বে দেশ।

সরকারি পক্ষের উত্তর: তুরস্কের নিজস্ব অর্থায়নেই এই প্রকল্প করা সম্ভব। দেশের মধ্যে অনেক বড় বড় কোম্পানি আছে যারা এই কাজ করতে আগ্রহী। আর বিদেশী বিনিয়োগ দেশে আসলে তো দেশেরই ভালো। জিম্মি হওয়ার প্রশ্নই আসে না। সারা দুনিয়ার সব দেশই তো বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে চায়।

এ উত্তরেও বিরোধীরা সন্তুষ্ট না। এবার তারা সরাসরি হুমকি দিচ্ছে এই কাজের টেন্ডারে যেন কোনো কোম্পানি না আসে। তাদের সাফ কথা, কেউ যদি এই কাজের টেন্ডার নেয় তাহলে বিরোধী দল ক্ষমতায় আসলে তাদের টেন্ডার বাতিল করে দেওয়া হবে এবং একটা টাকাও ফেরত দেয়া হবে না।

আমার মতে, এখানে বিরোধীদল ভুল করছে। প্রজেক্টের বিরুদ্ধে যুক্তি দিতে পারে, বিতর্কে জড়াতে পারে। কিন্তু টেন্ডারের অংশগ্রহণকারী কোম্পানিকে হুমকি দেওয়াটা রাজনৈতিক শিষ্টাচারে পরে না। আর এতে এই প্রকল্পের গুনগত মানের কোন উন্নতি হবে না বরং শুধু শুধু টেন্ডারে যে কোম্পানি ঢুকতে আগ্রহী তাদের মনে ভয় ঢুকিয়ে সরকারকে আরও বেশি লসে ফেলে দিবে।

এবার বিরোধীদের কথা যদি এই টেন্ডার কোনো কোম্পানি পায় এবং কাজ শুরুও করে। তাহলেও এই কাজ করতে লাগবে সাত থেকে ১০ বছর। ওখান থেকে আসবে হাজার হাজার কোটি টন মাটি। এই মাটি ফেলতে ব্যবহার হবে হাজার হাজার ট্রাক। এই মাটি খনন তখন ব্যাপক বায়ু দূষণ করবে। এই বিশাল পরিমাণ মাটি তখন কোথায় ফেলবে। আর এই ট্রাকগুলো ইস্তাম্বুলের যাতায়াত ব্যবস্থাকে পুরো অচল করে দেবে।

সরকারের যুক্তি হলো: বায়ু দূষণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এই ট্রাকগুলো ইস্তাম্বুলের যাতায়াত ব্যবস্থাকে বাইপাস করে বিকল্প পথ ব্যবহার করবে। সেজন্য খাল খননের আগেই রাস্তাঘাট এবং ব্রিজ তৈরি করা হচ্ছে। আর এই বিশাল পরিমাণ মাটি এই খালের তীরবর্তী শহর গড়তে এবং কৃষ্ণ সাগরে মাটি ভরাট করে একটি পোর্ট নির্মাণ করা হবে।

এবার বিরোধীদের যুক্তি: এই খাল খনন করলে মারমারা সাগরের জলজ প্রাণীগুলো হুমকির মুখে পড়বে। কারণ কৃষ্ণ সাগর এবং মারমারা সাগরের পানির তাপমাত্রার পার্থক্য অনেক। আর পানির উচ্চতা এবং লবণাক্ততারও তারতম্য আছে। সুতরাং এই দুই সাগরের পানির মিশ্রণ ঘটলে ওই অঞ্চলের জলজ প্রাণীর জীবন হুমকির মুখে পড়বে।

সরকারের উত্তর: এই যুক্তি ভিত্তিহীন। কারণ এই দুই সাগর তো ইতিমধ্যে বসফরাস প্রণালির মাধ্যমে যুক্ত। ইকোলজিক্যাল সমস্যা বা পানির তাপমাত্রার সমস্যা হলে তো অনেক আগেই মারমারা সাগরের সব প্রাণী মারা যাওয়ার কথা। যদিও এখন সামুদ্রিক শ্লেষ্মা বা মিউসিকাস এর আক্রমণে মারমারা সাগর ভয়ংকর হুমকির মুখে তবুও সরকারের কথায় যুক্তি আছে।

বিরোধীদের আরেকটি যুক্তি হলো এই খাল খনন করলে ইস্তাম্বুলে খাবার পানির সংকট হবে। কারণ এই খালের প্রস্তাবিত রুটের ওপর আছে অনেকগুলো জলধারা যা ইস্তাম্বুলের খাবার পানি সরবরাহ করে।

সরকারের উত্তর: ইস্তাম্বুলে নিত্য ব্যবহার্য পানি সরবরাহের জন্য ১০টি জলধারা আছে। আর ওই খালের রুটের উপর পড়েছে দুটি জলধারা। একটি পুরপুরি এই খালের মধ্যে চলে যাবে আরেকটির আংশিক যাবে এই খালের মধ্যে। তাতে ইস্তাম্বুলের মোট দরকারির পানির শতকরা ৩ ভাগ নষ্ট হবে। তবে সরকার পানি সংরক্ষনের জন্য মেলেন ড্যাম নামে একটি প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। সেটা এত বড় একটি পানি সংরক্ষণ প্রজেক্ট যে পুরো ইস্তাম্বুলের পানির চাহিদা মেটাতে এই একটি জলধারাই যথেষ্ট।

এর পরের যুক্তি হলো, এই খালের কারণে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি নষ্ট হয়ে যাবে। এতে বিপুল পরিমাণ খাদ্য সংকট হবে দেশে। 

৭ লাখ ৩০ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই দেশে শুধু মাত্র ৩০০ মিটার প্রস্থের একটি খাল খননে খাদ্য সংকটে পড়বে কথাটা খুব যুক্তি সঙ্গত লাগে না।

বিরোধী পক্ষ বলছে, এই খালের কারণে ইস্তাম্বুলে ভূমিকম্প ঝুঁকির পরিমাণ বাড়বে। কারণ ইস্তাম্বুল খুবই ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা; তাই এই খাল খননের কারণে ভূমিকম্প প্লেটের উপর অনেক বড় প্রভাব ফেলবে এবং অনেক বড় ভূমিকম্প নিয়ে আসবে।

সরকারের কথা হলো- এই খাল যে রুটে খনন করা হচ্ছে সেই রুটে কোন ভূমিকম্প প্লেট নেই। এই ব্যাপারে তুরস্কের প্রায় আড়াইশো বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, বিশেষজ্ঞ এবং ৩৫টিরও বেশি সংস্থা একত্রে একটি রিপোর্ট বের করেছে। যে রিপোর্টেও এ ধরণের আশঙ্কাকে নাকচ করে দেয়া হয়েছে। আর ভূমিকম্প যে প্লেটের কারণে হয় তা থাকে ভূমির ১৫ থেকে ২৫ কিলোমিটার গভীরে। আর এই খালের গভীরতা মাত্র ২১ মিটার। অর্থাৎ এর গভীরতা একটি বিল্ডিং বা ব্রিজ করতে যতটুকু গভীরে যেতে হয় মাত্র ততটুকুই। তাই এই খাল খনন ভূমিকম্পের প্লেটে কোন ক্ষতি করবে না এবং ভূমিকম্পের প্রভাব ও বাড়াবে না।

আরেকটি যুক্তি, এই খাল খননের মাধ্যমে ইস্তাম্বুল এখন হয়ে যাবে একটি দ্বীপ। দুই দিকে দুই খাল মাঝখানে একটি দ্বীপ। এই দ্বীপে ভূমিকম্প বা অন্য কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে এই লাখ লাখ মানুষ দ্রুত কোথাও নিয়ে যাওয়াও কঠিন হবে।

এক্ষেত্রে উত্তর হল, ভূমিকম্পে মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে রাস্তায় অথবা খালি জায়গায় অবস্থান করে। ১০-১৫ কিলোমিটার দূরে দৌড়ায় না। আর ওই দ্বীপটাই ইস্তাম্বুলের প্রাণকেন্দ্র তাই ওখানে দুর্যোগ মোকাবেলায় সব ধরণের প্রস্তুতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে।

আসলে দুইও পক্ষের কথায় যুক্তি আছে। বিরোধীদেরকে ধন্যবাদ দেওয়া দরকার তারা এতগুলো খুঁটিনাটি বিষয় বের করে সরকারকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছেন। সরকারকে ধন্যবাদ দেওয়া দরকার কারণ এতো বেশি লোক দিয়ে গবেষণা করিয়েছেন এবং সব বিষয় ভেবে খেঁটে খুঁটে তারপর প্রকল্পে নেমেছেন। 

বিরোধীদের একটাই দোষ যে তারা টেন্ডারে অংশগ্রহণকারী কোম্পানিদেরকে হুমকি ধামকি দিচ্ছে। এটা বাড়াবাড়ি।

বিদ্রঃ সরোয়ার আলমের এই লেখাটি ৩০ জুন ২০২১ তারিখ যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়।

Byসরোয়ার আলম

তুরস্কের সোফাগেট এবং ইউরোপে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগানের সঙ্গে এক বৈঠকে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লেয়েনকে চেয়ারে না বসিয়ে বরং সোফায় বসানো হয়েছিল।  এ ঘটনাকে ইউরোপে “সোফাগেট” স্কান্ডেল নামে অভিহিত করা হয়।

এপ্রিলের ৭ তারিখ ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রধান চার্লস মিশেল এবং ভন ডের লেয়েন রাষ্ট্রীয় সফরে তুরস্কে এসে এরদোগানের সঙ্গে বৈঠক করেন।  সে বৈঠকে এরদোগান এবং চার্লস মিশেল পাশাপাশি চেয়ারে বসেন আর ভন ডের লেয়েনের এবং তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত চাভুসওগলু মুখোমুখি সোফায় বসেন।

ভন ডের লেয়েনের এই সোফায় বসা নিয়ে হুলুস্থুল কাণ্ড শুরু হয়েছে ইউরোপে।

ইউরোপীয় গণমাধ্যম, বিশেষ করে জার্মান এবং ব্রিটিশ মিডিয়া, বিষয়টি নিয়ে প্রচুর মুখরোচক খবর ছাপায় এবং তুরস্কের ওপর একচেটিয়া দোষ চাপায়। তুরস্ক নাকি ইচ্ছে করেই তাকে চেয়ারে না বসিয়ে সোফায় বসিয়েছে। এটা নাকি এরদোগানের গোঁয়ার্তুমির কারণেই হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

এমনকি ইতালির প্রধানমন্ত্রী এ নিয়ে এরদোগানকে ডিক্টেটর (স্বৈরাচার) পর্যন্ত বলতেও দ্বিধাবোধ করেননি।

অথচ তুরস্কের পক্ষ থেকে এবং ইউরোপীয় কমিশনের পক্ষ থেকে বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে যে তুরস্কের এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রটোকল কর্মকর্তারা আলোচনা করেই আসন বিন্যাস ঠিক করেছেন।

কূটনৈতিক প্রোটকলের নিয়ম অনুযায়ী কোনো রাষ্ট্রপ্রধান অন্য কোনো দেশে গেলে সফরকারী দেশ থেকে প্রোটকল কর্মকর্তারা গিয়ে সফরের সব কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খুঁটিয়ে দেখেন।

সফরকারী নেতা কোথায়, থাকবেন, কী খাবেন, কার সঙ্গে দেখা করবেন, কোন চেয়ারে বসবেন, চেয়ারের উচ্চতা কতটুকু হবে, এমনকি চেয়ার, টেবিল এবং বৈঠক রুমের রং কী হবে, কোন দেশের পতাকা কোথায় থাকবে ইত্যাদি সব কিছু নির্ধারণ করেন তারা।

সে প্রথা অনুযায়ী ৭ এপ্রিল ওই বৈঠকের আগে ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রধান চার্লস মিশেলের অফিস থেকে প্রোটকল কর্মকর্তা আঙ্কারায় এসে সব কিছু ঠিক ঠাক করে যান। তখন তারা আসন বিন্যাসে চার্লসের জন্য চেয়ারের ব্যাবস্থা এবং ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট ভন ডের লেয়েনের জন্য সোফার ব্যবস্থা দেখেও সন্তুষ্ট হন।  তখন ইউরোপীয় প্রোটকল কর্মকর্তারা ভন ডের লেয়েনের জন্য চেয়ারের দরকারবোধ করেননি।  সুতরাং বিষয়টি নিয়ে আসলে তুরস্ককে দোষ দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।

অথচ ইউরোপে বিষয়টি নিয়ে এখনও তোলপাড় চলছে।  সবকিছু এত স্পষ্ট করে দেওয়ার পরেও ইউরোপের কতক মিডিয়া এবং ভন ডের লেয়েনের ভক্ত কিছু ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্যরা এ নিয়ে নিত্য নতুন সুর তুলছেন তুরস্কের বিরুদ্ধে।

এমনকি তারা বিষয়টি নিয়ে এমনই পানি ঘোলা করতে থাকেন যে কয়েকদিন আগে এরদোয়ানকে নারী বিদ্বেষীও বলেছেন।  তিনি নাকি এই নারী বিদ্বেষের কারণেই ভন ডের লেয়েনকে চেয়ারে বসাননি।  কারণ, ভন ডের লেয়েন একজন নারী।

জার্মান এই সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিজেও বলতে দ্বিধাবোধ করেননি যে তিনি নারী হওয়ার কারণেই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এবং ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান এই দুই পুরুষ মিলে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করেছেন! আর এটা নাকি হয়েছে মূলত এরদোগানের নারীবিদ্বেষের কারণে!

আর এরদোগান যে নারী বিদ্বেষী তার প্রমাণ নাকি তিনি দিয়েছেন ইস্তান্বুল কনভেনশন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে!

হায়রে ইউরোপ, হায়রে দুনিয়া!  বাংলাদেশে একটা কথা আছে- কিসের সঙ্গে কী পান্তা ভাতে ঘি!

প্রোটকলের নিয়ম, সোফায় বসা, এরদোগান, নারী বিদ্বেষ, ইস্তান্বুল কনভেনশন এতগুলো বিষয়কে কিভাবে একত্রে লিংক করিয়ে দিলেন!

অথচ এমন ভুরিভুরি উদাহরণ আছে যেখানে এরদোগানের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের নেতৃত্বে থাকা নারী লিডাররা বসে বৈঠক করেছেন।  যেমন জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মারকেল, সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে ছাড়াও আরও অনেকে।  তাদেরকে কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও প্রটোকল অনুযায়ী যতটুকু সম্মান দেওয়া দরকার তার সর্বোচ্চটাই দেখিয়েছেন এরদোগান। এ নিয়ে এর আগে কখনও প্রশ্ন উঠেনি।  এবার কী হলো যে, এরদোগানকে নারীবিদ্বেষী বা ডিক্টেটর পর্যন্ত বলা হলো?

এখানে আসলে মূল বিষয় হচ্ছে ভন ডের লেয়েন এবং চার্লস মিশেলের মধ্যকার রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই।

এপ্রিলের ২৯ তারিখ পলিটিকো ইউরোপে এ নিয়ে বিস্তারিত এক আর্টিকেল ছাপানো হয়।

“প্রেসিডেন্সিয়াল পাওয়ার ওয়ার: ভন ডের লেয়েন বনাম মিশেল” শিরোনামের ওই খবরে বলা হয় তাদের দুজনের মাঝে এই “পাওয়ার ওয়ার” বা শক্তির লড়াই শুরু হয় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে যখন তারা উভয়েই ইইউর গুরুত্বপূর্ণ দুই পদে আসীন হন।

দ্বন্দ্বের মূলে ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃত্বের লড়াই।  এই জোটটির মূল লিডার কি কমিশনের প্রধান নাকি কাউন্সিলের প্রধান?

ভন ডের লেয়েন জার্মানির সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এবং ইইউ কমিশনের ইতিহাসের প্রথমবার নির্বাচিত নারী নেত্রী আর চার্লস মিশেল বেলজিয়ামের সাবেক প্রধানমন্ত্রী যে দেশটিতে ইইউর হেডকোয়ার্টার অবস্থিত।

দুইজনই চাচ্ছেন তার নিজের পদকে ইইউর সর্বোচ্চ পদ হিসেবে দেখাতে।  এ কারণে তারা বিদেশ সফর করতেন আলাদা আলাদা।  দুজনকেই যেন তখন আলাদাভাবে ইইউ নেতার মর্যাদা দেওয়া হয়।  কিন্তু তুরস্ক সফরে আসলেন তারা একত্রে।  আর ঝামেলাটা লাগলো এখানেই।

চার্লস মিশেলের প্রোটকল টিম তুরস্কে এসে সবকিছু ঠিক ঠাক করে গেলেন এবং কৌশলে তারা ভন ডের লেয়েনকে মেসেজটা দিয়ে দিলেন যে লিডার তুমি না বরং ইইউর লিডার একজনই তিনি হলেন মিশেল, তাই তুরস্কের লিডারের পাশে চেয়ারে বসার অধিকার শুধু মিশেলেরই আছে।

অথচ ইউরোপের এই নারী নেত্রী ঘটনাটিকে নিয়ে তার ক্ষমতায় থাকা সংস্থার প্রধানকে দোষারোপ না করে বরং দোষ দিলেন এরদোগানের।
উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে!

আসলে তুরস্ক এবং এরদোগান ইউরোপে এমন এক হট টপিক যে যদি কেউ ওখানে পপুলার হতে চায় সে তুরস্ক এবং এরদোগানের বিরুদ্ধে কিছু একটা বলতে পারলেই হলো অমনি তার সমর্থন বেড়ে যাবে।  যেমন ব্রেক্সিট ভোটের সময়, জার্মানিতে, নেদারল্যান্ডে, হাঙ্গেরিতে নির্বাচনের সময় ভোটারদের মনোযোগ আকর্ষণে তুরস্ক এবং এরদোগান বিরোধী বক্তব্য, ব্যানার ফেস্টুন ব্যবহার করা হয়েছিল বারবার।

আর ভন ডের লেয়েনও তাই ইউরোপীয় পার্লামেন্টে তার নেতৃত্বের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য সোফায় বসানোর বিষয়টিকে নিয়ে তুরস্কের বিরুদ্ধে চড়াও হচ্ছেন।

বিদ্রঃ সরোয়ার আলমের এই লেখাটি ০১ মে ২০২১ তারিখ যুগান্তর অনলাইনে ছাপানো হয়।

Byসরোয়ার আলম

তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এরবাকান যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত হন

নাজিমুদ্দিন এরবাকান,
১৯৯৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সেনা অভ্যুত্থানের দৃশ্য। ইনসেটে নাজিমুদ্দিন এরবাকান। ফাইল ছবি

তুরস্কের ইতিহাসের সর্বশেষ সফল সামরিক অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি ২৮ ফেব্রুয়ারি।  ১৯৯৭ সালের আজকের এই দিনটিতে তখনকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে স্মারকলিপি দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। ট্যাঙ্ক গোলাবারুদ আর সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার না করেই অর্থাৎ প্রত্যক্ষ সামরিক শক্তি ব্যবহার না করেই প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন এরবাকানকে বন্দুকের নলের মাথায় ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা হয়।  

উত্তর আধুনিক সামরিক অভ্যুত্থান নামে পরিচিত এই অবৈধ ক্ষমতা দখলে প্রত্যক্ষ সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করছিল তখনকার গণমাধ্যম, এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলো।

পাঁচজন সামরিক কর্মকর্তা এবং পাঁচজন উচ্চ পর্যায়ের রাজনীতিবিদদের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় সুরক্ষা কাউন্সিলের সদস্যরা ২৮ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা দিল যে রাষ্ট্র  “ইসলামপন্থী হুমকির” সম্মুখীন। ক্ষমতাসীনরা রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতার উপর বড় হুমকি স্বরূপ। একটি স্মারকলিপি জারি করে সমস্ত ধর্মীয় স্কুল বন্ধ করার, সব  বেসরকারি ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তরের এবং বহু ধর্মীয় সংস্থা এবং এনজিওর কার্যক্রম নিষিদ্ধ কারার দাবি জানায় ।

এরা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে নামিয়ে দেওয়ার জন্য সামরিক শক্তি প্রয়োগের হুমকি দেয়, তুরস্কের সাংবিধানিক ভিত্তি ধর্মনিরপেক্ষতাকে রক্ষার জন্য ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে ব্যাপক মিডিয়া প্রচারনা চালায় এবং সেক্যুলারদের সাথে আঁতাত করে। এ ক্যাম্পেইন চলতে থাকে একই বছরের ১৮ জুন এরবাকানের পদত্যাগ করার দিন পর্যন্ত। 

যেভাবে নাজিমুদ্দিন এরবাকানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়

কীভাবে এবং কেন এটি ঘটেছে তা বোঝার জন্য আসুন আরেকটু পিছনে ফিরে যাই। ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বর মাসের সংসদ নির্বাচন। সংবিধান অনুযায়ী কট্টর সেক্যুলার এই দেশটির সংসদে জনগণের ভোটে সবচেয়ে বেশি আসন পেয়ে বিজয়ী হয় কল্যাণ পার্টি নামে একটি ইসলামিক রাজনৈতিক দল। 

ব্যাপক জনপ্রিয় একটি ইসলামী সংগঠন “মিল্লি গোরুশ” এর রাজনৈতিক শাখা ছিল এ দলটি। ৩৬ বছর ধরে তুরস্কে সোচ্চারভাবে ধর্মীয় রাজনীতি করার কারণে “মিল্লি গোরুশ” আন্দোলনের নেতা এরবাকানকে এবং তার পার্টিকে নিষিদ্ধ করার হয় বারবার । তবুও আধুনিক তুরস্কের ইতিহাসে সেবারই প্রথম ধর্মীয় সংস্থার সাথে যুক্ত কোনও ইসলামিক রাজনৈতিক দল জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়।

নাজিমুদ্দিন এরবাকান। ফাইল ছবি

তবে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়া অন্য দলের সাথে জোট বেঁধে সরকার গঠন করতে হত এরবাকানকে। কিন্তু সেনাবাহিনী অন্য রাজনৈতিক দলগুলিকে এরবাকানের দলের সাথে ঐক্যজোটের সরকার গঠন না করার জন্য চাপ দেয়। এবং সবচেয়ে বড় বিজয়ী দলকে পাশ কাটিয়ে সরকার গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয় অন্যসব দলগুলোকে। তবে দেড় বছর পরে বিরোধী দলগুলো  টেকসই সরকার গঠনে ব্যর্থ হওয়ার পরে রাষ্ট্রপতি কল্যাণ দলকে জোট গঠনের অনুমতি দেয়। 

ধর্মনিরপেক্ষ সম্প্রদায়, সামরিক ও গণমাধ্যম দেশটির মুসলিম পরিচয়কে আরও শক্তিশালী করতে চায় বলে নতুন প্রধানমন্ত্রী এরবাকানকে সমালোচনা করেছিল।
এরবাকান একটি সামাজিক রক্ষণশীল গোষ্ঠির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, মুসলিম দেশগুলিতে সফর করেছিলেন এবং মুসলিম দেশগুলির মধ্যে জি-7 এর আদলে একটি আন্তর্জাতিক সঙ্ঘ গঠনের চেষ্টা চালিয়েছিলেন।  

এরবাকানের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী ও গণমাধ্যমের প্রচার এই দাবি জোড়ালো করে তুলেছিল যে তার দল তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তি ধ্বংস করতে চায়। তখন গণমাধ্যমে একটি জনপ্রিয় স্লোগান ছিল “ধর্মনিরপেক্ষতা বিলীন হয়ে যাচ্ছে, দেশে শরীয়ত আসছে”।

এমনকি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তখন ধর্মীয় সংস্থাগুলোকে রাষ্ট্রের জন্য পিকেকে সন্ত্রাসী সংগঠনের চেয়ও বড় হুমকি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। 

উত্তর-আধুনিক এই সামরিক অভ্যুত্থানের পরে কী ঘটল? 

সাংবিধানিক আদালত কল্যাণ পার্টিকে যথেষ্ট সেক্যুলার না হওয়ার অভিযোগে সরকার থেকে নিষিদ্ধ করে। এবং এরবাকান সহ এ পার্টির অন্যান্য নেতৃস্থানীয় বাক্তিদেরকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। পরে সেনা সমর্থিত নতুন সরকার ধর্মীয় মত প্রকাশের বিরুদ্ধে আইনী লড়াই শুরু করে। তারা সরকারি সকল প্রতিষ্ঠান থেকে ধর্মীয় রক্ষণশীল লোকদের বের করে দেয়। একটি ড্রেস কোড আইন কার্যকর করার মাধ্যমে হিজাব পরিধানকারী ছাত্রীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এই নিষেধাজ্ঞাটি অন্যান্য সরকারী প্রতিষ্ঠানে আগে থেকেই কার্যকর ছিল। এবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও এর আওতায় আনা হয়। 

নাজিমুদ্দিন এরবাকানকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর হিজাব পরিহিত ছাত্রীদের ক্লাস থেকে বের করে দেয়ার ঘটনা ঘটে। ছবি: পলিটিক্স টুডে

হাজার হাজার শিক্ষার্থীর ছাত্রত্ব বাতিল করা হয়। সাড়ে তিন হাজার মহিলা শিক্ষককে তাদের চুল ঢেকে রাখার জন্য বরখাস্ত করা হয়েছে, এগারো হাজার শিক্ষককে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় এবং পদত্যাগে অস্বীকৃতি জানালে আর তিনহাজার পাঁচশ সাতাশ জোন শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা হয়। 

এছাড়াও সশস্ত্রবাহিনীর ধর্মীয় ভাবাপন্ন কর্মকর্তাদের ব্যাপকহারে ছাটাই করা হয়। ওই সময় ১ হাজার ৬২৫ জন বাহিনীর সদস্যকে বরখাস্ত করা হয়ে এবং আরও ২ হাজার ৫০০ জন অবসর নিতে বাধ্য করা হয়। সামরিক বাহিনীতে কর্মরত সব সদস্যদের স্ত্রীদেরকে হিজাব খুলতে বাধ্য করা হয়। 

প্রায় এক হাজার মানুষকে ভুয়া অভিযোগে জেলে পুরে রাখা হয়েছিল। প্রায় ১ কোটিরও বেশি লোক এবং অনেক সিভিল সোসাইটিকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। মোট কথা, ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসীদের উপরে একটা স্টিম রোলার চালিয়ে দেওয়া হয়। 

তখনকার একজন সেনা কমান্ডার তো বলেই দিলেন, ‘২৮ শে ফেব্রুয়ারি (পরবর্তী এই স্টিম রোলার) এক হাজার বছর ধরে চলবে’। 

তবে পাঁচ বছর যেতে না যেতেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় আসে রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগানের নেতৃত্বে এরবাকানেরই দল থেকে বেরিয়ে আসা একদল লোক। আর তখন থেকেই শুরু বর্তমান ক্ষমতাসীন একে পার্টির অধ্যায়। ক্ষমতায় আসার পরই ধর্মীয় মতপ্রকাশের বিরোধিতা করে করা আইনগুলো  শিথিল করতে কাজ শুরু করে এরদগানের একে পার্টি এবং ২০১৩ সালে এসে হিজাবের ওপরে নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি উঠিয়ে নিতে সক্ষম হয়। কিন্তু ১৯৯৭ সালের উত্তর-আধুনিক সামরিক অভ্যুত্থানের বিভীষিকাময় দিনগুলো তুর্কিদের মন থেকে কখনই উঠে যাবে না।

Byসরোয়ার আলম

তুরস্কের সঙ্গে আরব আমিরাতের সম্পর্ক উন্নয়ন কি আদৌ সম্ভব? 

২০১২ সালে আবুধাবির যুবরাজ শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ ও তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগান আঙ্কারায় একটি বৈঠকে মিলিত হন। ফাইল ছবি: রয়টার্স
২০১২ সালে আবুধাবির যুবরাজ শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ ও তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগান আঙ্কারায় একটি বৈঠকে মিলিত হন। ফাইল ছবি: রয়টার্স

কাতারের সঙ্গে সৌদি নেতৃত্বাধীন আরব জোটের মধ্যে সমঝোতা মুসলিম বিশ্বে স্বস্তি নিয়ে আসলেও সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মিসর কিছুটা অস্বস্তিতে ভুগছে। 

২০১৭ সালে সৌদি আরবের নেতৃত্বে আমিরাত, বাহরাইন, এবং মিসর  কাতারের ওপর যে অবরোধ দিয়েছিল তাতে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিল মিসর এবং আরব আমিরাত। 

গত তিন বছরে এই অবরোধের কারণে আমিরাত এবং মিসর দাবিয়ে বেড়িয়েছে এই অঞ্চল।  সৌদি আরবকে পাস কাটিয়ে আমিরাতই যেন হয়ে উঠেছিল মধ্যপ্রাচ্যের মোড়ল। 

বিশেষ করে ২০১৩ সালে মিসরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সামরিক জান্তা সিসিকে সরাসরি সমর্থন এবং সৌদি যুবরাজ সালমানের ওপরে প্রভাব আবুধাবি রাজতন্ত্রকে আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল।  আত্মবিশ্বাসী এবং অহংকার এতটা তুঙ্গে উঠেছিল যে, অন্যান্য মুসলিম দেশের ওপর চড়াও হওয়ারও চেষ্টা করেছিল বারবার।  এমনকি তুরস্কের বিরুদ্ধে এত আক্রমণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল যার দ্বিতীয় উদাহরণ মুসলিম বিশ্বে বিরল।  

সেই আমিরাত এখন তুরস্কের সঙ্গে সুসম্পর্ক পুনরায় স্থাপনের, সম্পর্কোন্নয়নের আহ্বান জানাচ্ছে।

আরব আমিরাতের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনোয়ার গারগাশ আবুধাবি ভিত্তিক স্কাইনিউজ আরবি চ্যানেলকে বলেছেন যে, সংযুক্ত আরব আমিরাত পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে  তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চায়। 

তার সর্বশেষ সাক্ষাৎকারে, তিনি তিন তিনবার জোর দিয়ে বলেন যে, ‘সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে তুরস্কের দ্বন্দ্ব কিংবা মতবিরোধ কোন পক্ষের জন্য কল্যাণকর হবে না। আমরা আরব বিশ্বে তুরস্কের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার … আমাদের সঙ্গে তুরস্কের কোন সীমান্ত সমস্যা নেই … আমাদের মধ্যে অবশ্যই নতুন করে সেতুবন্ধন তৈরী করতে হবে।”

মধ্যপ্রাচ্যে শান্তিকামী, শান্তিপ্রিয় মানুষের মনে আশা জাগানোর মতো কিছু বিবৃতি।চমৎকার সব শব্দ দিয়ে গড়া সময়োপযোগী কিছু বাক্য বিন্যাস! কিন্তু এই বিবৃতি মিথ্যা আশা দেখানোর, মনোযোগ অন্যদিকে ফিরানোর ব্যর্থ প্রয়াস কিনা তা ভেবে দেখার বিষয়। 

কারণ উপরোক্ত কথাগুলোর পরেই তিনি ঝুলি থেকে আসল বেড়ালটি বের করেছেন। 

তিনি বলেন, আবুধাবি চায় তুরস্ক যেন আরব বিশ্বের সঙ্গে তার সম্পর্কের কম্পাস পুনরায় ঠিক করে।  তুরস্ক যেন মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রধান সমর্থক না হয়। তুরস্কের সঙ্গে আমিরাতের সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে তুরস্ক আরব দেশগুলোতে তার ভূমিকা প্রসারিত করতে চায়।  

আসলে এই কথার মাধ্যমে তিনি আরব আমিরাতকে আরব বিশ্বের নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করছেন।  আর আরব বিশ্বের পক্ষে তুরস্ককে কিছু শর্তও জুড়ে দিয়েছেন। 

আরব বিশ্বের সমস্যার পেছনে তুরস্ক এবং আমিরাতের ভূমিকা 

আরব বিশ্বের নেতা কে? সে প্রসঙ্গে নাই বা গেলাম।  বরং আসুন দেখা যাক আরব বিশ্বের সমস্যার পেছনে তুরস্ক এবং আমিরাতের ভূমিকা কী ছিল? 

ইয়েমেনকে ধ্বংস করা, সেখানে হাজার হাজার লোককে হত্যা করা, লক্ষ লক্ষ মানুষকে বাস্তুহারা করা কাতারের উপরে অবৈধভাবে অবরোধ আরোপ করা, মিসরের নির্বাচিত এবং বৈধ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পেছনে আসল কলকাঠি কে নেড়েছিল? তুরস্ক নাকি আরব আমিরাত? 

কোটি কোটি আরব জনগণ এবং ফিলিস্তিনদের বিরোধিতা সত্ত্বেও ইসরাইলের সঙ্গে আমিরাতসহ অন্য আরব দেশগুলোর সম্পর্ক স্থাপন কি তুরস্কের কাজ? 

লিবিয়াতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারের বিরুদ্ধে নির্বিচারে নিরীহ মানুষ হত্যাকারী সন্ত্রাসী খলিফা হাফতারকে সমর্থন দিয়েছিল কি তুরস্ক নাকি আরব আমিরাত? সিরিয়াতে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে সাহায্য করায় আমিরাতের ভূমিকা, আর বাকি ছোটখাটো কর্মকাণ্ডের কথা নাহয় নাই বা বললাম। 
এ সবগুলোর পিছনে আরব আমিরাত প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।  আর এই কাজের কোনটিই আরব জনগণের স্বার্থে ছিল না। 

অথচ তুরস্ক ৪০ লাখেরও বেশি সিরিয় শরণার্থী আশ্রয় দিয়ে, কাতারের পক্ষে অবস্থান নিয়ে, ইয়েমেনে ত্রাণ পাঠিয়ে, লিবিয়ায় বৈধ সরকারের পক্ষে দাঁড়িয়ে, মিসরের জনগণের ভোটে নির্বাচিত বৈধ সরকারকে সমর্থন করে, ফিলিস্তিনের পক্ষে সোচ্চার হয়ে সমগ্র আরব বিশ্বের সাধারণ মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছে। 

কাতার ভিত্তিক একটি আরব জনমত জরিপ সংস্থা গত বছরের নভেম্বরে ১৩টি আরব দেশে ২৮ হাজার লোকের ওপরে একটি জরিপ চালায়।  ওই জরিপের অনেক প্রশ্নের মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল আরব বিশ্বে কোন দেশের প্রভাব (বিদেশ নীতি) ইতিবাচক বা কম ক্ষতিকারক।  ইরান, আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, চীন নাকি তুরস্ক? আশ্চর্যের বিষয় হল, জরিপে উঠে এসেছে- আরব বিশ্বে তুরস্কের বৈদেশিক নীতিকে সবচেয়ে কম ক্ষতিকর হিসেবে মনে করে মধ্যপ্রাচ্যের নাগরিকরা।  জরিপে অংশগ্রহণকারী শতকরা ৫৮ ভাগ আরব লোক তাদের এলাকায় তুরস্কের নীতিকে ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করেন।   

এই যখন বাস্তব অবস্থা তখন গারগাশের উক্তি অতিরঞ্জিত বৈ কি।  

আর তিনি যদি সত্যই তুরস্কের সঙ্গে তার দেশের সম্পর্কের উন্নতি চান।  তবে তার দেশকে আগে তুরস্ক বিরোধী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা উচিত নয় কি? 

আন্তর্জাতিকভাবে তুরস্কবিরোধী যে বিশাল প্রোপাগান্ডা নেটওয়ার্ক তারা তৈরি করেছেন তার ইতি টানবে কি আবুধাবি? 

যেমন আমিরাতের যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ইউসুফ আল ওতাইবা আমেরিকাতে তুরস্ক বিরোধী যে লবি চালাচ্ছেন তার কি হবে? তুরস্কবিরোধী তার কর্মকাণ্ড ফাঁস হওয়া অনেক ডকুমেন্টের মাধ্যমে প্রমাণিত।  তিনি যে আমেরিকার নতুন প্রশাসনের কাছে আঙ্কারা বিরোধী লবি চালিয়ে যাবেন না তার নিশ্চয়তা কী? 

আমিরাতের টাকায় তুরস্কের ভিতরে ও বাইরে প্রতিষ্ঠিত ভুয়া সংবাদের কারখানাগুলো কি বন্ধ হবে?

গত কয়েক বছর ধরে আমিরাতি টাকায় পরিচালিত তুর্কি, আরবি এবং ইংরেজি ভাষায় বিভিন্ন নামধারী এবং নামকাওয়াস্তের গণমাধ্যম গুলোতে তুরস্ক সম্পর্কে ভুয়া, মিথ্যা সংবাদের পাশাপাশি কট্টর তুরস্ক বিরোধী প্রচারণা চালিয়েছে দেধারছে। সেই সঙ্গে সমর্থন দিয়েছে ফেতুল্লাহ গুলেনের সন্ত্রাসী সংগঠন, পিকেকে সন্ত্রাসী সংগঠনসহ আরও অনেক তুরস্ক বিরোধী নিষিদ্ধ গ্রুপকে।আমিরাতের টাকায় ইউরোপ এবং আমেরিকাতে পরিচালিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে তুর্কি বিরোধী প্রচারণাগুলো কি বন্ধ হবে? 

এছাড়াও তুরস্কের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নাক গলানো, বাধা প্রদান, তুরস্ক বিরোধী জোটকে সমর্থন, তুরস্কের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর সঙ্গে এক জোটে কাজ করা ইত্যাদির কী হবে? অর্থাৎ আবুধাবি তুরস্ক বিরোধী যে বিশাল প্রোপাগান্ডা মেশিন নিয়ে আটঘাট বেধে নেমেছিল তা গুঁটিয়ে ফেলতে পারবে কি? 

আরব আমিরাত যদি সত্যি সত্যিই তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন চায় তাহলে এই সংশোধনমূলক পদক্ষেপগুলো নেয়া উচিত।  কিন্তু আরব আমিরাতের এত বছর ধরে তিলে তিলে গড়া এই তুরস্ক-বিরোধী ষড়যন্ত্রের জাল কি এত সহজে গুঁটিয়ে নেওয়ার বিষয়? 

আমরা ইতিবাচক হতে চাই।  আমরা মনে করি আমিরাতি মন্ত্রী তার কথায় যথেষ্ট নিষ্ঠাবান।  আমরা তার কথায় আস্থা রাখতে চাই।  আমরা চাই মুসলিম বিশ্ব বন্ধুত্ব, ভ্রাতৃত্ব এবং একে অপরকে সম্মানের মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে এগিয়ে যাক। শান্তি ফিরে আসুক এ অঞ্চলে।